সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১


স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ইসলামী আহার নীতি : মোঃ শামছুল আলম


প্রকাশিত:
১৫ জুন ২০২০ ২২:০২

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ২২:০৪

 

সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন আমাদের এই দুনিয়ার জীবনে এনে দেয় জান্নাতি সুখ। তাই আমাদের উচিত দেহমনে সুস্থ থাকার চেষ্টা করা। সুস্থ থাকার জন্য অনেক চেষ্টা-তদবিরই আমরা করি। অনেক ছোটাছুটির পরও সুস্থতা নামক সেই সোনার হরিণটি অধরাই থেকে যায় আমাদের কাছে।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের যে ধ্বংসলীলা চলতেছে, তাদেখে অনেকেই সুস্থ থাকার আশাই ছেড়ে দিয়েছেন! এমতাবস্থায় আসুন-না আমরা ইসলামের নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করি। প্রায় ১৫০০ বছর আগে প্রিয় নবী (সা.) সুস্থতার জন্য যে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন তা যদি আমরা মানতে পারি, তাহলে ইনশাল্লাহ আমরা সুস্থতার সহিত বাকি জীবনটা উপভোগ করতে পারব।

১ম, খাবার গ্রহণের পূর্বে রাসূল (সা.) আমাদের আল্লাহর নাম নিতে তথা ‘বিসমিল্লাহ’ বলে খাওয়া শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই পৃথিবীতে আমাদের খাবারের জন্য যা কিছু রয়েছে, তার সকল কিছুই আল্লাহর নেয়ামত। সুতরাং, ‘বিসমিল্লাহ’ বলার মাধ্যমে আমরা যেমন আমাদের সামনে পরিবেশিত খাবারের জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করি, যার মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের উপর সন্তুষ্ট হন, ঠিক তেমনি আমাদের খাবারে আল্লাহ বরকত দেন, যা আমাদের জন্য কল্যাণকর হয়।

২য়. মানুষ সাধারণত রোগাক্রান্ত হয় খাদ্য ও পানীয়ের দ্বারা। সে হিসেবে সব রোগের মূল কেন্দ্রস্থল মানুষের পেট। তাই খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে পরিমিত মাত্রায় খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। ইসলাম এ বিষয়ে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতে নির্দেশ দিয়েছে এবং অতি ভোজন করতে নিরুৎসাহিত করেছে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন-
‘পেটের এক-তৃতীয়াংশ খাদ্য দিয়ে, এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)।

৩য়. প্লেটে পরিবেশিত খাদ্যের শেষ কণাটি পর্যন্ত মুছে খেয়ে নেওয়া রাসূল (সা.) এর সুন্নাহ। রাসূল (সা.) তার সামনে পরিবেশিত আহারের শেষ কণাটি পর্যন্ত মুছে আহার করতেন।
বর্তমানে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, খাবারের মূল পুষ্টিগত নির্যাস পাত্রের তলায় এসে জমা হয়।
পাশাপাশি খাবার পর আঙ্গুল চেটে নেওয়াও সুন্নাহর অংশ। খাবার শেষে আঙ্গুল চেটে নেওয়ার মাধ্যমে হজম ক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পাচক রসের অধিক নিঃসরণ ঘটে।

৪র্থ. খাবার ও পানীয় ঢেকে রাখা। রাসূলুল্লাহ (সা.) খাদ্য ও পানীয় সবসময় ঢেকে রাখার জোর তাকিদ দিয়েছেন। কেননা, তাতে অসুস্থতার পাশাপাশি মানুষের মৃত্যুরও ঝুঁকি রয়েছে। হাদিস শরিফে ইরশাদ হচ্ছে- ‘রাসূল (সা.) বলেন-
তোমরা খাদ্য ও পানীয় ঢেকে রাখো, মশকের মুখ বন্ধ করে দাও, প্রদীপ নিভিয়ে দাও এবং ঘরের দরজা বন্ধ করে দাও। কারণ, শয়তান বন্ধ মশক খুলতে পারে না, বন্ধ দরজাও খুলতে পারে না এবং বন্ধ পাত্রও খুলতে পারে না। তোমাদের কোনো ব্যক্তি যদি পাত্র ঢাকার মতো কিছু না পায়, তবে সে যেন একটি কাঠ আড়াআড়িভাবে রেখে দেয় এবং আল্লাহর নাম স্মরণ করে।’ (মাজাহ)

৫ম.খাদ্যে ফুঁ না দিয়ে খাবার শুরু করা। খাবার ও পানীয়ে ফুঁ দেয়ার কারণে অনেক ধরনের রোগ হতে পারে। ‘হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) পানীয়ে ফুঁ দিতে নিষেধ করেছেন। একজন আরজ করল, পাত্রে কখনো কখনো ময়লা আবর্জনা দেখা গেলে কি করা? তিনি (সা.) বললেন, তা ঢেলে ফেলে দেবে।’ (তিরমিজি, রিয়াদুস সালেহীন)।

আধুনিকবিজ্ঞান বিষয়টিকে জোর দিয়ে আমল করার পরামর্শ দিয়েছে। কারণ, পানীয়ে ফুঁ দিয়ে তা পান করলে তাতে কার্বনডাইঅক্সাইড মিশে আমাদের শরীরে ক্ষতিকারক জটিলতা তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।

৬ষ্ঠ. হাত পরিষ্কার রাখার অভ্যাস সবারই থাকা দরকার। যার মাধ্যমে সহজেই অসুস্থতা থেকে বাঁচা যায়। হাত নানা ধরনের জীবাণু বহন করে বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। তাই রোগমুক্ত থাকতে নিয়মিত ভালোভাবে হাত ধুতে হবে। সঠিক নিয়মে হাত ধোয়ার অভ্যাস একটি ভালো ভ্যাকসিনের চেয়ে বেশি কাজ করে। তাই দেড় হাজার বছর পূর্বে খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধৌত করার প্রতি ইসলামের নির্দেশ এসেছে। রাসূল (সা.) খাওয়ার আগে হাত ধোয়ার আদেশ দিয়েছেন।
'আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) পানাহারের আগে উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত ধুয়ে নিতেন।’ (মুসনাদে আহমাদ)।

৭ম. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইসলামের মৌলিক নির্দেশনা ও ঈমানের অঙ্গ। পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার প্রতিও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কারণ, পরিবেশ দূষণের কারণে মানব সমাজে বিভিন্ন ধরনের রোগ ছড়ায়। হাদিসে এসেছে, রাসূলে কারিম (সা.) ইরশাদ করেন-

‘তোমরা তোমাদের বাড়ির আঙ্গিনার সব দিকে পরিষ্কার রাখবে। ইহুদিদের অনুকরণ করো না। তারা বাড়িতে আবর্জনা জমা করে রাখে।’ (সুনানে তিরমিজি)।
তা ছাড়া কেউ যদি মিসওয়াক, ওজু, গোসল, পোশাক-আশাক প্রভৃতির ক্ষেত্রে ইসলামি নির্দেশনা মেনে চলে তাহলে সে অপরিচ্ছন্নতাজনিত রোগব্যাধি থেকে নিরাপদ থাকতে পারবে।

৮ম. দৈহিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতাও জরুরি। বরং মানসিক সুস্থতা দৈহিক সুস্থতার পূর্বশর্ত। কারণ মানসিক প্রশান্তি ও উৎফুল্লতা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। মানসিক উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতা দেহের রোগ প্রতিরোধ কমিয়ে ফেলে। তাই ইসলাম মনোদৈহিক স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে বৈবাহিক জীবন ব্যবস্থার প্রতি খুব গুরুত্ব দিয়েছে। তা ছাড়া ইসলামের ইবাদত ব্যবস্থা ও জিকির-আজকারের দ্বারাও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন-

‘জেনে রাখ! আল্লাহ তায়ালার জিকির দ্বারা অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়।’ (সূরা: রাদ, আয়াত: ২৮)।

৯ম. যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ করা নিষেধ করা হয়েছে। কারণ তাতে রোগব্যাধি ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন-

‘তোমরা তিন অভিশপ্ত ব্যক্তি থেকে বেঁচে থাকো। তারা হলো- যে পানির ঘাটে, রাস্তার ওপর ও গাছের ছায়ায় মলমূত্র ত্যাগ করে।’ (সুনানে আবু দাউদ)।

এককথায়, আধুনিক বিজ্ঞান মানবদেহ রোগাক্রান্ত হওয়ার যেসব দিক নির্ণয় করেছে এবং এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে, তা প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে মানবতার কল্যাণ ও মুক্তির দিশারী বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) পুরোপুরিভাবে বর্ণনা করে গিয়েছেন। তাই বলা যায়, ইসলাম এমন একটি জীবন ব্যবস্থার নাম, যেখানে মানবতার কল্যাণ ও সফলতার জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার সেখানে তাই করা হয়েছে। কেউ যদি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা মেনে চলে তাহলে সে সুন্দর জীবন যাপন করতে পারবে, ইনশাআল্লাহ!

মানুষ হিসেবে আমাদের প্রিয় নবী (সা.)- এরও খাবার গ্রহণের প্রয়োজন ছিল। তবে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠতম মানুষ ও সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। আল্লাহ তাআলা বলেন-

“তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মাঝে রয়েছে উত্তম দৃষ্টান্ত।” –সূরা আহযাব, আয়াত : ২১

অতএব, মুসলিম হিসেবে আমাদের জীবনে কাউকে অনুকরণ করতে হলে নবীজিই হলেন সেই মানুষ। তিনি একটি সফল সুন্দর জীবনের আর সবকিছুর মত খাবার গ্রহণের সুন্দরতম পদ্ধতিটিও আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন। এর অনুসরণের মাঝেই রয়েছে আমাদের জন্য সুস্থতা ও কল্যাণ।

 

মোঃ শামছুল আলম
লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top