সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০


বি স্মার্ট উইথ মুহাম্মদ : কাজী খাদিজা আক্তার 


প্রকাশিত:
১৬ জানুয়ারী ২০২১ ১৭:১৮

আপডেট:
১৬ জানুয়ারী ২০২১ ১৭:৪৫

ছবিঃ কাজী খাদিজা আক্তার 
 

রাসূল (স.) কে নিয়ে বেশির ভাগ সিরাহ গ্রন্থ বা জীবনী বই পড়লে আমরা দেখতে পাই তাঁর জীবনের ৪০ বছরের পরের ঘটনাগুলো বেশিই প্রাধান্য পায়। কিন্তু ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভের আগে কিভাবে শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত মুহাম্মদ (স.) নিজেকে গড়ে তুলেছেন এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দার পরিচয় প্রস্ফুটিত করেছেন তা আমরা খুব কম লিখা থেকেই জানতে পারি। আমাদের মধ্যে সবসময় একটা অনুভূতি কাজ করে মুহাম্মদ (স.) নবী ছিলেন, আমরা তাঁর মতো হতে পারবোনা। হ্যা, আমরা সাধারণ মানুষ তাঁর মতো হতে পারবোনা কিন্তু তাঁকে অনুসরণ করে নিজেদেরকে গঠন করতে পারি, পরিবর্তন করতে পারি, সবার প্রিয় সর্বোপরি আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারি। আর এটাই হওয়া উচিত। "বি স্মার্ট উইথ মুহাম্মদ" ড. হিশাম আল- আওয়াদি এর একটি চমৎকার বই যেখানে মুহাম্মদ (স.) এর জীবনের শুরু থেকে অর্থাৎ শৈশব, কৈশর এবং যৌবনের এবং তারও পরবর্তী কিছু সময়ের বর্ণনা দেয়া হয়েছে এবং সাথে সাথে আমরা আমাদের জীবনে কিভাবে তা প্রয়োগ করে নিজেদের সহজ সুন্দর করে গুছিয়ে নিতে পারি তার দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যদিও আমরা জানি রাসূলের জীবন আমাদের অনুসরণীয় তারপরও আমরা কতজন আছি যে শুধু জানতে চাই রাসূল (স.) আমাদের জন্য কি জীবন বিধান রেখে গেছেন আর সেক্ষেত্রে অনুসরণের বিষয়টাতো আরও পরের কথা। কেবল আমরা আমাদের সামনে কিছু প্রশ্ন দাঁড় করিয়ে দেই, মুহাম্মাদের মতো এতো অসম্ভব নিখুঁত চরিত্রের অধিকারী কি আমরা হতে পারবো? আমরা সাধারণ মানুষরা কি এমনতরো খোদাপ্রেমী হতে পারবো? এতো স্বার্থত্যাগী, পরোপকারী আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। সবকিছু সম্ভব নয় তবে অনেক কিছুই সম্ভব। 

মাত্র বিশ বছর বয়সে ৫৭১ সালে মা আমিনা বিধবা হন আর মুহাম্মদ (স.) হন বাবাহারা। রাসূলের শৈশব তাই মাকে ঘিরে। আদর ভালোবাসা দিয়ে মা আমিনা তাঁকে লালনপালন করেন। রাসূল (স.) এর বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের দায়দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন দাদা আবদুল মুত্তালিব। তাই মা আমিনার সংসারের প্রতি তেমন মনোযোগ দিতে হয়নি। তিনি মুহাম্মদ কে নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। শিশুর মানসিক বিকাশে ভালোবাসা আর আদরের বিকল্প নেই। তাই শিশুদের সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সুন্দর সময় কাটানো আমাদের প্রত্যেক মা বাবারই উচিত তা আমরা যত ব্যস্তই থাকিনা কেন। আমার মনে হয় জীবনের সবকিছুই যদি আমি, আমরা, আমাদের সন্তানদের জন্য করে থাকি তাহলে এতো ছোটাছুটি না করে কিছুটা নিখাঁদ সময়ও আমাদের সন্তানদের দিতে পারি। এ সহজ সত্য আমরা সবাই জানি শুধু মাঝে মাঝে ভুলে যাই। 

রাসূল (স.) এর মা আমিনা মারা যান যখন তাঁর বয়স মাত্র ছয় বছর আর মা আমিনার বয়স ছাব্বিশ। মায়ের মৃত্যুর পর তিনি দাদার বাড়িতে লালিত পালিত হন। সেখানেও তিনি সবার আদর যত্নে ছিলেন। তাঁর দাদি ফাতিমা আমর তাঁকে ভীষণ আদর যত্ন করতেন। মুহাম্মদ (স.) এর দাদা সবসময় নাতির প্রশংসা করতেন। বড় হয়ে মুহাম্মদ বড় কিছু হবেন সেটা তিনি ছোটবেলা থেকেই বলতেন। সেজন্যই বলা হয়ে থাকে বাচ্চাদের সামনে তাদের প্রশংসা করুন এরা অনুপ্রাণিত হবে। আরও ভালো হবার প্রতিযোগিতা ওদের মনে গেড়ে বসবে। কারণ প্রতিটা শিশুর মধ্যেই প্রতিভা আছে। প্রতিভাগুলোকে আলোয় বের করে নিয়ে আসার দায়িত্ব আপনার, আমার, আমাদের সকলের। আট বছর পর্যন্ত মুহাম্মদ (স.) দাদার সাথে ছিলেন এরপর চলে যান তাঁর চাচার কাছে। মুহাম্মদ এর শৈশবের বেশিরভাগ সময় কেটেছে মরুভূমিতে। আর এই মরুভূমি মুহাম্মদকে জীবনশিক্ষা দিয়েছে। মরুভূমিতে থেকে মুহাম্মাদের যেমন সামাজিক যোগাযোগ এর দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি শারীরিক সামর্থ্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। মরুভূমি থেকে নিয়ে আসা মূল্যবোধ রাসূল (স.) তাঁর পরবর্তী বাস্তব জীবনে কাজে লাগিয়েছেন। পারিবারিক ভাবেই তিনি সাদাসিধা জীবনের প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন কারণ, তাঁর মা শুকনো মাংস খেতেন, দাদা দানের টাকা জোগাড় করে হজ পালনকারীদের পানির ব্যবস্থা করতেন, চাচা যৌথ পরিবারের খরচ জোগাতেন। মুহাম্মদ(স.) কখনও পেট পুরে খাননি। বেশিরভাগ সময় শুকনো রুটি খেতেন। খাবার না থাকলে সিয়াম পালন করতেন। আমরা হয়তো তাঁর মতো হতে পারবোনা তবে একটু ধৈর্যশীল এবং মিতব্যয়ী হতে পারি এবং আমাদের সন্তানদের সে শিক্ষা দিতে পারি। "আত্মশৃঙ্খলা" বলে একটি কথা আছে। আমরা সেই আত্মাকে বা নিজেকে যেভাবে শৃঙ্খলা সেখাবো সেভাবেই আত্মা তথা জীবন শৃঙ্খলিত হবে।

"বি স্মার্ট উইথ মুহাম্মদ" এই বইটির সহজ সুন্দর উপস্থাপনা আমাকে, মুহাম্মদ (স.) এর জীবন আদর্শ সহজ করে বোঝার সামর্থ্য দিয়েছে। গৎবাঁধা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর একঘেয়েমী শিক্ষার দিকে আমাদের সন্তানদের কেবল ঠেলে দিচ্ছি। হয়তো সময়ের সাথে দৌড়াবো বলে, যেন পিছিয়ে না যাই। কিন্তু রাসূলের জীবনাদর্শ থেকে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নৈতিক শিক্ষা দিতে পারি। উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারি। শারীরিক দক্ষতা শৈশব গঠনের একটি বিশেষ দিক। যা মুহাম্মদ (স.) অর্জন করেছিলেন খুব ছোট বেলা থেকেই। যেসব শিশুরা শারীরিকভাবে বেশি সক্রিয় সেসব শিশুরা বাস্তব জীবনে সামাজিক এবং পারিবারিক পরিবেশে বেশি সফল এবং জনপ্রিয়ও বটে। মরুভূমিতে থাকা অবস্থায় শিশু মুহাম্মদ অনেক শারীরিক কাজ করতেন। যেমন - পানি আনা-নেয়া, গবাদি পশুর দেখাশুনা করা, তাঁবু টানানো, বড়দের সাহায্য করা ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে অন্যকে সাহায্য সহযোগিতা করার মনোভাব তাঁর ছোটবেলা থেকেই গড়ে উঠেছিল। 

মুহাম্মাদ (স.) এর শৈশবকাল আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাবো তাঁর জীবনে যৌথপরিবারের অবদান বা গুরুত্ব কতোটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিলো। রাসূল (স.) এর বেড়ে উঠার পেছনে দাদা-দাদি ছাড়াও চাচা-চাচির ভূমিকাও ছিলো বেশ বড়। মানব সমাজের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাওয়া যায় বর্ধিত পরিবার সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। ইয়াতিম হয়েও রাসূল (স.)  কিন্তু একা বড় হননি তাঁর পেছনে যে মানুষগুলোর অবদান রয়েছে তাঁরা হচ্ছেন তাঁর দাদা-দাদি, চাচা-চাচি পরিবারের আরও অনেকে। তিনি মায়ের কাছ থেকে ত্যাগের শিক্ষা পেয়েছেন, বাবার কাছ থেকে ন্যায়পরায়ণতা, দাদার কাছ থেকে সহজে হার না মানা, বড় দাদা হাশিমের কাছ থেকে দানশীলতা, নেতৃত্বের গুণও অর্জন করেছিলেন যৌথ পরিবারের মধ্য থেকে। পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষই ছোটদের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য একজন শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেন। তাই যৌথ পরিবার গুলো থেকে শিশুরা যে শিক্ষা পায় তা কোনোভাবেই একক পরিবার থেকে সম্ভব নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের সমাজের যৌথ পরিবারের অস্তিত্ব খুব কম। সবাই এড়িয়ে চলে। আমরা হয়তো বাস্তবতার খাতিরে যৌথ পরিবার ভেঙে আলাদা হই অনেক সময় আর কোনো অপশন থাকেনা। কিন্তু পরিবারের সকল সদস্যদের সাথে যেন সবসময় যোগাযোগ থাকে, আপনার সন্তানকে তাঁর পূর্বপুরুষদের সাথেও অবগত করান। এখানে এই বইটিতে হিশাম আল- আওয়াদি একটি চমৎকার কথা বলেছেন "সন্তানদের তার বংশ গাছ দেখান।" এভাবে শিশুদের মধ্যে তার সম্পূর্ণ পরিবার সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি করতে পারেন। আপনি যদি আপনার পরম আত্মাীয় থেকে দূরে থাকেন তাহলে আপনার সন্তানও দূরে থাকবে। রাসূল(স.) এর জীবন থেকে আমরা বর্ধিত পরিবারের সুব্যবহার গুলো দেখতে পাই।

মানুষ তার পরিবেশ দ্বারা নির্মিত বা প্রচন্ড রকম প্রভাবিত। আমরা প্রায়শই নেতিবাচক প্রভাবের জন্য পরিবেশকে দায়ী করে থাকি। রাসূল (স.) তাঁর জীবনের ৬৩ বছরের মধ্যে ৫৩ বছর কাটিয়েছেন মক্কার পরিবেশে। রাসূল (স.) যখন মক্কায় প্রথম আসেন তখন মক্কার পরিবেশ কিন্তু মোটেও পরিচ্ছন্ন ছিলোনা। গোত্রে গোত্রে খুন খারাপি, মূর্তিপূজা, অশ্লীলতা, চুরি ডাকাতি পতিতাবৃত্তি কি ছিলোনা তখন। এমন পরিবেশে থেকেও রাসূল (স.) কিন্তু পথভ্রষ্ট হননি বরং পথভ্রষ্টকারীদের সঠিক পথের সন্ধান দেখিয়েছেন। সেখানে শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বেশ স্মার্টলিই ধরে রেখেছিলেন। একটি জঞ্জালপূর্ণ সমাজ পরিবেশকে পরিচ্ছন্নভাবে প্রস্ফুটিত করেছিলেন নিজ গুনে এবং নিজের ব্যক্তিত্বকে বজায় রেখে। কাজেই শুধু পরিবেশের দোহাই না দিয়ে নিজেদের ইতিবাচক দিকগুলো ধরে রাখি সেটাকেই বিকশিত করি আর জলাঞ্জলি দেই সকল অশোভন এবং অসুন্দরকে।

রাসূল (স.) ছিলেন স্মার্ট। যেকোনো পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেবার এবং আত্মস্বাতন্ত্র বজায় রাখার অসম্ভব ক্ষমতা ছিলো তাঁর।বিচক্ষণতার সাথে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরিবেশের কাছে সময়ের সাথে হার মেনে নেননি। তাঁর জীবন আমাদের শুধু অনুপ্রেরণা দেয়। মাত্র ৬৩ বছরের ইতিহাস আমাদের জীবন-বিধান। রাসূল (স.) এর জীবনমুখী শিক্ষা কেবলই আমাদের অনুপ্রেরণা দেয় আর তাই আমরা অনুসরণ করি এবং করবো। বি স্মার্ট উইথ মুহাম্মদ। 

 

কাজী খাদিজা আক্তার 
প্রভাষক (ইংরেজি)  
সরাইল সরকারি কলেজ

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top