সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ১৮ই এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১


রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমাদান : ড. শাহনাজ পারভীন


প্রকাশিত:
১৯ এপ্রিল ২০২১ ২১:৪৭

আপডেট:
১৮ এপ্রিল ২০২৪ ২২:৪৩

 

বছর ঘুরে পৃথিবীতে আবার এলো পবিত্র রমাদান মাস। এই মাসের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআন কারীমে বর্ণনা করেছেন: 'রমাদান মাসই হল সে মাস, যাতে অবতীর্ণ করা হয়েছে পবিত্র কুরআন, যা মানুষের জন্যে হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্যে সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসটি পাবে, সে যেন এই মাসে রোজা রাখে। (২:১৮৫)

রোজা শব্দটি ফারসি, উর্দু, হিন্দি ও বাংলায় ব্যবহৃত হয়। আরবিতে একে ‘সওম’ বলে, যার বহুবচন হলো ‘সিয়াম’। রোজা এবং সওম বা সিয়াম অর্থ বিরত থাকা। ইসলামি শরিয়ত ও ফিকহের পরিভাষায়, রোজা হলো সুবেহ সাদিক থেকে সন্ধ্যা বা সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌন সম্ভোগ থেকে ইবাদতের উদ্দেশ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে বিরত থাকা বা সংযম অবলম্বন করা। মহান আল্লাহ এই সম্পর্কে পবিত্র কুরআন কারীমে বর্ণনা করেছেন: ‘আর তোমরা পানাহার করো যতক্ষণ রাত্রির কৃষ্ণরেখা হতে প্রভাতের শুভ্ররেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের কাছে প্রতিভাত না হয়। অতঃপর নিশাগম পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো।’ (২: ১৮৭)।

‘ইসলাম' পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যথা: (ক) কালিমা অর্থাৎ এই সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ বা ইলাহ নেই, হজরত মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর প্রেরিত বান্দা ও রাসুল (খ) সালাত কায়েম করা (গ) জাকাত আদায় করা (ঘ) হজ্ব করা এবং  (ঙ) রমাদান মাসে রোজা পালন করা।’ (বুখারি, হাদিস: ৭)। 

পবিত্র কোরআন শরীফে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি; যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (২: ১৮৩)। রমাদানের প্রথম দশক রহমতের। রমাদানের প্রথম দশকে করুণার সওগাত নিয়ে এই পৃথিবীতে রহমত নেমে আসে। মহান আল্লাহর একটি বিশেষ গুণ হলো করুণা ও রহমত। তিনি দুনিয়াব্যাপী সর্বক্ষণ, সর্বক্ষেত্রে তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির ওপরে করুণা ও রহমত বর্ষন করেন। কোনো অবস্থাতেই তা থেকে তিনি সরে আসেন না। মহান আল্লাহ চান তাঁর বান্দা তাঁর গুণাবলিসমূহ অর্জন করে সে গুণে গুণান্বিত হয়ে মহান আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি সেই গুণের প্রকাশ ঘটাক।

রমাদানের দ্বিতীয় দশক মাগফিরাত ও শেষ বা তৃতীয় দশক হচ্ছে নাজাতের। রমাদান একই সাথে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস। মহান আল্লাহর দয়া বা রহমত সর্বকালে সর্বত্র বর্ষিত হতে থাকে; পবিত্র রমাদান মাসে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং  শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। ফলে রোজা, নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, দান-সদকা, ফিতরা, জাকাত, জিকিরসহ যাবতীয় ইবাদত অনুশীলন ও তাকওয়া অর্জন সহজ হয়। এই মাসে আমরা মহান আল্লাহর দয়া-করুণা লাভ করতে পারলেই আমাদের যাপিত জীবনে নানান বিপদ-আপদ ও বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা পাওয়া আমাদের জন্য সহজ ও সম্ভব হবে। তাই আমাদের উচিৎ এই বরকতময় মাসটি পুরোপুরি ইবাদতের মাধ্যমে প্রতিটি মুহূর্তের হিসাবে মনোযোগী হওয়া। এই মাসের অনুশীলন যদি পুর্বাপর মাসগুলোতে প্রয়োগ ও যাপন করতে পারি, তাহলে আমরা আমাদের ইহ-পারলৌকিক জীবনে সফলকাম হওয়া সহজ হবে।

রমাদান মাসটি আমাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এই মাসে মাসব্যাপী রোজা পালন করা আমাদের জন্য ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য। ফরজ ইবাদতের পাশাপাশি রোজার সঙ্গে সম্পর্কিত দুটি ওয়াজিব হলো সদকাতুল ফিতর প্রদান করা এবং ঈদের নামাজ আদায় করা। এছাড়াও  রমাদানের বিশেষ সুন্নত আমলগুলো হলো প্রতি রাতে বিশ রাকাত তারাবিহ নামাজ আদায় করা, তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা, সাহ্রি খাওয়া, ইফতার করা ও করানো। পবিত্র কুরআন করিম বেশি বেশি তিলাওয়াত করা এবং রোজার শেষ দশকে ইতিকাফ করা, রমাদানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোয় শবে কদর সন্ধান করা এবং ঈদের জন্য শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা। রাসূল সা. বলেছেন: মহান আল্লাহ বলেন: সিয়াম (রোজা) ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য। কিন্তু সিয়াম আমার জন্য। তাই আমিই এর প্রতিদান দিব। (বুখারী: ১৭৭৮) জান্নাতে ‘রাইয়ান’ নামক একটি দরজা আছে। রোযাদার ছাড়া আর কেউ সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না।’ রোযাদাররা প্রবেশ করলে তা বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং ঐ দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করবে না। (বুখারী: ১৭৯৭)

সিয়াম ঢাল স্বরুপ। তাই সংযমের মাস রমাদানে রহমত পাওয়ার জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদেরকে সংযমী ও নিয়ন্ত্রিত আচরণ করতে হবে। কোরআন ও হাদিসে ‘রহমত’ শব্দের দুটি বিশেষণ রূপ ব্যবহৃত হয়েছে, তা হলো ‘রহমান’ ও ‘রহিম’। এই শব্দ দুটি বিসমিল্লাহর মধ্যে রয়েছে। উম্মুল কোরআন বা কোরআন জননী সুরা ফাতিহার দ্বিতীয় আয়াতে অনুরূপ রয়েছে। কোরআনের সঙ্গেও রহমতের সম্পর্ক সুনিবিড়। রহমত মহান আল্লাহ তাআলার বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্য। অতএব এই মাসে আমাদের যাপিত জীবনে মহান আল্লাহর এই বৈশিষ্ট্যসমূহ নিজেদের জীবনে বেশি বেশি অনুশীলন করতে হবে। আমাদের আচরণ, জীবন অনুশীলন এবং অন্যের প্রতি দরদী আচরণের মাধ্যমে যদি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এর প্রভাব ফেলতে পারি, তাহলেই আমাদের সিয়াম সাধনা সার্থক হবে। 

আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল সা. বর্ণনা করেছেন: অন্যায় কথাবার্তা, গীবত, মিথ্যা গালিগালাজ, অপবাদ, অভিসম্পাত ইত্যাদি যে লোক রোজা থাকা অবস্থায় ছেড়ে না দেয়, সে লোকের পানাহার ত্যাগে মহান আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (তিরমিযী: ৭০৭) অথচ বর্তমান সময়ে সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি, দ্রব্রমূল্যের উর্দ্ধগতি, ভেজাল জিনিষের ছড়াছড়িতে বাজার সয়লাব। এই রমাদানে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বর্তমান করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে করোনা পরিস্থিতির অবস্থা ব্যাপক খারাপ হওয়া সত্ত্বেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সচেতনভাবে মানুষ চলাফেরা করছে না। আক্রান্ত এবং মৃত্যূর সংখ্যা প্রতিদিনই পুরনো মাত্রা ছাড়িয়ে নতুন নতুন রেকর্ড করছে। তারপরেও মানুষ পুরোপুরি সচেতন হচ্ছে না। আমাদেরকে পুরোপুরি লকডাউন মেনে ঘরে অবস্থান করতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। রমাদান মাসের কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, সুশৃঙ্খল জীবন আচার এবং সর্ব অবস্থায় মহান আল্লাহর ওপর নির্ভরতা আমাদের এই কঠিন সংকট উত্তরণে সহায়ক হবে ইনশা আল্লাহ!

 

ড. শাহনাজ পারভীন
কবি, প্রিন্সিপাল: তালবাড়ীয়া ডিগ্রি কলেজ, যশোর

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top