সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১


মহাসন্ধিক্ষণে বিশ্ব ফুটবল : পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
৩ মে ২০২১ ২১:৩৬

আপডেট:
১৫ জুন ২০২১ ২০:৪৮

 

ইওরোপীয়ান সুপার লীগের ঘোষণা:
১৮.০৪.২০২১, রবিবার রাতে ইওরোপের বৃহৎ ১২টি ক্লাব ঘোষণা করে দিল, তারা শুরু করতে চলেছে ইওরোপীয়ান সুপার লীগ আর সাথে সাথে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল বিশ্ব ফুটবলে। বিরাট প্রশ্ন চিহ্নের মুখে পড়ে গেল বিশ্ব ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা হিসেবে ফিফা এবং উয়েফার কর্তৃত্ব।

 

কী এই ইওরোপীয়ান সুপার লীগ:
ইংল্যান্ডের ৬টি ক্লাব- আর্সেনাল, লিভারপুল, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, ম্যাঞ্চেস্টার সিটি, চেলসি, টটেনহ্যাম হট্সপার, স্পেনের ৩টি ক্লাব- রিয়েল মাদ্রিদ, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ, বার্সেলোনা এবং ইটালির ৩টি ক্লাব- এসি মিলান, ইন্টার মিলান এবং জুভেন্টাস মোট এই ১২টি ক্লাব ফাউন্ডার মেম্বার হিসেবে শুরু করতে চলেছে ইওরোপীয়ান সুপার লীগ। এদের সঙ্গে পরে আরও ৩টি ক্লাব ফাউন্ডার মেম্বার হিসেবে যোগ দেবে। ১৫টি ফাউন্ডার ক্লাব এবং কোয়ালিফাই করা ৫টি ক্লাব নিয়ে ২০ ক্লাবের এই টুর্নামেন্টের উদ্দেশ্য হল অধুনা চ্যামপীয়ন্স লীগের জায়গায় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্লাব টুর্নামেন্ট হিসেবে ইএসএলকে প্রতিষ্ঠিত করা। ১০টি দলকে ২টি গ্রুপে ভাগ করে মিড উইকে খেলা হবে

হোম & অ্যাওয়ে পদ্ধতিতে। মিড উইকে খেলা ফেলার কারণ, যাতে সপ্তাহান্তে নিজেদের ঘরোয়া লীগের খেলা খেলতে অসুবিধা না হয়। দুই গ্রুপের প্রথম ৩টি দল অর্থাৎ ৬টি দল সরাসরি কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নেবে আর বাকি ২টি স্থানের জন্য দুই গ্রুপের চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানাধিকারীদের মধ্যে আবার হোম & অ্যাওয়ে পদ্ধতিতে খেলা হবে। অগস্টে শুরু হয়ে এই টুর্নামেন্টের ফাইনাল হবে মে মাসের শেষ দিকে।

 

কেন এই সিদ্ধান্ত:
ক্লাবগুলো বলছে একটি উন্নততর মানের ফুটবল টুর্নামেন্ট করাই তাদের লক্ষ্য, যেখানে বিশ্বের সেরা ২০টি ক্লাব মুখোমুখি হবে এবং দর্শকেরা সুযোগ পাবেন দারুণ প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল দেখার; আর্থিক দিক দিয়ে আরও লাভবান হবে ক্লাবগুলি এবং খেলোয়াড়রা। বর্তমানে একটি ক্লাব চ্যামপীয়ন্স লীগ খেলে পায় ৪০ থেকে ৮০ মিলিয়ন পাউন্ড, অঙ্কটা টুর্নামেন্টে ক্লাবের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে। ইওরোপীয়ান সুপার লীগে সেখানে শুধুমাত্র অংশগ্রহণ করবার জন্য তারা পাবে ২৫০-৩০০ মিলিয়ন পাউন্ড। এছাড়া টিভি রাইটস বেচে বা নিজেদের চ্যানেলে সম্প্রচার করে পেতে পারে সমসংখ্যক অর্থ। টুর্নামেন্টের প্রধান স্পনসরার হিসেবে আমেরিকার জেপি মর্গান ব্যাঙ্ক ঘোষণা করেছে ৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার, এছাড়া থাকছে অন্যান্য সহকারী স্পনসরাররা।

উল্লেখ্য গতবারের চ্যামপীয়ন্স লীগের ফাইনালিস্ট দুই ক্লাব জার্মানির বায়ার্ন মিউনিখ এবং ফ্রান্সের প্যারিস সেন্ট জার্মাইন কিন্তু এই সুপার লীগে যোগ দিচ্ছে না। জার্মানির আর এক বড়ো ক্লাব বর্সিয়া ডর্টমুন্ড জানিয়ে দিয়েছে তারা এই লীগে যোগ দেবে না।

 

ফুটবল প্রফেসরের ভবিষ্যদ্বাণী:
এরকম কিছু হতে পারে তার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন আর্সেনালের প্রবাদপ্রতিম (অধুনা প্রাক্তন) ফুটবল ম্যানেজার আর্সেন ওয়েঙ্গার। ২০০৯ সালে গার্ডিয়ান পত্রিকায় তিনি বলেন, ১০ বছরের মধ্যে ইওরোপের বড়ো ক্লাবগুলো নিজেদের সুপার লীগ চালু করলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

তিনি এর বিরোধী ছিলেন, কিন্তু আশঙ্কা করেছিলেন এটা ঠেকানো যাবে না। আর্সেন বলেছিলেন, এই ধরনের লীগে যেন অবনমন চালু থাকে। এইখানেই প্রশ্নচিহ্নের মুখে এই নতুন লীগ। ফাউন্ডার ১৫টি ক্লাব এখানে চিরস্থায়ী ভাবে থাকবে, এদের বাইরে মাত্র ৫টি ক্লাব এই টুর্নামেন্টে কোয়ালিফাই করতে পারবে। অবলুপ্ত  হয়ে যাবে চ্যামপীয়ন্স লীগ।

উয়েফা কিন্তু এর আভাস অনেকদিনই পাচ্ছিল। তারা ২০২৪ সাল থেকে চ্যামপীয়ন্স লীগে ৩২টির বদলে ৩৬টি টিমের টুর্নামেন্ট করতে চলেছিল, এতে ম্যাচ সংখ্যা বৃদ্ধি পেত এবং স্বভাবতই ম্যাচ ফী এবং টিভি রাইটস থেকে ক্লাবগুলোর বাড়তি আয় হত।

ঐতিহ্যশালী ক্লাবগুলোর টুর্নামেন্টে কোয়ালিফাই করবার সম্ভাবনাও তাতে বৃদ্ধি পেত।

তবে আর্সেন ওয়েঙ্গারের ভবিষ্যদ্বাণীর অনেক আগেই এই ইঙ্গিত ছিল। দিনটা ১৯৯২ সালের ৭ই নভেম্বর  শনিবার, আর্সেনাল ফুটবল ক্লাব কভেন্ট্রিকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে প্রিমিয়ার লীগের শীর্ষে অবস্থান করছে আর ওদিকে সেদিনই তাদের ভাইস চেয়ারমযান ডেভিড ডীন সংবাদ মাধ্যমে জানালেন তাদের ইওরোপীয়ান সুপার লীগের পরিকল্পনা। তিনি তার প্রস্তাবে বলেন, এই লীগ জাতীয় দলকেও শক্তিশালী করবে, ইওরোপের সেরা দলগুলো নিয়মিত পরস্পরের বিরুদ্ধে খেললে খেলোয়াড়দের মান বাড়বে এবং এতে প্রিমিয়ার লীগের কোনও ক্ষতি হবে না। সেইসময় মাইক ডীন যে খসড়া পেশ করেছিলেন, সেখানে বলা হয়েছিল ৪০টি দলকে দুটি গ্রুপে ভাগ করে প্রতিযোগিতার খেলাগুলি হবে। খেলোয়াড়দের অতিরিক্ত খেলার চাপ কমানোর জন্য প্রিমিয়ার লীগের ক্লাবের সংখ্যা কমানো হবে, তাতে করে প্রিমিয়ার লীগের মানের উন্নতি হবে এবং ইএসএলে খেলা দলগুলোকে লীগ কাপে খেলার থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। প্রসঙ্গত ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ফুটবলে তিনটি প্রতিযোগিতা হয়। প্রিমিয়ার লীগ, এফ এ কাপ(বিশ্বের প্রাচীনতম ফুটবল প্রতিযোগিতা) এবং লীগ কাপ। লীগ কাপের গুরুত্ব সবথেকে কম এবং অনেকসময় ক্লাবগুলো তাদের খেলোয়াড়দের বিশ্রাম দেওয়ার জন্য লীগ কাপে দ্বিতীয় সারির দল নামায়। আর্সেনাল সেকালেই তাদের তৎকালীন স্টেডিয়াম হাইবারিকে ঢেলে সাজানোর জন্য ২২ মিলিয়ন পাউন্ড লগ্নি করেছিল, দর্শকদের সমস্তরকম স্বাচ্ছন্দ্যর কথা ভেবে এবং ইএসএলকে মাথায় রেখেই ছিল তাদের এই উচ্চাকাঙ্খী পরিকল্পনা।

এই পরিকল্পনায় যে দূরদর্শিতা ছিল, তা ক্লাবগুলোর এবারের ইএসএল শুরুর ঘোষণা থেকেই প্রমাণিত, কিন্তু এর সবথেকে দুর্বল দিক ফাউন্ডার ক্লাবদের চিরস্থায়ী অবস্থানের প্রস্তাবের কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি।

 

ফুটবল কর্তৃপক্ষর প্রতিক্রিয়া:
প্রিমিয়র লীগ, লা লীগা, সিরি এ এবং উয়েফা কর্তৃপক্ষ একযোগে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, এই ক্লাবগুলো যদি অবিলম্বে ইএসএলের পরিকল্পনা থেকে সরে না আসে, তবে সমস্ত ডোমেস্টিক লীগ, কাপ এবং ইওরোপীয়ান চ্যামপীয়ন্স থেকে তাদের বহিষ্কার করা হবে। ফিফা জানিয়ে দিয়েছে ইএসএলে খেলা কোনও ফুটবলারকে দেশের হয়ে খেলতে দেওয়া হবে না। কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, তিনি ফুটবল কর্তৃপক্ষকে এই ক্লাবগুলোর কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে বলেছেন।

 

ইএসএল ফাউন্ডার ক্লাবদের বক্তব্য:
এই শাস্তির হুমকিতে ক্লাবগুলি একেবারেই ঘাবড়াচ্ছে না। এই ক্লাবদের বোর্ডের অনেক সদস্য কিন্তু এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন, তবে তারা নীতি নির্ধারণের জায়গায় নেই। এই ক্লাবগুলির মালিকরা মনে করছেন ফুটবল রেভিনিউটাই আসল নির্ণায়ক শক্তি। আর তাদের খেলোয়াড়রা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে না খেলতে পারলে তারা খুশিই হবেন, তাতে খেলোয়াড়দের চোট আঘাতের সম্ভাবনা কমে যাবে এবং অনেক তাজা অবস্থায় ইএসএলে খেলতে পারবে। জাতীয় দলের হয়ে খেলতে গিয়ে ফুটবলারদের চোট পাওয়া নিয়ে ক্লাব এবং জাতীয় সংস্থার বিরোধ নতুন কিছু নয়। ক্লাবগুলো মনে করে তারা খেলোয়াড়দের মোটা স্যালারি দেন, চোট পাওয়া খেলোয়াড়দের জন্য জাতীয় সংস্থাগুলো তাদের যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ দেয় না। এই বড়ো ক্লাবগুলো মনে করছে তাদের যে বিরাট সমর্থককুল সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে, তাতে তাদের বাদ দিয়ে ফুটবলের নিয়ামক সংস্থারা কিছুই করতে পারবে না।

 

উপসংহার:
এই প্রবণতা যে অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং ফুটবলের পক্ষে ক্ষতিকর, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রাক্তন খেলোয়াড়রা একযোগে এর নিন্দা করেছেন। ইএসএলে খেলা ক্লাবগুলোর সঙ্গে অন্যান্য ক্লাবদের বিশাল আর্থিক বৈষম্যর সৃষ্টি হবে, বড়ো ক্লাবের বিরুদ্ধে খেলতে না পারলে তাদের স্পনসরার পাবার সম্ভাবনা কমে যাবে, কমে যাবে টিভির সত্ত্ব থেকে টাকা পাবার সম্ভাবনা। আমরা হয়ত আর রোনাল্ডো, মেসিদের দেখতে পাব না আন্তর্জাতিক ফুটবলের আঙিনায়। কিছু অর্থগৃধ্নু ক্লাব মালিকদের জন্য ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবীর জনপ্রিয়তম এই খেলা। আমাদের আশা, এই ক্লাবগুলোর বোদ্ধা সমর্থকরাই তাদের ক্লাব মালিকদের বিরোধিতায় সরব হবেন, তারা বেঁকে বসলে, তাদের বোড়ে করে ক্লাব মালিকদের মুনাফা লোটার চক্রান্ত ব্যর্থ হবে আর এই অতিমারির করাল কালে ফুটবল রক্ষা পাবে এক মহামারির কবল থেকে।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top