সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

বালি ভ্রমণ ১: সোহানা হোসেন স্বাতী


প্রকাশিত:
২২ এপ্রিল ২০২০ ২২:২৭

আপডেট:
৮ জুলাই ২০২০ ২২:৩৭

 

বালি বেড়াতে গিয়ে ছোট্ট দুটো মজার ঘটনা ঘটেছে। ভলকানো দেখতে গেলাম কিন্তামানি এলাকায়। শহর থেকে বেশ দূরে এবং অনেক উঁচুতে। মসৃণ রাস্তার দু'পাশে কমলা বাগান। যত ওপরে যাচ্ছি তত বেশী ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে।মেঘ যেন নেমে এসেছে হাতের কাছে। মেঘ ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমাদের গাড়ি প্রথম পয়েন্টে এসে দাঁড়ালো, এখান থেকে আগ্নেয়গিরি দেখা যায়, এখানে দাঁড়িয়ে টুরিস্টরা ছবি তোলে।আমাদের গন্তব্য অবশ্য ২য় পয়েন্টে, যেখানে রেস্টুরেন্ট এ খেতে খেতে আগ্নেয়গিরি এবং লেক এর সৌন্দর্য দেখা যায়।

 

আমরা যখন ১ম পয়েন্টে দাঁড়ালাম পড়ন্ত দুপুর। মেঘের লুকোচুরিতে মনে হচ্ছে বিকেল। একটু পর পর মেঘ এসে ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে সব। মেঘের এতোটাই অবাধ্যতা যে ছবি তোলাই দায়। যাই হোক কিছু ছবি তুলে আমরা গাড়ির দিকে এগোচ্ছি ফুটপাথ ধরে । পাহাড়ি পথ, একপাশে রেলিং দেওয়া আরেক পাশে মেইন রোড, পথচারী এবং হকারদের বেশ ভিড়। টুরিস্টরা একে অন্যকে সাইড দিয়ে সরু ফুটপাথে যাওয়া আসা করছে।চলতি পথে হঠাৎ দেখি স্যারন পরিহিত এক ইন্দোনেশিয়ান যুবক হাসিমুখে এগিয়ে এসে মিঠুর সাথে হ্যান্ডসেক করছে, বয়স ৩০ এর মত হবে গোলাগাল মুখ , মুখে রাজ্যের হাসি । মিঠুও হেসে হেসে কথা বলছে। যুবক এতো খুশি যে হাতই ছাড়ছে না।দুজনের চোখেই খুশির ঝিলিক, সে মিঠুকে বার বার জিজ্ঞেস করছে তাকে মনে আছে কি না ? মিঠু তাকে চেনা হাসিতে আশ্বস্ত করছে যে তার অবশ্যই মনে আছে।আমি একটু পিছনে ছিলাম এগিয়ে যেতেই মিঠু পরিচয় করিয়ে দিল আমার সাথে। ঘটনা পরিষ্কার হল এবার, মিঠু ৬ মাস আগে যখন বালি গিয়েছিল তখন এই যুবক ছিল তাদের টিমের গাইড।
মুখে একরাশ হাসি নিয়ে যুবক আমাকে জানাল, ওদের অফিসের ৭০ জনের টিম ম্যানেজ করা তার একার পক্ষে সম্ভব ছিল না যদি না স্যার তাকে হেল্প করত। আরও জানালো স্যার খুব ভালো এবং কাজের বিষয়ে খুব গোছানো । অবশেষে বিদায় নেবার পালা, তখনও তার মুখে হাসি লেগে আছে । তার সেই হাসি সংক্রমিত হল আমাদের মাঝেও। বিদায় নিয়ে সে চলে গেল, তার ২ গেস্ট নিয়ে যারা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল তার সাথে। আমরাও দ্রুত পা চালালাম গাড়ির দিকে। এতো মানুষের ভিড়ে তার সাথে দেখা হওয়াটা ছিল আসলেই অবাক হবার মত ঘটনা, তার চেয়েও বেশী ভালো লাগছিল সে ঠিকই একজন অতিথিকে মনে রেখেছে। একজন বিদেশীর মুখে স্বামীর প্রশংসা শুনে মনে মনে খুশি আমি, মুখে চাপা হাসি নিয়ে দুষ্টুমি করে বললাম, " যাক বিদেশ বিভূঁইয়েও দেখি তুমি বেশ পরিচিত ! "
গম্ভীর কণ্ঠে জবাব এলো " তাড়াতাড়ি করো মেঘে ঢেকে গেলে আর ভলকানো দেখতে হবে না ..."

 

বালি এবং নুসা পেনিডা মিলিয়ে ৬ টা বীচ দেখেছি আমরা। এতো দিন সমতলে দাঁড়িয়ে বীচ দেখেছি, এবার কিছুটা ব্যাতিক্রম। পাহাড়ের উপর থেকে দেখেছি অসাধারণ কিছু বীচ।ছোট বেলায় ভিউ কার্ড বা পোস্টারে যেমন দেখেছি, ঠিক তেমন বীচ এবার নিজ চোখে দেখা।তবে একটা সমস্যাও হয়েছে । প্রচন্ড সুন্দরের সামনে গেলে নিজেকে ক্যামন যেন তুচ্ছ মনে হয় , আবার সুন্দরের মাঝে ক্যামন যেন ভয় ভয়ও থাকে । কেন ভয় বা কিসের ভয় সেটা বোঝা যায় না তবে একটা মন খারাপের অনুভূতি থাকে। একটা বীচে তো নামতেই পারলাম না। গাছের শিকড় এবং লতা দিয়ে মই এর মত খাঁড়া প্রাকৃতিক সিঁড়ি যেটা বীচে যাওয়ার একমাত্র পথ , যে পথে নামতে ১ ঘন্টা এবং উঠতে ১ ঘণ্টা লাগে।আমার সাহসে কুলায়নি।কেবলি মনে হয়েছে আর কিছু দিন আগে হলে হয়ত পারতাম।

 

ক্রিস্টাল বীচে দেখেছি জলের স্বচ্ছতা , সেই সাথে স্বল্পবসনা শ্বেতাঙ্গিনীদের শরীরের ভাঁজ ভাঁজে আনন্দ উচ্ছ্বাসও যেন ক্রিস্টাল ক্লিয়াল , কোন রাখ ঢাক নেই , নেই কোন মেকী অভিনয়।

 

পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে নিচে বীচের ক্ষুদে মানুষগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল প্রতিটা মানুষের জীবনে কতো স্বপ্ন, কতো চাওয়া, কতো অভিযোগ ... অথচ একটা বড় ঢেউ এসে নিমিষেই ভাসিয়ে নিতে পারে। এতো বিশালতায় মাথাটা ক্যামন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল , মনে হচ্ছিল আমার চারিদিকে কেবলই শূন্যতা। জীবন জীবিকা সংসার সবই যেন তুচ্ছ। একদিকে প্রকৃতির এতো রূপ, এতো উদারতা ... অপর দিকে আমাদের নিজস্ব সংকীর্ণতা। প্রকৃতির এতো ঐশ্বর্য, আর আমরা কিনা বদ্ধ ঘরে মুখ গুজে মোবাইল, ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে একটা ফেইক জীবন যাপন করে চলেছি। ভুলে গেছি শ্বাস নিতে । আনন্দে মেতে থাকা মানুষগুলোকে দেখে একটা কথাই বার বার মনে হয়েছে ...

“আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি।"

 

দেখতে দেখতে ৭ টা দিন কাটিয়ে, শেষ দিনের মুখোমুখি। দূরে কোথাও যাওয়া নেই , পথে পথে ঘোরা । মিঠুর সাথে পাল্লা দিয়ে হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করেই খানিকটা পিছিয়ে পড়েছিলাম বার বার ।বিভিন্ন ভাবনায় আনমনাও ছিলাম একটু। হঠাৎ এক শ্বেতাঙ্গিনী আমার হাতটা ধরে থামাল , বয়স আনুমানিক ৫৫ হবে , স্টাইলিস্ট মহিলা, কিছু একটাতে হেলান দিয়ে বসে ছিল। আমার বুকে পড়ে থাকা মালাটা স্পর্শ করে যা বলল তার অর্থ হল আমার মালাটা খুব চমৎকার আর এটা আমাকে মানিয়েছে বেশ।
সে আরও বলল , " you are so nice, perfect Indian beauty."
আমি হেসে আপত্তি জানালাম , " I am not Indian ma'am . I am from Bangladesh . Do you know Bangladesh ?"
সে জানালো সে ইউরোপিয়ান এবং সে বাংলাদেশ খুব ভালো চেনে। তার রিলেটিভ কেউ একজন বাংলাদেশে চাকরী সুত্রে এসেছিল।
মিঠু ততোক্ষণে থেমে গেছে আমাকে পেছনে না পেয়ে । তার সাথে হাসি বিনিময় করে হাত মিলিয়ে বিদায় নিয়ে যখন মিঠুর কাছে গেলাম, সে জানতে চাইল ' কী কথা তাহার সাথে, তার সাথে ?'
আমি হেসে হেসে জানালাম, " মালাটা নাকি সুন্দর , মালার সাথে আমিও। তুমি না বলো ,ওরা কারও দিকে তাকায় না । এরা তো মালাও দেখে মালার মালকিনকেও দেখে ... পারফেক্ট বিউটিও দেখে..."
আমি আরও আল্লাদের সাথে বলি, "মনে আছে, চায়নাতেও এক লেডী এমনই বলেছিল।"
এবার মুখ খুলল সে , " হুম মনে আছে। কিন্তু একটা বিষয় খেয়াল করেছ, কেবল মাত্র ওল্ড লেডীরাই তোমাকে দেখে ইদানিং এমন কথা বলছে ! "
আমি কপট রাগে ওর কাছাকাছি গিয়ে বলি " Old is gold ... আমার বুড়োই পছন্দ ! যেমন তোমাকে পছন্দ ! হা হা হা ..."

 

সোহানা হোসেন স্বাতী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top