সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংককে এক টুকরা স্পেন : আনিসুল কবীর


প্রকাশিত:
১৬ মে ২০২০ ১৯:৫৩

আপডেট:
১৬ মে ২০২০ ১৯:৫৭

 

মানুষের খাদ্যাভাস বা বিভিন্ন ধরনের রান্না কিন্তু আর মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে সীমাবন্ধ নেই। খাবার-দাবার যেন এখন মানুষের লাইফস্টাইলের অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সময় সেই দেশের বিখ্যাত খাবার সম্পর্কে জানা ও সেসব খাবারের স্বাদ আস্বাদন করা ভ্রমণের আনন্দকে অনেক বাড়িয়ে তোলে। ভ্রমণের সময় মানুষ সবচেয়ে পছন্দ করে স্ট্রিট ফুড খেতে। বর্তমানে ভ্রমণ বা ঘুরাঘুরির জগতে স্ট্রিট ফুড বেশ জনপ্রিয় শব্দ। বিদেশে ঘুরতে গিয়ে বা নিজ দেশে বসে (পড়–ন দাড়িয়ে) দেশী বিদেশী স্ট্রিট ফুড খাওয়া এখন ফ্যাশন। বাংলাদেশের শহরাঞ্চলগুলোতে বেশ আগে থেকেই চটপটি ফুচকা, ঝালমুড়ি, বুট বা ছোলামাখা, ডালপুরি ইদ্যাদি জনপ্রিয় স্ট্রিটফুড দেখা গেলেও এখন শীতকালে বিভিন্ন রকমের পিঠাও পাওয়া যায়। এমন কি ঢাকা শহরের অনেক এলাকার রাস্তায় ফুড কার্টে (বিশেষ ধরনে ঠেলা গাড়ি) বার্গার, ফিস এন্ড চিপস্, পিৎজা, প্যানকেক ইত্যাদি বিদেশি চটকদার খাবার দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। মানুষ খাচ্ছেও মন ভরে। রাস্তার ধারের এসব খাবার এখন নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সব ধরনের মানুষকেই খেতে দেখা যাচ্ছে। ভ্রমণ সম্পর্কিত বিদেশি টিভি চ্যানেলগুলো অনেক আগে থেকেই স্ট্রিট ফুড নিয়ে অনুষ্ঠান প্রচার করে আসছে। মজার মজার সেসব খাবার ও খাবারের প্রস্তুতপ্রণালী দেখতে ভালোই লাগে। টেলিভিশনের ট্রাভেল চ্যালেন গুলো পরিনত হয়েছে ফুড ট্র্যাভেল চ্যানেলে কিংবা লাইফ ষ্ট্যাইল চ্যানেলে। সেজন্য বলা যেতে পারে ঘোরাঘুরির সাথে বৈচিত্রপূর্ন খাবারের স্বাদ আস্বাদনের গভীর যোগসূত্র সবসময় ছিলো। তবে এখন বোধহয় একটু বেড়েছে।

আমি অনেক আগে থেকেই ট্র্যাভেল সম্পর্কিত টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর পোকা। পৃথিবীর সবগুলো মহাদেশের অধিকাংশ দেশেই মনে হয় ঘোরা হয়ে গেছে আমার। ভার্চুয়ালী। টেলিভিশনের আশীর্বাদে। এখন ট্রাভেল চ্যানেলগুলোর খুব জনপ্রিয় একটি বিষয় হচ্ছে বিভিন্ন দেশের স্ট্রিট ফুড। বিশেষত ইউরোপ আমেরিকা এবং এশিয়ার বড় বড় দেশগুলোর স্ট্রিটফুড নিয়ে শত শত টিভি প্রোগাম প্রচার হচ্ছে। পৃথিবীর জনপ্রিয় শেফ, চলচিত্র তারকা কিংবা জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক খাবার নিয়ে অনুষ্ঠান করে নিজেদের জনপ্রিয়তার পারদ বাড়িয়ে চলেছেন। টেলিভিশনের কল্যানে আমিও বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত খাবারদাবার বিশেষত স্ট্রিটফুড বা ফুটপাতের খাবার বিষয়ে আগ্রহী হয়েছি বিভিন্ন সময়। টেলিভিশনে দেখতে দেখতে পৃথিবীর বেশ কিছু বিখ্যাত খাবারের নাম ও চেহারা সম্পর্কে একটা প্রচ্ছন্ন ধারণাও হয়েছে। অনেক সময় টেলিভিশনে দেখে কোন কোন বিশেষ খাবারের প্রতি একটা বাড়তি আকর্ষণ বোধ করেছি। মনে হয়েছে, আহা আমি যদি ঐ দেশটিতে ভ্রমণ করতে যেতে পারতাম। আর ঐ দেশের রাস্তায় দাড়িয়ে অমুক খাবারটি খেতে পারতাম। বেশ অনেকটা সময় ধরে বিভিন্ন ট্রাভেল চ্যানেলে স্পেনের একটা খাবার দেখে আমার ভালো লেগেছে। সেই খাবারটির নাম পায়েল্লা/পায়েইয়া (Paella)। খাবারটির সাথে আমাদের খিচুড়ির মিল আছে। স্পেনিশ খিচুড়ি বললে খুব একটা দোষ হবেনা হয়তো। পায়েল্লা বা পায়েইয়া অল্প আঁচে গোল চেপ্টা বাসনে মুরগীর মাংশ, চিংড়ি, ঝিনুক, অন্যান্য সামুদ্রিক খাবার বা সবজি দিয়ে রান্না করা হয়। এটি স্পেনের জাতীয় খাবার এবং এটি মুলত ভ্যালেন্সিয়া এলাকায় বেশি জনপ্রিয়।

টেলিভিশনে দেখে স্পেনে বসে পায়েল্লা বা পায়েইয়া খাবার আশা এখন পর্যন্ত ধরাছোয়ার বাহিরে থাকলেও আামার মনে আশা প্রায় অনেকটাই পুরণ হয়েছিলো ২০১৫ সালে থাইল্যান্ড ভ্রমণে গিয়ে। স্পেনে বসে স্পেনিশ পায়েল্লা না খেতে পারলেও স্পেনিশ সেফের তৈরী পায়েল্লা খাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো থাইল্যান্ডে বসে। ব্যাংককে চাতুচক (Chatuchak Weekend Market) নামের সানডে মার্কেটে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো ২০১৫ সালের সেই থাইল্যান্ড ভ্রমণে। চাতুচক মার্কেট বিদেশী পর্যটকের স্বর্গরাজ্য। বিশেষত পশ্চিমা বিশ্ব থেকে অসংখ্য মানুষ এই মার্কেটে ঘুরতে আসে। এখানে জামাকাপড় থেকে শুরু করে প্রায় সব কিছুই পাওয়া যায়। একতালা মার্কেটটিতে প্রায় ১৫ হাজার ষ্টল আছে এবং এটি ২৭টি সেকশনে বিভক্ত। চাতুচকে অসংখ্য দোকানের মধ্যে স্ট্রিট ফুডের দোকানও অসংখ্য। যেহেতু এখানের বেশিরভাগ ক্রেতা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসে। সেজন্য পৃথিবীর অনেক দেশের অনেক বিখ্যাত খাবারই এখানে বিক্রি হতে দেখা যায়। চাট্টুচকে কিছুটা সময় ঘুরাঘুরি করেই আমার জায়গাটিকে আন্তর্জাতিক স্ট্রিট ফুডের স্বর্গ্যরাজ্য মনে হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের বিখ্যাত খাবার এখানে বিক্রি হতে দেখেছি। আর আগেই বলেছি আমি স্পেনের বিখ্যাত খাবার পায়েল্লা বা পায়েইয়া (Paella) খাওয়ার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী ছিলাম। আর চাতুচক মার্কেটের স্ট্রিটফুডের সারিতে স্পেনিশ দোকানও যে আছে সেটা আমার আগেই জানা ছিলো। বেশ কয়েক বছর আগে ডিসকভারি ট্রাভেল এবং ট্রাভেল এন্ড লিভিং (টিএলসি) দুটি চ্যানেলের বেশ কয়েকটা ট্রাভেল শোতে থাইল্যান্ড ভ্রমণের অনুষ্ঠান দেখেছি। সেসব ট্রাভেল শোতে চাতুুচক মার্কেটের একজন শেফকে সব সময় দেখিয়েছে। খুব মজার লোক সন্দেহ নাই। স্পেনিস শেফ। নাম শেফ ফার্নান্ডো (Chef Fernando) । Chef Fernando's Paella  লেখে সার্চ দিলে এই মজার পাচকের কান্ডকারখানা দেখতে পারবেন। আন্তর্জাতিক সব ট্রাভেল চ্যানেলেই ভদ্রলোক বেশ জনপ্রিয়। থ্যাইল্যান্ড ভ্রমণের উপর যে কোন অনুষ্ঠানেই তাকে দেখানো হয়। তার জনপ্রিয়তার কারন হচ্ছে রান্নার সময় সে নাচ, গান ও বিভিন্ন প্রকার মজার মজার অংগভঙ্গি করে যা খুবই আকর্ষণীয়।

চাতুচক মার্কেটের ভিতরের দৃশ্য

নাচ গান আর অংগভঙ্গির মাধ্যমে পর্যটকদের আনন্দ দিচ্ছেন শেফ ফার্নান্ডো


রান্না চলছে, সাথে দর্শকদের সাথে আড্ডা


আগে থেকে জানা থাকায় চাতুচতে ঘুরতে গিয়ে মনে মনে শেফ ফার্নান্ডোর রেস্টুরেন্টটা খুজছিলাম। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় আমার বহুকাংখিত ফার্নান্ডোর পায়েল্লার দোকান খুব সহজেই পেয়েছিলাম সেদিন। শেফ ফার্নান্ডোর অদ্ভূত অংগভঙ্গি আর নাচ দেখে অনেক মজা লেগেছে বলাই বাহুল্য। বেশ অনেক পর্যটকের সাথে দাড়িয়ে ছবি ও ভিডিও করে নিয়েছিলাম সেদিন। সাথে সাথে আমার বহুদিনের ইচ্ছার অর্ধসমাপ্তি ঘটালাম স্পেনিশ শেফের নিজের হাতে বেড়ে দেয়া এক প্লেট গরম পায়েল্লা খেয়ে, আর প্লেট হাতে সেলফি তুলে। এখন শুধু বাকি থাকলো স্পেনের কোন শহরের রাস্তার পাশে বসে পায়েল্লা খাবার স্বপ্নটা। যদিও সেদিন চাতুচকের রেস্টুরেন্টটিকে আমার মনে হয়েছিলো এক টুকরো স্পেন।


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top