সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

দি অস্ট্রেলিয়ান বোটানিক গার্ডেনে একদিন : মোঃ ইয়াকুব আলী


প্রকাশিত:
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:২৭

আপডেট:
২৯ মার্চ ২০২৪ ১৮:২২

 

চার ঋতুর দেশ অস্ট্রেলিয়া। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্রীষ্মকাল, মার্চ থেকে মে পর্যন্ত শরৎকাল, জুন আগস্ট পর্যন্ত শীতকাল আর সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বসন্তকাল। পঞ্জিকা অনুযায়ী ঋতুর বিভাজন এমন হলেও বাস্তবে একই দিনে সব ঋতুর দেখা অহরহ পাওয়া যায় তাই অস্ট্রেলিয়ায় বহুল প্রচলিত একটা কৌতুক হচ্ছে এখানে তিনটা জিনিসকে কখনোই বিশ্বাস করবেন না। সেই তিনটা জিনিস হলো অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া, কাজ আর মেয়েমানুষ। আমরা আজ বিস্তারিত সেই আলোচনায় যাবো না বরং আবহাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবো।

পঞ্জিকা অনুযায়ী এখানে এখন বসন্তকাল। শীতের শেষে সেপ্টেম্বরের প্রথম দিন থেকেই তাপমাত্রা হঠাৎ করে বেড়ে যায়। আর হুমায়ুন আহমেদের ভাষায় বসন্তের লিলুয়া বাতাস বইতে শুরু করে। প্রকৃতিতে যৌবনের স্পন্দন দেখা যায়। গাছগুলো পুরনো পাতা বিসর্জন দিয়ে নতুন পত্রপল্লবে সুশোভিত হয়। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন জায়াগায় চেরি উৎসবের আয়োজন করা হয়। চেরি উৎসব বলতে চেরি ফলের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। অনেকগুলো ফুল এসময় একসাথে ফুটে সেগুলোর সামগ্রিক সৌন্দর্যকে চেরি উৎসব বলা হয়। এছাড়াও গাছে গাছে চোখ জুড়ানো, মন ভুলানো বাহারী রঙের ফুল দেখা যায়।

সারা অস্ট্রেলিয়ায় দীর্ঘ শীতের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে বিভিন্ন রকমের উৎসব আয়োজন করা হতে থাকে যেমন সিডনির অন্যতম সিগনেচার ফেস্টিভ্যাল বন্ডাই উইন্ড উৎসব যেখানে  রঙ বেরঙের শতশত ঘুড়ি বন্ডাই সমূদ্র সৈকতের আকাশে ভেসে বেড়ায়। সকাল এগারোটায় শুরু হয়ে সেই উৎসব চলে বিকাল চারটা পর্যন্ত। করোনার কারণে এবছর সমস্ত উৎসব নিষিদ্ধ করা হয়েছে আমাদের মেয়ে তাহিয়া আর আমি মিলে ঠিক করলাম গত ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২০ শনিবার আমরা অস্ট্রেলিয়ান বোটানিক গার্ডেনে যাবো যেটা মাউন্ট এনানে অবস্থিত। সারা অস্ট্রেলিয়া জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক বোটানিক গার্ডেন। দি অস্ট্রেলিয়ান বোটানিক গার্ডেন আমাদের বাসা থেকে সবচেয়ে সন্নিকটে তাই আমরা সেখানে যাওয়ার জন্যই মনস্থির করলাম।

এই ফাঁকে দি অস্ট্রেলিয়ান বোটানিক গার্ডেনের কিছু তথ্য দিয়ে রাখি। বাগানটি ৪১৬ হেক্টরএখানে প্রায় চার হাজার প্রজাতির গাছপালা রয়েছে।  জমির উপর অবস্থিত। বাগানের এই বিশাল এলাকাজুড়েই রয়েছে বিভিন্ন ধরণের আর্টওয়ার্ক। সেই ১৮১৮ সাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায় পার করে বাগানটি আজকের এই অবস্থায় এসেছে। ১৯৮৮ সালে অফিসিয়ালি বাগানটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হয়। শুরুতে এখানে ঢোকার জন্য ফিস নির্ধারণ করা হলেও ২০১১ সাল থেকে সেটা বাতিল করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। গত বছরই দি অস্ট্রেলিয়ান বোটানিক গার্ডেন তাদের ত্রিশ বছর পূর্তি পালন করেছে। সেই উপলক্ষে বিশাল একটা ইংরেজিতে ত্রিশ লেখা ভাস্কর্য বাগানের কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়েছিলো।

আমাদের বাসা থেকে বোটানিক গার্ডেনে যেতে কুড়ি মিনিটের ড্রাইভ। অবশ্য আপনি সিডনি সিটি থেকে যেতে গেলে ঘন্টাখানেকের ড্রাইভ। গাড়িতে সাধারণত শীতাতপ যন্ত্র চালিয়ে রাখা হয় কিন্তু আজ আর সেটা করলাম না কারণ বাইরে বসন্তের নাতিশীতোষ্ণ বাতাস বইছিলো। তাই আমরা বসন্তের বাতাস গায়ে মেখে এগিয়ে চললাম। বোটানিক গার্ডেনে প্রবেশ করার সাথে সাথে গায়ে একটা শীতল বাতাসের ছোঁয়া লাগলো। একটু এগিয়ে যেতেই নাকে মধুর মৌ মৌ গন্ধ এসে লাগলো। আমরা সামনে খেয়াল করে দেখি বোটানিক গার্ডেনের স্প্রিং গার্ডেনে ফুটে আছে অনেক ফুল। এই মৌ মৌ গন্ধ সেখান থেকেই আসছে।

আমরা নির্দিষ্ট কার পার্কিঙে গাড়ি রেখে ফুলের বাগানের কাছে গেলাম। সেখানে অনেক মানুষ ফুলের, ফুলের সাথে নিজের বা নিজেদের পরিবারের ছবি তুলছে। আমরাও বিভিন্ন রকমের ছবি তুলতে শুরু করলাম। আমাদের পাশেই এক নবদম্পতি ছবি তুলছিলেন। তাদেরকে ছবি তুলতে দেয়ার জন্য আমরা কিছুক্ষণ আমাদের হাটা থামিয়ে দিলাম। উনাদের ছবি তোলা শেষ হলে আমাদের ধন্যবাদ দিলেন নির্বিঘ্নে ছবি তোলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। আমি বললাম ইটস ওকে। এ ধরনের সৌজন্যমূলক কথাবার্তা অস্ট্রেলিয়ার পথেঘাটে হরহামেশাই হয়। আমি বললাম আপনি কি বাতাসের গন্ধটা অনুভব করতে পারছেন। উনি বললেন হ্যাঁ। আমি বললাম এটা মধুর গন্ধ। শুনে উনি বললেন, তাই তো ভাবছিলাম গন্ধটা কেন এতো পরিচিত মনে হচ্ছিলো।

অস্ট্রেলিয়ান বোটানিক গার্ডেনে অন্য সময়গুলোতেও অনেক মানুষের সমাগম থাকে কিন্তু বসন্তকালে সংখ্যাটা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যায়। বোটানিক গার্ডেনের বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পরিকল্পনামাফিক লাগানো লক্ষ লক্ষ গাছ। পুরো বোটানিক গার্ডেন ঘুরে দেখতে হলে আপনাকে সারাদিন সময় নিয়ে আসতে হবে। গার্ডেনের হ্রদগুলোতে হাস, পানকৌড়ি সাতার কেটে বেড়াচ্ছে। আপনার কপাল ভালো হলে শতবর্ষী কচ্ছপের দেখাও পেয়ে যেতে পারেন। এছাড়াও কপাল যদি আরও একটু ভালো হয় তবে পেয়ে যেতে পারেন ক্যাংগারুর দেখাও।

ঘুরতে ঘুরতে আমাদের ক্ষিধে পেয়ে গেলো। বোটানিক গার্ডেনের মধ্যে রয়েছে বাচ্চাদের জন্য একটা পার্ক, একটা ক্যাফে, টয়লেট আর শেডের তলায় আছে বার বি কিউয়ের ব্যবস্থা। তবে ক্যাফেতে খাবারের দাম আমার কাছে একটু চড়াই মনেহয়েছে। এইবার করোনার কারণে ক্যাফে বন্ধ থাকায় বাগানের কেন্দ্রে একটা ভ্রাম্যমাণ ক্যাফে স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে আইসক্রিম থেকে শুরু করে হালকা খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যাচ্ছে। আমি তাহিয়া আর রায়েনাকে দুটো আইসক্রিম কিনে দিলাম। এতক্ষণ যে ফুলের সমারোহ দেখছিলাম সেগুলো শুধুমাত্র বসন্তকালীন অস্থায়ী ফুলের বেড।

এরপর আমরা মূল বাগানের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। বাসন্তী বাগানের ফাঁকে কয়েকটা ধাতব মৌমাছির মূর্তি আছে। মূর্তি দুটোর কংকাল ধাতুর তৈরী হলেও শরীরটা মাটির এবং সেই মাটির মধ্যে শরীরের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রকমের ফুলের গাছ লাগানো। দেখতে অনেক সুন্দর। অন্যান্য সময়ে এতো বেশি সুন্দর না লাগলেও শরীরের বাসন্তী ফুলগাছগুলোতে এই সময়ে ফুল ফুটে মৌমাছিগুলোকে জীবন্ত রুপ দেয়। বাচ্চারা এমন মৌমাছি দেখে খুবই অবাক হলো। অনেকেই মৌমাছির সামনে পিছনে দাড়িয়ে ছবি তুলছিলেন। আমিও এক মা মেয়েকে ছবি তুলতে সাহায্য করলাম।

আমরা ঘুরেফিরে একসময় একেবারে চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। সেখানে এক টুকরো সবুজের বিছানা। বাচ্চারা সেখানে যেয়ে শুয়ে পরলো। সেখান থেকে চারপাশে অনেকদূর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। সেখানে এক অস্ট্রেলিয়ান দম্পতি এসে ছবি তোলা শুরু করলো। দুটো আফ্রিকান বাওবাব গাছ আছে সেখানে। যেগুলো দেখতে সাধারণ গাছের উল্টো। মনেহয় মাটি থেকে হঠাৎ একটা আস্ত কান্ড বের হয়ে গেছে। তারপর কান্ডের মাথার শাখাগুলোকে মনেহয় যেন শিকড়। অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রমহিলা একটা বাওবাব গাছকে জড়িয়ে ধরে আছে আর ভদ্রলোক তার ছবি তুলছে দেখে আমি পাশ থেকে বললাম, কেউ একজন গাছের সাথে ভালোবাসা করতেছে। আমার কথা শুনে উনারা দুজনেই হেসে দিলেন। তারপর ভদ্রলোক বললেন, এটাতো আফ্রিকান বাওবাব গাছ। আমি বললাম জি এটা বাওবাব গাছ। উত্তর শুনে উনি গাছের ছোট্ট নেমপ্লেট দেখিয়ে বললেন কিন্তু এখানে তো অন্য নাম লেখা। আমি বললাম, এটাকে বলে সায়েন্টফিক নাম কিন্তু আমি নিশ্চিত এটা বাওবাব গাছ। তারপর উনারা আমাদের বিদায় জানিয়ে এগিয়ে গেলেন অন্য বাওবাব গাছটার দিকে। আমি তখন আবারও বললাম, ডোন্ট লুজ হার উইথ দ্য ট্রিস। আমার কথা শুনে ভদ্রলোক আবারও হাত নেড়ে সায় দিলেন।

এরপর আমরা গাছের ছায়াঢাকা পথ পার করে একটা খোলা জায়গায় এসে পৌছালাম। সেই জায়গাটায় বোটনিক গার্ডেনের সবচেয়ে উঁচু জায়গা। পাশেই একটা বিশাল আকারের গোলাকৃতি পানির ট্যাংক। একটা রাস্তা চলে গেছে পানির ট্যাংকের দিকে। সেই রাস্তায় দাড়ালে দূর থেকে মনেহবে আপনি শুনে দাড়িয়ে আছেন কারণ রাস্তাটার পিছনে পুরোপুরি ফাঁকা। এভাবে চলতে চলতে আমাদের সময় ফুরিয়ে এলো। এখানে উল্লেখ্য বোটানিক গার্ডেন শীতকালে বিকাল পাঁচটা এবং গ্রীষ্মকালে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে।

বোটানিক গার্ডেনে এর আগেও আমরা গিয়েছি এবং তার সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়েছি কিন্তু এইবারের ভ্রমণটা ছিলো মনেরাখার মতো। কারণ সারাটা সময়ই আমাদের নাকে ফুলের মধুর মৌ মৌ গন্ধটা লেগে ছিলো তাই এইবারের ভ্রমনটাকে আমরা বললাম, "মৌমাছিদের সাথে একটা দিন"।

 

মোঃ ইয়াকুব আলী
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top