সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

দেবভূমি পেরিয়ে : ডঃ গৌতম সরকার


প্রকাশিত:
২২ অক্টোবর ২০২০ ২৩:১১

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:২৯

 

সকালে ঘুম থেকে উঠে যোশিমঠে একটা চক্কর মারলাম, প্রথমে গেলাম রোপওয়ে স্টেশন৷ ১৯৯৪ সালে যোশিমঠ থেকে আউলি পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটার আকাশপথে এই আনন্দভ্রমণ শুরু হয়েছে; উচ্চতা ৩,০৪৯ মিটার - পথে দশটি পিলার আছে ৷ পুরো পথটা দুটি ভাগে বিভক্ত - প্রথম পর্বে কাঁচের কেবিনযুক্ত কেবলকারে পৌঁছে যাওয়া যায় আট নম্বর পিলার পর্যন্ত, জায়গাটির নাম গড়সন; সেখান থেকে কিছুটা হেঁটে পৌঁছতে হবে চেয়ারকার স্টেশনে এবং ঝুলন্ত চেয়ারকারে বসে যেতে হবে আউলি ৷ এছাড়াও আরো অনেক দ্রষ্টব্য আছে যোশিমঠে, তাই তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে মালপত্র গাড়িতে তুলে পায়ে হেঁটে একটু চড়াই ভেঙে পৌঁছে গেলাম শঙ্করাচার্য আশ্রমে৷ এক অদ্ভূত শান্ত পরিবেশের এই আশ্রমে সারাদিনে ধরে হরেক কিসিমের কাজ চললেও -কোথাও কোনো শব্দ নেই; অদ্ভুত এক নৈঃশব্দের মধ্যে  সবাই নিজ নিজ কাজটি করে যাচ্ছে, কোথাও কোনো ছন্দপতন ঘটছেনা ৷ ওখান থেকে অনেকটা উৎরাই পথ পেরিয়ে গেলাম নৃসিংহনাথ মন্দিরে -যেখানে শীতকালে বদ্রীনাথজির পূজো হয় ৷ এছাড়াও দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে গৌরীশঙ্কর মন্দির, নবদূর্গা আর গণপতিজির মন্দির৷

সব কিছু দেখে যাত্রা শুরু করলাম ২০ কিলোমিটার দূরে আউলির উদ্দ্যেশে৷ আউলিতে আমাদের পরের দুদিনের জন্যে জি. এম. ভি. এনের স্কি-রিসর্টে বুকিং ছিল৷ কপাল ভালো এদিনও এখানে থাকার জায়গা পেয়ে গেলাম ৷ পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছে রিসর্টের ঘরগুলো ৷ একটু দামি হলেও সার্বিক কোয়ালিটি এবং লোকেশন বিচার করলে পয়সা উশুল হয়ে যায়৷ রিসর্ট থেকে বেরোতে হলে আপনাকে অনেকটা নীচে নামতে হবে, প্রায় এক কিলোমিটার নিরবিচ্ছিন্ন অবতরনের পর একটা চায়ের দোকান আর একটা হোটেল পাবেন; তারপর রাস্তা অপেক্ষাকৃত সমতল হয়ে একদিকে গেছে যোশিমঠ আর অন্যদিকে ITBP ক্যাম্প৷ তাই বৈকালিক ভ্রমণ আমার না হলেও আমার স্ত্রীর পক্ষে বেশ কষ্টকর; সেই কারনে উৎরাইয়ে নামলেও চড়াইয়ে ওঠার সময় গাড়ি নিয়ে যোশিজির ডাক পড়ল ৷

পরেরদিন ভোর থেকে আকাশ জুড়ে বৃষ্টি৷ এদিন আমাদের প্ল্যান ছিল কেবলকার চড়ে গড়সন পর্যন্ত গিয়ে তারপর আরো কয়েক কিলোমিটার ট্রেকপথে গড়সন টপে পৌছাবো, কিন্তু বিধি বাম -সারাদিন ধরে বৃষ্টি একই ভাবে ঝরে গেল -আমাদের এককথায় ঘরে আটকে রাখলো ৷ ক্রিকেট হয়তো সাময়িক ভাবে কিছুটা কোয়ালিটি সময় কাটাতে সাহায্য করেছিল, কিন্তু কাহাঁতক বেড়াতে এসে ঘরে বসে থাকা যায় ! তাই বিকেলবেলা যখন মেঘ-কুয়াশার আবরণ ভেদ করে হোটেলের বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করছি তখন প্রকৃতি আমাদের দিকে মুখ তুলে চাইলো৷ আবার যেন নতুন করে সূর্যোদয় হল, সারা আকাশ রাঙিয়ে শেষ সূর্যের কিরণছটা গোটা এলাকাকে মায়াবী এক আবির রঙে রাঙিয়ে তুললো আর বৃষ্টির সাময়িক বিরতিতে আমরাও চট করে কাছাকাছি এক গ্রাম থেকে ঘুরে এলাম৷

আগেরদিন বিকেলবেলা সেই যে আকাশ গুমোট ভাব কাটিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, পরের দিন সকালেও আকাশ ঘন নীল আর নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে প্রায় ১৮০ ডিগ্রী জুড়ে শোভা পাচ্ছে দুনাগিরি, কামেট, মানা, ত্রিশুল, নীলকণ্ঠ, মুকুটের মতো সব নামজাদা হিমশৃঙ্গ৷ তাই ভোরবেলাই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল৷ আমাদের রেষ্টহাউসের একদম মাথায় এক মন্দির আছে আর শুনেছি ওখান থেকে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দুটোই খুব ভালোভাবে দেখা যায়৷ তাই সময় নষ্ট না করে ভোর ভোর পৌঁছে গেলাম মন্দির চত্বরে, তবে মনে রাখার মতো সূর্যোদয় হলোনা; তবু যা হল ততটাই সন্তুষ্টি নিয়ে ঘরে ফিরলাম৷ আজ আমাদের চেয়ারকারে গড়সন পর্যন্ত গিয়ে ওখান থেকে গড়সন টপে ট্রেক করে যাবার ইচ্ছে আছে ৷ সেইমতো সাড়ে আটটা নাগাদ কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট সেরে নটা নাগাদ সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলাম রোপওয়ে স্টেশনের উদ্দ্যেশ্যে ৷ উড়ানটা কিন্তু বেশ থ্রিলিং - খোলা চেয়ার, আপনি বসার পর একটা হ্যান্ডেল কাম প্যাডেল ওপর থেকে নেমে আসবে যেখানে আপনি হাত আর পা রাখতে পারবেন ৷ মাত্র এক কিলোমিটারের যাত্রা; গড়সনে পৌঁছে প্রায় 2-3 কিলোমিটার ট্রেক করে পৌঁছতে হবে অসম্ভব সুন্দর এক তৃণভুমি ছড়ানো পাহাড় ও উপত্যকায়, যা আপনার জীবনের এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে৷

ট্রেক পথটা বেশ সহজ, প্রারম্ভিক জার্নির চড়াই পথটা কড়া রোদে পার হওয়া কিছুটা কষ্টকর কিন্তু ওইটুকু পেরিয়ে আপনি যেই ঘন জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন পথ কিন্তু অনেকটাই আসান হয়ে পড়বে; এক কিলোমিটার হাঁটার পর নির্জন বনমধ্যে পড়বে হনুমানজির এক মন্দির, তারপর আরেকটু চড়াই ভাঙলেই পৌঁছে যাবেন সেই স্বপ্নসুন্দর বুগিয়ালে – দিগন্ত ছোঁয়া পর্বতশ্রেণীর দৈর্ঘ্য -প্রস্থ জুড়ে নামজাদা কোনো চিত্রশিল্পীর এক অনন্য চিত্রকল্প৷ তারপর যতই এগোই পরতে পরতে খুলতে থাকে হিমালয়ের মাহাত্ম্য; যখন সত্যিসত্যিই গড়সন টপে পৌঁছলাম তখন মনে হল স্বর্গে পৌঁছে গেছি কারন এর ওপরে পার্থিব কোনো কিছুর অস্তিত্ব কল্পনা করাটাই যথেষ্ট অকল্পনীয় ৷ খুব ভালো লাগলো ওপরে পৌঁছে ৷ আকাশ একটু মেঘ -মেদুর, কিন্তু তাই বলে এই মেঘে বৃষ্টি আসার কোনো সম্ভাবনা নেই ৷ একদম টপে উঠে আকাশের দিকে মুখ করে সটান শুয়ে গেলাম মখমলি নরম সবুজ ঘাসের বিছানায় ৷ কতক্ষন শুয়ে ছিলাম জানিনা, হঠাৎ করে ঠান্ডা হাওয়া সর্বশরীরকে কাঁপিয়ে দিতে লাগলো, বুঝলাম এবার ফিরতে হবে ৷ আরোহনের চেয়ে অধঃপতন প্রকৃতির নিয়মে সবসময় তাড়াতাড়ি হয়, তাই যখন আধ ঘন্টার মধ্যে নীচে পৌঁছলাম তখন দেখি বৈশালী নিচে বসে ঠান্ডা হাওয়ায় হি হি করে কাঁপছে ৷

পরের দিন অর্থাৎ নয় তারিখ ভোরে ঘুম ভেঙে উঠে দেখি আকাশের মুখ আবার ভার, আজ আমরা আউলি ছেড়ে যাবো তাই আমাদের মনখারাপের প্রতিচ্ছবি যেন আকাশের চোখেমুখেও ধরা পড়ছে ৷ এর ওপর টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে; পরে শুনলাম এই বৃষ্টি আগের দিন রাত একটা থেকে হচ্ছে, রাতে আমরা টের পাইনি ৷ বাইরে বেরিয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখি আগের দিনের সেই তুষারধবল শৃঙ্গগুলো ঘন কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে; মনটা খারাপ হয়ে গেল - ইচ্ছে ছিল এই জায়গা ছাড়ার সময় আউলির আকাশ -বাতাস, পরিবেশ -প্রকৃতি সবকিছুকে চোখের দেখা দেখে শেষবারের মতো বিদায় জানাবো, কিন্তু কোথায় কি ! চোখের সামনে ঘন কালো কুত্সিত মেঘ ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছেনা ৷

তবে আমাদের তো যেতেই হবে, অগত্যা সময় নষ্ট না করে তৈরী হতে থাকলাম ৷ আজ আমাদের গন্তব্য খিরসু -অনেকটা পথ, প্রায় 200 কিলোমিটার -তাই জলখাবার খেয়ে নটা নাগাদ বেরোবার জন্য বাইরে বেরিয়ে দেখি .......আরে !!! আকাশ তো একদম পরিষ্কার !!! বৃষ্টি থেমে গেছে, আর মেঘের আড়াল থেকে সূর্য পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে না পারলেও উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করছে, আর সেই আবছা রক্তিমার ক্যানভাসে মুকুট, নীলকণ্ঠ, ত্রিশূল প্রভৃতি হিমশৃঙ্গগুলো আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে ৷ সকালের মনখারাপটা নিমেষের মধ্যে কেটে গেল, গেস্ট হাউস থেকে চোখ ভোরে প্রকৃতির অপরূপ -অনির্বাণ সৃষ্টিকে দর্শনে কুর্নিশ জানিয়ে নটা-পনেরো নাগাদ পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম ৷

আগেই বলেছি, আজ আমাদের দীর্ঘ যাত্রা, যাত্রা না বলে প্রতিযাত্রা বলাই ভালো কারন এবার আমরা যে যে রাস্তা ধরে, যে যে জায়গার ওপর দিয়ে আমাদের ভ্রমণ শুরু করেছিলাম এবার সেই সব গুলো ছাড়তে ছাড়তে ফিরব; এটা যে কোনো ভ্রমণপ্রিয় মানুষের কাছে বেশ কষ্টের ৷ যদিও এখনো দুটো জায়গা দেখা বাকি তবুও ভ্রমণটা শেষ হতে চলেছে ভাবলেই বুকটা চিন চিন করে উঠছে ৷ আউলি থেকে নেমে এলাম যোশিমঠ, যোশিমঠকে পাশ কাটিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল পিপলকোটি হয়ে বিরহী - তারপর এসে পৌঁছলাম গাড়োয়াল হিমালয়ের বেশ ঘন জনবসতিপূর্ণ জেলাশহর চামোলি; চামোলি থেকে রাস্তা কেটে গেছে -প্রথমটা যে পথ দিয়ে চোপতা গোপেশ্বর হয়ে আমরা এসেছিলাম আর পরেরটা যেটা দিয়ে এখন আমরা যাবো খিরসু ৷ অনেক সুন্দর সুন্দর ছবির মতো পাহাড়ি জনপদ পেরিয়ে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম কর্ণপ্রয়াগ -পঞ্চপ্রয়াগের অন্যতম, এখানে অলকানন্দা আর পিন্ডার নদীদ্বয়ের সঙ্গম ঘটেছে; সঙ্গমের ঠিক ওপরে আছে কর্ণের এক মন্দির ৷ কথিত আছে সূর্যদেব এই জায়গায় কর্ণকে কবচকুন্ডল দান করেছিলেন৷

বেলা হয়ে গেছে, রাস্তায় এক জায়গায় খেয়ে নিলাম, পথ চলেছি তো চলেছি, শেষ আর হয়না ----অবশেষে পাঁচটা নাগাদ খিরসু পৌঁছলাম ৷  

পউরি গাড়োয়াল জেলার এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন ঠিকানা হল খিরসু ৷ কিন্তু এখানেও দেখি আকাশভরা মেঘ, কটেজে ঢোকার কয়েক মুহূর্তের মধ্যে শুরু হল বৃষ্টি -এ যেন খিরসুর আকাশ আমাদের আসার অপেক্ষা করছিল ৷ ফলতঃ নতুন একটা জায়গায় এসে প্রথম মুহূর্ত থেকেই গৃহবন্দী ! এ যে কি ফ্রাসট্রেটিং !.......চুপচাপ ঘরের মধ্যে এক কাপ চা নিয়ে গুম হয়ে বসে থাকলাম ৷ সবথেকে যেটা খারাপ লাগছে এখানে আমাদের থাকা মাত্র এক রাতের, তাই বৃষ্টির কারনে বেরোতে না পারলে এ জায়গাটি তো কিছুই দেখা হবেনা ৷ কাল সকালে আর কতটুকুই বা দেখতে পাবো ! ....আর বৈশালীতো সকালে বেরোতে পারেনা !

কিন্তু অন্য সব জায়গার মতো এখানেও প্রকৃতি আমাদের প্রতি সদয় হল, হঠাৎ দেখি সাড়ে ছটা নাগাদ আকাশ একদম পরিষ্কার, বৃষ্টি থেমে গেল, আর আমরাও এতটুকু সময় না করে বেরিয়ে পড়লাম ৷ উত্তরাখন্ডের এই অংশের সুবিধা হল এখানে সূর্য অস্ত যায় সাতটার পর আর গোধূলির আলোতে রাস্তাঘাটে ঘোরা যায় আটটা পর্যন্ত৷ এখানে অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে এক মন্দিরের অবস্থান -ঘন্টাকর্ণ মন্দির ; কিন্তু মন্দিরে যাবার আগে আমাদের গেস্ট হাউসের ওপরে হসপিটালের চত্বর থেকে অসম্ভব মনকাড়া সূর্যাস্ত দেখলাম; তারপর পৌঁছলাম মন্দির আর মন্দিরের পিছনে এক ছোট সুন্দর গ্রামে ৷  মন্দিরটি এক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ প্রাঙ্গণের মধ্যে, কলেজের একটা বিল্ডিং এখনো বৃটিশ স্থাপত্য ধরে রেখেছে ৷ মন্দিরের পিছনের রাস্তাটা বড় মনোরম ..... মায়াবী পরিবেশে এক নিশিডাক শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু এবার সত্যি সত্যি চতুর্দিক অন্ধকার হয়ে এসেছে, তাই আর অ্যাডভেঞ্চারে না গিয়ে হোটেলে ফিরে যাওয়াই মনস্থ করলাম ৷

খিরসুতে আমাদের কটেজের সামনে দিয়ে একটা রাস্তা গড়গড় করে উৎরাইয়ে নেমে গেছে .....কোথায় গেছে কে জানে !!! তবে কাল থেকেই রাস্তাটার এক অমোঘ টান আমি টের পাচ্ছি ৷ কাল আবহাওয়ার কারণে আর সন্ধ্যেবেলা মন্দির দর্শনে ওপরের দিকে যাওয়ায় এই আ্যডভেঞ্চারটা বাকি থেকে গেছে আর উৎরাইয়ের বহর দেখে বুঝলাম ফিরে আসতে দম বেরিয়ে যাবে, তাই এই রাস্তা আমার স্ত্রীর পক্ষে অতিক্রম করা সম্ভব নয় ৷ অতএব খিরসুতে দ্বিতীয় দিন সকালে প্রাতঃভ্রমণের জন্য এই রাস্তাটাই বেছে নিলাম ৷ সকালে ঘুম থেকে উঠে জানলা খুলতেই সুপ্রভাত জানালো অজস্র জানা -অজানা পাখির কাকলি; আর এখন সেই পাখিদের সঙ্গে নিয়ে (যার মধ্যে বেশিরভাগই চড়ুই ), তাদের লাফালাফি দেখতে দেখতে আর কিচিরমিচির শুনতে শুনতে আমি  উৎরাই পথে মাধ্যাকর্ষণের টানে গড়গড়িয়ে নীচের দিকে নামতে থাকলাম ৷ যতই নামি ততই ওঠার কথা ভেবে বুকটা ধুকপুক করতে থাকে, অবশেষে একটানে প্রায় এক কিলোমিটার পথ নেমে যেখানে পৌঁছলাম সেটা হল খিরসু আসার মূল পিচের রাস্তা, অর্থাৎ আগের দিন এই রাস্তা ধরে এখানে পৌঁছেছি ৷ একবার ভাবলাম ফেরার সময় ওই ভয়ংকর চড়াইয়ে না গিয়ে গাড়ির রাস্তা ধরে গেলে কেমন হয় ! এই ভেবে নজর করে দেখি রাস্তাটা তিন -চারটে পাহাড়কে বেড় দিয়ে (৮-১০ কিমি হবে ) খিরসুতে গিয়ে পৌঁছেছে ৷ অগত্যা সেই আশা ত্যাগ করতে হল, বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে একটু দম নিয়ে শুরু করলাম আমার আরোহণ ৷  নিজেকে বোঝালাম -আরে বাবা, খঞ্জও গিরি লঙ্ঘন করতে পারে আর আমি এইটুকু পারবো না ; তাই আমিও ধীরে ধীরে চারপাশের মনোমুগ্ধ প্রকৃতি দেখতে দেখতে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম ৷

আজ ব্রেকফাস্টের পর আমরা বেরিয়ে পড়ব, আমাদের পরবর্তী আর শেষ গন্তব্যস্থল ল্যান্সডাউন, এখান থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার ৷ জলখাবার খেয়ে লাগেজ গাড়িতে তুলে মিনিট পনেরোর জন্য আমরা দুজনে বেরোলাম শেষ বারের মতো খিরসুকে একটু হৃদয় দিয়ে ছুঁতে ৷ আগেই বলেছি আমাদের গেস্ট হাউসের ঠিক ওপরেই খিরসুর একমাত্র হসপিটাল, গিয়ে দেখি চারদিক শুনশান, কেউ কোথাও নেই, বেশ কয়েকটা বড় বিল্ডিং আছে তবে ডাক্তার-রোগী কারোর দেখা পেলামনা ৷ অফিসে ঢুকে দেখি একটিমাত্র লোক মাথা নীচু করে কাজ করে চলেছে ৷  তাকে আর বিরক্ত করলাম না, আর আমাদেরও তাড়া আছে, তাই ফিরে এলাম ৷ খিরসুর বাজার মানে এক চিলতে ম্যালের পাশে চার থেকে ছটা দোকান, পাশেই বনদপ্তরের একটা জঙ্গল ট্রেল আছে কিন্তু খুলবে দশটার পর ৷ এ যাত্রায় আমাদের আর দেখা হলনা; সাড়ে নটা নাগাদ খিরসুকে শেষ বিদায় জানিয়ে যাত্রা শুরু করলাম ৷

খিরসু থেকে উনিশ কিলোমিটার দূরে আরেক মনকাড়া পর্যটন ঠিকানা হল পউরি, গাড়োয়াল হিমালয়ের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলাশহর ৷ খিরসু থেকে পউরি পর্যন্ত রাস্তাটা কখনো ভুলবোনা, ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ, রাস্তার দুপাশে পাইন, ফার, ওক, খরসু সারা রাস্তা জুড়ে যেন চাঁদোয়া খাটিয়ে রেখেছে ৷ একটা অদ্ভুত সোঁদা গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে গোটা পাহাড় জুড়ে, পাহাড়ে বৃষ্টি হলেই এই মথিত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে সারা এলাকা জুড়ে ৷ আর তার সাথে গাড়ির আওয়াজে শত শত পাখির নিরুপদ্রব সংসারে সাড়া পড়ে গেল, তাদের আতঙ্কিত ওড়াউড়ি দেখতে দেখতে কখন যেন পউরি পৌঁছে গেলাম ৷ তবে আমরা পউরির মূল শহরে না ঢুকে তার আগেই বাইপাস করে বেরিয়ে গেলাম ৷ ইচ্ছে ছিল পউরির জি. এম. ভি. এন. ট্যুরিস্ট লজটা দেখবো --যাই হোক এগিয়ে চললাম, যতই এগোই প্রকৃতি ততই যেন নতুন নতুন রূপে আমাদের সামনে চমকের ওপর চমক দিতে লাগলো, আমরা শুধু নীরব বসে থেকে সেই সৌন্দর্য্য উপভোগ করে যেতে লাগলাম ৷ অনেক সময় ক্যামেরা তোলার কথাও মনে পড়লোনা ৷ কেমন এক আবেশে আবিষ্ট রেখে পথটা কখন যেন শেষ হয়ে গেল ৷ অবশেষে যখন ‘গাড়োয়াল রাইফেলস’ চালিত স্বচ্ছ, সুন্দর, কোলাহলমুক্ত ল্যান্সডাউনে পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে পৌনে একটা বাজে ৷ সংক্ষেপে বলতে গেলে -প্রথম দর্শনেই গিরিশহরটাকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে ফেললাম ৷

 

ডঃ গৌতম সরকার
অর্থনীতির শিক্ষক, যোগমায়া দেবী কলেজ, কলকাতা, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top