সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ' -- মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি দর্শন : ডা: মালিহা পারভীন


প্রকাশিত:
৩১ অক্টোবর ২০২০ ১৮:৪৪

আপডেট:
২৪ এপ্রিল ২০২৪ ০৩:৩৪

ছবিঃ মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি

 

ময়মনসিংহের মেয়ে আমি। অথচ  মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ি দেখা হলো না এ  যাবত! তাই এক দুপুরে সাত জনের এক ভ্রমন দল মুক্তাগাছার উদ্দ্যেশে শহরের টাউন হল মোড়ে একত্রিত হলাম। মেঘলা দিন, টিপ টিপ বৃষ্টি। ভাড়ার জন্য গাড়ি খুঁজছিলাম। চোখে পরলো ঝকঝকে বি আর টি সি  দোতালা বাসের পা দানিতে দাঁড়িয়ে শীর্ণকায়  হেলপার ডাকছে -' - মুক্তাগাছা ২০ টাকা,  ২০ টাকা'  --।

কিছু না ভেবেই হুড়মুড় ক'রে সবাই উঠে পড়ি। সিঁড়ি বেয়ে একদম দোতালায়। সামনের সীট সব আমাদের দখলে। গাড়ি চলতে শুরু করে হেলে দুলে । আমরাও দুলতে থাকি জমিদার বাড়ি দেখতে যাবার আনন্দে আর দোতালা বাস ভ্রমনের উত্তেজনায়।

মসৃন রাস্তা। দোতালায় বসে  রিক্সা, গাড়ি কেমন দূরে দূরে লাগে। আকাশ, গাছপালা কাছে চলে এসেছে যেন। ময়মনসিংহ থেকে মাত্র ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মুক্তাগাছায় আমরা ২০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম।

প্রায় ৬৫ একর আয়তনের মুক্তাগাছা শহরটির গোড়াপত্তন করেছিলেন ১১৩২ সালে জমিদার আচার্য চৌধুরি। জেনেছি ১৭২৭ খৃষ্টাব্দে মুক্তারাম নামে একজন স্থানীয় বাসিন্দা পিতলের তৈরি হাতল ওয়ালা একটি লন্ঠন নিয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে আসা জমিদারদের স্বাগত জানিয়েছিল। তার এই আতিথেয়তায় খুশি হয়ে জমিদাররা এ অঞ্চলের প্রাচীন নাম  ' বিনোদ বাড়ি' পরিবর্তন করে ' মুক্তাগাছা' রাখেন।

মুক্তাগাছা বাস স্ট্যান্ড থেকে জমিদার বাড়ি কাছেই। সামন্য পথ আমরা দলবলে হেঁটে  ঝিরঝির বৃস্টি মাথায় রওয়ানা দেই। মহা সড়ক ছাড়া প্রায় সব পথ  ভাংগা চোরা। চারপাশটা দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। জমিদার বাড়ি যেতে  দুই পাশে শ্যাওলা জমা পুকুর। ধোপারা কাপড় ধুচ্ছে। সেই ময়লা পানি উপচে রাস্তায় গড়াগড়ি যাচ্ছে। গরুর গোবর,  ময়লার স্তুপ পেরিয়ে অবশেসে আমরা জমিদার বাড়ির বিশালাকার সিংহ দরজার দেখা পেলাম।  যেন এক হিরন্ময় স্তব্ধ ঐতিহ্য মাখা অতীত আমাদেরকে স্বাগত জানালো দীর্ঘশ্বাসে।

ছবিঃ মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির প্রবেশ দ্বার

প্রায় ১০০ একর জমির উপর অনন্য স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত এই জমিদার বাড়িকে মুক্তাগাছা রাজবাড়িও বলা হয়ে থাকে। জমিদার শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরি মুর্শিদ কুলি খাঁর কাছে থেকে পুরস্কার হিসাবে এই বিনোদবাড়ির জমিদারিটি পান।

১৭২৭ সালে জমিদার শ্রীকৃষ্ণ আচার্য বন্দবোস্ত পাবার পর উনিশ থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি তাঁর উত্তরাধিকারীগণ নির্মাণ করেন এই স্থাপনা। এই জমিদার বাড়িতে মোট ১৬ টি অংশে ১৬ জন জমিদার বাস করতেন।

ছবিঃ জমিদার বাড়িতে লেখিকা
জমিদার বাড়ির প্রবেশ দ্বারটিতে আছে অসাধারন সব কারুকাজ। লোহার পাত আর কাঠের পাটাতন দিয়ে করা চমৎকার ছাদ। ভিতরে আছে জমিদারের মায়ের ঘর, তোষাখানা , রাজ-রাজেশরী মন্দির, রানীর অন্দরমহল, লোহার নির্মিত দ্বিতল হাওয়াখানা, অতিথি ঘর, সিন্দুক ঘর, নাটমন্দির সহ বহু ভবন। 

নাটমন্দিরের পশ্চিমাংশে আছে ঘূর্ণায়মান মঞ্চ যেখানে সে সময় গান বাজনা হতো। এটি এ অঞ্চলের দ্বিতীয় ঘূর্ণীয়মান মঞ্চ। প্রথমটি ছিল কলকাতায়। জমিদার বাড়িতে আছে রানী বিদ্যাময়ীর মহল যিনি বর্তমানের  ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহি বিদ্যাময়ী  স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা।

ছবিঃ জমিদার বাড়িতে লেখিকা

বিলুপ্ত এই জমিদারদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধায় মন ভরে উঠলো যখন জানলাম ১০,০০০ বইয়ের একটি দুর্লভ লাইব্রেরি ছিল এ বাড়িতে। বর্তমানে এর কিছু অংশ বাংলা একাডেমীতে রক্ষিত আছে।

শ্যাওলা পরা ভাঙা, আধ ভাঙা সূক্ষ কারুকাজ করা শ্বেত পাথরের, কাঠের, ইটের অসংখ্য দালান স্থাপত্য শৈলীর অনন্য নিদর্শনের স্বাক্ষী আজ আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে। আমাদের মুগ্ধতা ক্রমেই বাড়ছিল।

কুঠুরির ভিতর কুঠুরি। অন্দরমহলের ভিতর অন্দরমহল। দরজায় ,ছাদে দারুন সব অসাধারন শিল্পকর্ম  ! শ্বেত পাথরের সিংহ দুয়ার। উঠানে বিশাল বিশাল পুরানো গাছ, পাশেই সাত ঘাট ওয়ালা মস্ত পুকুর, বিশাল বিশাল মন্দির।

সেদিন ছাই রঙা মেঘ ছিল আকাশ জুড়ে । জমিদার বাড়ির ভেজা সবুজ অগোছালো ঘাসে পা রেখে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম সব। এ মহল, সে মহল। অদ্ভুত প্রাগৈতিহাসিক গন্ধ চারিদিকে । শূন্য ভাঙা প্রাসাদ  জুড়ে গা ছমছম ভাব ।

স্নান ঘরের পাশে ঘাসে ঢাকা একটা গর্ত মতন জায়গা দেখিয়ে গাইড বললেন এটা সুড়ং পথের মুখ। এই সুড়ঙ্গ পথের সাথে যোগাযোগ ছিল ময়মনসিংহের প্রানকেন্দ্রে অবস্থিত রাজা শশীকান্তের জমিদার বাড়ির। এই পথে গোপনে জমিদাররা  যাতায়াত করতেন।  জীবন সব যুগেই বিচিত্রতায় ভরা, রহস্যময়। 

বহতা এ জীবন। বর্তমান, ভবিষ্যত এক সময় অতীত হয়ে যায়। ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম এই ইট পলেস্তারার ভাঁজে লুকিয়ে আছে কত জমকালো জীবনের গল্প। কত না দীর্ঘশ্বাস, হাসি, কান্না , নিষ্ঠুরতা , মানবিকতা/ অমানবিকতার দিন রাত্রি !

সব ছাপিয়ে জীর্ণকায় বাড়িটির অবশিষ্ট অসাধারন শৈল্পিক সৌন্দর্য পর্যটকদের চোখ, প্রান মুগ্ধ করবেই ! 

 

ডা: মালিহা পারভীন
কবি ও কথা সাহিত্যিক



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top