সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

পাখীর দেশে কবিতার দেশে : ডঃ গৌতম সরকার


প্রকাশিত:
৩০ নভেম্বর ২০২০ ২০:৫২

আপডেট:
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৭:১৬

 

ল্যান্সডাউন শহরটি মূলতঃ গাড়োয়াল রাইফেলসে সেনা ভর্তি প্রক্রিয়া চালানোর জন্য ১৮৮৭ সালে স্থাপিত হয়েছিল ৷ ভারতের তত্কালীন ভাইসরয়ের নামানুসারে জায়গাটির নামকরণ হয় , এখন জায়গাটিতে গাড়োয়াল রাইফেলসের কম্যান্ড অফিস ৷ গাড়োয়াল রাইফেলস অসম্ভব দৃঢ়তার সঙ্গে জায়গাটির স্বকীয়তা বজায় রেখেছে ৷ কথিত আছে, এই শহরটি গড়ে তুলতে একটা গাছেরও মূলোচ্ছেদ করা হয়নি --ফলতঃ নীল পাইন, দেওদার, ওক আর তাদের শাখায় শাখায়, পাতায় পাতায় অজস্র চেনা -অচেনা পাখ -পাখালি নিয়ে এই শহরে আপনি রাস্তার যেকোনো বাঁকে বসে অল্প বয়সের উচ্ছাস -অনুভূতি নিয়ে কবিতা লিখতে পারবেন -সে আপনি কবি হন বা না হন তাতে কিছু যায় আসে না ৷

ল্যান্সডাউনে গাড়োয়াল মন্ডল বিকাশ নিগমের দুটি গেস্ট হাউস আছে ; একটি বাজার এলাকা থেকে পাহাড়ের কয়েকটা মনকাড়া চড়াই বাঁক পেরিয়ে নির্জন এক পাহাড়ি প্রান্তে, বাজার বলতে দোকানপাট, হোটেল, বাস স্ট্যান্ড, ছোট গাড়ি স্ট্যান্ড --কিন্তু সবটাই ওই ধরুন চার -পাঁচ একরের মধ্যে, বাদবাকি সবটাই রাইফেলসের, সেখানে কোনো ব্যক্তিমালিকানার সম্পত্তি নেই ৷ গাড়োয়াল মণ্ডলের আরেকটা প্রপার্টি আছে শহরের একদম মাথায় -সেই জায়গাটিকে বলা হয় ' টিপ - ইন - টপ '৷ এই জায়গাটি থেকে সূর্যাস্ত, আর তুষারধবল পাহাড়চূড়া দেখতে অসম্ভব ভালো লাগে ; আর আমাদের কটেজটা ছিল এই সানসেট বা স্নোভিউ পয়েন্টের ঠিক ওপরে, ফলে আমরা কটেজে বসেই এই দৃশ্যগুলো দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম, যদিও আবহাওয়ার কারণে তুষারশোভিত কিরীটশ্রেণী দেখার সৌভাগ্য হয়নি এযাত্রায় হয়ে ওঠেনি৷

দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে আধ ঘন্টা রেষ্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শহরটা দেখতে, এখানে সূর্যাস্ত হয় প্রায় সাতটায় ; তাই ‘টিপ ইন টপ’ থেকে নীচের দিকে এগিয়ে চললাম, আউলি থেকেই আমাদের ভ্রমণপাঁচালীতে যেটার সানন্দ সংযোজন হয়েছে সেটা হল বিভিন্ন প্রজাতির পাখির উপস্থিতি, ল্যান্সডাউনের জঙ্গলাকীর্ণ শহরে তাদের উপস্থিতি যেন আরোও বেশি সোচ্চার ৷ কিছুটা নেমে পেলাম সেন্ট মেরিস চার্চ ; এটা বহুবছর অব্যবহৃত ছিল, পরে গাড়োয়াল রাইফেলস এর সংস্কার করে ৷ এর কাছাকাছি একটা শিশুপার্ক দেখলাম, যেখানে দোলনা, স্লিপ, সী -স, বসার বেঞ্চ, ইত্যাদি সবই আছে  কিন্তু সবটাই একদম মুক্ত প্রকৃতির বুকে, জঙ্গলের বুকে, কোথাও কোনো কুড়ুল, কাস্তে, কোদালের কোপ পড়েনি ৷ আরো এক কিলোমিটার হালকা উৎরাইয়ে গিয়ে পেলাম আরোও প্রাচীন এক রোমান ক্যাথলিক চার্চ, সেন্ট জনস চার্চ -- অপরূপ সুন্দর প্রেক্ষাপটে এর অবস্থান, রাস্তা এবং প্রকৃতি যেন বৃষ্টি ধোওয়া এক স্বপ্ন ৷

আমরা সেই নিশি ডাকে আরো অনেকটা নেমে গেলাম, সারাপথে আমাদের পাশ দিয়ে গাড়ির পর গাড়ি উঠে যাচ্ছে ওপরের সানসেট পয়েন্টে, আর আমরা চলেছি উল্টো পথে ৷ যখন আমরা প্রতিযাত্রা শুরু করলাম তখন আর সূর্যাস্ত দেখার সময় নেই, মাঝে মাঝে পথের বাঁক থেকে সূর্যের গতি প্রকৃতি দেখতে দেখতে চড়াইয়ে উঠতে লাগলাম ৷ ওপরের একটা চক থেকে রাস্তা নেমে গেছে নীচের বাজার এলাকা গান্ধীচকে, আর আরেকটা ওপরের জি.এম.ভি.এন ট্যুরিস্ট লজে ৷ কিন্তু আজ বাজার থাক, ইতিমধ্যে সূর্য্য অস্ত গেছে, ঘড়ি দেখাচ্ছে ঘন্টার কাঁটা সাড়ে সাতটা ছুঁয়েছে; তাই আজকের মতো সবকিছু স্থগিত রেখে হোটেলে ফেরা মনস্থ করলাম ৷

ল্যান্সডাউনের সব থেকে বড় মজা হল, এখানে প্রচুর প্রচুর অ্যাপ্রোচ রোড ৷ ইচ্ছেমতো পছন্দের রাস্তা বেছে নিয়ে ঢুকে পড়া যায় প্রকৃতির একদম অন্দরমহলে ; রাস্তা ধরে ইচ্ছেচলা চলতে চলতে অথবা পথের কোনো বাঁকে সুন্দর সাজানো সবুজ বেঞ্চে বসে প্রকৃতিপাঠ নিতে নিতে সময় কখন পাখা মেলে উড়ে পালাবে টেরই পাবেননা ৷ তবে সব পথ কিন্তু আমআদমির জন্য নয় ......মাঝেমাঝেই নাক বরাবর কোনো পথে ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে দাঁড়াতে হয় --' ইয়ে রাস্তা আম আদমিকে লিয়ে নেহি হ্যায় ' ৷ তবে তাতে আপনার হাঁটার দমে টান পড়বে না ; পাখির ডাক, বাতাসের ফিসফাস, আন হেমন্তেও শুকনো পাতা ঝরার টুপ টাপ শব্দ গোটা ল্যান্সডাউন ঘিরে ৷ আপনি যদি একটু হলেও প্রকৃতিপ্রেমিক হন, পাহাড়ি পথের কুহকি বাঁক যদি আপনাকে ক্রমাগত উস্কাতে থাকে --যাই দেখে আসি, বাঁকের ওধারে কি আছে !!!, পাহাড়, পাহাড়, পাহাড় দেখতে দেখতে এতটুকু একঘেয়েমি না আসে, ক্লান্তিবোধ না করেন, দু -তিন মাস পাহাড়ের সাথে মোলাকাত না হলে পেট গুড় গুড় করে, খিদে কমে যায়, রাতে ঠিক ঘুম হয়না, তাহলে আমার অনুরোধ এখানে কমপক্ষে আপনি তিনদিন থাকুন ৷ কথা দিচ্ছি এতটুকু খারাপ লাগবেনা, পরন্তু প্রকৃতি নিজেকে উজাড় করে দেবে, আপনি ধন্য হবেন, কোনোমতেই ক্ষুণ্ন হবেননা ৷

পরেরদিন সকালে ছটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম, আমাদের কটেজের চত্বর থেকে বেরিয়েই ডানদিকে একটা রাস্তা ঘুরে গেছে, শোবার ঘর থেকে রাস্তাটা দেখেছি, কিছুটা চোখে পড়ে,  ঘন কালো রাস্তার অনেকটাই সবুজ জঙ্গলের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে ৷ মনস্থ করলাম, আজ এই রাস্তা ধরেই যাবো, কিছুটা এগোনোর পর জঙ্গল আরোও ঘন হল, চতুর্দিকে আবছা অন্ধকার, আকাশ মেঘলা -তাই প্রভাতী সূর্যকিরণের বিচ্ছুরণে জোয়ারের অভাব ৷ তখন গোটা ল্যান্সডাউন শহর জেগে উঠেছে, আর গাড়োয়াল রাইফেলসের অফিসার থেকে ট্রেনি সবাই শারীরিক কসরত শুরু করে দিয়েছে ; রাস্তা ধরে রঙিন ইউনিফর্ম পড়া জওয়ান ভাইয়েরা জগিং করতে করতে এগিয়ে চলেছে, দূরে অফিসার ক্লাবে সবাই ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজে মগ্ন, বেশ কয়েকটা বাঁক পেরিয়ে উপস্থিত হলাম একটা ছোটো চকে যেখানে একটা তিরচিহ্ন দিয়ে ওপরের দিকে নির্দিষ্ট করা আছে -দূর্গামন্দির ৷ এই সফরে মন্দির যে কত দেখলাম ইয়ত্তা নেই, তবু দেখলাম আমার মতো নাস্তিক লোকেরও এখানে এসে মন্দির দর্শনে কোনো ক্লান্তি নেই, এই জন্যই এই জায়গাটার নাম 'দেবভুমি !!!’ যাইহোক ওপরের কাঁচা রাস্তাটা ধরে এগিয়ে গেলাম , কিছুদূর যাবার পর দেখি স্বর্গের সিঁড়ি গড়গড় করে ওপরে উঠে গেছে , ঘাড় তুলে মন্দিরটিও দেখতে পেলাম ৷ সাধারণ একটা মন্দির ; কোনো বিশিষ্ট স্থাপত্যের ছাপ নেই তাই আর ওপরে ওঠার কষ্ট নিলাম না ৷ তাছাড়া টের পাচ্ছি ট্যুরের শেষে এনার্জিও রিজার্ভে চলে গেছে ৷ অতএব ফিরে এলাম, আবার পুরনো পথ ধরে এগিয়ে চললাম ৷ কিছুদূর গিয়ে বেশ কয়েকটা বাড়িঘর চোখে পড়ল , দূর থেকে ভাবলাম বোধহয় বাজারে পৌঁছে গেলাম -কিন্তু না এটা ডিফেন্সেরই কিছু অফিস আর সাথে আর্মি স্কুল ; এই সকালে যদিও স্কুল বন্ধ, আরো কিছুটা পথ হালকা চড়াই ধরে নেমে একটা বাঁকে গিয়ে পৌঁছলাম যেখান থেকে পাখির চোখে লোয়ার ল্যান্সডাউন দেখা যাচ্ছে ৷ আরোও একটা বাঁক পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম নীল পাহাড় আর সবুজ জঙ্গলে অবস্থিত ল্যান্সডাউনের নামকরা কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে ; যেমন তার পরিবেশ তেমনি নয়নমনোহর বিল্ডিং ; সামনে প্রশস্ত মাঠ আর সেই মাঠে শরীরচর্চায় মেতে উঠেছে আপামর ছাত্র -শিক্ষক ৷ অনেকটা হাঁটা হল, মাঠের পাশে বেঞ্চিতে বসে শরীরচর্চা দেখতে দেখতে বেশ খানিকটা সময় বিশ্রাম নিলাম ৷ প্রতিগমনে রাস্তাটা দীর্ঘ মনে হল, দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি আস্তে আস্তে শরীরকে গ্রাস করছে টের পেলাম ৷

ল্যান্সডাউনে সাইটসিয়িংয়ের কিছু নেই, নীচে থাকলে গাড়ি করে ‘টিপ ইন টপে’ আসা যেত -কিন্তু আমরা তো এখানেই আছি ; আর দেখার মধ্যে ওই দুটো চার্চ - সেন্ট মেরিস আর সেন্ট জনস ৷ সব দেখা হয়ে গেছে , আর বাকি বলতে ভুল্লাতাল ; ব্রেকফাস্ট খেয়ে যোশিজির গাড়িতে রওয়ানা হলাম তিন কিলোমিটার দূরের এখানকার একমাত্র লেক দর্শনে ৷ গিয়ে দেখলাম -লেক বলাটা একটু বাড়াবাড়ি, একটা বড় পুকুর বলা যেতে পারে, ওইটুকু পরিসরেই বোটিংয়ের ব্যাবস্থা আছে ৷ ওই লেক দেখতেই ট্যুরিস্টের কিন্তু কোনো খামতি নেই, আর মনে হল আমরা ছাড়া বাকি সবাই বোটিংয়ের আনন্দে বিহ্বল ৷ ওখান থেকে ফিরলাম বাজারে ; কোনো জায়গায় গিয়ে তার বাজারটা আমাদের অবশ্যদর্শনের মধ্যে পড়ে, কারন বাজারটা হল যেকোনো জায়গার প্রাণ, তাই চটপট একটা জায়গা সম্বন্ধে ফার্স্টহ্যান্ড ধারণা পাওয়ার জন্য বাজার হল সবথেকে বিশ্বাসযোগ্য জায়গা ৷ বাজারে এক কাপ চা খেয়ে চললাম এখানকার আরেক জি.এম.ভি.এনের ট্যুরিস্ট লজ দেখতে, প্রকৃতির কোলে ঠাঁই পাওয়া অসম্ভব সুন্দর এক পর্যটন ঠিকানা ৷ রাস্তাটা এত সুন্দর, আপনার দ্রুত হাঁটতে ইচ্ছা করবেনা, মনে হবে .....ইশ ! এতো সুন্দর রাস্তাটা এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল ৷ বেশ অনেকটা সময় কাটিয়ে যখন হোটেলে পৌঁছলাম তখন পেট বিদ্রোহ শুরু করে দিয়েছে, ঘড়ি বলছে দেড়টা বাজে ৷

এই ট্যুরটি আমার ছোট্ট বেড়ানোর জীবনে সবচেয়ে প্রলম্বিত ট্যুর ৷ ট্রেন জার্নি আর ফেরার দিনটা ধরলে ষোল দিনের আলেখ্য ৷ মনটা কি তাই বেশি খারাপ লাগছে !!! যদিও জানি দুজনের জন্যই কলকাতায় নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে অনেক অসম্পূর্ণ কাজ অপেক্ষা করে আছে ; তবু এই পরিবেশে দাঁড়িয়ে কলকাতার কর্মক্লান্ত পরিস্থিতির কথা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে ৷ মনখারাপটা গুণিতক হারে বেড়ে যাচ্ছে আকাশের অসহযোগিতায় ; এখানে আসার পর গত দুদিনে কোনো তুষারশোভিত পাহাড় চূড়া দেখার সৌভাগ্য হয়নি ৷ আজ আবার সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার, সকালে একরকম ছিল, দুপুরের পর থেকে কোথা থেকে পালে পালে কালো মেঘ এসে সময়ের বহু আগেই পাহাড়ের বুকে সন্ধ্যা ডেকে এনেছে ৷ দুপুরের খাবার পর বেরোলাম সবচেয়ে কাছের স্পট ‘টিপ- ইন- টপে’-র উদ্দ্যেশ্যে ; আমাদের আস্তানার ঠিক এক ধাপ নীচে ৷ কিন্তু ওই যা হয় ----“ দেখি নাই শুধু চক্ষু জুড়িয়া

ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া ....”

তবে আমরা শেষ ঠিকানা হলেও আইটিনারিতে রেখেছি ৷ কিন্তু বিধি বাম ! ওই দুশো মিটার রাস্তার অর্ধেক যেতে না যেতেই শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি, কি ভাগ্যি একটা কাঁচের পর্যবেক্ষণ ঘর পেলাম, দৌড়ে গিয়ে মাথা তথা সর্বাঙ্গ বাঁচালাম ৷ সমস্যা হল প্রতি মুহূর্তে ওই ‘চার বাই চার’  আস্তানায় নতুন নতুন ট্যুরিস্টদের আশ্রয় দিয়ে চলেছে ; বৃষ্টি নিজের খুশিমতো হয়ে চলেছে, কমার কোনো লক্ষন নেই ৷ কিছুক্ষণ পর বুঝলাম এই বদ্ধ জায়গায় নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে, অক্সিজেনের অভাব ঘটছে ৷ অগত্যা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কটেজে ফিরে এলাম ৷ আজ আবারও চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ইন্ডিয়া -সাউথ আফ্রিকার খেলা ; আস্তানায় ফিরে ক্রিকেটে মনোনিবেশ করলাম ৷ বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ আকাশ বেশ কিছুটা পরিষ্কার হল, আমরা শেষবারের মতো ল্যান্সডাউন দর্শনে বেরোলাম ৷

প্রথমে গেলাম সান সেট (টিপ ইন টপ ) পয়েন্টে, সূর্যর কোনো ঠিকানা নেই ; কিন্তু তাতে ট্যুরিস্টদের উত্সাহে কোনো খামতি ঘটছেনা ৷  ওই সংকীর্ণ পাহাড় কিনারে শত শত মানুষ সেল্ফি, ডুওফি, গ্রূফি, ইত্যাদি ছবি অতি দক্ষতা এবং প্রতিযোগিতার সাথে নিয়ে যেতে লাগলো ৷ আমরা প্রায় বুড়ো-বুড়ি খুব একটা সুবিধে করতে না পেরে ওই জায়গা থেকে পিঠটান দিলাম ৷ ওখান থেকে বেরিয়ে আমার পুরনো পথ ধরে এগিয়ে গেলাম, দশ মিনিট হাঁটার পর পৌঁছলাম সেন্ট মেরিস চার্চ ; এখান থেকে বাঁ হাতি একটা রাস্তা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেছে ৷ কাল এই পথে যাইনি, তাই আজ ওই পথ ধরেই এগিয়ে গেলাম, কুড়ি মিটারের মতো যাওয়ার পর রাস্তাটা কাঁচা মাটির পথ হয়ে ঘন জঙ্গলে ঢুকে গেছে ৷ সঙ্গিনীকে সঙ্গে নিয়ে ওই পথে ভেঞ্চার করার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা, কিন্তু পিচ রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে আর গাড়োয়াল রাইফেলসের অপরূপ সুন্দর এক ব্যালকনি সাজিয়ে রাখা আছে ৷ সেখানে আমাদের স্বাগত জানাতে হাজির হয়েছে নাম না জানা বেশ কয়েকটা পাখি ৷ ক্যামেরা তুলে ধরতেই তারা আমার লেন্সের সীমানায় বিভিন্ন ভঙ্গিতে ধরা দিতে লাগলো, ছবি তুলে তুলে ক্লান্ত হয়ে অনেকক্ষন সেই প্রকৃতি-বারান্দায় বসে রইলাম ৷ ' সন্ধ্যা নামিছে বনে বনে '.... এর আগে কখনো টের পাইনি সন্ধ্যা নামারও একটা নিজস্ব সরগম আছে ৷ জীবনে প্রথম টের পেলাম পায়ে পায়ে আপন ছন্দে সন্ধ্যা আসছে নিঃশব্দ পদচারণে ; ক্লান্তশরীরটাকে টেনে টেনে আরো কিছুটা পথ এগোলাম, পৌঁছলাম সেন্ট জনস চার্চে ৷ তখন আশপাশের জঙ্গলে ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেছে, হঠাৎ হঠাৎ করে চমকে দিয়ে কোনো বন্য প্রাণী গাছপালা ঝাপটিয়ে দৌড়ে জঙ্গলের আরো গভীরে চলে যাচ্ছে ৷ আমাদেরও ফেরার সময় হয়েছে ৷ আমরাও তো পরিপূর্ণ ; একটা ট্যুরে যা পাওয়ার তার চেয়ে বেশি পেয়ে গেছি ৷ বাড়ি থেকে যেভাবে ট্যুর প্ল্যান করেছিলাম, একবারও ভাবিনি দুজনে সবকটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছতে পারবো, কিন্তু পেরেছি --সেটা দেবভুমির কৃপায় না আমাদের শারীরিক সক্ষমতায় সে তর্কে যাচ্ছিনা ; কিন্তু একটা কথা আমাদের এর থেকে আর বেশি কিছু চাহিদা ছিলনা ৷ তাই গাড়োয়ালের দেবভূমিকে ছেড়ে যাবার কষ্টর সাথে সাথে পাওনার খাতায় ক্রেডিটের অঙ্কটাও যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক ৷ অন্ধকার রাত্রে এই সমস্ত আপাত দেনাপাওনার হাত ধরে ধরে ক্লান্ত শরীরে কটেজে পৌঁছলাম ৷

 

ডঃ গৌতম সরকার
অর্থনীতির শিক্ষক, যোগমায়া দেবী কলেজ, কলকাতা, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top