সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

নীলাচল, বান্দরবান : শাহানারা পারভীন শিখা


প্রকাশিত:
৩০ ডিসেম্বর ২০২১ ০০:২০

আপডেট:
৩০ ডিসেম্বর ২০২১ ০০:২১

ছবিঃ শাহানারা পারভীন শিখা

 

সেবার যখন নীলগিরি তে বেড়াতে গেলাম তখন থেকেই একটা গোপন ইচ্ছে মনে পুষে রাখা ছিল। 
এই পাহাড়ের চূড়ায় পা ছড়িয়ে চাঁদের আলোয় ভেসে যেতে একটা রাত কাটাবো।
সৌন্দর্যের আঁধার যেন এই নীলগিরি। 
সেবার দিনে যেয়ে দিনেই ফিরে আসছি আমরা।

বেশ অনেক বছর হয়ে গেল। মনের ইচ্ছে মনেই রয়ে গেল। মাঝে মাঝে ওকে মনে করিয়ে দিতাম শুধু। 

সপ্তাহ দুই আগে বান্দরবান ঘুরে এলাম। মনের গোপন 
ইচ্ছেটা  পূর্ণতা পেল নীলাচল যেয়ে। পাহাড়ের চূড়ায় রাত কাটাবো। এটাই আমার কাছে অনেক! নীলগিরিতে এবার যাওয়ার সুযোগ হয়নি সময়ের স্বল্পতার কারনে। 

'নীলাচল '। মেঘের রাজ্যে যার বাস। পাহাড়ের চূড়ায় বসেই দেখা যায় সূর্য উদয় এবং অস্ত যাওয়া। আমাদের ও সেই ইচ্ছেই ছিল। একরাত কাটাবো ওখানে। 

কিন্তু আমাদের বিধি বাম৷ বান্দরবান ট্যুরের সময়টায় আবহাওয়া খারাপ ছিল। ঘূর্ণিঝড়' জাওয়াদের' কারনে সিগনাল চলছিল তখন। ছিল টিপটিপ বৃষ্টি।
মনটা একটু খারাপই হলো। নির্ধারিত প্রগ্রাম। তাই পেছানোর সুযোগ ছিল না। 

বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমরা রওনা দিই বান্দরবানের পথে।শহরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর প্রায় তিনটা পার। মেঘলা দিনে সূর্য অস্ত যাওয়ার মনোরম দৃশ্যটা দেখার কোনই সম্ভবনা ছিল না। তাই অতো তাড়া ছিল না আমাদের। 

লোকেশান জেনে রওনা দিই আমরা নীলাচলের উদ্দেশ্যে।
পাহাড়ের গা বেয়ে চলেছি। বৃষ্টি ভেজা রাস্তা। প্রকৃতির মোহনীয় রূপ!অদ্ভুত এক অনুভূতি। 
একটু আগে মনে আসা বিষাদ ঝরে গেছে সেই কখন! 
আমরা উঠছি। উপর থেকে উপরে। আমাদের চারপাশ জুড়ে মেঘেদের বসতি। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারি যেন। আমার কাছে কেমন স্বপ্নময় এই পথটা। 

আগেও এসেছি একবার। তখন থাকার কোন ব্যবস্থা ছিল না এদিকটাই।
এবার থাকার জন্য বেশ কিছু রিসোর্ট দেখলাম যেতে যেতে। 
সরিসৃপের মতো আঁকাবাকা মসৃণ রাস্তা।
হালকা বৃষ্টি মাথায় নিয়েই পৌঁছে গেলাম নীলাচল পাহাড়ের চূড়ায়। 
চূড়ার এই জায়গাটা বেশ প্রশস্ত। 
আছে রিসোর্ট, গাড়ি পার্কিং এর সুবিশাল জায়গা। দর্শনার্থীদের জন্য অনেক কিছুই তৈরি হয়েছে দেখলাম। আমাদের নির্ধারিত কটেজের দেখা পেলাম না। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বললো বা দিকের রাস্তায় গেলেই পেয়ে যাবেন। 
গাড়িতে বসেই দেখতে পেলাম পাহাড়ের গায়ে ঝুলতে থাকা তিনটি কটেজ " নীলাচল নীলাম্বরী "।

ছাতা নিয়ে একটা ছেলেকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। ও এই কটেজের একজন। জানালো,মাঝের কটেজটাই আমাদের। 
আমি গাড়িতে বসেই চারপাশে চোখ রাখি। 
সামনে সরু রাস্তা নেমে গেছে আরো গহীনে। দুপাশের সবকিছু সাদায় ঢেকে আছে। হঠাৎ করে মনে হলো কুয়াশায় ঢেকে গেছে সব। যখন জানলাম এগুলো মেঘ। আনন্দের বদলে হঠাৎ করে ভয় এসে বাসা বাঁধে। ভয় জড়ানো চোখে চারপাশে তাকাই। 
পিচ্ছিল রাস্তা দুপাশে গভীর খাদ, পাহাড়ের গায়ে ঝুলে থাকা কটেজ! 
কোন মতে ছাতা মাথায় নিয়ে কটেজে ঢুকি।
 দুটো রুমের একটা কটেজ। দুটোই আমাদের। 
রুমের সাথে বারান্দা। যেখানে বসেই দেখতে পাওয়া যায় পুরো বান্দরবান শহর।
ভয়ে ভয়ে বারান্দার দরজা খুলে দিই। বাতাসের সাথে সাদা মেঘ আমাকে ছুঁয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। 

ঠান্ডাটা ঘিরে ধরে আমায়। তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে রুমে এসে বসি।

ফ্রেস হয়ে কটেজ থেকে বেরিয়ে এই রিসোর্টের রেস্টুরেন্টে যেয়ে বসি। বেশ বড়। খোলা বড় বারান্দায় চেয়ার টেবিল পেতে রাখা। ঘোরানো সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠা যায়। 

 ওখানে দাঁড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করি মেঘের নীচে ঢেকে থাকা শহরটাকে। 

"মেঘ সরে গেলেই শহরটা দেখা যাবে" ওখানকার একজন আমাকে বললো। 

টেবিলে খাবার রেডি করছে ওরা। আর আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকি বাইরে। অবাক হয়ে ভাবি,সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্য কতো শতো আয়োজনে ভরিয়ে  রেখেছেন। 

ওখান থেকেই দেখি নীলরঙা টিনের চাল দিয়ে তৈরি ছোট্টো কটেজগুলো। চারপাশে ঘন সবুজ। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে গেছে রাস্তা। 

আমাদের কটেজের পাশে একটা দোলনা দেখলাম। ওখানে বসে দোল খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও নীচের গভীর খাদের দিকে তাকিয়ে সেই ইচ্ছেটাকে ক্ষ্যন্ত দিলাম। তবে দোলনায় বসে ছবি তুলতে ভুলিনি। 

বৃষ্টি তখন অনেকটাই থেমে গেছে। 

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে একেবারে উপরের স্থানে চলে গেলাম। যেখানে আকর্ষণীয় অনেক কিছু তৈরি করা হয়ছে আনন্দের উপকরণ হিসেবে। 

আকাশের মুখ ভার। তবে আমাদের চোখে মুখে উপচে পড়া আনন্দ। ঝলমলে উজ্জ্বল দিনের যেমন এক রূপ।মেঘলা দিনেরও আছে অন্য এক রূপ।

 সর্বত্র মেঘেদের ওড়াউড়ি। 

বেশ কিছু পর্যটক ভিজে ভিজেই ঘুরছে। ছবি তুলছে। পাহাড়ের গায়ে তৈরি সিড়ি দিয়ে বেশ নীচে দাঁড়িয়ে দেখার জায়গা আছে। সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখি, দূরে পাহাড়ের গায়ে টিমটিমে আলোর সারি। কোনটা চলছে। বুঝলাম ওটা পাহাড়ি রাস্তা। গাড়ি চলছে। 

পাহাড়ি জীবন এখন অনেকটাই সহজ হয়ে এসেছে। বিদ্যুৎ আছে । আছে পিচ ঢালা রাস্তা। 

বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি। আবারও মেয়ে ঢেকে যাচ্ছে সব। 

বৃষ্টি আসছে আবার। সন্ধ্যা নামার আগেই রাত নেমে এলো। খাড়া ভাবে নেমে যাওয়া পিচ্ছিল রাস্তা ধরে খুব সাবধানে নেমে ফিরে আসি রুমে। 

বারান্দায় পেতে রাখা চেয়ার দুটোই বসে দুজন চা খাবো আর বসে বসে নিঝুম প্রকৃতি দেখবো এমনই ভাবনা ছিল। কিন্তু বৃষ্টি মাখা মেঘের জন্য বারান্দায় বসার কোন উপায় ছিল না। ওখানে দাঁড়িয়েই দেখলাম নীচের শহরটাকে মেঘের রাজ্যে ডুবে যেতে। আবার মেঘ সরে জেগে উঠতে। আমি মাঝে মাঝেই দরজা খুলে উঁকি ঝুঁকি মারি। 

এরপর ঝুম বৃষ্টি। মাথার উপর টিনের চালায় পড়ে সেই বৃষ্টির শব্দ অন্য এক আবেশ নিয়ে আসে। সাথে করে আনা ব্লুটুথে রবীন্দ্র সংগীত বাজিয়ে দিই। মানুষের সুখ হীন জীবনে নিপাট প্রকৃতি কখনো সখনো  সুখের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। 

 

সকালে সূর্য উদয় দেখতে পাবো না হয়তো। এমনই ভাবনা ছিল।

 কিন্তু সকালে ঘুম ভেঙে যায় পাখির আওয়াজে। বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। বৃষ্টি নেই। আর মেঘ ও সরে গেছে। আস্তে আস্তে জাগতে থাকা জীবনের চিত্র দেখতে থাকি। 

সূর্য উদয় দেখতে কটেজের বাইরে আসি। 

তীব্র বেগে ছুটে চলা হোন্ডা দেখে অবাক হলাম। বাবা মা ছোট বাচ্চা নিয়ে এই সাতসকালে যাচ্ছে কোথাও হয়তো।  একটু পরেই দেখলাম পাহাড়ি বাবা আর ছোট শিশুকে সে পথেই ফিরে যেতে। কর্মজীবী স্ত্রী কে পৌঁছে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে ওরা। 

সূর্য উঠি উঠি করেও উঠছেনা যেন। 

মানুষের কোলাহল শুনতে পেলাম। বেশ কিছু পর্যটক আসছে।  সূর্য উদয়  দেখতেই এরা আসছে এখানে। 

পূব আকাশে সূর্যের দেখা পেলাম। তবে ঝলমলে রঙিন আলোয় ভেসে নয়। হালকা লালিমা ছড়িয়ে। সেটুকুই মুগ্ধ করার মতো। মন ভরে চারপাশটা দেখি।আবারও মেঘে ঢেকে যেতে থাকে চারপাশ।

 

সকালের নাস্তাটা বান্দরবান শহরের একটা রিসোর্টে করার দাওয়াত ছিল।

 তৈরি হয়ে নিই আমরা। প্রান ভরে চারপাশ টা দেখতে দেখতে ফেরার পথ ধরি।

 

শাহানারা পারভীন শিখা
কবি ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top