সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

পর্ব পাঁচ: বাঙ্গালী আড্ডা


প্রকাশিত:
২৮ মে ২০১৯ ০৬:৩৬

আপডেট:
৫ এপ্রিল ২০২০ ১৯:৫৩

বাঙ্গালী  আড্ডা

আমেরিকায় আমাদের সপ্তম দিন চলছে। দপুরের দিকে (নাকি বিকেল, ঘড়ি এখনো কেনা হয় নি)গেলাম একটা ক্র্যাফট মার্কেটে। অনেক দূরে, অন্য বাসে যেতে হয়। সব জায়গায় এষা আমাদের গাইড। সে দেখলাম সবই চিনে। ক্র্যাফট মার্কেটে ঢুকে এবার রীতার (আমার স্ত্রী) মাথা নষ্ট। আমার মাথা ঠিক আছে তবে আমি একটা মাথা কিনে ফেললাম (ছবি দ্রষ্টব্য)। কেনাকাটা শেষে যখন এষা বিল দিচ্ছিল ক্রেডিট কার্ডে তখন খেয়াল করলাম বিল নিচ্ছিল যে মেয়েটি সে ফিস ফিস করে এষাকে বলছে ‘ কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করতে পারি? ’

কি প্রশ্ন?

- ‘আচ্ছা এটা (আমার কেনা মাথাটা) কেউ কিনে না, হঠাৎ হঠাৎ একজন দুজন কিনে। কিন্তু কেন কেনে জানতে পারি?’ এষা দেখলাম গলা আরেক ধাপ নামিয়ে ফিস ফিস করল, ‘ আমার বাবা একজন কার্টুনিস্ট ... তার মাথাটা একটু খারাপ আছে!’ আমি না শুনার ভান করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলাম।  

যাহোক আমার কেনা মাথা (নয় ডলার, নিজের মাথার দামও বোধহয় এত না!) ও অন্যান্য জিনিষ পত্র নিয়ে আমরা বাস স্টপে এসে দাড়ালাম। সঠিক টাইমে বাস চলে এল কিন্তু আমাদের না নিয়ে বাস চলে গেল। বাসের ড্রাইভার ভিতর থেকে হাত পা নেড়ে কিসব বলছিল আমাদের উদ্দেশ্যে, বোঝা গেল না। এষা দেখলাম বেশ রেগে গেল, ‘এখান থেকেই আমি আগেও উঠেছি। আজ থামবে না কেন? ’ আমি বললাম বাদ দাও, উবার ডাক। শেষ মেষ উবার ডাকা হল। 

মূহুর্তে উবার চলে এল। উবারের চালক দেখলাম গেইম অফ থ্রোনসের বিখ্যাত লেখক জর্জ আর আর মার্টিন, মানে দেখতে ঐরকম আরকি। তবে খুবই ভদ্র। আমাদের কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা, দিনটা কেমন কাটছে ইত্যাদী খোঁজ খবর নিল, আজকের আবহাওয়া এবং আমাদের নিয়ে তাকে বিশেষ চিন্তিত মনে হল। উবারে করে শহরের মাঝে এক বার্গার রেস্টুরেন্টে এসে থামলাম আমরা। বার্গার অর্ডার দেয়া হল। কিন্তু কোক নিতে হবে নিজেরটা নিজে। বিশাল মেশিন কোকের। প্রথমে খালি গ্লাসে ফর ফর করে বরফ পড়ল। তারপর কোকের ছবিতে চাপ দিতেই অনেকগুলো অপশন চলে এল, নরমাল কোক, ডায়েট কোক, জিরো ক্যাল কোক, ফান্টা, স্প্রাইট, পেপসি... আরো হাবিজাবি কি সব। আমি ডায়েট কোকে চাপ দিলাম। তারপর আবার সাত আটটটা অপশন চলে এল। ডায়েট কোকের যে এত ফ্লেভার আছে কে জানতো?  যাহোক নরমাল ফ্লেভারের ডায়েট কোক নিয়ে তাতে ঢাকনা লাগিয়ে স্ট্র ঢুকিয়ে অবশেষে টেবিলে এসে বসতে পারলাম। উফ কোক খাওয়ার যে এত যন্ত্রনা কে জানতো! 

রাতে ফারহানের বাসায় চায়ের দাওয়াত। ফারহান হচ্ছে এখানকার বাঙালী কমিউনিটির প্রেসিডেন্ট। তার বাসায় গিয়ে দেখি আরো অনেক বাঙালী তরুন তরুনী উপস্থিত। তারা সবাই এষার বয়সী বা তার চেয়েও কম বয়সী । তিনজন দম্পত্তিকে পাওয়া গেল, মোটামোটি সবাইই পিএইচডি করছে। সবার সঙ্গেই গল্প হল, চা খাওয়া হল। মনে হচ্ছিল দেশের কোন আড্ডায় বসে আছি। একজন তার বিড়াল নিয়ে এসেছে দেশ থেকে। সেই গল্পও শুনলাম। এই বিখ্যাত বিড়ালের নাম মিউ। তার বাংলাদেশী পাসপোর্ট, আইডি নম্বর সবই আছে (তার শরীরে মাইক্রো চিপ লাগানো আছে, ওটা দিয়ে তাকে ট্র্যাক করা যায়)। তার নখে দেখলাম রংবেরঙের নেইল ক্যাপ লাগানো, যাতে অন্য কাউকে খামচি দিতে না পারে। তবে সে যথেষ্ট ভদ্র বিড়াল। শুধু আামেরিকান বিড়াল দেখলে নাকি ভয়ানক রেগে যায়! 

আড্ডার এক ফাকে যাওয়া হল ডাউন টাউনে। রীতার শখ ডাউন টাউনের শুক্রবারের পার্টি দেখবে বিদেশীদের। সবাই যার যার গাড়ীতে ছুটলো ডাউন টাউনে। আমরা ফারহানের গাড়িতে। ডাউন টাউনে দিনের বেলা একাধিক বার গিয়েছি কিন্তু রাতে গিয়ে দেখি হুলস্থুল অবস্থা। শত শত বিদেশী তরুণ তরুণী মোটামোটি সবাই হালকার উপর ঝাপসা ড্রাঙ্ক, বাতাসে এ্যালকোহলের গন্ধ! জায়গায় জায়গায় পুলিশ গম্ভীর হয়ে দাড়িয়ে। একজন তরুণ এক পুলিশকে দেখলাম জড়িয়ে ধরেছে, যেন তার কত দিনের জানি দোস্ত! পুলিশ দেখলাম যথেষ্ট ধৈর্যশীল, সক্রেটিসের মত গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। মাঝে মধ্যে হাত তুলে বক্তৃতার ভঙ্গিতে কি সব বলছে। 

ফিরে এসে আবার চা পর্ব। তারপর আরেকজনের বাসায় খিচুড়ি পর্ব তারপর শুরু হল ভূত পর্ব ... মানে ভূতের গল্প। যার যা ভূতের স্টক ঝেড়ে দিল, আমিও দু’ য়েকটা ঝাড়লাম। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, আবহাওয়াটাও ভূতুরে বটে। একজনকে পাওয়া গেল, তার নাম সাগর। সে মোটামোটি ভূত বিশেষজ্ঞ। পিএইচডি করছে (ভূত  নিয়ে না অবশ্য) সে ভারতে থাকার সময় সাধু তান্ত্রিক নাগা সন্ন্যাসী এদের সবার সঙ্গে ভূত-প্রেত নিয়ে ফ্ল্যাগ মিটিং করেছে একাধিকবার। কিন্তু তার আফসোস এখনও কোন ভূতের সন্ধান পায় নি। এক পর্যায়ে প্ল্যানচেট করার ব্যর্থ চেষ্টা করা হল, কিন্তু ভূত-প্রেতের সন্ধান মিলল না। এই করতে করতে দেখি রাত তিনটা। বাসায় আসতে আসতে চারটা। এষা জানালো এরা নাকি এরকমই ভীষন আড্ডা বাজ। আড্ডায় বসলে রাত তিনটে চারটা বেজে যায়!     

মজার ব্যাপার হচ্ছে পরদিন আমরা তিনজন কোথায় যাওয়ার জন্য যেন দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ একটা বাস আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। বাসের দরজা খুলে ড্রাইভার চেঁচিয়ে বলল ‘ আমি দুঃখিত ঐদিন তোমাদের নিতে পারি নি কারণ ওটা দুই লেনের রাস্তা.....’ আরো কি কি সব ব্যাখ্যা করল বুঝলাম না। এষা অবাক হয়ে বলল, 

- ‘ তুমি আমাদের মনে রেখেছো?’ 

- ‘হ্যাঁ, তোমরা যে নিরাপদে ফিরেছো দেখে ভাল লাগছে।‘  

আমরাতো আমেরিকান ড্রাইভারের ব্যবহারে মুগ্ধ!

 

লেখকঃ কার্টুনিস্ট/ সম্পাদক
উম্মাদ, স্যাটায়ার কার্টুন পত্রিকা

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top