সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

পর্ব নয়: ভার্জিনিয়া ট্যুর, প্রেসিডেন্টের শহরে!


প্রকাশিত:
২ জুন ২০১৯ ০৪:৫৮

আপডেট:
৫ এপ্রিল ২০২০ ২০:১০

আহসান হাবীব

২৫ তারিখ সকালে ছোট্ট একটা প্লেনে করে আমরা তিনজন রওনা দিলাম ভার্জিনিয়ার উদ্দেশ্যে (প্লেন ভাড়া অবশ্য ছোট্ট ছিল না!)। যে এয়ারপোর্টে নামব সেটার নাম ডালেস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। এক ঘন্টা দশ মিনিটে পৌঁছে গেলাম সেখানে। বিশাল এয়ারপোর্ট আর লোকে লোকারন্য। সব সাদা, শুধু আমরা তিন কাল্লু (অবশ্য এষাকে অতটা কালো বলা যাবে না হয়ত। আমি ভেবেছিলাম আমেরিকায় এসে এখানকার আলো বাতাসে আমার রংটা বোধ হয় একটু খুলবে, কোথায় কি! মূল এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে তিনবার নিচে নামলাম এস্কেলেটর সিড়িতে, তিনবার উপরে উঠলাম তারপর ফের আবার নামলাম। তারপর একটা ট্রেন ধরতে হল। ৫ কি ৭ মিনিটের ট্রেন। কোন সীট নেই, সব দাঁড়িয়ে ।  

অবশেষে ট্রেন থেকে নেমে ফের ঐ এস্কেলেটর সিড়ি দিয়ে উঠা আবার নামা। তারপর বাইরে এসে তানিমকে ফোন দিলাম। তানিম সম্পর্কে আগেই বলেছি। মোস্তফা তানিম, সায়েন্স ফিকশন লেখক (ম্যাকগাইভার মামা বইটা দিয়ে যার সায়েন্স ফিকশন লেখালেখির শুরু) আর আশিফ এন্তাজ রবি। দুজনেই লেখক। এদের  দুজনকেই তাদের প্রথম তারুণ্যের বয়স থেকে চিনতাম। কাজেই তাদের সঙ্গে একটা আন্তরিকতা ছিলই। এখানে  এসে সেই আন্তরিকতা রিফিল করে তাদের গাড়িতে চড়ে রওনা হলাম তানিমের বাড়ির উদ্দেশ্যে। পথে নানান গল্প হল। 

বিশ মিনিটে তানিমের বাড়ি পৌঁছে গেলাম। এখানে দূরত্ব মাপা হয় মিনিটে। পথের হিসাব করলে অনেক মাইল। ওরা বলে মাত্র বিশ মিনিটের পথ। আসলে হয়ত ত্রিশ মাইল। যাহোক তানিমের বাড়ি দেখে আমিতো মুগ্ধ। এধরনের বাড়িকে বলা হয় টাউন-হাউজ। চারটা বাড়ি এক সঙ্গে লাগানো তার একটা তানিম কিনে নিয়েছে। বাড়ির দাম আর লিখলাম না, তিন তলা বিশাল বাড়ির নিচে একটা হল রুম বেড রুম, উপরে ড্রইংরুম কিচেন তিন তলায় তিনটা বেড রুম ওটাই আমাদের জন্য। পুরা ফাইভ স্টার হোটেলের সুযোগ সুবিধা।

কিছুক্ষনের মধ্যে আরো কয়েকজন এসে হাজির হলেন। তার মধ্যে একজন এটিএন নিউজের সাবেক সংবাদ পাঠিকা লাভলী, আমাদের কাজী তাপসের কলিগ (এখন অবশ্য অন্য প্রফেশনে এখানে), রাজশাহীর মেয়ে অমি, বুয়েটের মুনির ভাই, সবাই বড় বড় কাজ করেন আর তানিম-রবির খুবই ঘনিষ্ঠ জন। আমাদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ হতে সময় লাগলো না। আমরা খেয়ে দেয়ে দুটো গাড়িতে সবাই রওনা হলাম। উদ্দেশ্য ডিসিতে যাওয়া। ডিসি মানে এখানে ওয়াশিংটন ডিসি। কিন্তু ঐ দিনটা ছিল উইকেন্ডের প্রথম দিন। আবার সামনে মেমোরিয়াল ডে তাদের, টানা তিন দিন ছুটি পেয়ে সবাই বেড়িয়ে পড়েছে বলে মনে হল। মেমোরিয়াল ডে আমেরিকানদের জন্য বিশেষ আবেগ ঘন একটা দিন (বিভিন্ন যুদ্ধে আমেরিকান সোলজার যারা মারা গেছে তাদের স্মরণে এই দিন)। এবার উইকেন্ডের সাথে মেমোরিয়াল ডে পড়েছে বলে সবাই বিভিন্ন স্পটে বেড়িয়ে গেছে, কারণ এখানেই সব বিখ্যাত মিউজিয়ামগুলো (আর কোন মিউজিয়ামেই নাকি ticket লাগে না, ফ্রি!). আর আমাদের মত ফাউ ট্যুরিস্টরাতো আছেই। দর্শনীয় হচ্ছে আমেরিকান ফ্ল্যাগ লাগানো বিশাল বিশাল মোটরসাইকেল নিয়ে বের হওয়া আমেরিকানরা! বেশিরভাগই বয়স্ক, প্রত্যেকেরই দীর্ঘ দাড়ি, অনেকটা হিপি  টাইপের। তানিম বলল এদের বেশিরভাগই নাকি ট্রাম্প সাপোর্টার। তারা একটু পর পর দলে বলে রাস্তা দিয়ে গর্জন করে ছুটে যাচ্ছে। একজন দেখলাম ঐরকম বিশাল মোটর সাইকেল নিয়ে এক চাকায় ছুটে যাচ্ছে। সে একটা দেখার মত দৃশ্য বটে।    

মজা লাগলো সবাই ছোট ছোট দু চাকার স্কুটি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখে। এখানে এটা আইফোনের অ্যাপ দিয়ে চালু করে চালানো যায়। কেউ হাঁটতে হাঁটতে টায়ার্ড হয়ে গেলে রাস্তায় পড়ে থাকা একটা স্কুটি চালু করে দিব্যি চলতে শুরু করে (এ জিনিষটা ঢাকায় শুরু হতে পারে, যেহেতু ফুটপাত দিয়েও এটা চালানো যায়)। আমাদের মুশকিল হচ্ছে কোথাও গাড়ি পার্কিং করা যাচ্ছে না। সব জায়গায় গাড়ি পার্ক করা। যেখানে সেখানে গাড়ি রাখা যাবে না, জায়গায় জায়গায় গম্ভীর মুখে পুলিশ দাঁড়িয়ে দর দর করে ঘামছে।

বহু কষ্টে এক জায়গায় একটা পার্কিং পাওয়া গেল, তাও একটা গাড়ির জন্য (অন্য গাড়িটা ততক্ষনে আমরা হারিয়ে ফেলেছি) । সেখানে পার্ক করে আমরা বেরুলাম। প্রথমে হোয়াইট হাউজ দেখলাম তারপর সেই ফরেস্ট গাম্প মুভির বিখ্যাত গম্বুজ (ওয়াশিংটন মনুমেন্ট)। সব শেষে লিঙ্কন মেমোরিয়াল। কিন্তু সব  জায়গায় ভয়াবহ ভিড়। ঈদে আমাদের ঢাকা চিড়িয়াখানা, জাদুঘরে যেমন ভীড় হয় অনেকটা ঐরকম। রবি একটা মজার গল্প বলল (সে সবসময়ই মজার মজার গল্প বলে)। এইরকম একটা মেমোরিয়াল ডেতে সে বেড়িয়েছিল (তার অফিস ডিসিতেই)। দেখে হোয়াইট হাউজের সামনে এক আমেরিকান তাদের প্রেসিডেন্টকে গালাগাল করছে প্রকাশ্যে...ভীড় করে গভীর মনোযোগে লোকজন তার গালাগাল শুনছে। এবং গালাগাল করতে  করতে সে যখন ক্লান্ত তখন পুলিশ এসে তাকে এক বোতল পানি দিয়ে একটু বিশ্রাম করে নেওয়ার অনুরোধ করল। এই হচ্ছে আমেরিকান পুলিশ। পুলিশ যদি কোন কারনে গাড়ি থামাতে বলে কোনো সন্দেহের কারণে,  তাহলে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামাতে হবে steering  এ হাত রেখে। যদি কেউ ভুলেও steering এ হাত না রেখে নিচের দিকে হাত বাড়ায় (মনে হতে পারে নিচ থেকে অস্ত্র তুলতে যাচ্ছে) তাহলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি, এবং সে রাইট পুলিশের আছে। 

নানা কারণে প্রেসিডেন্ট লিঙ্কনের আমি ভক্ত। কয়েকটা কারণ ব্যাখ্যা করা যাক। তিনি একজন ল’ইয়ার ছিলেন, তার সমস্ত আইনি জীবনে কখনো ক্রিমিনাল কেস তিনি করেন নি (মানে কখনো কোনো ক্রিমিনালের পক্ষে দাঁড়ান নি)। আরেকটা কারণ হচ্ছে একটা ছোট্ট মেয়ের অনুরোধে তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে দাড়ি রেখেছিলেন। শেষ এবং অন্যতম কারণ হচ্ছে তিনি সেই মহান প্রেসিডেন্ট যিনি দাস প্রথা বিলুপ্ত করে গেছেন ...। এই মহান মানুষটির বিশাল ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে সত্যি অভিভূত হলাম। ভাবলাম তানিম আর রবিকে ধন্যবাদ দেই আমাদেরকে এমন একটা জায়গায় আনার জন্য (ভার্জিনিয়ার ট্যুর ওদের প্ল্যান করা)।  তানিমকে খুঁজে পেলাম না ভীড়ের মধ্যে, তবে রবিকে দেখলাম এক চিপায় দাঁড়িয়ে ভুষ ভুষ করে বাংলাদেশের বিলুপ্ত কয়লার ইঞ্জিনের মত ধূয়া ছাড়ছে, যদিও আমাকে বলেছে আমেরিকায় এসে নাকি সে সিগারেট একদম ছেড়ে দিয়েছে!

ফেরার পথে একটা বাঙালী রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নেওয়া হল। দেখলাম দল বেধে বাঙালী লোকজন সেখানে আড্ডা দিচ্ছে, যথারীতি টেবিল চাপড়ে হাতি ঘোড়া মারছে তারা। যেহেতু এখানে মশা, মাছি নেই! 

রাতে দেখলাম বাদ ইফতার (এখানে ইফতার হয় রাত ৮.৩০ এ) তানিমের বাসায় বিশাল আড্ডার আয়োজন। অনেক বিশিষ্ট লোকজন আসতে শুরু করেছেন,  ইনারা এখানে সবাই স্থায়ীভাবে আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ডাক্তার, আর্কিটেক্ট, ব্যবসায়ী, সংবাদ পাঠিকা কে নেই! বোঝা গেল তানিমের বাসায় প্রায়ই উইকেন্ডে এরকম আড্ডা হয়, খাওয়া দাওয়া হয়। সঞ্চালক থাকে রবি না হলে তানিম (বিশেষ ধরনের বুম মাইক্রোফোন তাদের হাতে, আবার ফেসবুক লাইভও হচ্ছে বলে মনে হল)। এবার ফেঁসেছি আমি। মানে আমি বলব ওরা শুনবে। সবাই উন্মাদ অফিসের পাগলামোর গল্প শুনতে চায়। আর ৪০ বছরে উন্মাদ অফিসের পাগলামোরতো শেষ নেই (যদিও এখন ভদ্র হয়ে গেছি আমরা)। গল্প বলা শুরু করলাম, সবাই মনে হল মজাই পেল। রবি যেহেতু আমাদের সাথেই ছিল কিছু কিছু পুরোনো গল্পের সূত্র সে ধরিয়ে দিচ্ছিল। এখন মুশকিল হচ্ছে সেই গল্পটা আর আমার মনে নেই (বয়সতো আর কম হল না, ৬২ রানিং! বয়সের কারণে এখানে এক জায়গায় ৩ ডলার ছাড়ও পেয়েছি, সে গল্প পরের এপিসোডে বলব)। এখন রবির ইজ্জত বাঁচাতে বানিয়ে বানিয়ে সেই গল্প আমাকে শেষ করতে হয়। তাই মাঝে মাঝেই দেখলাম রবি’র ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে,  তার মানে তার মনে থাকা গল্পের সাথে আমার উন্মাদীয় গল্প মিলছে না! কি জ্বালা!!

সেদিনের মত ভার্জিনিয়ায় আমাদের প্রথম দিন শেষ হল। 

পুনঃ এখানে ইন্টারস্টেট এয়ারপোর্টে ভয়াবহ চেকিং এর কথা আর বললাম না। আমি ভেবেছিলাম আমরা বিদেশী বলে এমন চেকিং, পরে দেখি না আমেরিকানদেরও একই ধরনের চেকিং! আমার চেকিংয়ের এক পর্যায়ে আমার মনে হচ্ছিল আমি বোধ হয় সত্যিই কোন ক্রিমিনাল যা আমি নিজেও জানি না!

 

লেখকঃ কার্টুনিস্ট/ সম্পাদক
উম্মাদ, স্যাটায়ার কার্টুন পত্রিকা


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top