সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

পর্ব দশ: ভার্জিনিয়া ট্যুর, ল্যুরে কেভানর্স


প্রকাশিত:
৫ জুন ২০১৯ ০৩:০৭

আপডেট:
৫ এপ্রিল ২০২০ ২০:১৬

আহসান হাবীব

ভার্জিনিয়ায় দ্বিতীয় দিনে আমরা ঘুম থেকে উঠেই ছুটলাম রবির বাসায়। ওখানেই ব্রেকফাস্ট তারপর ল্যুরে কেভার্ন জার্নি। রবির বাসাটা ঢাকার অ্যাপার্টমেন্টের মত, দশ তলা। তার চার তলায় তাদের গোছানো ফ্ল্যাট। রবির স্ত্রী মিতুকে আগেই চিনতাম যখন তারা সদ্য বিয়ে করেছিল। এখনো সে একদম আগের মতই আছে। তবে খুবই দ্বায়িত্বসম্পন্ন মনে হল। রবির সকল জ্বালা যন্ত্রনা আগের মতই নিরবে সহ্য করে যাচ্ছে বলেই মনে হল। তাদের দুই কন্যাও দেখলাম দিব্যি বড় হয়ে গেছে। ছোটটা গম্ভীর টাইপের, বড়জন মায়ের মতই হাসি খুশি। 

মিতুর করা অসাধারন ঘরোয়া নাস্তা শেষ করে আমরা তিনজন আর তানিম, রবি রওনা হলাম ল্যুরে কেভার্নসের উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ যাত্রা। গাড়ি চালাচ্ছে তানিম আর পাশে বসে রবি, পিছনে আমরা তিনজন। অসাধারন রাস্তা, কখনও সাজেকের রাস্তার মত হু হু নিচে নেমে যাচ্ছে আবার হু হু করে উপরে উঠে আসছে। পথে অবশ্য তানিম আমাদের কয়েকটা ওভার লুক দেখালো, হাজার হাজার ফিট উপরে প্যাঁচানো রাস্তা সেখানে দাড়িয়ে উপর থেকে প্রকৃতি দেখা। অসাধারন সব দৃশ্য! আমরা কয়েক জায়গায় থেমে এরকম দৃশ্য দেখলাম। এই রাস্তা গুলি যথেষ্ট ঝুকি পূর্ণ। একবার যদি টার্ন ভুল করে তাহলে হাজার হাজার ফিট নিচে গুলির মত ছিটকে পড়তে হবে।

এই প্রসঙ্গে একটা জোক না বলে পারছি না। এইরকম এক জায়গায় একটা সাইনবোর্ড, তাতে লিখা “সাবধানে গাড়ী টার্ন নিন। ছিটকে পড়লে নিচে তিন হাজার ফিট খাদ। তবে পড়েই যদি যান ডানে তাকাতে ভুলবেন না, ওখানে অপূর্ব একটা জলপ্রপাত আছে কিন্তু!” 

আমেরিকান টুরিস্টরাও ভীড় করে দেখছে অসাধারন এই সব দৃশ্য। এক ইন্ডিয়ানকে দেখলাম নিয়ম না মেনে অনেকখানি নিচে নেমে পোজ দিয়েছে, আর এক পা পেছালে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারপরও তার স্ত্রী বলছে ‘আরেকটু পিছাও, আরেকটু পিছাও!!’ আমরা দ্রুত একটি মর্মান্তিক দৃশ্য না দেখার জন্য ওখান থেকে পালালাম। পথে অবশ্য অসাধারন একটা বনে থেমেছিলাম যেখানে বিশাল বিশাল সব গাছের অরণ্য। বলে রাখা ভালো এইসব জঙ্গলেই ব্ল্যাক বিয়ার থাকে। মাঝে মধ্যেই তারা বের হয়ে এসে ট্রাফিক জ্যাম লাগিয়ে দেয়। 

দু ঘন্টার মধ্যে আমরা পৌছে গেলাম ল্যুরে কেভার্নসে। যথারীতি এখানেও প্রচুর ভীড়। পার্ক করার জায়গা নেই। তারপরও ভাগ্য সুপ্রসন্নই বলতে হবে খুব কাছেই একটা পার্কিং পাওয়া গেল। এখানে ticket কাটতে হয় দুভাবে। অন লাইনে কাটলে দ্রুত ঢুকে যাওয়া যায়, আর লাইন দিয়ে মানে ম্যানুয়ালী লাইনে দাঁড়িয়ে কাটলে দেরী হয়। অনলাইনে সার্ভারে ঢোকা যাচ্ছে না বলে আমরা লাইনে দাঁড়ালাম। তখনই একটা মজার ঘটনা ঘটল। যে মেয়েটি আমাদের ticket দিচ্ছিল সে একটা ছোট্ট ভুল করল। কার্ড থেকে টাকা কেটে নিতে গিয়ে উল্টো টাকা ভরে দিল। এখনতো টাকাটা ফের বের করে নিতে হবে, সেটা যেন কিছুতেই হচ্ছিল না। মেয়েটি কাকে কল দিল, আসল একজন এক্সপার্ট। চেষ্টা-চরিত্র করে সেও পারল না, এবার আসল মনে হয় ম্যানেজার। সেও ফেইল করল। এদিকে পিছনে লাইনে লোকজন বিরক্ত হয়ে উঠছিল,  কিছু বলছিল না। কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই। এর মধ্যে এষা এল। তারা পাশের একটা গিফট শপে ছিল, সে ভেবেছে আমি নিশ্চয়ই কোন সমস্যা করেছি যার কারণে দেরী হচ্ছে।

যাহোক এসময় দেখা গেল আমাদের ticket কাউন্টারে আমি তানিম আর রবি ছাড়া আর কেউ নেই। সবাই পাশের অন্যান্য কাউন্টারে সরে গেছে। শেষ পর্যন্ত তারা রণে ভঙ্গ দিল। অতিরিক্ত ৬৫ ডলার আর কার্ড থেকে কিছুতেই বের করে নিতে পারল না (ticket ২৮ ডলার করে)। তারা সরি বলল। আমার বয়স ষাটের উপরে বলে আমার টিকিটে ৩ ডলার মাফ করে দিল, বয়স্ক আর শিশুদের জন্য ছাড় আছে। (সত্যিই যে বুড়ো হয়ে গেছি এখানে এসে আবার নতুন করে টের পেলাম)। এরকম ক্ষেত্রে নাকি বিদেশী হলে পাসপোর্ট দেখে। আমার পাসপোর্ট দেখতেও চাইল না, সাদা চুলের এমনই মাহাত্ম্য! এখানেই শেষ না, ওরা দেরী করেছে বলে আমাদের লাইন ছাড়াই আরেকটা মূল লাইনে দাঁড়  করিয়ে দিল। আর সরি বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলতে লাগলো!

তানিম একটা ইন্টারেস্টিং কথা বলল। এখানে যারা সংখ্যালঘু মানে বিদেশী (তানিমদের মত) তারা যদি একটু হাউ কাউ করে তাহলে এরা ভয় পেয়ে যায়। যেমন এই টিকিট কাটার সমস্যার সময় যদি তানিম একটু উঁচু গলায় বলত ‘ তোমরা পেয়েছ কি? আমাদের বিদেশী পেয়ে ticket কাটায় ঝামেলা করছো ?’ ব্যাস তাহলেই নাকি হুলুস্থুল শুরু হয়ে যেত।

যাহোক অচিরেই আমরা ল্যুরে কেভার্ন গুহা প্রান্তে এসে দাঁড়ালাম এবং ঢুকেও গেলাম। ঢোকার মুখে একটা সবুজ পর্দা ঝোলানো। সবার ছবি তোলা হচ্ছে। কারণ আমরা পরিদর্শন শেষ করে  যখন বেরুব তখন ওরা একটা ফটো এ্যালবাম ধরিয়ে দিবে। আমাদের সবার পিছনে রেডিমেড থাকবে ল্যুরে কেভার্নস এর অসাধারন সব শিল্প কর্ম। বিষয়টা মেকি। কিন্তু অনেকেই এই এলবাম কিনে নেয় ২৪ ডলার দিয়ে। আর না কিনে নিলেও কোনো সমস্যা নেই। ভিতরে ঢুকে ভাগে ভাগে আমরা ঘুরতে শুরু করলাম। প্রকৃতি যে কত সুন্দর হতে পারে এর ভিতরে না ঢুকলে বোঝা যাবে না। এর সৌন্দর্য এত তীব্র যে কিছুক্ষন পর আমি ছবি তোলা বাদ দিলাম। আসলে সৌন্দর্যের সঙ্গে যখন অতিমাত্রায় বিস্ময় মিশে যায় তখন আর সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না। আমার যেন তাই হল। সৌন্দর্যকে অতিক্রম করল বিস্ময়!! 

ঐ গুহা থেকে বের হয়ে এসে আমি মনে মনে ভাবলাম পৃথিবীতে দু ধরনের মানুষ আছে। একদল ল্যুরে কেভানর্স দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছে আরেক দল এখনো করেনি। আমি প্রথম দলে। ভাবলাম তানিম আর রবিকে আবার একটা ধন্যবাদ দেই ভার্জিনিয়া ট্যুর প্ল্যানে এটা রাখার জন্য। যথারীতি সেই আগের মত... তানিমকে খুঁজে পেলাম না ভীড়ের মধ্যে, তবে রবিকে দেখলাম এক চিপায় দাঁড়িয়ে ভুষ ভুষ করে বাংলাদেশের বিলুপ্ত কয়লার ইঞ্জিনের মত ধূয়া ছাড়ছে, যদিও আমাকে বলেছে আমেরিকায় এসে নাকি সে সিগারেট একদম ছেড়ে দিয়েছে!

এবার মানবিক পার্টটায় আসি। বহু বছর আগে, প্রায় ত্রিশ বছরতো হবেই, আমার মাকে আমার মেঝো ভাই  এই ল্যুরে কেভার্নসে নিয়ে এসেছিল। আমার মায়ের যে ছবিটা ছিল সেটা হচ্ছে তিনি একটা ডিম পোচের উপর হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে (বিষণ্ণ মুখে, বিষণ্ণতার কারণ লিখেছি আগের কোন পর্বে)। ডিম পোচটা পাথরের। কুসুমটা টক টকে লাল যেমনটা আসল ডিম পোচে থাকে। আমিও সেই ডিম পোচের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি (এরা বলে ফ্রাইড এগ স্ট্রাকচার)। কিন্তু পাথরের ডিম পোচটা এখন সাদা। ডিমটা আগে লাল ছিল এখন আস্তে আস্তে সাদা হয়ে গেছে, এই কথাটা এটেনডেন্টরা মাইক্রোফোনে বলছিল। আমার মা পাথরের ডিম পোচে  হাত দিতে পেরেছিলেন। এখন কোথাও কোন হাত দেয়া যায় না। আমার খুব আশ্চর্য বোধ হল, ত্রিশ বছর আগে মা যেখানটায় দাঁড়িয়েছিলেন আমি সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। লাল কুসুমটা সাদা হয়ে আছে, কবির ভাষায় বলতে হয়...

“ জীবনের সব রং মুছে নিয়ে  

সেই কবে তুমি, কোথায় গিয়েছ চলে

আজ এই বিষণ্ণ বেলায় তবু মনে হয়,  যেন জীবন গিয়েছে থেমে

সময়ের ক্লিন্ন অবসাদে...”  ইত্যাদী ইত্যাদী। আমার লেখা লেখির সময় এই কবি যে কোথা থেকে এসে হঠাৎ হঠাৎ হাজির হয় বলা মুশকিল! (ছোট বেলায় বাংলা পরীক্ষায় ভাব-সম্প্রসারণ বা ব্যাখ্যা লিখার সময় মাঝে মাঝেই লিখতাম, তাই কবি বলিয়াছেন... আমার মনে হয় এই বেলায় এসে সেই কবিই আমার উপর ভর করে মাঝে মধ্যে!) 

এই প্রকৃতির অপার বিস্ময়ের বিজ্ঞানটা একটু বলা যাক। গুহার ভিতরে স্ট্যালেকটাইট (উপরের থেকে নামা), স্ট্যালেকমাইট (নিচ থেকে উঠা) মিলে তৈরী হয়েছে এই স্ট্রাকচার। এরা তৈরী হয়েছে পানির ফোটা ফোটা করে পড়ার কারণে, অদ্রবনীয় ক্যালসিয়াম সল্ট থেকে। এই স্তম্ভগুলোর ওয়ান কিউবিক ইঞ্চি তৈরী হতে সময় লেগেছে ১২০ বছর । ল্যুরে কেভানর্স তৈরী হতে সময় লেগেছে প্রায় ৭ মিলিয়ন বছর... ভাবা যায়?

পরে ল্যুরে কেভার্ন থেকে ফিরে এসে আবার রবির বাসা। ইফতার এবং ডিনার এক সাথে। পথে জানতে পারলাম মোস্তফা তানিম নাকি ভাল হাত দেখতে পারে। রবির বাসায় হাত দেখা পর্ব শুরু হল। তানিম আমারটা দেখল আমি তারটা দেখলাম। পরেতো মোটামোটি হাত দেখার মেলা বসে গেল। আমি হাত দেখে সবার ভূত ভবিষ্যত বলতে লাগলাম। এর মধ্যে আরো অনেকেই এসে হাজির হয়েছেন।

নানারকম ভর্তা ভাজি দিয়ে দারুন এক খাওয়া দাওয়া হল, আড্ডাও হল মন্দ না। হঠাৎ এসে হাজির হলেন এক বয়স্ক দম্পতি (আমাদের মতই) পরে দেখি লেখক আসিফ মেহেদীর বাবা মা। তারাও এখানে থাকেন। বাইরে তখন বৃষ্টি হচ্ছিল এর মধ্যেও তারা টুক টুক করে হেঁটে চলে এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে, যেটা এখানে আমার নিজস্ব পরিচিতরা পারে নি। জানতে পারলাম তারা ১৩ মাস ধরে আছেন এখানে, ছোট ছেলে তারিকের বাসায়। তারিক এখানে খুবই জনপ্রিয়। রবির ধারনা সে ইলেকশনে দাঁড়ালে সিনেটর হয়ে যাবে। মিরপুরের মানুষদের হঠাৎ ভার্জিনিয়ায় পেয়ে বেশ ভাল লাগলো।  

ভার্জিনিয়ায় আমাদের দ্বিতীয় দিন ফুরিয়ে গেল দেখতে দেখতে! গভীর রাতে ফিরে চললাম আমাদের ডেরায়, মোস্তফা তানিমের বাসায়।

 

লেখকঃ কার্টুনিস্ট/ সম্পাদক
উম্মাদ, স্যাটায়ার কার্টুন পত্রিকা


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top