সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

পর্ব চৌদ্দ: বিদায় টেক্সাস এবং মহা বিপদ!!


প্রকাশিত:
২৬ জুন ২০১৯ ১৮:৩৩

আপডেট:
৬ এপ্রিল ২০২০ ১৯:৪৮

আহসান হাবীব

টেক্সাস থেকে বিদায় নেওয়ার সময় হয়েছে। এর মধ্যে একদিন উন্মাদের একসময়ের জনপ্রিয় রম্য লেখক হোসেন তৌহিদ জুয়েল এসে হাজির। অবশ্য তার আসারই কথা ছিল, সে থাকে অস্টিনে। আমাদের অবশ্য অস্টিনে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সময়ের কারণে সম্ভব হল না বলে ও নিজেই চলে এসেছে। একাই এসেছে, বউকে আনে নি সঙ্গে। মনে আছে ঢাকায় তাদের বিয়েতে আমি ছিলাম আক্ষরিক অর্থে প্রথম গেস্ট!

জুয়েল অনেক আগে একবার বলেছিল আপনি টেক্সাসে এলে আপনাকে আমি ডালাস শহর পুরোটা ঘুরিয়ে দেখাব। কারণ আমি এখানে অনেকদিন ছিলাম, এই এলাকাটা ভাল চিনি। সেই আমি এলাম সত্যি কিন্তু হাতে সময় নেই। জুয়েল বলল কোন ব্যাপার না আপনি আমাকে ঘন্টা খানেক সময় দিন। চলুন আমার সাথে। ওর সঙ্গে ওর বিএমডাব্লিউ গাড়িতে চড়ে বের হলাম আমি একাই। ও মুহুর্তে নিয়ে এল একটা জায়গায়। জায়গাটা বেশ সুন্দর। ওখানে বিশাল একটা টাওয়ার ৫০ তলা উচু, নাম ইউনিয়ন টাওয়ার। ১৮ ডলার  টিকিট কেটে ঐ টাওয়ারের লিফটে চড়ে বসলাম আমরা। উপরে এসে টাওয়ারের চারদিকে হাঁটলেই পুরো ডালাস দেখা হয়ে যায়। আমরাও তাই করলাম, একটা চক্কর দিলাম। আসলেই পুরো ডালাস এক নজর দেখা হয়ে গেল। জুয়েল কথা রেখেছে। আমাকে পুরো ডালাস দেখিয়ে দিল দশ মিনিটে! 

ওখানে উপরে একটা রেস্টুরেন্টও আছে। যেটা মুভিং, একটু একটু করে ঘুরতে থাকে। মজার রেস্টুরেন্ট।



ওখান থেকে বের হয়ে জুয়েল আমাকে একটা বিশেষ রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। এরা পরিবেশ বান্ধব খাবার পরিবেশন করে। আমেরিকায় এধরনের রেস্টুরেন্ট নাকি দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। খাবারটা মজার ছিল, স্যুপ আর বিশেষ এক ধরনের পিৎজ্জা। পিৎজ্জা জিনিষটা আমার প্রিয় নয় কিন্তু এটা বেশ ভাল লাগলো। খাওয়া দাওয়ার পর জুয়েল আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল। তাকে আবার লিখতে বললাম। সে বলল লিখবে, দেখা যাক সত্যিই লিখে কিনা। তবে সে যে ভাল লিখে উন্মাদের পাঠকরা সেটা এখনো জানে। বিদায় জুয়েল!

কাল চলে যাব টেক্সাস থেকে তাই বিপাশা-তূর্য , অমি-সমিক এল বিদায় জানাতে। সাথে তাদের বাচ্চারা। রাতে ওদের সাথে অনেকক্ষণ গল্প হল। ওদের ছোট্ট বেলার মজার বোকামো গুলো নিয়ে হাসাহাসি হল বেশ। তারপর সত্যি সত্যি বিদায় নিতে হল। আপনজনের কাছ থেকে বিদায় নেয়াটা আসলেই বেশ কষ্টের একটা ব্যাপার। বিপাশা বলল, “আমি কেঁদে ফেলার আগেই গাড়িতে উঠে পড়তে চাই”। অমিতো কেঁদেই ফেলল, তার ছোট্ট মেয়েটা তারস্বরে কাঁদতে লাগলো। সে যাবে না, কিছুতেই যাবে না।             

অবশেষে এলেন শহরে রনি-নিকির বাসা থেকে আমরা বিদায় নিলাম। রনি তার গাড়িতে আমাদের নামিয়ে দিতে রওনা হল। আধা আধি রাস্তা আসতেই হঠাৎ ভয়াবহ ঝড় শুরু হল, সাথে বৃষ্টি (পরে বুঝেছিলাম এই ঝড়টা আমেরিকার অনেক জায়গাতেই হয়েছিল)। পথেই এষার ফোনে ইমেইল আসলো আমাদের আমেরিকান ঈগল ফ্লাইট ক্যানসেলড। হায় হায় বলে কি! তারপরও আমরা কোনমতে এয়ারপোর্টে গেলাম কি ব্যাপার বুঝতে। গিয়ে শুনি আসলেই ঝড়ের জন্য আমাদের ফ্লাইট ক্যানসেলড। ফ্লাইট ছিল বিকাল ৩ টায়। এখন এটা ছাড়বে রাত সাড়ে আটটায় অথবা পরদিন সকাল দশটায়। আমরা ঠিক করলাম আটটারটায় যাব। এয়ারপোর্টেই বসে থাকব, কারণ আবার রনির বাসায় গিয়ে ফিরে আসা টাইমে হবে না।  

আমরা এয়ারপোর্টে থেকে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। এক ফাঁকে রনির গাড়িতে করে বাইরে একটা রেস্টুরেন্টে খেয়েও এলাম। সময়টা কিছু কাটল। 

এক সময় সময় হয়ে এল আমাদের, রনির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢুকে গেলাম চেকিংয়ে। বলাই বাহুল্য তখনও আমরা প্রি-চেকড যাত্রীই আছি,  যাকে বলে লো রিস্ক ট্রাভেলার। কাজেই খুব বেশী চেক হল না। বেশ আরামেই ঢুকে গেলাম এয়ারপোর্টের ভিতরে। আর টেনশন নেই। তখন নিশ্চয়ই ঈশ্বর মুচকি হেসেছিলেন। 

মূল এয়ারপোর্টের ভিতর ঢুকে আমরা হতভম্ভ! শত শত মানুষ গিজ গিজ করছে!! সীটে বসার জায়গা নেই। কার্পেট পাতা মেঝেতে কেউ শুয়ে আছে কেউ বসে আছে, সে এক  ভয়াবহ অবস্থা! ব্যাপার কি? জানা গেল ৪০টা প্লেন যাত্রা স্থগিত করেছে ফলে এই অবস্থা। আটটায় প্লেন ছাড়ার কথা আমাদেরটা, ছাড়ল না। বলল ওয়েদার এখনো ভাল না। নয়টায়ও ছাড়ল না, এমন কি দশটায়ও ছাড়ল না, বলল আমাদের জরুরী ভিত্তিতে অন্য টার্মিনালে যেতে হবে। ছুটলাম আমরা সেখানে, ওখানে যেতে হবে ট্রেনে করে। তাই গেলাম। সেখানে আবার অপেক্ষা। এদিকে এয়ারপোর্টের ওয়াশ রুমগুলো সব কলাপস করেছে। বেশীর ভাগ অটো-ফ্লাশ কাজ করছে না। আসলে এত মানুষের চাপ নিতে পারছে না বোধহয়। খাবারের দোকানগুলো খাবার দিয়ে কূল পাচ্ছে না। সব জায়গায় লাইন। আমাদের সঙ্গে কিছু খাবার ছিল তাই খেলাম। শেষ পর্যন্ত ঘোষণা আসল হ্যাঁ বারটায় আমাদের প্লেন ছাড়বে। বোর্ডিং কার্ড দেখিয়ে সবাই উঠে গেল এক সময়। কিন্তু আমরা তিনজন আর দুজন বৃদ্ধ আমেরিকান মহিলা আটকে গেলাম। বিষয় কি? আমাদের সীট নেই। কারণ রাত ৮টার টিকেট আমাদের দেয়া হয়েছিল স্ট্যান্ড বাই হিসেবে। এখন কেউ যদি না যায় তবে তার জায়গায় আমরা উঠতে পারব নইলে কাল সকাল দশটায়। বলে কি? দেশে হলে হাউ কাউ লাগিয়ে দিতাম হয়ত। এখানে সেটা করা যাচ্ছে না বলে দাঁত কিড়মিড় করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু না অবশেষে আমরা ৫ জন উঠতে পারলাম। প্লেন ছাড়ল, ঈশ্বর মনে হয় তখন আবার মুচকি হাসলেন।

কারণ হল, প্লেনে না যেন হামানদিস্তায় উঠেছি। আবহাওয়া খারাপ ফলে প্রবল টারবুলেন্স। মোটামোটি ডিব্বার ভিতর ঝাল মুড়ির মত ঝাঁকুনি খেতে খেতে রওনা হলাম। কতক্ষণ যে ঐভাবে ছিলাম জানি না। ল্যান্ড করার সময় দেখা গেল প্লেন ল্যান্ড করতে পারছে না... প্রচন্ড ঝড় অব্যাহত! জানালা দিয়ে দেখাচ্ছে বাইরে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে! শেষ মেষ পাইলট ঘোষনা দিল এখানে সম্ভব না, আমরা অন্য এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতে যাচ্ছি। বলে কি! প্লেনের ভিতর একটা হাহাকার উঠল। সত্যি সত্যি প্লেন ল্যান্ড করল নর্থ ক্যারোলিনার একটা অচেনা এয়ারপোর্টে, নাম শার্লট ডগলাস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট! তখন রাত আড়াইটা বাজে। 



   এই নতুন এয়ারপোর্র্টের লোকজন জানাল তারা কিছুই জানে না এই হঠাৎ ল্যান্ডিং সম্পর্কে। আমাদের দুশো যাত্রীর কি হবে এই মুহর্তে তারা কিছু বলতে পারছে না। বলে তারা তাদের কাউন্টার বন্ধ করে চলে গেল। এদিকে এই এয়ারপোর্টে আমরা প্রায় দুশোর মত যাত্রী ছাড়া আর কেউ নেই। দোকান পাট সব বন্ধ। নিঃশব্দ এয়ারপোর্ট। ঘণ্টা খানেক পর একজন এল এবং ঘোষণা দিল আমাদেরকে কাল সকাল ন’টায় আরেকটা প্লেনে করে সাউথ ক্যারোলিনার গ্রীনভিল এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিবে। আমাদের চিন্তার কোনো কারণ নেই। কিন্তু চিন্তার আসলে যথেষ্টই কারণ ছিল কারণ সবাই ক্ষুধার্ত! এবং আমাদের প্যাসেঞ্জাররা বেশির ভাগই যথেষ্ট বৃদ্ধ-বৃদ্ধা (এধনের ফ্লাইটে হালকা স্ন্যাকস, কোক, পানি, জুস, চা, কফি দেয়। কিন্তু টার্বুলেন্সের কারণে দিতে পারে নি)। এদিকে সব দোকান পাট বন্ধ। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রত্যেকটা দোকানে হাই ভলিউমে মিউজিক ছেড়ে তারা দোকান বন্ধ করে চলে গেছে। এ কেমন রসিকতা! তখনই প্রত্যেক প্যাসেঞ্জারের ফোনে ইমেইল আসলো, প্রত্যেককে ১২ ডলার করে দেয়া হয়েছে রাতের খাবারের জন্য। এষার ফোনেও এসেছে তার মানে আমরা তিনজন এখন ৩ বারং ৩৬ ডলারের মালিক, কিন্তু লাভ কি? ক্যাশ ডলার পেলে না হয় চিবিয়ে খাওয়ার একটা প্রচেষ্টা নেয়া যেত!!

আরও সর্বনাশ হচ্ছে প্রচন্ড ঠান্ডা এয়ারপোর্টে! কিছু কম্বল দেয়া হল বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের। তবে আমরা ভাগে পেলাম না (ভিতরে ভিতরে খুশীও হলাম আমাকে তরুণ মনে করে দেয় নি বোধহয়!)। যাহোক কোনমতে ৬টা বাজল, দোকান পাট খুললো। আমি আর এষা গিয়ে আমাদের ৩৬ ডলারের সদগতি করলাম, খাবার দাবার কিনে আনলাম। অন্যরাও তাই করল। তারপর আস্তে আস্তে এয়ারপোর্ট জেগে উঠতে শুরু করল। মানুষ জনে ভরে গেল। ওদিকে ন’টা বাজল, কিন্তু আমাদের প্লেনের খবর নেই। ১০টা বাজল, বলা হল প্লেন আছে পাইলট নেই। কি জ্বালা! এগারটা বাজল, বলা হল পাইলট এসেছে দুজন কিন্তু কে চালাবে এখনও ঠিক হয় নি ... ঐ আলোচনা চলছে। 



অবশেষে সাড়ে এগারটায় আমরা প্লেনে উঠলাম। বাই দিস টাইম প্লেন কিন্তু পুরাই খালি। কারণ বেশ কিছু প্যাসেঞ্জার ঐ রাতেই উবার নিয়ে চলে গেছে। কিন্তু যাদের বড় লাগেজ আছে প্লেনে, তাদের পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না। যেমন আমাদের। আর এত রাতে, খারাপ আবহাওয়ায় লং ড্রাইভে (২ ঘণ্টা) উবারে যেতে সবাই নিষেধ করেছে। যাহোক শেষ পর্যন্ত গুটি কয়েক যাত্রী নিয়ে ন’টার প্লেন ছাড়ল সোয়া বারটায়। মাত্র বিশ মিনিটে পৌঁছে গেলাম সাউথ ক্যারোলিনার গ্রীনভিল এয়ারপোর্টে। মনে মনে ভাবলাম মাত্র বিশ মিনিটের জন্য এত কাহিনী। আগে জানলেতো হেঁটেই রওনা দেয়া যেত! 

উবারে এষার বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর ২টা বাজল। বিদায় টেক্সাস... বিদায় ওকলাহোমা। 

পুনঃ ওহ বলা হয়নি, আমরা এক ফাঁকে গিয়েছিলাম বিখ্যাত বইয়ের দোকান “Barnes and Noble” এ। কত রকমের বই যে আছে! যে বইটাই কিনতে যাই সেটাই আমার শ্যালক রনি গিফট হিসেবে দাম দিয়ে দেয়। এরকম বেশ কিছু বই বগলদাবা করে বের হয়ে আসলাম। ওখান থেকে ফেরার পথে লঙ হর্ন গরুর বেশ কিছু ভাস্কর্য দেখলাম। টেক্সাসের এই গরু অনেকই বিখ্যাত।

 

লেখকঃ কার্টুনিস্ট/ সম্পাদক
উম্মাদ, স্যাটায়ার কার্টুন পত্রিকা

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top