সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

ভ্রমণ কাহিনী: ইস্তানবুল পৌঁছানো আর আমার হারানো ফোন (পর্ব ১)


প্রকাশিত:
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০২:২৮

আপডেট:
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০২:৩৪

ছবি: লেখক

প্রভাত ফেরী: বৎসরের শেষভাগে আমরা কোথাও না কোথাও বেড়াতে যাই। এবার ধার্য্য হয়েছে তুরস্ক আর মিশর যাওয়া হবে তারপর বাংলাদেশ প্রতিবতসরের মতন। আমার ভাগ্য বলতে হবে মেয়ে দুটো এ পর্যন্ত একবারো বাংলাদেশ যেতে না করেনি। করবেই বা কেনো একজনের জন্ম ওখানে আর ওদের নানা নানু আর দাদু যে রয়েছে এখনো! কিছুদিন যাবত নিউ সাউথ ওয়েলস এর দাবানলে সিডনির আকাশ ভারী আর সাথে সাথে আমার মনটাও! আজ যাবার দিনে পরিস্তিতি খুব খারাপ, তাপমাত্রা চল্লিশের উপর , প্রচন্ড ঝড় বাতাস দাবানল কে ক্যাটাসট্রোফিক পর্যায়ে নিয়ে গেছে!

মসজিদের সামনে লেখক

বন জঙল , পশু পাখী তো পুড়ছেই , মানুষের ঘরবাড়ি পুড়ছে , জীবনের ক্ষতিও হচ্ছে - যাত্রা তবু থেমে থাকে না। মেয়ে দুটো মায়ের মতোই , কোনো টেনশন নেই শেষ দিনের জন্যে ও জরুরী শপিং রেখে দিয়েছে।এ দোকান থেকে ও দোকান যখন ওরা ঘুরছে আর আমি নির্বিকার , বেলা দুটো বাজে- একজন ঘনঘন ঘড়ি দেখছে আর টেনশনে প্রায় দাবানলের মতই ফেটে পড়ছে! এক মেয়ে বলে উঠলো “ ওরকম করলে আরও দেরী হবে বি কুল এবাউট ইট !”

রাত নয়টা পয়তালললিশে ফ্লাইট, গোছগাছ সেরে ট্যাক্সিতে উঠলাম যখন প্রচন্ড ঝড়! আমাদের আটটা লাগেজ বহনকারী মিনিবাসটা দুলে দুলে উঠছে আর লেবানীজ ট্যাক্সিচালক বললেন তাকে সাবধানে চালাতে হচ্ছে। আমি আল্লাহর নাম নিলাম আর ভয়ে ভয়ে বললাম “ যদি ঝড়ের কারণে আমাদের ফ্লাইট ক্যানসেল হয়?! “ সাথে সাথে চতুর্দিক থেকে চোখ রাঙানি “ তোমার যত সব অলুক্ষনে কথা! “ আরেকজন বলল “ তোমার সাথে আমি আর বেড়াতে যাব না ! রিয়েলি ! “ আমি ব্যাপারটা শোধরাতে আমতা আমতা করে বললাম” না না ঝড়ের কারণে কোনো অসুবিধা হলে প্লেনের ল্যানডিং এর হয়, টেক অফ এ হয় না ! “

জগতে ভাবটাই সবটুকন! তবে লক্ষ করেছি যখন থেকে কবি কবি ভাব ধরেছি তখন থেকে যেন ভরসা হারাচ্ছি! বরাবরের মতন যথারীতি পাসপোর্ট, তুরস্কের ভিসার কাগজ সব আমার কাছে। আমি ব্যাংকে টাকা তুলতে গিয়ে মনের ভুলে লাগেজ ফেলে চলে আসছিলাম। এক মেয়ে তা মনে করিয়ে দিল। লাগেজ ড্রপের লাইনে হঠাৎ দেখা গেলো ভিসার কাগজ নেই! সেটাও ব্যাংকে ফেলে এসেছি! মেয়েদের বাবা আমার আগেই দৌড়ে গিয়ে কাগজগুলো এনে টেনশন ফ্রি হলেন! বড়কন্যা আমাকে মুচকি হাসতে দেখে পাসপোর্টগুলো দখলে নিলো আর বললো “ তুমি আব্বুকে এই বয়সে এরকম টেনশনে ফেলে দিতে পারো না ! দেখো তো কিরকম দৌড় দিতে হলো! “ আমি একেবারে হাত পা ঝাড়া এবার প্রথম সিডনি থেকে কাতার আর দুঘনটা বিরতির পর দোহা থেকে ইস্তানবুল যাত্রার জন্যে প্লেনে উঠলাম।

প্লেনের প্রথম প্রায় পনেরো ঘন্টা আর তারপর আড়াই ঘন্টা বিরতির পর আবার সাড়ে চার ঘন্টা বিরক্তিকর যাত্রা শেষে ইস্তানবুল পৌঁছুলাম পুরো একদিন পর! মাঝখানে আমার ফোন হারিয়ে যাত্রার শুরুতেই নাটকীয় এক অবস্থা- বলছি একটু পর..

ইস্তানবুল এয়ারপোরটে আমাদের জন্য এক ভদ্রলোক অপেক্ষা করছিলেন নাম ঝুলিয়ে। উনি আমাদের ট্যাক্সিচালক পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। বাইরের ঝক্মকে নীলাকাশ আর সাদা তুলো তুলো মেঘ দেখে মন ভরে গেলো। ইয়ং এন্ড হ্যানডসাম রাজকুমারের মতন ট্যাক্সিটালক সাদা সারট কাল প্যান্ট পরেছে আর সুন্দর মারসিডিজ ভ্যান নিয়ে এসেছে । ভেতরে পানি আর চকলেট রেখেছে আর আপ্যায়নে যথেষ্ট খুশী করার চেষ্টা তার।আমাদের ভালো করেই জানা ইউরোপ আমেরিকায় এদের ইনকামের একটা অংশ হলো টিপস এবং এই ড্রাইভাভার বেশ বড় টিপস পাবে আমাদের কাছ থেকে !

ইস্তানবুল একটা আশ্চর্যজনক শহর এই অর্থে যে এটি দুই মহাদেশ জুড়ে! আর আমরা ড্রাইভ করে বসফোরাস ব্রিজ পার হয়ে এক মহাদেশ থেকে আর এক মহাদেশে গেলাম! নীচের মারমারাস সমুদ্র , সমুদ্রে জাহাজ, উপত্যকায় বাড়িগুলো নীলাকাশ - কি যে সুন্দর!! বেশ ট্রাফিক জ্যাম , আমাদের বাম দিকে একটা ছোট্ট গাড়ি অনেকক্ষন পাশাপাশি চলছিল। গাড়িতে সামনের সিটে তিনজন বসেছে, পেছনে চারজন আর পাঁচজন তিন থেকে দশ বৎসরের মধ্যে বাচ্চা গাড়ির মধ্যে স্বাধীনভাবে চলাচল করছে! একটি বাচ্চা দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে, আরেকজন গিয়ারবকসের কাছে দাঁড়ানো, অন্যেজন পেছনে চলাচল করছে ! আমরা প্রথম হতবাক, অতঃপর গুনাগুনী এবং অনেকক্ষন পর্যবেক্ষণ শেষে আমি যেই ছবি তুলতে গেলাম আমার সহযাত্রীরা সব একযোগে “না না খবরদার তুলবে না “ করে চিৎকার করে উঠলো ! কিভাবে তুরস্কের মতন উন্নত দেশে এভাবে ড্রাইভিং এলাউ করে মাথাতে আসে না তবে ড্রাইভারের মাথা ঠান্ডা কোনো সন্দেহ নেই- সে নির্বিকার সুন্দর ড্রাইভ করে চলেছে।

আমরা হোটেলে পৌঁছে রুম থেকে মারমারাস সমুদ্রের ভিউ দেকে মুগ্ধ! সকলে বেশ টায়ারড বিধায় আগেকার প্ল্যান মাফিক আর বিকেল বেলায় বাইরে যাওয়া হলো না। হোটেল রেস্টুরেন্টে বসে ভিউসহ কাবারই বা মন্দ কি ! তারপর ঘুম - পরদিন বলু মসক দেখতে যাবার কথা।

ও হ্যাঁ , আমার ফোন হারাবার কথা না বলে আজ শেষ করা যাচ্ছে না। দোহাতে প্লেন থেকে নেমেছি দুইঘনটা পর ইস্তানবুলের প্লেন ধরব বলে। মেয়ে দুটো ওয়াশরুমে যাবে বলে থামলাম আর তক্ষুনি আমার নজরে পড়ল যে আমার হাতে তো ফোন নেই! প্লেনে ফেলে এসেছি। বলতেই মেয়ে দুটো চোখ উল্টালো -যেন আবার !! মেয়েদের বাবা রাজ্যের বিরক্তি সহ আমার সাথে ফিরতে পথে রওনা করলো বকবক করতে করতে “ তুমি পারো ও ! কোথায় ফেলে আসলে ফোনটা?! এখন কিভাবে পাবে ?! ‘ গিয়ে একটা জায়গায় সিকিউরিটি আটকে দিল “ mam , you can’t go any further .” আমি বললাম “ but I left my phone on the plane “ . তাকে সিট নম্বর বলাতে সে বললো সে দেখছে আর আমাদের দেখাল “ they’re waiting for their boots !” তাকিয়ে দেখি একটি কাপল, দুজনই হেসে কুটিকুটি , ছেলেটি তার শীতের বুট ফেলে এসেছে।

তারপর একজন ওর uggboots নিয়ে উপসথিত হলো । তাই দেখে আমাকে মেয়েদের বাবা বললেন “ তুমি নিজের ব্যগে ফোন রেখে এখানে খুঁজছো না তো ?” আমি বললাম “ তুমি মেয়েদের কাছে যাও আমি আসছি।” আমি মনে মনে ভাবলাম আমার কেন এতো টেনশন কম ?! শুধু তো সেলফোন নয় ওটার সাথে যে আমার ব্যাংক কার্ড , ড্রাইভারস লাইস্যানস আর মেডিকেয়ার কার্ড ও রয়েছে ! বাংলা শুনে সিকিউরিটির লোকটি বাংলায় বললো “ আপনারা দুজনই একসাথে অপেক্ষা করুনানা! কোথায় থাকেন? ইস্তানবুল ? “ আমি বললাম “ না , সিডনি । আপনি ? “। “ আমি ঢাকায় থাকি” বলেই সে দৌঁড় দিল “ দাঁড়ান এক মিনিট আসছি , ওরা ফোন পেলেও নানান সিকিউরিটি কারণে দেরী করবে।” একটু পরই আমার ফোন হাতে সে হাজির “ এটি আপনার ফোন ?” আমি বললাম “ হ্যাঁ দেখুন না স্ক্রিন সেভাবে আমার ছবি । “ “ ও আমি খেয়াল করি নি। মুচকি হেঁসে “ ভালো থাকবেন।” জয়তু বাঙালী পৃথিবীর সমস্ত জায়গায় - আমি মনে মনে বললাম। বাইরে বললাম অনেক ধন্যবাদ । সেই যুগলটাও আমাদের সামনে সামনে হাঁটছে। আগে প্রেমিক যুগল দেখলে হিংসা করতাম এখন আর করিনা । পৃথিবীতে এর চাইতে স্বর্গীয় জিনিষ আর নেই । প্রেমিকদের প্রেম আনন্দে তো বাড়েই , বিরহে বাড়ে , বেদনাতেও বাড়ে.......

(চলবে)

লেখক: শাহনাজ পারভীন
(সিডনি, অস্ট্রেলিয়া)


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top