সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

পর্ব দুই: আমেরিকায় প্রথম সকাল


প্রকাশিত:
৩১ মার্চ ২০২০ ১৯:৫১

আপডেট:
৫ এপ্রিল ২০২০ ০৬:২১

আহসান হাবীব

আমেরিকায় এসে মানে সাউথ ক্যারোলিনার ক্লেমসনে মেয়ের বাসায় ঢুকে আমি আর আমার স্ত্রী রীতিমত চমকিত! সে বিশাল এক বাসা নিয়ে একা থাকে। ভিতরের দিকে দুটো বেড রুম, বাইরের ড্রইং রুমটা বিশাল, যেখানে একই সঙ্গে রান্নাঘর, বেসিন, সিংক, ডাইনিং টেবিল সব আছে। বিশাল ফ্রিজ, চার বার্নারের চুলা, মারবেল পাথরের ডাইনিং টেবিল কি নেই! পিছনে ব্যাকইয়ার্ড, চারিদিকে গাছপালা, রকিং চেয়ার পাতা। বাথরুমেও কি নেই! গিজার, ওয়াসিং মেশিন, বাথটাব, কাপড় শুকানোর যন্ত্র। এ সব কিছুই এই বাড়িতে রেডিমেড আছে, মানে আগে থেকেই আছে। এখানকার সব বাড়িই এমন। আমার মেয়ে সব কিছু এমন গুছিয়ে রেখেছে যে আমার মনে হল আমি যেন ফাইভ স্টার হোটেলে ঢুকেছি!

সন্ধ্যায় এসেছি। মেয়ের বাসায় কোন বিছানা নেই। বিশাল এক ফোমের মত কিছু একটা পেতে রেখেছে । তার রান্না করা খাবার খেয়ে দেয়ে সেখানে শুতেই ফোমের মধ্যে আমি তলিয়ে গেলাম মনে হল। ফোমের নরম ষ্পঞ্জ সাঁতরে উঠে আসার মত অবস্থা আমার আর নেই; আমি উঠার চেষ্টাও করলাম না। ঘুমিয়ে গেলাম। মা মেয়ে কত রাত পর্যন্ত গল্প করেছে টেরও পেলাম না।

সকালে ঘুম থেকে উঠে অতি আধুনিক বাথরুমে সেভলন দিয়ে দাঁত মেজে ফেললাম। পেস্ট ভেবে এ্ই ভুল দিয়ে ক্লেমসনে আমার সকাল শুরু। নাস্তা খেয়ে বেরুলাম আমরা ঘুরতে, প্রথমে ডাউন টাউনে। সেখানে নানান অত্যাধুনিক দোকান আছে, বার আছে, রেস্টুরেন্ট আছে। আমরা কিছু ডলার এষার কার্ডে ঢুকিয়ে নিলাম, কারণ এখানে সব কিছু ক্রেডিট কার্ডেই হয়। রাস্তার ধারের বুথ থেকে এষাই ঢোকালো। তার আগে আমরা গেলাম অনির বাসায়। অনি হচ্ছে এখানে এষার প্রিয় একজন। তার হাজব্যান্ড মামুন এখানে পিএইচডি করছে। তাদের বাসাটা ডুপ্লেক্স টাইপের, খুবই গোছানো। দুজনেই বরিশালের ছেলে-মেয়ে, মামুনের দাদার নিবাস পিরোজপুর। আর কে না জানে পিরোজপুর হচ্ছে আমাদের জন্য একটা নষ্টালজিক জায়গা। পিরোজপুর শুনলেই বুকের কোথায় গিয়ে যেন লাগে! আর কি আশ্চর্য আজ মে মাসের ৫ তারিখ!!! এই দিনে পিরোজপুরের বলেশ্বর নদের জেটিতে আমাদের প্রিয় বাবাকে পাকিস্তানী মিলিটারীরা গুলি করে হত্যা করে! বড় ভাইয়ের ভাষায় ‘ ভরা পূর্ণিমায় ফিনকি ফোটা জোছনায় তার রক্তাক্ত দেহ ভাসতে থাকে বলেশ্বর নদীতে। হয়ত নদীর শীতল জল তাঁর রক্ত সে রাতে ধুয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। পূর্ণিমার চাঁদ তার সবটুকু আলো ঢেলে দিয়েছে তাঁর ভাসন্ত শরীরে...’

... যাহোক তাদের সঙ্গে অল্প কিছুক্ষন সময় কাটালাম। কারণ আমরা মনে হল তাদের সকালের ঘুম মাটি করেছি। তারপরও অনি দ্রুততম সময়ে চা আর সমুচা তৈরী করে ফেলল। ঢাকার সিঙ্গারা সামুচা আমার প্রিয় (যদিও আমার ওপেন হার্ট সার্জারীর পর আমার জন্য এসব স্ট্রিকটলি নিষেধ)। আমেরিকার সামুচা বেশ আগ্রহ করে খেলাম। অনিদের বাসার সামনেই বাস থামে। বলতে বলতেই বাস চলে এল, আমরা ছুটলাম বাস ধরতে। বাসে উঠে বাসের দরজায় আমি আটকে গেলাম। কারণ তাড়াহুড়ো করে জুতোর ফিতে বাধা হয় নি। একটা ফিতে কোথায় যেন আটকে গেছে। বাসের মহিলা ড্রাইভার অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, এজ ইফ আমি ভিতরে না ঢুকে ঢাকার বাসের মত গেটে ঝুলে আছি! আমি হাসি মুখে হাত নাড়লাম, ড্রাইভারও হাত নাড়ল কিন্তু তার চোখে বিস্ময়! বলাই বাহুল্য আমার এক পা তখনও আপ্রান ভাবে জুতার ফিতে ছুটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, এবং অবশেষে ছুটলোও। আমি এমন ভঙ্গিতে ঢুকলাম যেন আমরা ওরিয়েন্টাল বিদেশীরা এ জাতীয় কেটারপিলার বাসে সাধারনত এভাবেই ঢুকে থাকি!

সে যাই হোক, একদম ফ্রি বাস, যেখানেই আমরা যাই না কেন। বিশাল ক্যাটারপিলার বাসটা দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ, যেন এই মাত্র শো রুম থেকে রাস্তায় নেমেছে। ভিতরে একবারেই ভিড় নেই, দু তিনজন বসে আছে। এষা আমাকে কিছু বিষয়ে সাবধান করল-

১) কোনো আমেরিকানদের দিকে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকা যাবে না।

( অবশ্য বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকা সম্ভবও না কারণ সামারের কারণে তাদের সবার পোষাক খুবই বিপজ্জনক রকম সংক্ষিপ্ত। সবাই হাফপ্যান্ট পরা। মেয়েদের ক্ষেত্রে অতি বিপজ্জনক হাফপ্যান্ট! এরকম আন্ডারওয়্যার প্যাটার্নের হাফপ্যান্ট এরা কোথায় পায় কে জানে!)

২) প্রথমে একবার তাকানোর পর খুব বেশী কৌতূহোল হলে দ্বিতীয়বার তাকানো যেতে পারে তবে মুখ ঘুরিয়ে নিতে হবে দ্রুত। আমি ভাবলাম একটা রিহার্সেল দেয়া যাক। একটা সুন্দরী মহিলার দিকে তাকালাম, সেও দেখি আমার দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আমিও দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। ভাবলাম দ্বিতীয়বার তাকানো যাক। তাকালাম। সেও দেখি দ্বিতীয়বার আমার দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। বাহ নিয়মটা তাহলে সেও জানে! দান দান তিন দান ভাবলাম তৃতীয়বার তাকানো যাক... কি হয় দেখি না (কার্টুনিস্টের জীবন নানান রকমের পর্যবেক্ষনের জীবন)। কি আশ্চর্য তৃতীয়বার তাকিয়ে দেখি মহিলা নেই। এত দ্রুত কোথায় গেল! হঠাৎ তাকিয়ে দেখি অন্যদিক থেকে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে আমার দিকেই যেন ছুটে আসছে, হাতে রাগবী খেলার একটা বেটন। সারছে! তবে না তারা অন্য দিকে চলে গেল। আমি পর্যবেক্ষন বাদ দিয়ে স্ত্রী কন্যার পিছনে ছুটলাম।

৩) ভুল করে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকলে কেউ যদি হাসি দেয় তাহলে আমাকেও হাসতে হবে। কিংবা হাত নাড়ে আমাকেও হাত নাড়তে হবে। (এই প্রসঙ্গে অনি বলল আমরা বাঙালীরা হাসলে নাকি হাসির রেশটা মুখে কিছুক্ষন থাকে। চট করে চলে যায় না। কিন্তু আমেরিকানরা হাসলে নাকি পরমুহুর্তে হাসি নাই হয়ে যায়! সকালে আমরা যখন বেরুলাম তখন দেখি এষার সামনের বাসার এক আমেরিকান একটা ভয়ঙ্কর কুকুর নিয়ে বেরুল, আমি তাকিয়ে দেখছিলাম, হয়ত বেশিক্ষনই তাকিয়ে ছিলাম। সে দেখি আমার দিকে হাত নাড়ল। আমিও নাড়লাম।

৪) রাস্তা পারাপারে সাবধান। কিছু পারাপার আছে দুটা সাদা দাগ দেয়া। দুই সাদা দাগের মাঝখান দিয়ে আমি যখন তখন হাঁটতে পারি। গাড়ি আসছে কি যাচ্ছে আমার দেখার বিষয় না। যেকোনো গাড়ি দাঁড়িয়ে যাবে।

৫) কিছু পারাপার আছে যার জন্য আমাকে একটা বাটন টিপতে হবে। অন্য পারে যখন হাঁটার ছবি আসবে তখন আমি রাস্তা পার হতে পারব, তার আগে নয়। ইউরোপেও এই সিসটেম দেখেছি।

৬) এখানে হ্যান্ডিক্যাপদের জায়গায় গাড়ি পার্ক করলে ১০০০ ডলার জরিমানা। রাস্তায় বোতল ইত্যাদি ফেললে ১০০০ ডলার জরিমানা। একটা বোতল দেখলাম রাস্তায় চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে পড়ে আছে। মনে হল নিশ্চয়ই ঢাকা থেকে আসা ‘কোনো বোতল ফেলা পাব্লিক’ খালি বোতল ফেলে ১০০০ ডলার জরিমানা দিয়ে পরে রাগে দুঃখে বোতলের উপর লাফিয়েছে কিছুক্ষন। নইলে বোতল এত চিড়ে চ্যাপ্টা হয় কিভাবে! তবে স্বীকার করতেই হবে খুবই পরিচ্ছন্ন শহর ক্লেমসন।

ডাউন টাউন দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখলাম দামি দামি সব গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় বিদেশীরা; মজার ব্যাপার হচ্ছে বেশির ভাগ গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে রেখেছে তাদের কান ঝোলা পোষা বিশাল কুকুরগুলি। তারা খুবই গম্ভীরভাবে শহরের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করছে বলে মনে হল। হেঁটে হেঁটে আমরা গেলাম এষার ইউনিভার্সিটিতে। অত্যন্ত প্রাচীণ এবং আধুনিক ইউনিভার্সিটি। ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত, একটু পর পর ভাস্কর্য, প্রতিটা ভাস্কর্যের পাশে মেটাল প্লেটে তার ইতিহাস লেখা আছে। কিছু কিছু ভাস্কর্যের সামনে ছবি তুললাম। বিশাল মাঠের এক পাশে এক জোড়া কামান। কামানের নাম টম এন্ড জেরি !!!

উইক্যান্ড দেখে পুরো ক্যাম্পাস খালি। ক্যাম্পাস কঠিন ভাবে মাদক ও ধূমপান মুক্ত। এক চিপায় দেখি এক জোড়া তরুণ তরুণী ভুস ভুস করে বাংলাদেশের কয়লার ইঞ্জিনের মত ধোয়া ছাড়ছে। আমাদের দেখে মনে হল লুকিয়ে ফেলল সিগারেট। আরেক জায়গায় এক জোড়া তরুণ তরুণী কঠিন প্রেমে মত্ত (জন স্নো আর ড্রাগন কুইন ডেনেরিস টারগ্যারিয়ান স্টাইল)! আমরা অন্য দিকে মাথা ঘুরিয়ে না দেখার ভান করলাম। তারা অবশ্য সিগারেটের ধোঁয়ার মত নিজেদের চট করে লুকিয়ে ফেলতে পারল না।

এষার মাইক্রোবায়োলজী ডিপার্টমেন্টে গেলাম, ল্যাবে গেলাম, তার অফিসে গেলাম। বিশাল ক্যাম্পাস। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত। এক জায়গায় বসে ভেন্ডিং মেশিন থেকে নামানো কোক আর অনির দেয়া আমেরিকান সমুচা খেলাম। আমার হাই ডায়বেটিস কিন্ত এখানে এসে সব নিয়ম কানুন ভুলে ইচ্ছে মত সবই খাচ্ছি।

আমাদের সঙ্গে কিছু খুচরা ডলার ছিল। এষা বলল এখানে সব কেনা কাটা ক্রেডিট কার্ডে, খুচরা ডলার হ্যান্ডেল করা মুশকিল। তাই ফেরার সময় ঢুকে পরলাম রাস্তার পাশের একটা ডলার সপে। এখানে যাই কিনি মূল্য এক ডলার। ঢুকেতো মাথা নষ্ট অবস্থা! দারুন দারুন সব জিনিষপত্র সব এক ডলার, কি করে সম্ভব? আমাদের কেনা কাটায় আমাদের মেয়ে বিরক্ত হয়ে গেল। যাহোক শেষ পর্যন্ত খুচরা ডলারগুলোর একটা ব্যবস্থা করে বের হয়ে এলাম। ঘড়িতে দেখি সাড়ে সাতটা বাজে। বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে সাতটা, তখনও বাইরে কড়া রোদ! আমার মনে হল আমি সময়ের ফাঁদে আটকা পড়েছি। আমেরিকান টাইম যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আর ঢাকা থেকে আনা আমার দুটো ঘড়িই রীতিমত ঘোড়া হয়ে উঠেছে, কেবল চিহিহিহি ডাক দিতেই বাকি! তারা আর ঘড়ি নেই! মনে হচ্ছে আমেরিকা থেকে একটা নতুন ঘড়ি কিনতেই হবে!

 

লেখকঃ কার্টুনিস্ট/ সম্পাদক
উম্মাদ, স্যাটায়ার কার্টুন পত্রিকা


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top