সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

পর্ব বারো: টেক্সাস ট্যুর


প্রকাশিত:
৩১ মার্চ ২০২০ ২০:১০

আপডেট:
৬ এপ্রিল ২০২০ ১৮:২৫

আহসান হাবীব ও পরিবার

টেক্সাসে যাওয়ার সময় দেখি আমাদের বোর্ডিং  পাসে লেখা “প্রি চেক” ! মানে কি? এষা গুগোল করে দেখে এর অর্থ এরা (মানে আমরা) লো রিস্ক ট্রাভেলার। কিন্তু প্রি চেক ট্রাভেলার হতে হলে ১০০ ডলার জমা দিয়ে দরখাস্ত করতে হয় আলাদা আলাদা ভাবে। তারপরে ওরা ভেরিফিকেশন করে অফিসিয়ালী ঘোষনা দেয় এরা লো রিস্ক ট্রাভেলার, এরা প্রি চেকড। মানে এদের ওত চেক করার দরকার নেই। আর সত্যি কি আশ্চর্য এবার চেকিং এর সময় আমাদের আর সেরকম চেকিং হল না। আলাদা একটা রাস্তা দিয়ে বের করে দিল, জুতা-বেল্ট-ঘড়ি কিছুই খুলতে হল না। এমনকি আলাদা একটা ঘরে ঢুকিয়ে দু পা ফাঁক করে উপরে হাত তুলে আসামীর ভঙ্গিতে যে দাঁড়াতে হয়, তাও করতে হল না! কি আশ্চর্য আমরা তাহলে কিভাবে প্রি চেকড হলাম?  কিমাশ্চর্যম!!

(পরে একজন বলেছে হঠাৎ হঠাৎ ওরা র‍্যান্ডমলি কাউকে কাউকে প্রি চেকড করে দেয়, মে বি আমরা তিনজন সেই ভাগ্যবান!!) 

যাহোক ছোটখাট একটা প্লেনে চড়ে রওনা হলাম টেক্সাস। দু ঘন্টার জার্নি। পৌঁছেও গেলাম। এয়ারপোর্টের নাম “ডালাস ফোর্ট ওয়র্থ”। বিশাল এয়ারপোর্ট, ফোর্থ বিজিয়েস্ট এয়ারপোর্ট অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড! ব্যাগেজ ক্লেইম থেকে আমাদের স্যুটকেস নিয়ে বেরুলাম (আমি ওপেন হার্ট সার্জারীর রোগী। আমার ডাক্তার বলে দিয়েছিল সাড়ে তিন কেজির বেশি যেন ওজন না টানি, এখন রীতিমত ২৩ কেজির সুটকেস টানতে হচ্ছে!)। বাইরে রীতার ছোট ভাই রনি অপেক্ষা করছে গাড়ী নিয়ে। দীর্ঘ দশ বছর পর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল, আমি ভেবেছিলাম আবেগঘন একটা দৃশ্য দেখব কিন্তু দুজনের ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হল কোন ব্যাপার না, গতকালইতো দেখা হয়েছে। খুবই প্র্যাকটিক্যাল তারা দুজন।

রওনা হলাম এলেন শহরে, ওখানেই রনি থাকে। বেশ পশ এলাকা। সব সিঙ্গেল বাড়ি। বাসায় ঢুকার সময় বিপদ হল। ভয়ঙ্কর কুকুরের গর্জন। রনির আমেরিকান স্ত্রী নিকির কুকুর আছে। বিশাল অস্ট্রেলিয়ান শেফার্ড কুকুর, নাম বনজো! কি জ্বালা! পুরো ক্লেমসনে বাড়ির বাইরের কুকুরের ভয়ে অস্থির ছিলাম।

এখন এখানে এসে ঘরের ভিতর কুকুর। কিন্তু না । নিকি তার কুকুরের গলায় কাঁধে কি সব বেঁধে সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে বেরুল। পরে শুনলাম বনজোকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ডগ সিটারের কাছে। এখানে কুকুরের জন্য ডগ সিটার আছে। প্রতিদিন সাধারণ সুবিধার জন্য ২৫ ডলার আর বেশি সুবিধার জন্য ১০০ ডলার। আমরা যে কদিন আছি বনজো থাকবে ডগ সীটারের কাছে। আহা তখন আবার আমার বেচারার জন্য মায়া হল। বিশাল এই কুকুরটা দেখতে কিন্তু চমৎকার! কান ঝোলা লোমশ, কিন্তু লেজ কাটা (অস্ট্রেলিয়ান শেফার্ডের নাকি লেজ কেটে দেয় এটাই নিয়ম)। এই প্রসঙ্গে একটা জোক মনে পড়ে গেল। বিদেশী জোক অবশ্যই... শাশুড়ী বেড়াতে আসছে জেনে মিঃ জোন্স তার কুকুরের লেজ কাটিয়ে নিয়ে এসেছে। মিসেস জোন্স বলল “এটা কেন করলে?” 

তোমার মাকে দেখে আমার কুকুর লেজ নাড়বে এটা আমি কিছুতেই সহ্য করব না। (এ জাতীয় জোকস অবশ্য আমার আর পছন্দ না। শাশুড়ীকে ছোট করে এরা প্রায়শই জোক পরিবেশন করে থাকে।)

লেজ কাটার আরেকটা জোক আছে। এটাও বিদেশী। বুলগেরিয়ার গাব্রভো শহরে নাকি সব বিড়ালের লেজ কাটা। কারণ হচ্ছে ওখানে প্রচন্ড শীত। বিড়াল দরজা দিয়ে ঢুকতে বা বেরোতে গেলে লম্বা লেজ এর কারণে বেশিক্ষন দরজা খোলা রাখে, ফলে ঠান্ডা ঢুকে যায়। তাই এই ব্যবস্থা, লেজ গোড়া থেকে কেটে দেয়।



নিকি বলল ডগ সীটারের কাছে ওরা অন্যান্য কুকুরের সাথে বেশ ভালই সময় কাটায়। ওখানে তারা নাকি বেশ একটা সামাজিক পরিবেশে থাকে! 

রনি-নিকির তিন বাচ্চা, বড় দুই ছেলে এবেন-ইডেন। তারা জমজ দুই ভাই, পুরাই আমেরিকান। সম্প্রতি তারা ষোল বছর পার করেছে। গাড়ী চালানোর লাইসেন্স পেয়েছে বলে দুই জনে গাড়ি নিয়ে বাইরে বাইরেই থাকে। বের হওয়ার সময় কয়েন দিয়ে টস করে নেয়, কে গাড়ি চালাবে। তবে দুজনেই খুবই ভদ্র। ছোট মেয়েটি ওনালী। কিউট চেহারার বাঙালী ভাব আছে। সে একজন জিমন্যাস্টিক চ্যাম্পিয়ন এই বয়সেই। বয়স মাত্র পাঁচ! আমার সঙ্গে বেশ খাতির হল। আমি আমার নানা প্রতিভা দিয়ে তাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করলাম। কিছুতেই কামিয়াব হতে পরলাম না। শেষে তার একটা কার্টুন আঁকার চেষ্টা করলাম (ক্যারিকেচার)। মনে হল ঈষৎ কামিয়াব হয়েছি,  সে ঘোষনা দিল “হি ইজ দ্যা বেস্ট আর্টিস্ট ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড!!”   এলেন শহরের জিমন্যাস্ট চ্যাম্পিয়ানের কাছ থেকে এমন একটি মৌখিক সার্টিফিকেট পাওয়া কম কথা নয়।    

পরদিন নাকি ডালাস রেডিওতে আমাকে ইন্টারভিউ দিতে হবে। কি জ্বালা! রনি নিয়ে গেল। এষাকে জোর করে নিয়ে গেলাম। বিশাল এক বিল্ডিংয়ের ন’তলায় ডালাস রেডিও স্টেশন। ওখানে তামিল রেডিও, ইন্ডিয়ান রেডিও সবই আছে। দু ঘন্টার লম্বা ইন্টারভিউ, এষাকেও সঙ্গে রাখলাম। বাপ বেটি মিলে একটা ইন্টারভিউ হল। দেশের অনেক ক্রিয়েটিভ লোকজন এখানে ইন্টারভিউ দিয়ে গেছেন বলে মনে হল। সানি নামের এক তরুণ আর তার স্ত্রী মিলে এই স্টেশন চালায়। সাথে তাদের বন্ধু রহিমও আছে যিনি টেকনিক্যাল সাইড দেখেন। মাত্র তিনজন মিলে বড় একটা বাংলা রেডিও স্টেশন! 

পরদিন বড় ভাইয়ের ছোট মেয়ে বিপাশার বাড়ি গেলাম। তাদের বাড়িটাও চমৎকার, দোতলা। ছোট্ট বিপাশা এখন আর ছোট্ট নেই, দুই বাচ্চা নিয়ে হিম শিম খাচ্ছে। ছোটটা নোয়াহ, মাত্র দু-মাসের। তাকে এই প্রথম দেখলাম। আর বড়টা নীল, চরম দুরন্ত। টার্জানের মত লম্বা লম্বা চুল। লাফ ঝাপও দিচ্ছে টার্জানের মত। তাকে আর আমার কোনো প্রতিভা দিয়ে কিছুতেই মুগ্ধ করতে পারলাম না। তবে এষার সঙ্গে বেশ খাতির হল। বিপাশার জামাই তূর্য, খুবই হেল্প ফুল। বাচ্চাদের ভাল টেক কেয়ার করে। কদিন আগেই গুলতেকিন ভাবী আর নুহাশ এসেছিল, আরেকটু আগে এলে তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত! 

ঐ রাতেই দেখা হল ভাগ্নি অমির সঙ্গে (বড় বোনের মেঝো মেয়ে, সে অপলা হায়দার নামে লেখালেখি করে। বেশ কিছু বইও বের হয়েছে তার)। তার জামাই সমিকের সঙ্গে দেখা হল। তাদের দুই বাচ্চা, এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটাকে এই প্রথম দেখলাম। নাম অয়োনা আর ছেলে অহন। দুজনেই শান্ত শিষ্ট দুই বাচ্চা, পুটপুট করে ইংরেজি বলছে। এরা বাংলা বুঝে কিন্তু বলে ইংরেজী। অমি একটু ইমোশনাল টাইপের, আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। আহা এরা সবাই কত কাছের, এখন হাজার হাজার মাইল দূরে আছে। অমিরা নতুন একটা বাড়ি কিনেছে, রাতে আমরা সেখানেই গেলাম। চমৎকার বাড়ি, পিছনে অনেক জায়গা। ওখানে বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব হল। রাতে থাকার প্ল্যান। ঐ রাতেই সমিক আমাদের নিয়ে গেল ডালাসের ডাউন টাউন দেখাতে।  জন এফ কেনেডি মেমোরিয়াল দেখলাম। ছ’তলা এই বিল্ডিং থেকেই তাঁকে (আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি) দু বার গুলি করে হত্যা করা হয়। যেখানে গুলি করা হয়েছে সেখানে রাস্তার উপর দুটি ক্রস আঁকা আছে, আমরা দেখলাম। 

পরদিন গেলাম একটা নেচার অ্যান্ড সায়েন্স মিউজিয়ামে, নাম “Perot Museum”। আমরা তিনজন আর অহন। বেশ ভাল লাগলো। এরা সব কিছু এত যত্ন   করে তৈরী করে, দেখে মুগ্ধ হওয়ার মত। বিশাল প্রাচীণ ডাইনোসরের সত্যিকারের কঙ্কাল, বিশাল ম্যামথ, সামুদ্রিক কচ্ছপ, সেইরকম সাইজ! কি নেই! এরা বাচ্চাদের  দিকটা খেয়াল রাখে। যেমন একটা জায়গা আছে যেখানে বিশাল স্ক্রিনে তিনটা ডাইনোসর দাঁড়িয়ে আছে। স্ক্রিনের সামনে তিনটা গোল স্পট। যেকোন একটা স্পটের উপর দাঁড়িয়ে নাচানাচি করলে ঐ ডাইনোসরও নাচানাচি করে, সাথে মিউজিক। অহন কিছুক্ষণ ক্লান্তিহীন নাচানাচি করল, ডাইসোরও নাচলো। আমারও ক্ষীণ ইচ্ছে হল ডাইনোসরের ভিতর ঢুকে একটু নাচি কিন্তু স্ত্রী কন্যার কথা ভেবে সাহস হল না। আর বয়সও একটা ফ্যাক্টর বটে, মাত্র একষট্টি। এই বিজ্ঞান মিউজিয়ামে আসলে বিজ্ঞান বক্তা আসিফকে নিয়ে আসা দরকার ছিল। 
মিউজিয়াম থেকে ফিরে দুপুরে অমির বাসায় খাওয়া দাওয়া হল। সন্ধ্যায় সমিক কাবাব নান নিয়ে এল, ওদিকে বিপাশারাও চলে এসেছে। ইফতার হল দারুণ। পরদিন ঈদ, খুঁজে খুঁজে ইউ টিউব থেকে “মন রমজানের ঐ রোজার শেষে ...” সেই বিখ্যাত গান বের করে ছেড়ে দেওয়া হল। এই গানটা শুনলে চোখে পানি চলে আসে। কত স্মৃতি এই গানটার সাথে ... মনে আছে ছোট বেলায় প্রতিটা ঈদে এই গান শুনে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠতাম। কারণ বাবা ঈদের সকালে রেডিওতে উঁচু ভলিউমে এই গান ছেড়ে দিতেন! আহ কি অসাধারন একটা গান লিখে গেছেন আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম!   

ইফতারের পর রাতে চাঁদ রাত পালন করার উদ্দেশ্যে ওরা আমাদের নিয়ে গেল একটা ফুটবল মাঠের মত বিশাল খোলা জায়গায়। বিশাল নকল মাঠ কিন্তু খুবই সুন্দর। ভিতরে আসল ইনডোর মাঠ। সেখানে নাকি ফুটবল, লাক্রস খেলা হয়। জায়গাটা অসাধারন। বিপাশা আমাদের একটা দোকানে কফি খাওয়ালো। খোলা জায়গা পেয়ে নীল আর অহন ছুটোছুটি করতে শুরু করেছে। প্রচুর বাতাস আর ঠান্ডা। একটা অদ্ভুত ভাস্কর্য দেখলাম, ট্র্যাশ প্লেট দিয়ে বানানো। দারুন লাগলো। ঘোরাঘুরির পর বিপাশারা আমাদের রনির বাসায় নামিয়ে দিয়ে এল। ঈদ আমরা ওখানেই করব।

পরদিন ঈদ। আমেরিকায় ঈদ। এখানে ছেলে মেয়ে সবাই এক সঙ্গে মসজিদে গিয়ে নামাজ পরে। আমরাও গেলাম। রীতা এই প্রথম মসজিদে ঈদের নামাজ পড়ল। ছোট খাট সুন্দর আধুনিক দোতালা মসজিদ, আমেরিকান ঈমাম। নামাজের পর বাঙালী, ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানীদের আলাদা আলাদা আড্ডা। আবার ফ্রি খাওয়া দাওয়াও আছে টেবিলের উপর। বেশ ভালই ব্যবস্থা। আমিও অনেক পরিচিত বাঙালী পেলাম। 

রাতে বাড়ি ফিরে আরো জমকালো ঈদ। অমিরা চলে এসেছে,  বিপাশাও চলে এসেছে তাদের বাচ্চাদের নিয়ে। ওদিকে ওকলাহোমা থেকে এসছে এষার বন্ধু শাদমান। ওরা এক সঙ্গে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করেছে। এখন সে ইউনিভার্সিটি অফ ওকলাহোমাতে ফিজিক্সে পিএইচডি করছে। বেশ ভালই একটা হই চই করে ঈদ হল আমাদের। খাওয়া দাওয়া, আড্ডা, সেলফি সবই থাকলো। নিকি খুবই সোশ্যাল টাইপ। বাংলা বলতে পারে না কিন্তু বোঝে। তার আমেরিকান রান্না বান্না অসাধারণ আর রনির বাঙালি রান্নাও অসাধারণ। বাংলাদেশ-আমেরিকা মিলে বেশ একটা মজাদার ঈদই হল বলতে হবে।  


পূণ: শেষ দিনে অবশ্য বনজোকে ফিরিয়ে আনা হয় তার ডগ-সীটার জীবন থেকে। এবং তার সাথে আমার কিঞ্চিৎ খাতিরও হয়ে যায়। সে তার ১০,০০০ গন্ধের গোডাউনে বোধ হয় আমার গন্ধও নিয়ে নেয়।

 

লেখকঃ কার্টুনিস্ট/ সম্পাদক
উম্মাদ, স্যাটায়ার কার্টুন পত্রিকা

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top