সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

একটি মানবিক রাষ্ট্রের আকাঙ্খা বনাম আব্বুদের হারিয়ে যাওয়া!


প্রকাশিত:
৫ জুন ২০১৮ ১১:৩৩

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৬:৪৫

একটি মানবিক রাষ্ট্রের আকাঙ্খা বনাম আব্বুদের হারিয়ে যাওয়া!

শাহেদ আলম : কি লিখবো, কি লেখা উচিৎ এই ভেবে অনেক সময় পার হলো। প্রবাদে বলে, খুনি খুন করার সময় নিজের অজান্তেই খুনের সাক্ষি রেখে যায়। চোর চুরি করার পর, চুরির সাক্ষী রেখে যায়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে অনেক দিক দিয়ে খুন করা হয়েছে, হচ্ছে। খুনের সাক্ষী রেখে যাওয়া হচ্ছে, সেটা একটা ইতিবাচক দিক।



শুধু মাদক বিরোধী অভিযানের নামে মে মাসে খুন হয়েছে ১২৪ জন।যখন লিখছি তখন হয়তো আরো ২/১০ জন বেড়েছে। হত্যাকান্ড বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে মানুষের নির্ঘম আর্তনাদও বেড়ে গেছে। আজ দুটি স্কুল পড়ুয়া মেয়ের বাবার নি:শব্দ কান্না, 'আব্বু কই' প্রশ্নের পরে 'গোঙানী'র শব্দ আমরা শুনেছি।বাকী ১২৪ জনের গোঙানীর শব্দ আমাদের কানে পৌছেনি। পৌছেনি, কারণ বাকী গুলির রেকর্ড নেই। অথবা, তারা আওয়ামী পরিবারের নয়।



ক্রসফায়ার নামক বিষয়টি যে, শুধুই ঠান্ডা মাথার হত্যাকান্ড সেটা আমরা জানি এবং জানতাম। কিন্তু এটাকে বৈধতা দেয়া, অথবা উন্নয়নের বটিকা হিসেবে খাওয়ানো হয়েছে, এবং আমরা খাচ্ছিলামও। সেই ক্রসফায়ার তার অপরাধের সাক্ষী রেখে গেল একরাম হত্যাকান্ডে। এমনকি মুত্যুর মুখে দাড়িয়েও 'আমি দোষী নই' -শব্দ উচ্চারণ করার পরও, রাষ্ট্রের বাহিনী তার বেচে থাকার আকুতিকে আইনী প্রক্রিয়ার নেবার প্রয়োজন মনে করেনি। মনে করেনি, কারণ আছে। পরে লিখছি সেটা।



কয়েকদিনআগে লিখেছিলাম এক ছাত্রদল নেতার এমনি হারিয়ে যাওয়ার কথা। তার ফুটফুটে মেয়ের সাথে ছবির কথা। মিছিলে যেই শার্ট গায়ে দিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন, সেই শার্টে তার মৃতদেহের কথা। খুব কম মানুষের কাছে মসেই মৃত্যুর ক্রন্দন পৌছেছিল। অথচ, সব রক্তের দাগ লাল, সব আর্তনাদের কষ্ট একই রকম হওয়ার কথা ছিল একটি মানবিক রাষ্ট্রে।



নির্বাচনী ব্যবস্থাকে একেবারে নষ্ট করার সাক্ষী রাখা হয়েছে খুলনা নির্বাচনে। পরিষ্কার ভাবে 'নিয়ন্ত্রিত' এবং সাজানো নির্বাচনে ভোট ডাকাতিকে নির্লজ্জভাবে জায়েজ করার রাষ্ট্রীয় চেষ্টার মধ্যেও প্রমান রয়ে গেছে, কিভাবে কোন প্রক্রিয়া গনতান্ত্রিক মূল ভিত্তি 'ভোটাধিকার' নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হল এবং হবে। এটা একধরনের সাংবিধানিক চর্চার হত্যাকান্ডও বলা চলে।



এবার আসি উন্নয়নের কথায়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট একটি দৃশ্যমান উন্নয়ন, এবং সে উন্নয়নে চুরির সাক্ষী রাখা হয়েছে, বিটিআরসি চেয়ারম্যানের কথায়।' তিনি বিব্রত হয়ে বলছিলেন, 'এটা স্পর্শকাতর বিষয়, মন্ত্রনালয় জানে কিভাবে দুটি কোম্পানীকে টেরিস্টোরিয়াল ব্যবসার পূর্ণ স্বত্ত দেয়া হয়েছে'।



এমন শত প্রমান রেখে যাওয়া হত্যাকান্ড আর চুরি'র মূল প্রশ্রয়দাতা যে রাষ্ট্রের সর্বচ্চ ক্ষমতাধর ব্যাক্তিটি, সেটা না বোঝার বা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। ডেভিড বার্গম্যান সম্প্রতি তার একটি রিপোর্টে বলেছে, রাষ্ট্রপ্রধান অন্তত ২টি রাজাকার পরিবারের সন্তানদের উঠিয়ে নেয়ার নির্দেশ/সম্মতি দিয়েছেন, বলে তথ্যে পরিষ্কার হয়েছে। খুলনা নির্বাচনে সব দেখা এবং জানার পরও, তিনি আশ্চর্য হয়ে বলেছেন, 'তারা এত ভোট পেল কিভাবে'? আর ক্রসফায়ার নিয়ে শক্ত এ নেতার উক্তি 'আমি ধরলে ছাড়ি না'।



বাহ! বাহ! এবং বাহবাই পেয়েছেন তিনি, পেয়েই যাচ্ছেন। সেই বাহবা দিতে একুশে পদকধারী সংবাদকর্মীও এক পায়ে খাড়া। কিন্তু তাকে কেউ মনে করিয়ে দেয় না যে, আইন তামাদি হয় না। কেউ তাকে মনে করিয়ে দেয় না, এই রাষ্ট্রটিকে মাত্র পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আপনাকে, রাষ্ট্রটি আপনার গিলে খাওয়ার জন্য ইজারা দেয়া হয়নি। আপনি ভাবতে পারেন, এই রাষ্ট্রের অধিকর্তা আপনি, অথচ সত্য হলো, আপনি আমার এবং আমাদের বেতনের টাকায় একজন সরকারী চাকুরে মাত্র। সহজ ভাষায়, 'জনগনের চাকর'-এটা মনে করিয়ে দেয়ার লোক নেই রাষ্ট্রে।



খালেদা জিয়ার আজকের হাজতবাস এ অনেকেই বলার চেষ্টা করেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনেদিত রায় হলেও, এটা তো অস্বীকার করা যাবে না যে, খালেদা এবং তার সাঙ্গরা ২ কোটি টাকা তছরুপ করেছেন! হ্যা, সেটা অনেকটাই সত্য। ২ কোটি তছরুপ হওয়া টাকার পরিষ্কার হিসেব ছিলনা খালেদাদের কাছে। আইন তামাদি হয়নি, সে কারণেই সেই আইনের ব্যবহার করা হয়েছে রাজনৈতিক দু:সময়ে।



এখন, সুসময়, রাষ্ট্রের সর্বচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ব্যাক্তিটির। তিনি অবলিলায় তার নির্দেশের হত্যা, চুরি, আর লুটপাট এবং রাষ্ট্রের সাংবিধানিক সব প্রতিষ্ঠানকে পঙ্গু করার সাক্ষী রেখে যাচ্ছেন প্রতিটি পদে পদে।



শেষ করি, এই বলে যে, উন্নয়নের গ্রান্ড ন্যারেটিভ বা চলমান ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক অপরাধকে সামনে নিয়ে আসা এই রিজিম, বার বার ভুলে যাচ্ছে একটি মানবিক রাষ্ট গঠনের স্বপ্নের কথা। যেই স্বপ্ন ৭১ এ দেখেছিল আমাদের বাবা মায়েরা।ইয়াহিয়ার লোক দেখানো উন্নয়ন ছিল, কিন্তু মানবিক রাষ্ট্র ছিল না। ৭০ এর জলোচ্ছাসে কক্সবাজার জলসীমায় হাজারো লাশের মিছিল আর সব হারানোর কান্না ঢাকা পড়েছিল, করাচী থেকে আসা মোটর শোভাযাত্রার সেই পৃষ্টা ভরা সংবাদে।এগুলো ইতিহাসের সত্যতা।



কত বছর পেরেলো, কই মানবিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন ত পূরণ হলো না। ইয়াহিয়ার উন্নয়ন মডেল এবং গনতন্ত্রের মডেল দুটোই এখন দৃশ্যমান। কিন্তু আরেকটি বিষয়ও দৃশ্যমান আছে। সেটা হলো মুক্তির চাপা কান্না এবং আকাঙ্খা। আমি এ কারণে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আশাবাদী হই। আমি আশাবাদি হয় পরিবর্তনের জন্য। সেই পরিবর্তন, সত্যিকার অর্থেই একটি মানবিক রাষ্ট্র গঠনের পরিবর্তনের জন্যে হবে। সেইরাষ্ট্রে আইন তামাদি হবে না, ফেলে আসা সব হত্যা, খুন আর চুরির সাক্ষর ধরে ধরে বিচার হবে। কিন্তু, ক্রস ফায়ার হবে না। আইন প্রতিষ্ঠিত হবে সেই দেশে। যেই আইন, একজন অপরাধীকেও তার ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবে, মেয়ের কাছে ফিরতে দেবে, প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে ফিরতে দেবে। হয়তো অলীক স্বপ্ন, কিন্তু স্বপ্নই তো বাচায় জীবনকে। যেই জীবনে স্বপ্ন নেই, সেই জীবন মৃত্যুর চেয়েও যন্ত্রনাদায়ক!


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top