সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ঠা আশ্বিন ১৪৩১

নতুন এক ইস্যুর নাম ‘ধর্মীয় অবমাননা’ : জোবায়ের মিলন


প্রকাশিত:
১২ নভেম্বর ২০২০ ২১:১৬

আপডেট:
১২ নভেম্বর ২০২০ ২১:৫৫

 

চলমান সময়ে কিছু ঘটনা বিস্ময়ের। ঘুরছে মুখে মুখে। চায়ের দোকানে, কফির আড্ডায়, রেস্তুরাঁয়, বাসে-ট্রেনে, বাসা-বাড়িতে, পথে-ঘাটে বেশ সরব। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দোষারুপের বদভ্যাস, বিষদগারের তীক্ষ্ণ তীর অন্যদিকে সামাজিক অবক্ষয়ের পতনে পর্যবসিত। সিলেটে এমসি কলেজে ভ্রমণরত দম্পত্তিকে হেনস্থা, স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে নির্যাতন ও ধর্ষণ! বিবস্ত্র করে এক নারীকে বেদরক প্রহার, যৌনাঙ্গে টর্চলাইট ঢুকিয়ে পৈশাচিক উল্লাস ও তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া। পাহাড়ী মেয়েকে ছয়জন মিলে দলগত যৌন অত্যাচার। ডিবি পুলিশের সদস্যের দ্বারা স্কুল ছাত্রীকে প্রলোভন দেখিয়ে জোরপূর্বক সহবাস। থানা হেফাজতে রায়হানের করুণ মৃত্যু। নির্বাহী কর্মকর্তাকে রাতের অন্ধকারে ঘরে ঢুকে হাঁতুড়ি দিয়ে থেঁতলে দেওয়া। সরকারী প্রকৌশলীকে দপ্তরে প্রবেশ করে রক্তাক্ত। কক্সজবাজারে প্রদীপ সাহার দানবীয় রূপ, সিনহা হত্যা। ডিআইডি মিজান। এমপি নিক্সন কান্ড। রিফাত-মিন্নির নাটকিয় খুন ও কিশোর গ্যাংদের অপ্রতিরোধ অগ্রসর। কলাবাগনে গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীর ল্যাফটেনেন্টকে সাংসদ পুত্রের আহত করার দু:সাহস এবং সে পুত্রের অবৈধ বহু কাহিনির প্রকাশ। টিকটক গ্রুপের যাচ্ছেতাই যেন একের পর এক মগেরমল্লুকের গল্প।
এই লেখা তৈরির মুহূর্ত পর্যন্ত প্রকাশিত ঘটনার মধ্যে লালমনিরহাটে ধর্মীয় অবমাননার নামে জীবন্ত এক মানুষকে শত শত মানুষ মিলে হত্যা ও লাশ আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া পিলে চমকে দিয়েছে অসচেতন, আধা সচেতন, সচেতন মহল সকলের। কী হচ্ছে চারদিকে? খুন আর খুন এখন পান্তা ভাতের মতো সহজ। হাতের মোয়ার মতো সস্তা। চাইলেই যে কাউকে পেটানো যায়, চাইলেই যে কাউকে খুন করা যায়। খুন করতে এখন এক মিনিট সময় লাগে না। জোর করা যায়, দখল করা যায়, কেটে টুকরো টুকরো করা যায় নিমিশে। দেখার লোক আছে, জানার জন আছে, বিচারের ব্যবস্থার বল আছে। তবু কী যেন নেই। কোথায় যেন একটা শূন্যতা উঁচু হয়ে হাহাকার করছে। সে শূন্যতা পূরণ না হলে সামনের দিনগুলোর কথা ভাবাই যাচ্ছে না, চিন্তা করা যাচ্ছে না কী হবে সে দিনগুলোর রঙ।
এই যে লোকটিকে ধর্মের নামে, ধর্মের অবমাননার নামে অল্প সময়ের মধ্যে পেটানো হলো, পৌরসভা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মারা হলো, দায়িত্বরতদের কাছ থেকে লাশ ছিনিয়ে নিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হলো! কেনো হলো? লোকটি কি সত্যি ধর্মের অবমাননা করেছে? কে কে দেখেছে বা শুনেছে? যারা যারা মেরেছে সবাই কি ওই মুহূর্তে উপস্থিত ছিলো? নাকি অল্প কয়েকজন প্রত্যক্ষ করেছে? করেলেও কি আইন ছিলো না? আইনের হাতে কি সোপর্দ করা যেত না? কেনো করা হলো না? কারা করলো এ কাজ? কিসের রাগ এতো তাদের? কাদের উপর রাগ? আর যে লোকগুলো এক ডাকে জরো হলো; কিছু না জেনে, না শুনে, না বুঝে ঝাপিয়ে পড়লো, গায়ের শক্তি ও লাঠিশোটা দিয়ে আঘাত করতে থাকলো এই লোকগুলোর মানসিকতা কোন্ জায়গায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছে বা উপস্থিত করানো হয়েছে তা কি সত্যি ভেবে দেখার নয়? আইন প্রয়োগকারী ও দায়িত্বপালনকারী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অতিসত্তর এ নিয়ে গবেষনায় বসা উচিত। না হলে আশুদিনে এই লোকগুলোকে সামলানো রাষ্ট্রের পক্ষে হবে দু:সাধ্য। এমনও তো হতে পারে অন্য বিষয়ে তাদেরকে ভুল বুঝিয়ে হাতে লাঠি আর বাঁশের বদলে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেওয়া হলো তবে কি তারা কিছু রাখবে? যা নির্দেশ দেওয়া হবে তা’ই তারা করে বসবে। তখন সামলানো হবে কী দিয়ে? ঘটনা হবে ভয়াবহ।
ভাইরাল হওয়া আগুনে পুড়িয়ে মারার ভিডিওটি দেখেছি। সহ্য হচ্ছিলো না। গা শিরশির করে উঠছিলো। হার্টবিট বাড়ছিলো। চোখ স্থির রাখলাম। যে কয়েকজন গুতিয়ে গুতিয়ে আগুনে তাও দিচ্ছিলো, গোল হয়ে যারা দাঁড়িয়ে ছিলো, আপনি যদি পরখ করেন, দেখবেন প্রত্যেকে কম বয়সী তরুণ। কিশোর। পায়ে রশি বাঁধা লাশটি আগুনের মধ্যে যারা টেনে টেনে মাছের টুকরোর মতো এপিঠ ওপিঠ করছিলো তারা তো নিশ্চয় ঘটনার শুরুতে ছিলো না, এদেশীয় প্রেক্ষাপটে মসজিদে সাধারণত বয়স্করা বেশি থাকে। গ্রামে তো আরও। তা হলে ওই বয়স্ক মানুষগুলো কই? টিনেজ কিশোররা এখন বেপরোয়া, উগ্র, যা-ইচ্ছা-তা করার শক্তি রাখে বলে কি তাদেরকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে তবে? লালায় লতিয়ে ওঠা কিশোর, তরুণর কি জানে সঠিক ধর্ম কী? তারা কি ধর্মের আদ্যোপান্ত বুঝে এগিয়ে এসেছে? একটি সমাজে, সংসারে, রাষ্টে কিছু অন্যায় হয়; অন্যায় হলেই কি নির্মমভাবে হত্যা করতে হবে? রাষ্ট্র বা ধর্ম তার কোনটিই কি এর পক্ষপাতিত্ব করে? ধর্মের বিজ্ঞজন যারা তারা কি চুপটি করে থাকবেন? এ সমাজ নষ্ট হয়ে গেলে, ভুল তথ্যে, ভুল ধর্মব্যাখ্যায় ঝাপিয়ে পড়ায় অভ্যস্ত হলে কার ক্ষতি? স্বার্থের কারণে, ব্যবহারে কৌশলী হলে সে ব্যবহার তো একদিন নিজের উপরই পরতে পারে! রাষ্ট্র, ধর্ম, সমাজ চিন্তকদের এখনই হতে হবে যুথবদ্ধ। গভীর চিন্তা না করলে দু:শ্চিন্তায় একদিন স্বাস্থ্যহানী নয় গণপ্রাণহানীর সম্ভাবনা সমুজ্জ্বল।
কেউ কেউ ধর্ম আর রাষ্টকে গোপনে দুই পক্ষে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ আইনকে অপদস্ত করতে করতে আইনের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি হতে সাহায্য করছে। কেউ কেউ বিচার-ব্যবস্থাকে ভঙ্গুর করে তুলছে। কেউ কেউ প্রশাসনের ভিতর-বাহির থেকে প্রশাসনকে পঙ্গুত্বের দিকে নিচ্ছে। কেউ কেউ সমাজকে নিয়ে খেলছে, কেউ কেউ রাষ্ট আর ধর্মকে নিয়ে জুয়ার আসর বসাচ্ছে। এর পরিণতি কোনদিকে যাবে সে মাত্র পালন কর্তাই জানেন। লৌকিক লোক যে জানে না তা’ও নয়। কিসের ভয়ে যেন লোকের মুখ বন্ধ। কিসের আশায় যেন তারা দ্বিতীয় পথে চলে যাচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ডে। ঘটিয়ে ফেলছে দুর্ঘটনা। সচেতন চোখ না ফেরালে আসবে কালো কাল। কালো তমশা ঘিরে ধরবে সবদিক থেকে, ছুটে পালাবার পথ হবে রুদ্ধ। অনিরুদ্ধ আলো থমকে মরবে। আলো ছড়িয়ে পড়বে না। সে আলোয় আলোকিত হবে না একটি মুখও । গভীর অন্ধকার কেবল জেঁকে ধরবে ভালো-মন্দ সকল পক্ষকে। তাতে রাষ্ট্রই বিনষ্ট হবে না, অরাজকতার এক অসম্ভবতা তৈরি হবে ডানে-বামে চতুর্দিকে।
ইদানিং কালে ‘ধর্মীয় অবমাননা’ নতুন এই ইস্যুর নামে যে কেউ যে কাউকে নাস্তিক-আস্তিকের দ্বিধান্বিত শিরোনামে জড়িয়ে জড়িয়ে-পড়ছে তর্কে, অপমান-অপদস্তে। মেজাজ হারিয়ে ঝুকছে আক্রমনের দিকে। ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ যেমন ধর্ম নিয়ে বয়ান দিচ্ছেন, অজ্ঞজনও বক্তৃতায় ভারী করছেন আশপাশ। জানা ও অজানা যে কেউ লিপ্ত হচ্ছেন হাতাহাতি দস্তাদস্তিতে। ধর্মকে এত সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে যে, প্রয়োজন আর অপ্রয়োজন সকল কিছুতে ধর্মযুদ্ধ ভাব। ধর্মী ও বিধর্মীর মধ্যে এ যুদ্ধ নয়। স্বধর্মের মধ্যেই এই যুদ্ধাংদেহী অবস্থা। পান থেকে চুন খসলেই ধর্মের দোহাই দিয়ে ভাংচুর, মারামারি। ধর্ম তো একান্ত নিজের বিষয়। সে নয় কি? ধর্ম কি মারামারি কথাই বলে! ধর্ম কি তর্কাতর্কি, হাতাহাতির কথাই বলে! শান্তির যে ধর্ম সে ধর্মকে আজকাল পাওয়া খুব কষ্ট, কিছু ধর্মলেবাজির কারণে। হাটে বাজারে ধর্ম নিয়ে যাদেরকে দেখি সরব তাদেরকে খোঁজ করলে তাদের ধর্মশিক্ষা কতটা পাই? ধর্মে শিক্ষিত যারা তারা মায়ায় মমতায় পরিবেশ শান্ত করেন, সত্য বোঝাতে সচেষ্ট হন। তাই তো হওয়া উচিত। ধার্মীকগণ আজকে আরও সামনে এগিয়ে না আসলে সামনে এক অদ্ভুত সময় অপেক্ষা করছে বলে মনে হয়। মনে হয় রাষ্ট্রকে ভিন্নভাবে নজরদারী করতে হবে। মানুষের মানসিকতার পরিবর্তনে সচেতনা মূলক কার্য পরিচালনা করতে হবে। সাহায্য করতে হবে। দুটি ভাগে যেন ভাগ হয়ে দা কুড়াল নিয়ে সামনাসামনি না দাঁড়ায়, রক্তের বন্যায় ভেসে না যায় সেদিকে খেয়াল দিতে হবে। কেবল এক চোখে ভোটের দিকে তাকালে, গদির দিকে তাকালে, ক্ষমতার দিকে তাকালে, দীর্ঘস্থায়িত্বের দিকে তাকালে যে কোনো রাষ্টে্রুরই চলবে না; সমাজের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও দিতে হবে কড়া নজন। মানসিক পরিবর্তনের বাঁকের দিকে করতে হবে দৃষ্টিপাত। রাষ্ট্রের এখন সবচেয়ে বড় খেয়াল করা দরকার ধর্মের নামে যে চিড় ধররছে তা কী করে কমানো যায়। অবিশ্বাস হলেই- যে কাউকে মেরে ফেলার যে চিন্তা তা কী করে দূর করা যায়।
আগে দেখতাম মসজিদ সামাজিক নামাজ আদায়ের ঘর। সমাজের সব মানুষ মসজিদে নামাজ পড়তো। সামাজিক বন্ধনে মসজিদ একটা দৃঢ় বন্ধনের আশ্রয় হতো। এখনও হয়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে মসজিদকে কেন্দ্র করে এক প্রকার রাজনৈতিক অপচেষ্টাও চলে। দুষ্টু লোকেরা তা করছে। যদি ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি, ব্যবসা বা কূটকৌশল হয় তবে তা ধর্মের জন্যই অমঙ্গল। সারা পৃথিবীতে এমনিতেই মুসলিম ধর্ম নিয়ে দ্বেষ-বিদ্বেষ চলছে। ধর্মের প্রতি যেন সাধারণ মানুষের বিশ্বাস হালকা না হয় সে দিকটার দিকে ধার্মীক জ্ঞানীদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে, সমাজকে সচেতন হতে হবে। রাষ্ট্রকেও তদারকি করতে হবে তা যেন কারো ব্যবহারে অসৎ দিকে না যায়।
যে কোনো মৃত্যুই ব্যথিত করে। অন্যায় বিচলিত করে। উগ্রতা অশান্তিতে ফেলে। আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা করে শঙ্কিত। প্রতিটি বিষয় যার যার নিয়মে সঠিক পথে চলবে সে প্রত্যাশ সকলের। অযাচিত মৃত্যু যেন না হয়। অন্যায় যেন সীমা না ছাড়ায়। উদ্রতা যেন প্রশ্রয় না পায়। আইন যেন তার পথে থাকে রাষ্টকেই তা ঠিক করতে হবে। দুষ্টু লোক সবজায়গায় ছিলো, আছে, থাকবে। দুষ্টুকে দমন করার জন্যই তো আইন, আইন দেখার জন্যই তো রাষ্ট্র। মানুষের জান-মালের নিরাপত্তার ভার তো রাষ্ট্রের হাতেই। রাষ্ট যদি পিচ্ছিল পথে হাঁটতে ভয় পায়, নড়ভড় করে, তার কর্মদায়িত্ব থেকে অলস হয়ে পড়ে, একরোখা বা একদিকের পথচারী হয় তবে তা রাষ্টের জন্যই বিপজ্জনক। রাষ্ট্র নিশ্চয় সে খেয়ালে আছে, থাকবে। লালমনিরহাটের প্রকৃত সত্য উদঘাটন করে রাষ্ট দোষীদের চিহ্নিত করবে, শাস্তির আওতায় আনবে এবং এহেন নির্মম কর্মটি যে সঠিন নয় তা আইনের দ্বারা প্রচার করবে বলে আশা করি। অনুরোধ করি, ধর্ম নিয়ে যে মেজাজী এক পরিস্থির উদ্ভব হচ্ছে ধীরে ধীরে তা থেকে ফেরানোর পথ যেন রাষ্ট্র বাতলায়। ধর্মীয় গুরুরা যেন ধর্ম বিষয়ে সাধারণকে সহয়তা করেন। সাহয্য করেন। বুঝান। শান্তির নিমিত্তে শান্ত হয়ে আশ্রয় দেন, বিতারিত না করেন। বিশ্বাস করি, লালমনিরহাটের বর্বরোচিত কাজটি কোনো সঠিক ধার্মীক মানুষেদের দ্বারা ঘটেনি। যারা ঘটিয়েছে তারা সঠিক ধর্ম হতে বিচ্যুত অথবা ভুল ব্যাখ্যার দ্বারা ভ্রান্ত। এমন কান্ড যেন আর ফিরে না আসে সে প্রার্থনা করি মনেপ্রাণে। রাষ্ট্রকে বলি, উদার হোন। সজাগ হোন, আরও আরও।

 

জোবায়ের মিলন
বার্তা প্রযোজক, বার্তা বিভাগ, এনটিভি, ঢাকা।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top