বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের মুখের ওপর যে জবাব দেন বঙ্গবন্ধু
প্রকাশিত:
৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০২:০৩
আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ০৮:৩৬

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কীভাবে বিশ্বব্যাংকে কার্যত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বিকল্প অর্থায়নে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন করছেন, তা আজ আর কারও অজানা নয়। কিন্তু এখন থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে তাঁর পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও কীভাবে বিশ্ব ব্যাংকের মুখের ওপরে জবাব দিয়েছিলেন, সে কাহিনিও সম্প্রতি উঠে এলো দিল্লিতে তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) স্মরণসভায়।
ঘটনাটি ১৯৭৪ সালের অক্টোবরের। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান বঙ্গবন্ধু। হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে দুই নেতার মধ্যে দীর্ঘ বৈঠকও হয়েছিল সেবার।
ওই একই সফরে বঙ্গবন্ধুর হোটেল স্যুইটে দেখা করতে এসেছিলেন বিশ্বব্যাংকের তখনকার প্রেসিডেন্ট রবার্ট এস ম্যাকনামারা। ওয়াশিংটন ডিসি-তেই বিশ্বব্যাংকের সদর দফতর, কাজেই ম্যাকনামারা নিজেই চলে এসেছিলেন অল্প দূরের হোটেলে।
বর্তমানে দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী তখন ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশের দূতাবাসে একজন তরুণ কূটনীতিবিদ। শেখ মুজিব-ম্যাকনামারার বৈঠকে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। আর এতদিন বাদে সেই ঘটনার কথাই তিনি শোনালেন দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুর শোকসভায়।
মি. আলীর কথায়, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সেখানে বিশ্বব্যাংকের কী ভূমিকা থাকতে পারে, তা নিয়ে দুজনের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে নানা কথাবার্তা হলো। ম্যাকনামারা তার আগে বাংলাদেশ সফরও করে গেছেন। ফলে আমাদের নবীন রাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়েও তার বেশ স্বচ্ছ ধারণা ছিল।’
আলোচনার শেষে বিশ্বব্যাংক প্রধান যখন প্রায় উঠে যাচ্ছেন, তখন হঠাৎ যেন কিছু একটা মনে পড়ে গেছে, সেই ভঙ্গিতে বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে তিনি বলে উঠলেন ‘অ্যান্ড ইয়েস, মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, হোয়েন আর ইউ ডিভ্যালুয়িং ইয়োর কারেন্সি?’
কারেন্সি ডিভ্যালুয়েশন বা মুদ্রার অবমূল্যায়ন তখন স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার একটা জনপ্রিয় দাওয়াই হিসেবেই দেখা হতো। অন্তত বিশ্বব্যাংক সেরকমই মনে করতো— যুক্তি দেওয়া হতো কারেন্সি ডিভ্যালু করা হলে সে দেশের রফতানি বাড়বে, বাণিজ্য ঘাটতি কমবে এবং বৈদেশিক ঋণ মেটানোর ক্ষেত্রেও খরচটা কম হবে।
অবশ্য উল্টোদিকেও যুক্তি কম ছিল না। একটা দেশের কারেন্সি শক্তিশালী হলে তার অর্থনীতিও শক্তিশালী বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের প্রধান সম্ভবত ধরেই নিয়েছিলেন— বাংলাদেশের অর্থনীতি যেহেতু কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তাই তারা তাদের (বিশ্বব্যাংকের) পরামর্শ বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব কিন্তু প্রশ্নটা শুনে চমকালেন না। ধীর স্থির ভঙ্গিতে তিনি রবার্ট ম্যাকনামারার দিকে মুখ তুলে তাকালেন।
তারপর খুব কেটে কেটে বললেন, ‘মিস্টার ম্যাকনামারা, ইফ ইউ ওয়্যার মাই ফিনান্স মিনিস্টার ইন প্লেস অব তাজউদ্দিন আহমেদ, আই ক্যুড হ্যাভ ডান ইট টুমরো মর্নিং!’
(অর্থাৎ, তাজউদ্দিন আহমেদের জায়গায় আপনি যদি আমার অর্থমন্ত্রী হতেন, তাহলে তো কালকে সকালেই আমি আমার কারেন্সি ডিভ্যালু করে দিতাম!’)
ছোট্ট একটা বাক্য। কোনও গড়িমসি নয়, ‘ভাবছি’ বা ‘দেখা যাক’ গোছের কোনও পাশ কাটানো উত্তরও নয়। কিন্তু তাৎক্ষণিক উত্তরে বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিষয়ে তিনি কেবল নিজের অর্থমন্ত্রীর পরামর্শই শুনবেন— আর কারও নয়।
‘কিছুটা হতবাক হয়েই মি. ম্যাকনামারা এরপরই বিদায় সম্ভাষণ সেরে মিটিং থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর একটি কথাও বলতে পারেননি তিনি। মুখের ওপরে বঙ্গবন্ধুর জবাবটা তার কাছে বোধহয় এতটাই অভাবিত ছিল’, বলছিলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী।
এর বহু বছর পর বিশ্বব্যাংক যখন বাংলাদেশে পদ্মা সেতুর অর্থায়নের লক্ষ্যে সেই প্রকল্প নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে মারাত্মক দুর্নীতির অভিযোগ তোলে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অনেকটা একই রকম দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা তখন পরিষ্কার জানিয়ে দেন— বিশ্ব ব্যাংকের কোনও সাহায্য দরকার নেই। বাংলাদেশ নিজের ক্ষমতাতেই পদ্মা সেতু বানিয়ে দেখাবে। তার সেই স্বপ্নকে সত্যি করে পদ্মা সেতুর স্প্যানগুলো ধীরে ধীরে নদীর বুকে এখন মাথা তুলছে। আর বিশ্ব ব্যাংক যে দুর্নীতির কথা বলেছিল, তার কোনোটিই আজ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি।
বিশ্ব অর্থনীতির অত্যন্ত ক্ষমতাবান এক ‘প্লেয়ার’ বিশ্ব ব্যাংকের চোখে চোখ রেখে এভাবে কথা বলার ক্ষমতা যে শেখ হাসিনা সম্ভবত পৈতৃক সূত্রেই পেয়েছেন— তারই উজ্জ্বল এক বিবরণ এভাবেই সামনে এলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩-তম শাহাদাত বার্ষিকীতে!-বাংলাট্রিবিউনের সৌজন্যে।
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: