সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১


আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের প্রথম স্বর্ণপদকজয়ী জাওয়াদ


প্রকাশিত:
১৪ জুলাই ২০১৮ ০৪:২৪

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:২৪

আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের প্রথম স্বর্ণপদকজয়ী জাওয়াদ

আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাফল্য ছিল রৌপ্য জয়। ২০১৭ অলিম্পিয়াডে ২৩ পয়েন্ট নিয়ে এই পদক জিতেছিলেন আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী। তার আগের বছরও জাওয়াদ পদক জিতেছিলেন। তবে সেটা ছিল ব্রোঞ্জ পদক। আর এ বছর তো ইতিহাসই গড়েছেন চট্টগ্রামের এই ছেলে।



রোমানিয়ায় অনুষ্ঠিত ৫৯তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে (আইএমও) প্রথমবারের মতো স্বর্ণপদক জিতেছে বাংলাদেশ। দেশের হয়ে অনন্য এই সম্মান বয়ে এনেছেন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী জাওয়াদ। ৪২ নম্বরের পরীক্ষায় সব মিলিয়ে ৩২ পেয়ে স্বর্ণপদক জিতেছেন তিনি।



স্বর্ণপদক জয়ের পর জাওয়াদ মুখোমুখি হয়েছিলেন দেশের শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলোর ফেসবুক লাইভে। সেখানে উঠে আসে তার এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার নানা তথ্য। গণিত অলিম্পিয়াডে কীভাবে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত বা কী কী বই পড়া উচিত, সে সম্পর্কেও পরামর্শ দেন আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী।



প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে জাওয়াদ বলেন, ‘আমার আসলে অনেক ভালো লাগতেছে। যখন প্রথম গণিত অলিম্পিয়াড দেই তখন আশা করতে পারিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আসব। আর সেখানে স্বর্ণপদক পাওয়ার কথা তো চিন্তাতেও ছিল না। সত্যি কথা বলতে এমন একটি পর্যায়ে এসেছি বা আসতে পেরেছি এবং স্বর্ণপদকটা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছি দেশ হিসেবে।’



এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ গ্রহণ জাওয়াদের। ২০১৬ সালে ব্রোঞ্জ, ২০১৭ সালে রৌপ্য, আর এবার স্বর্ণ। কোন কোন বইগুলো পড়ে তিনি প্রস্তুতি নিয়েছেন জানতে চাইলে জাওয়াদ বলেন, ‘আমার গণিতে প্রথম আগ্রহ জন্মায় ধাঁধা থেকে। পরবর্তীতে প্রাইমারি ম্যাথ ক্যাম্প করে বুঝতে পারি আসলে আমার অনেক কিছু করার আছে। তখন আমি প্রথমেই ক্লাস সিক্স থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত গণিত বইগুলো শেষ করি। কারণ ওখানেই বেসিক সব কিছু দেওয়া আছে। এরপর জাফর ইকবাল স্যারের “গণিত এবং আরো গণিত” বইটা পড়ি। তারপর জুনিয়র থেকে ন্যাশনাল ক্যাম্পের সময় বেশ কিছু ইংরেজি বই পড়েছি। যেমন আর্ট এন্ড ক্রাফট অব প্রবলেম সল্ভিং স্ট্র্যাটেজি, জিওমেট্রিক রিভিসিটেড। এই বইগুলো প্রতিটিই অসাধারণ এবং বেশ সহজ ভাষায় লেখা এবং এগুলো পড়ে বোঝা যায় কীভাবে চিন্তা করতে হবে এবং কীভাবে সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে।’



এই গণিতের জন্য কতটা সময় ব্যয় করতেন জাওয়াদ? সে সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘স্কুলে পড়াশোনার জন্য যথেষ্ট সময় দিতাম। প্রতি সপ্তাহে নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য অঙ্ক করতাম। তখন আসলে দেখা যেত, আধা ঘণ্টার জন্য হয়তো একটা অঙ্ক নিয়ে বসেছি কিন্তু সেটা সমাধান করতে করতে দুই-তিন ঘণ্টা লেগে গেছে। যখন আইএমওতে চান্স পাই, তখন দৈনিক চার-পাচ ঘণ্টা বা তার চেয়েও বেশি সময় দিতাম। এ ছাড়া অনেক বেশি কন্টেস্ট করতাম। কারণ আইএমওতে চার ঘণ্টা পরীক্ষা দিতে হতো। তাই বেশি করে করতাম।’



এবার প্রস্তুতিটাও বেশ ভালো ছিল বলে জানান জাওয়াদ। তার ভাষ্য, ‘এবার প্রিপারেশন বেশ ভালো ছিল। আশা করছিলাম আমি এবার বেশ ভালো করব। কিন্তু আসল সত্যি কথা হচ্ছে, আমাদের আইএমওতে খুব ভালো প্রিপারেশন নিয়েও খুব বেশি লাভ নেই।  কারণ এখানে আমাদের করতে হয় প্রবলেম সল্ভিং টেস্ট। তো অনেক ভালো ভালো দেশের যে কেউ হোঁচট খেয়ে যেতে পারে। আমি আশা করছিলাম এটা যেন না হয়।’





৫৯তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণকারী ৬ সদস্যের বাংলাদেশ দল। ছবি: সংগৃহীত

আইএমওতে নিজের পরীক্ষা নিয়ে জাওয়াদ বলেন, ‘আমি আসলে এক আর দুই আগে শেষ করি। এরপর প্রায় দুই ঘণ্টার মতো সময় ছিল হাতে। তখন তিন নম্বর সমস্যা ধরি। তিন নম্বর অঙ্কটা আইএমওর সবচেয়ে বড় সমস্যা। তবে আমি চেষ্টা করেছি। কোনটা ধরে এগোলে কি হয় তা নিয়ে ভেবেছি। এই সমস্যা অনেকে সমাধান করতে চার ঘণ্টাও লেগে যায়।



আমার একটা আইডিয়া সুন্দরভাবে কাজ করছে। অবশ্য একেবারে শুরুতে আরও একটা আইডিয়া ছিল। যেটা আমি লিখে দিয়ে এসেছি, সেটার পর প্রথম আইডিয়াটা ব্যবহার করতে পারলে পুরো সমস্যার সমাধানটাই হয়ে যেত। কিন্তু পরীক্ষার মধ্যে আসলে সেটা করা সম্ভব হয়নি।’



নিজের কৌশল সম্পর্কে জাওয়াদ বলেন, ‘আমার স্ট্র্যাটেজি ছিল, এক দুই আগে করব এরপরে তিন। প্রথম দিন জ্যামিতি সহজ ছিল। তাই আমার খুব বেশি সময় লাগেনি। আমার কিছু সময় লেগেছে দুই নম্বর সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে। কারণ দুই অনেক লম্বা আর অনেক কিছু দেখাতে হয়। আর বাকি যা সময় ছিল তা তিনের পেছনে দিয়েছি। দ্বিতীয় দিন কম্বিনেটরিক্স ছিল, এটা আমার খুব পছন্দের বিষয়। কিন্তু দ্বিতীয় দিনের এই সমস্যাটা অনেক কঠিন ছিল, এক ঘণ্টারও বেশি লেগে যায়। অনেক নার্ভাস ছিলাম। কিন্তু যখন দাবার সঙ্গে এর মিল দেখেছি, তখন খুব সহজেই সমাধান করতে পেরেছি।’



বাংলাদেশের ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোতে কী কী ঘাটতি আছে জানতে চাইলে জাওয়াদ বলেন, ‘আমাদের ক্যাম্পগুলোতে হয়তো আরও একটু ভালোভাবে ট্রেইন দিলে আমরা সামনে আরও ভালো করব। যেমন বীজগণিত অথবা নাম্বার থিউরির কিছু অংশ পরীক্ষায় আসে যেগুলো আমাদের সিলেবাসের বাইরে। যেখানে উচ্চতর গণিতের আইডিয়াগুলো ব্যবহার করে সেখানে কাজ করতে হয়।



সিলেবাসের বাইরে বলতে আইএমও সিলেবাসের বাইরে। তবে বাংলাদেশের সিলেবাসের সাথে কিছু মিল আছে। যেমন ভেক্টর, আরেকটা ব্যাপার আছে লিনিয়ার অ্যালজেব্রা। আমাদের বাংলাদেশের বইগুলোতে এর কিছুটা দেওয়া আছে। কিন্তু সেগুলো আসলে সেভাবে পড়ানো হচ্ছে না, বিশেষ করে কলেজগুলোতে। আমরা যদি এগুলোর কনসেপ্ট ঠিকভাবে ধরতে পারতাম, তাহলে হয়তো আমরা আরও ভালো করতে পারতাম।’



এ সময় ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, ড. কায়কোবাদ, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালদের ধন্যবাদ জানান জাওয়াদ। তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমত ধন্যবাদ দিতে চাই প্রথম আলো-ডাচবাংলা ও গণিত অলিম্পিয়াড কমিটিকে। কারণ তারাই এটাকে সম্ভব করেছে। আর বিশেষ ধন্যবাদ দিতে চাই শ্রদ্ধেয় ড. জামিলুর রেজা স্যার, কায়কোবাদ স্যার, জাফর ইকবাল স্যার ও মুনির হাসান স্যার। আরও ধন্যবাদ দিতে চাই, ভলিন্টিয়ার যারা আছেন এই ম্যাথ অলিম্পিয়াডে।’



ধন্যবাদের পাশাপাশি নিজেদের সীমাবদ্ধতাও তুলে ধরেন জাওয়াদ। তিনি বলেন, ‘আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, এই এক জায়গাতেই যে স্বর্ণপদক বিজয় হইছে তা কিন্তু না, ১৪ বছর ধরেই আমরা এগিয়ে আসছি এই মুহূর্তের জন্য। তো এই ১৪ বছরে যারাই এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন বিশেষ করে ক্যাম্পে যারা ট্রেনিং করিয়েছেন তাদের সকলকেই ধন্যবাদ। আসলে বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে তো আমরা বড় বড় ট্রেইনার আনতে পারি না। আমাদের যেটা করতে হয়, এক জেনারেশন একটু করে পরের জেনারেশনকে শেখায়। এভাবেই আমাদের বৃদ্ধি হয়েছে। প্রথমবার যেমন এই প্রতিযোগিতায়  তিন মার্ক পেয়েছিল বাংলাদেশ, এবার সেই বাংলাদেশই পেল ৩২ মার্ক।’



নতুনদের জন্য জাওয়াদের পরামর্শ ছিল এ রকম, ‘ছোট যারা বিভিন্ন ধাঁধা বা ইন্টারেস্টিং কিছু দিয়ে গণিতের মজা বোঝা। আর জুনিয়রদের লেভেলের জন্য প্রথমে সেকেন্ডারি লেভেলের বই মানে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিশেষ করে পুরনো বইগুলো, কারণ ওইগুলোতে অনেক বিশদ আকারে দেওয়া আছে। এখনকার বইগুলো অনেক সংক্ষিপ্ত করে লেখা। বেসিক এই কন্সেপ্ট ক্লিয়ার হওয়ার পর আর্ট এন্ড ক্রাফট অব প্রব্লেম সল্ভিং, বিভিন্ন সাবজেক্ট ওয়াইজ বই, যেমন নাম্বার থিউরির জন্য ১০৪ নাম্বার থিউরি প্রব্লেম, জিওমেট্রির জন্য জিওমেট্রি রিভিসিটেড। বাংলাতেও বেশ কিছু ভালো বই আছে, যেমন মোহতাসিম মীমের সংখ্যাতত্ত্ব পড়া যেতে পারে। এ ছাড়া আগের আসরের প্রশ্নগুলোও সল্ভ করা যেতে পারে।’


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top