সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১


লিবিয়ায় বন্যা : হাজার হাজার মানুষ সমুদ্রে ভেসে গেছে


প্রকাশিত:
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০০:০৮

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:২৫

 

পূর্ব লিবিয়ার স্বঘোষিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ওসামা হামাদ জানিয়েছেন, বন্যা ও ঝড়ে অন্তত দুই হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এ ছাড়া এখনো নিখোঁজ আছে হাজার হাজার মানুষ। দেরনাকে দুর্যোগপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে বলে তিনি জানান। স্থানীয় কর্মকর্তারা বলছেন, পানির স্রোতে পুরো এলাকা সমুদ্রে ভেসে গেছে।
লিবিয়ায় উদ্ধারকারী দল সাগর থেকে মৃতদেহগুলো উদ্ধার করতে হিমশিম খাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শহর দেরনার অ্যাম্বুল্যান্স কর্তৃপক্ষের মতে, কমপক্ষে দুই হাজার ৩০০ জন নিহত হয়েছে।

গত সপ্তাহে গ্রিসে আঘাত হানার পর, ঝড় ড্যানিয়েল রবিবার ভূমধ্যসাগরের ওপর দিয়ে চলে যায়। অতি শক্তিশালী নিম্নচাপের ফলে ভারি বর্ষণে গেল সপ্তাহে গ্রিসেও ভয়াবহ বন্যা হয়।
এ ধরনের আবহাওয়া গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়, আটলান্টিকের হারিকেন এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় টাইফুনের মতো। ড্যানিয়েলের আঘাতে দেরনায় দুটি বাঁধ এবং চারটি সেতু ভেঙে পড়ে। ফলে শহরের বেশির ভাগ অংশ ডুবে যায়। রেড ক্রিসেন্ট বলছে, এখন পর্যন্ত ১০ হাজার মানুষ নিখোঁজ রয়েছে।
মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

মিসরসহ অন্য কিছু দেশ থেকে সাহায্য আসতে শুরু করেছে লিবিয়ায়। কিন্তু লিবিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে উদ্ধার প্রচেষ্টা ব্যাহত হচ্ছে। কারণ দেশটি দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী সরকারের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। লিবিয়া রাজনৈতিকভাবে পূর্ব এবং পশ্চিম দুই ভাগে বিভক্ত।
২০১১ সালের বিদ্রোহে দীর্ঘ সময়ের শাসক গাদ্দাফির পতন এবং পরে নিহত হওয়ার পর থেকে লিবিয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের অভাব রয়েছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইরান, ইতালি, কাতার এবং তুরস্ক বলেছে, তারা সাহায্য পাঠিয়েছে বা পাঠাতে প্রস্তুত। রবিবার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বন্যার পানি শহরের মধ্যে প্রবেশ করেছে এবং স্রোতে মানুষ, গাড়িসহ সব ভেসে যাচ্ছে। ফলে হাজার হাজার মানুষ সমুদ্রে ভেসে যায় এবং অন্যরা বাঁচার জন্য বাড়ির ছাদে আশ্রয় নেয়। চারদিকে ভয়াবহ এক পরিস্থির সৃষ্টি হয়।

লিবিয়ার পূর্ব দিকের সরকার হিশাম চকিউয়াত বলেছেন, ‘আমি যা দেখেছি তাতে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম, এটা ঠিক সুনামির মতো।’ তিনি বিবিসি নিউজআওয়ারকে বলেছেন, দেরনার দক্ষিণে একটি বাঁধ ভেঙে যাওয়ার ফলে শহরের বড় অংশ সমুদ্রে টেনে নিয়ে গেছে। বিশাল এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে। এলাকাটির প্রচুর ক্ষতি হয়েছে, যা প্রতি ঘণ্টায় শুধু বাড়ছে।’

বায়দা শহরের একজন ত্রাণকর্মী কাসিম আল-কাতানি সংবাদ সংস্থা বিবিসিকে বলেছেন, উদ্ধারকারীদের জন্য দেরনায় পৌঁছানো বেশ কঠিন ছিল। কারণ শহরের বেশির ভাগ প্রধান প্রধান সড়ক ভেঙে পড়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় কেন এমন ধ্বংসযজ্ঞ ঘটল, তা বের করতে তদন্ত শুরু করা হয়েছে। ত্রাণকর্মী কাসিম আল-কাতানি অরো বলেন, দেরনা এবং পূর্বাঞ্চলীয় শহর বেনগাজি পুনর্নির্মাণের জন্য ২.৫ বিলিয়ন লিবিয়ান দিনার দেওয়া হবে।

কাতানি জানান, দেরনায় বিশুদ্ধ খাবার পানি নেই। চিকিৎসাসামগ্রীরও অভাব রয়েছে। তিনি আরো যোগ করে বলেন, দেরনার একমাত্র হাসপাতালটিতে রোগী ধারণের জায়গা নেই। কারণ হাসপাতালে ৭০০টিরও বেশি মৃতদেহ জড়ো করা হয়েছে। হাসপাতালটি খুব বেশি বড় নয়।

এদিকে রবিবারের ঝড়ে দেশটির সোসা, আল-মারজ এবং মিসরাতা শহরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বিবিসিকে বলেছেন, সম্ভবত শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার (আট মাইল) দূরে অবস্থিত বাঁধটি প্রথমে ভেঙে পড়ে। ফলে পানি নদী উপত্যকা থেকে দ্বিতীয় বাঁধের দিকে চলে যায়। যেটি দেরনার কাছাকাছি অবস্থিত। ফলে দেরনার সঙ্গে আশপাশের এলাকাগুলোও প্লাবিত হয়েছিল।

রাজা সাসি নামে একজন স্থানীয় বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু মধ্যরাতে আমরা প্রচণ্ড একটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। পরে দেখি বাঁধটি ভেঙে গেছে।’

লিবিয়ার সাংবাদিক আব্দুল কাদের আসাদ বলেন, লিবিয়া রাজনৈতিকভাবে পূর্ব এবং পশ্চিম দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ার কারণে উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হচ্ছে।
তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘এমন লোক আছে যারা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে কিন্তু সাহায্য আসছে না। লিবিয়ার কোনো উদ্ধারকারী দল নেই, কোনো প্রশিক্ষিত উদ্ধারকারীও নেই। গত ১২ বছরে সব কিছুই ছিল শুধু যুদ্ধ নিয়ে।’ তবে বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও, ত্রিপোলিতে সরকার ১৪ টন চিকিৎসাসামগ্রী, ব্যাগ এবং ৮০ জনের বেশি ডাক্তার এবং প্যারামেডিকসসহ একটি বিমান পাঠিয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির জরুরি বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর ব্রায়ান ল্যান্ডার বলেছেন, সংস্থাটির কাছে পাঁচ হাজার পরিবারের জন্য খাদ্য সরবরাহ রয়েছে।

উপকূল বরাবর বেনগাজি থেকে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পূর্বে দেরনা এলাকাটি উর্বর জাবাল আখদার অঞ্চলের নিকটবর্তী পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত। গাদ্দাফির পতনের পর এই শহরটি একসময় জঙ্গিদের দখলে চলে গিয়েছিল। সেখানে ইসলামিক স্টেট গ্রুপের জঙ্গিরা আস্তানা গড়ে তোলে। এর কয়েক বছর পর জেনারেল খলিফা হাফতারের অনুগত বাহিনী লিবিয়ার ন্যাশনাল আর্মি (এলএনএ) তাদের বিতাড়িত করেছিল।

জেনারেল খলিফা হাফতার বলেন, পূর্বাঞ্চলীয় কর্মকর্তারা বর্তমানে বন্যার কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানার চেষ্টা করছে। উদ্ধার অভিযানে সহায়তার জন্য রাস্তা পুনর্নির্মাণ এবং বিদ্যুৎ পুনরুদ্ধারের চেষ্টাও করছে।

লিবিয়ার নেতৃস্থানীয় আল-ওয়াসাত নিউজ ওয়েবসাইট বলেছে, বছরের পর বছর ধরে চলা সংঘাতের ফলে দেরনায় সঠিকভাবে পুনর্নির্মাণ এবং অবকাঠামো ধরে রাখতে পারেনি। তাই সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। দেশটির অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ আহমেদকে উদ্ধৃত করে তারা আরো বলেছে, ‘নিরাপত্তা, বিশৃঙ্খলা এবং অবকাঠামোগুলোর দিকে গুরুত্ব দেয়নি লিবিয়ার কর্তৃপক্ষ। ফলে এই বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে।’


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top