সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১


মসজিদ-মন্দিরে যেখানে শুধু এক দেয়ালের ফারাক


প্রকাশিত:
১৯ মে ২০১৯ ১৯:৩৩

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:৫৯

মসজিদ-মন্দিরে যেখানে শুধু এক দেয়ালের ফারাক

ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের সংরুর জেলা। এখানকার মালেরকোটলা একদিকে মুসলিম অধ্যুষিত একটি শহর, অন্যদিকে এ শহরের সমসন্স কলোনিতে মূলত সব হিন্দু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর বাস। আবাসিক এলাকাটিতে কয়েক পরিবার শিখ সম্প্রদায়ের লোকজন থাকলেও একটিও মুসলিম পরিবার নেই। তারপরও বছরের পর বছর ধরে শহরটির ধর্মীয় সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের পরিচায়ক হয়ে পাশাপাশি অবস্থান করছে আকসা মসজিদ এবং লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির।



আকসা মসজিদের আঙিনায় থাকা বিশাল বেলপত্র গাছের পাতা লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দিরের শিবলিঙ্গ সাজানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি আর প্রার্থনার গুঞ্জন শেষ হওয়ার পরই শুনতে পাওয়া যায় মসজিদ থেকে আসা আজানের সুর।



মসজিদ প্রধান রোজই প্রতিবেশী মন্দিরের পুরোহিতকে ‘রাম রাম’ ভুলে অভিবাদন জানান। অন্যদিকে পণ্ডিত মহাশয় সতর্ক নজর রাখেন যেন পবিত্র রমজান মাসে মসজিদে আসা মুসল্লিদের কোনো অসুবিধা না হয়। দীপাবলি আর ঈদে এই দুই ধর্মীয় উপাসনালয়ে মিষ্টি আর ফলমূল উপহার হিসেবে আদান-প্রদান হয়ে থাকে।



সমসন্স কলোনির অধিবাসীদের মতে, শুধু মসজিদ আর মন্দিরের মধ্যকার একটি নয় ইঞ্চি পুরু দেয়ালটিই নয় এর চেয়েও বড় অংশিদারিত্ব আছে তাদের মধ্যে। সেটি হল ‘প্রতিবেশীর জন্য ভালোবাসা’, এমন এক বন্ধন যা কোনো ‘রাজনীতিক বা নির্বাচন’ আলগা করতে পারবে না।



মন্দিরের ২৬ বছর বয়সী তরুণ পুরোহিত চেতন শর্মা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ‘এখানকার পরিস্থিতি অনেকটা রামায়ণের অযোধ্যার মতোই। কিন্তু এটা আমাদের শান্তি আর ভালোবাসায় ভরা অযোধ্যা। এখানকার শান্তি কেউ নষ্ট করতে পারবে না।’



‘নির্বাচন আর নেতা দিয়ে কি আসে যায়, এরা তো আসবে যাবে। কিন্তু প্রতিবেশীর সঙ্গে তো রোজ থাকতে হয়, প্রতিদিনই একজনের আরেকজনকে দরকার পড়ে।’



পুরোহিতের পাশে বসে সমবয়সী তরুণ মৌলভী মোহাম্মদ হাসিম সুর মেলালেন প্রতিবেশীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে মন্দির-মসজিদ নিয়ে আলোচনা করি না। কেউ আমাদেরকে এসব নিয়ে উস্কানি দিতে পারে না। আমরা প্রতিদিনই একে অপরকে সাহায্য করি, শুভেচ্ছা জানাই। মই থেকে শুরু করে পানি, আমরা সবই ভাগ করে ব্যবহার করি।’



প্রতিবারই নির্বাচনের আগে ধর্মকে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে কোনো না কোনো ধরনের ভাঙচুর বা ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেগুলো আঁচড় কাটতে পারেনি এই মন্দির আর মসজিদের মানুষগুলোর বন্ধনে।



আকসা মসজিদের প্রধান মোহাম্মদ সাব্বির (৩৭) বলেন, ২০১৬ সালে পবিত্র কুরআন বিনষ্ট করার ঘটনায় ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও ঘটেছিল ভারতজুড়ে। ওই সময় এলাকার হিন্দু এবং শিখ সম্প্রদায়ের সবাই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।



‘হিন্দু আর শিখ ভাইরা সেদিন মসজিদের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। আমাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে পাহারা দিয়েছিলেন। অন্তত এই কলোনিতে কোনো উত্তেজনা হয়নি,’ বলেন তিনি।



মসজিদ প্রধানের সঙ্গে একমত পোষণ করে পন্ডিত শর্মা বলেন, ‘নেতাদের তো কাজই যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়া। তারা মাঝখান দিয়ে শুধু স্বার্থ হাসিল করে নেয়। এখানেও আশপাশে ধর্মীয় নিদর্শন ভাঙচুর এবং কারফিউ জারির মতো ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেজন্য আমরা কখনো নিজেদের মধ্যে কথা বন্ধ করি না। আবার নির্বাচন নিয়ে আলোচনাও করি না।’



এই শান্তি যেন কখনোই বিঘ্নিত না হয়, সেজন্য মসজিদ ও মন্দির কর্তৃপক্ষ নিজ নিজ প্রাঙ্গণে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়েছে। ‘বাইরের লোক ঝামেলা করবে আর তখন দোষ যাবে মসজিদের ওপর। তাই আমরা দু’পক্ষই ক্যামেরা লাগিয়ে নিয়েছি,’ বললেন শর্মা।



বলা হয়ে থাকে, আকসা মসজিদটি অন্তত অর্ধশতাব্দী পুরনো। তখন এই সমসন্স কলোনির জন্মও হয়নি। তবে লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল অনেক পরে, ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি।



ধর্মীয় সম্প্রীতির উদাহরণ দিতে গিয়ে পন্ডিত শর্মা সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি ছিল দেখার মতো। মসজিদের মুসলিম ভাইয়েরা আমাদেরকে এবং মন্দিরে আসা পুণ্যার্থীদের চা-নাস্তা দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন। আমরাও তাদেরকে দীপাবলি, দশেরাসহ সব পূজা-অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাই।’



এমনকি মন্দিরের নির্মাণ কাজের সময় পানি এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ করে সহায়তা করেছিল মসজিদ কর্তৃপক্ষ। এখনো মন্দিরে প্রতিমা স্থাপনা থেকে শুরু করে যে কোনো আয়োজনে নাস্তার ব্যবস্থা মসজিদই করে। ‘‘দু’টোই তো ঈশ্বরের আবাস। তুমি যার জন্য খুশি ভোট দাও, শুধু রাজনীতি ঢুকিয়ো না এখানে,’’ বলেন মসজিদ প্রধান সাব্বির।


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top