সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

গলির ধারের ছেলেটি: আশরাফ সিদ্দিকী'র সফল ট্রাজেডি : রহমান মাজিদ


প্রকাশিত:
১৫ জুন ২০২০ ২৩:০২

আপডেট:
১৬ জুন ২০২০ ০১:০৮

 

করোণার বিষ ফণার নিচে যখন স্তব্ধ পৃথিবীর জীবনাচার, কর্মমুখি মানুষকে গৃহভ্যন্তরে লুকিয়ে রেখে ক্লান্তিহীন বয়ে যাচ্ছে সময়ের কাঁটা, তখন মানবীয় জীব হিসাবে জরুরী মানবিক দায়িত্ব পালনে আমাকে যেতে হয় ব্যাংকিং সেবা দিতে। পথে ঘাটে কোন জনমানুষের চিহ্ন পর্যন্ত নাই। শহুরে কুকুরগুলো রাজপথ দখলে নিয়ে দেদারসে ঘুমাচ্ছে। অফিস থেকে ফেরার সময় মিরপুর দুই নাম্বার ওভার ব্রিজের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতেই দেখি জীর্ণ চেহারার দশ বারো বছরের একটা ছেলে বসে আছে ধুলোর চাদরে । আমাকে দেখেই কাঁচুমাচু মুখ করে কাঁদো কাঁদো গলায় কিছু খাবার চাইল। মানিব্যাগ খুলে একশত টাকার একটা নোট বের করে হাতে ধরিয়ে হাঁটতে শুরু করতে যাব ঠিক তখনই ছেলেটা নিচু হয়ে পায়ের উপর পড়ে সালাম করল। সাথে সাথে আমার মন চলে গেল ডঃ আশরাফ সিদ্দিকীর "গলির ধারের ছেলেটি" নামক বিখ্যাত সেই গল্পের গভীরে।

বাংলা সাহিত্যের মহারাণীকে যারা নানাবিধ অলংকারে সুসজ্জিত করেছেন, তাদের মধ্যে আশরাফ সিদ্দিকী অন্যতম। মহারাণীর কন্ঠে তালিব মাষ্টার নামে যে কাব্যিক হার তিনি পরিয়েছেন তার জ্যোতির্ময় আভায় বিদূরিত হয়েছে বিষয়ের সঙ্কট ও আঙ্গিকের আঁধার। অপরদিকে কথা সাহিত্যে মানিক বাবু, শরৎ বাবুর মতো শিল্পীরা যেখানে আশ্রয় নিয়েছেন গ্রামীণ দরিদ্র্য সমাজের করুণ কাহিনি নির্ভর অনুসঙ্গের, আশারাফ সিদ্দিকী সেখানে বেঁছে নিয়েছেন ক্ষুধাক্লিষ্ট শহুরে পথশিশুদের রুঢ় বাস্তবতা। ইট পাথরের শহরে সুউচ্চ দেয়ালঘেরা প্রাসাদে থাকতে থাকতে মানুষের মনটাও হয়ে যায় পাথরের মত নির্মম। এক দিকে রাশি রাশি খাবার ফেলে দেয়া হয় ডাষ্টবিনে অন্যদিকে পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য গলির ধারে, পথের মোড়ে, ঘুপচি ঘাপচার  ভিতরে বসবাসরত মানুষেরা কুকুরের সাথে লড়াই করে সেই খাবারের জন্য। ঠনঠনে সেই পাথরের ভিতর থেকে সুমিষ্ট দ্রাক্ষারস বের করে আনতে আশরাফ সিদ্দিকী যে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন, বাংলা সাহিত্যে শামসুর রাহমান ছাড়া আর কারো পক্ষে তা সম্ভব হয়েছে বলে আমার জানা নাই। এখানেই একজন শিল্পীর সার্থকতা।

“গলির ধারের ছেলেটি" গল্পে তিনি যে সার্থক ট্রাজেডি এঁকেছেন, বাংলা সাহিত্যের সুনীল আকাশে তা এক অনন্য আসন অলংকৃত করে থাকবে সুদীর্ঘকাল, তাতে কোন সন্দেহ থাকার ক্ষুদ্রতম অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি না। ট্রাজিক কাহিনি সংশ্লিষ্ট সাহিত্য বলতে পাঠক, সমালোচক এবং বোদ্ধামহলগন সাধারণত শেকসপিয়ারের হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, ওথেলো, বা কিং লেয়ারকেই বুঝে থাকেন । অথচ একথা জনশ্রুতি আছে যে নাট্যকার টমাস কিড তাঁর বিখ্যাত নাটক "দ্যা স্প্যানিশ ট্রাজেডি" তে যে ট্রাজেডি অংকন করছেন তার কমবেশি অনুসৃত হয়েছে শেকসপিয়ারীয় ট্রাজেডিগুলোতে। টমাস কিড তখন নতুন ঘরানার রিভেঞ্জফুল ট্রাজেডির নানারকম পরিক্ষা-নিরিক্ষা করছিলেন। শেকসপিয়ারীয় নাটকগুলোতেও রিভেঞ্জ ট্রাজেডির উপস্থিতি লক্ষণীয়। কিন্তু আশরাফ সিদ্দিকী রিভেঞ্জ নয় ঘটিয়েছেন ব্যক্তিক ট্রাজেডির সার্থক রুপায়ন। গল্পের অন্তর্নিহিত ট্রাজেডিটা এতই বেদনাদায়ক যে তাতে প্রভাবিত হয়ে এর কাহিনি অবলম্বনে সুভাস দত্ত নির্মাণ করেছেন "ডুমুরের ফুল" নামক ফুল বাংলা সিনেমা। গল্পের কাহিনি এগিয়েছে এভাবে

"দশ বারো বছরের একটি ছেলে লাড় মিয়া। তার ডান হাতটি জন্মগতভাবে অকেজো। মা-বাবা, ভাই-বোন বলতে সংসারে তার কেউ নাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ এবং ঢাকা মেডিকেল এলাকায় ভিক্ষা করে বেড়ায় সে। ছেলেটা ভিক্ষার দারুণ একটা কৌশল আয়ত্ত করছে, কেউ ভিক্ষা না দিলে তার পায়ে ধরে সালাম করে। ফলে সবাই তাকে ভিক্ষা দেয়। গল্পটা উত্তম পুরুষে লেখা বিধায় কাহিনি চরিত্রে লেখক নিজেই উপস্থিত। ঢাকা মেডিকেলের পাশে একটা দোকানের নিচে বস্তা টাঙিয়ে সেখানেই রাত্রি যাপন করে সে। বেশ কয়েকদিন ছেলেটাকে না দেখে লেখক একটু মনোকষ্টে ভোগেন কারণ এরই মধ্যে ছেলেটার সাথে লেখকের একটা ভাব তৈরি হয়ে গিয়েছে। কয়েকদিন পরের কথা, লেখক একদিন মেডিকেলে ভর্তি তার এক বন্ধুকে দেখার জন্য গেলে কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে যায় লাড় মিয়ার সাথে। লাড়ের গায়ে হাসপাতালের ধবধবে পোষাক। দুধের মতো শাদা বিছানা। স্প্রিং এর খাটে ঘুমায় আর হাসপাতালের স্বাস্থকর খাবার যেমন পাউরুটি, কলা, ডিম, পুডিং, মাছ, মাংস ইত্যাদি মনের আনন্দে খায় আর এ বেড থেকে ও বেডে রোগীদের আশে পাশে ওয়ার্ডের চিপায় চাপায় ঘুরে বেড়ায় আর গুনগুন করে গান গায়। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলে কেউ একজন এখানে ভর্তি করে দিয়েছে বলে আলাপচারিতায় লেখককে জানায় সে। লাড় এখন হাসপাতাল থেকে যেতে চায় না। কারণ এখানকার মতো দামি খাবার আর বিছানা সে কোথায় পাবে?। রোকেয়া নামক একজন সেবিকা লাড়-কে খুব ভালবাসে, আদর করে, যত্ন নেয়। রোকেয়ার মা-বাবা মারা যাবার পরে একমাত্র ছোট ভাইটিকেও হারিয়ে ফেলে। ফলে লাড়ের ভিতরে সে তার ছোট ভাইকে খুঁজে পায়। তাই সে লাড়ের জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে চকোলেট নিয়ে আসে। এত আদর ভালবাসা লাড়-কে বেহেস্তের সুখানুভূতি এনে দেয়। লাড় তো বেহেস্তেই ছিল, আদি পিতা-মাতা আদম হাওয়ার নিষিদ্ধ গন্দম খাওয়ার অপরাধে সেখান থেকে বিতাড়িত হয় তারা। ইস! তারা যদি ঐ নিষিদ্ধ গন্দম না খেত তবে পৃথিবীতেও আসতে হতনা  ভিক্ষাও করতে হতনা। লাড় এখন পুরোপুরি সুস্থ। হাসপাতালের বড়ো কর্মকর্তা তাকে ডিসচার্জ করার জন্য রোকেয়াকে চাপ দেয়। বুঝতে পেরে লাড় ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো দিয়ে নিজের পা কেটে ফেলে যাতে তাকে রিলিজ না দেয়া হয়। মাসখানেক পরে আবারো সেই বড়ো কর্মকর্তা এসে লাড়ের ফাইলটা দেখে রোকেয়া-কে ধমকায় তাকে এখনও ডিসচার্জ না করার জন্য। রোকেয়ার মন খারাপ। লাড়-কে ডেকে বলে তাকে চলে যেতেই হবে। এখানে কেউ সারাজীবন থাকেনা। লাড় আবার হাসপাতালে থাকার সুতো খুঁজতে থাকে। রোকেয়ার পিছে পিছে ঘোরে আর ঔষধের বোতল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে কোনটার কোন কাজ। তাকের তৃতীয় নাম্বার বোতল দেখিয়ে আবার জিজ্ঞেস করে ওটা খেলে কি হয়। রোকেয়া বিরক্ত হয়ে জবাব দেয় "ওটা খেলে কোনদিন হাসপাতাল থেকে বাড়ি যেতে হয় না। লাড় মুখস্ত করতে থাকে তৃতীয় নাম্বার বড়ো কালো বোতলটা। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে লাড় আস্তে আস্তে গিয়ে সেই বোতলের পুরো ঔষধ ঢক ঢক করে গিলে ফেলে। আসলে বোতলটা ছিল টিংচার আয়োডিনের। ঔষধের তীব্র ঝাঁজে তার ঠোঁট মুখ জিহবা ঝলসে যায। মুহূর্তে পেটের ভিতরের নাড়ি ভুঁড়ি ছিঁদ্র হয়ে লাড়ের মৃত্যু হয়। লাড়ের শেষ পরিণতিতে ওয়ার্ডের সবাই চৌদ্দ নাম্বার বেডের পাশে জড়ো হয়ে বলাবলি করে  লাড় আত্মহত্যা করেছে। রোকেয়া তখন কাঁদতে কাঁদতে জানায় লাড় আত্মহত্যা করে নাই বরং সে হাসপাতালে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য টিংচার আয়োডিন খেয়ে নিয়েছে"।

আলোচ্য গল্পের শেষ দৃশ্যে চিত্রিত করুণ ট্রাজেডি পাঠকের চোখে এনেছে বেদনার অশ্রু আর গল্পকারের মাথায় পরিয়েছে সার্থকতার তাজ। "গলির ধারের ছেলেটি" গল্পে আশরাফ সিদ্দিকী তাঁর তীক্ষ্ণ অর্ন্তদৃষ্টি এবং প্রখর কন্পনাবলে অবহেলিত সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের চরিত্রের যে লুকায়িত রহস্য উন্মোচন করেছেন তা বাংলা সাহিত্যে এক অনুপম দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top