সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

আঘ্রাণ : সাহানা খানম শিমু


প্রকাশিত:
১৬ জুন ২০২০ ২১:৩১

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:৪৬

 

মাসুকের এ কি রকম অনুভূতি হচ্ছে। আধো ঘুম, আধো জাগরণের মাঝামাঝি। একবার মনে হলজ্জ আমি কি মরে যাচ্ছি? পরক্ষণেই চোখ দুটো খুলে রাখতে চাইছে, পারছে না, আপনা আপনি বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু একি হঠাৎ একটা তীব্র ঘ্রাণ নাকে এসে সমস্ত ইন্দ্রিয়কে বিবশ করে দিচ্ছে। বোধের সকল কণিকা গুলোতে কাঁপন লাগল। কম্পনের মাত্রা অনায়াসে রিখটার স্কেলের সাত মাত্রাকে যেন ছাড়িয়ে গেল। এত বড়ো কম্পনের পরও ঘুমিয়ে পড়া আটকানো গেল না। শ্বাস টেনে ঘ্রাণের পুরোটুকু শুষে নিতে ইচ্ছে হচ্ছে, এই মাতাল করা ঘ্রাণটা আজ পঁচিশ বছর যাবৎ ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। একটা সময় গেছে হেন জায়গা নেই যেখানে সে খুঁজে ফিরেছে, কিন্তু এত বছর পর বিদেশ বিভূঁইয়ে এই ঘ্রাণটা এল কিভাবে? এর উৎসের সন্ধানে জেগে থাকার প্রচন্ড ইচ্ছে পরাজিত হল ঘোর তন্দ্রার অতলতার কাছে। গাঢ় এবং গভীর বন্য ঘুম ডুবিয়ে নিয়ে গেল জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি। এ অবস্থান থেকে মৃত্যুর কাছে যেতে যত কদম পাড়ি দিতে হবে আবার জীবনে ফিরতেও ঠিক তত কদমই অতিক্রম করতে হবে।

জলবায়ু বিষয়ক এক সেমিনারে যোগ দিতে নিউইউর্ক এসেছিল মাসুক হায়দার, বাংলাদেশের অন্যতম পরিবেশ বিজ্ঞানী। সেমিনার স্থল নিউইউর্ক হলেও, এটা আয়োজনের পুরো দায়িত্ব ডেনমার্কের একটি বে-সরকারি সংস্থার। তারাই অন্যান্য দেশের বে-সরকারি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতি বছরই বিভিন্ন দেশে এই ধরণের সেমিনারের আয়োজন করে থাকে। কয়েকটি দাতা সংস্থা থেকেও প্রতিনিধি আসে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পরিবেশবিদরা অংশগ্রহণ করতে এসেছে। বাংলাদেশ থেকে শুধু একজনই মাসুক হায়দার। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ তত্ত্ববিদ্যা বিভাগে। এর পরের পুরোটা সময়ই মাটি, বায়ু আর জল নিয়ে কাটিয়েছে। কাজ করেছে কখনও দেশী কখনওবা বিদেশী সংস্থায়। বর্তমানে কাজ করে একটি বিদেশী প্রতিষ্ঠানে এর সঙ্গে সঙ্গে কিছু কনসালটেনসিও করে বিভিন্ন সংস্থায়। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া মুসকিল হবে যেখানে সে যায়নি। কোনো কোনো দেশে গিয়েছে বেশ কয়েকবার করে। এবারকার সেমিনারটা আকার আয়তন এবং আয়োজনে বেশ বড়ো। তিনদিনের সেমিনারের প্রথম দিন আজ। মাসুকের বক্তৃতা দেবার দিন। মূল বক্তা পাঁচজন। মাসুক তিন নম্বরে বক্তব্য তুলে ধরবে। সবকিছুই ঠিকঠাক। গতকাল রাতেও ল্যাপটপে পেপারস্গুলো আবার করে দেখেছে। কোনো কিছু ক্রটি রয়েছে কিনা। শেষ মুহূর্তের দেখে নেওয়া। প্রোজেক্টরও সঙ্গে রয়েছে, প্রোজেক্টরের ফিল্ম শেষবারের মতো চেক করেই ঘুমোতে গেছে। আজ ভোরে উঠে সেভ করা, গোসল সবই ঠিক মতো সেরেছে, সমস্যা হয়নি কোথাও। পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবনে তেমন বড়ো কোনো অসুখে পড়েনি কখনও। বক্তাদের বক্তব্যের পর শুরু হবে আলোচনা, এরপর প্রশ্নোত্তর পর্ব। সবকিছুই নিয়ম মতোই চলছিল। অডিটোরিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ। প্রথম বক্তা বক্তব্য তুলে ধরছেন। সবাই  মনোযোগ দিয়ে শুনছে। মাসুকও মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। দ্বিতীয় বক্তা শুরু করার পর পরই বুকের বাঁ দিকটা কে যেন খামচে ধরেছে। প্রথমে আমলে নেয়নি ব্যাপারটা। কিন্তু না, খামচা-খামচির তীব্রতা এবং স্থায়ীত্ব দুই-ই বাড়ছে। সঙ্গে মাথাটা  কেমন চক্কর দিচ্ছে। ঘাড়টা হঠাৎ মনে হয় দুর্বল হয়ে পড়ছে। ক্রমে মাথাটাকে ধারণ করবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। মাথাটা ঘাড়ের ওপর সোজা হয়ে থাকছেই না যেন। নাক-মুখ দুটোই খোলা রেখে নিশ্বাস নিয়ে কুলাতে পারছে না। বুক জুড়ে অক্সিজেনের ঘাটতি। ক্রমে ঘাটতির মাত্রা বাড়ছে। না-হ আর সহ্য করা যাচ্ছে না। সুতরাং ডাকতেই হল ভলেনটিয়ার গোছের একজনকে। একটা সচল অনুষ্ঠানের মাঝে, হাঁকডাক করে হুলস্থূল করতে একদমই ইচ্ছে হচ্ছিল না মাসুকের। এত বড়ো সেমিনার পৃথিবীর প্রায় সবজায়গার লোক সমবেত হয়েছে। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যে সকল দেশ মূলত দায়ী তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকারনামা নিতে হবে, বিশ্ব জলবায়ুকে যেন আরও ক্ষতিগ্রস্থ না করে তারা। অন্যদিকে আক্রান্ত দেশগুলোর বিভিন্ন দাবি-দাওয়া, নিয়ম-নীতি, মানতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কত কত এজে্নডা নিয়ে হাজির বিভিন্ন দেশের পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। আর এই সময় মাসুকের এই অস্বাভাবিক শারীরিক অবস্থার জন্য ও কিছুটা যেন লজ্জিত। ভলেনটিয়ার মেয়েটা যখন কাছাকাছি আসলো ততক্ষণে আরও খারাপ অবস্থা। মাসুক ঘেমে নেয়ে একাকার। কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তারপর ধরাধরি, এ্যাম্বুলেন্স, হসপিটাল, এমারজেন্সি, নার্স-ডাক্তার, অক্সিজেন, মাস্ক, ঔষুধ কতকিছু। দুইদিন হসপিটালে চিকিৎসার পর মোটামুটি ভালো। তবে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষায় হৃৎপিন্ডের জটিলতা ধরা পড়েছে। যদিও এ যাত্রায় বেঁচে গেছে। অপারেশনের প্রয়োজন এবং তা এখন করাই ভালো, মাসুকের যদি আপত্তি না থাকে ওরা করতে চায়। হসপিটাল কর্তৃপক্ষ থেকে জানান হল কোনো নিকটআত্মীয়কে খবর দিতে চাইলে ঠিকানা দিলে ওরাই যোগাযোগ করবে। হসপিটালের শ্বেত শুভ্র বিছানায় বসে ভাবছে মাসুক ‘কাকে খবর দেব, কে আছে আমার নিজের?’ মা-বাবা তো কবেই গত হয়েছেন। ভাইবোন আছে দুই চারজন। তবে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল। মাসুক নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে সবার কাছ থেকে। সেইদিন থেকেই হয়তোবা বিচ্ছিন্নতার যাত্রা শুরু। তবে ধীরে ধীরে তার মাত্রা বেড়ে আরও পোক্ত হয়েছে। মাসুকের জীবন আচার তাকে আরও বিচ্ছিন্ন করেছে পরিবার থেকে। একা একাই থাকে। প্রায় প্রতি রাতেই পানীয় পানের অভ্যাস আছে। সূচিবায়ুতা, পবিত্রতা নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই, নিজের মনেই এগুলো সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করে নিয়েছে। তাই পরনারীতে জৈবিক চাহিদা পূরণে সে সাচ্ছন্দ্য। এজন্য কোনো গ্লানি বা অপরাধবোধ কাজ করে না। শরীর নিয়ে সূচিবায়ু নেই। শরীরকে শরীর ছূঁলেই তা অপবিত্র হয়ে যায় এ বিশ্বাস নেই মাসুকের। তাই সহজ মেলামেশা ততটা, যখন যাকে ভালো লাগে যতটা। শরীর নিয়ে সাধারণ মানুষের ধারণার সঙ্গে ওর মিল নেই। ও বুঝতে পারে না ভালোলাগার কিছু করলে বা সেই মতো চললে তা খারাপ হবে কেন? ভালো তো সব সময়ই ভালো হওয়ার কথা। ওর ভালো লাগে বলেই তো ভালো লাগার কোনো মানুষের সান্নিধ্যে উষ্ণতা খুঁজে ফেরে। নিজের অফুরন্ত ভালোলাগাগুলোকে ভালোলাগার তীব্রতায় পৌঁছে নেয়। এই তীব্রতাকে ছুঁতে সে নিষিদ্ধ পল্লীতে রাত্রি যাপনেও পিছপা হয়না। ভাইবোনেরা নিজেদের সামাজিক জীবনে ছেলে-মেয়ে নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত বলে ওর স্বেচ্ছাচারী  জীবন থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখে। এতে মাসুক কষ্ট পেলেও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। তাই অপারেশনের দিনক্ষণ নির্ধারণ কারও জন্য আটকে রাখতে হয় না। আরেকটা বিষয় অর্থ, মাসুক তার বোহেমিয়ান জীবনে অর্থের প্রয়োজন কখনও অনুভব করেনি। যা করতে চেয়েছে যেভাবে চলতে চেয়েছে, অর্থের কারণে তাতে সমস্যা হয়নি। তবে ওর দেশী বিদেশী ব্যাংক একাউন্টে কত ক্যাশ রয়েছে তা হিসেব করেনি কখনও। হসপিটালের খরচপাতি বহন করার অর্থ ওর আছে। কিন্তু আয়োজক সংস্থা জানাল, অনুষ্ঠান চলাকালে মাসুক অসুস্থ হয়েছ্‌ তাই ওরা খুবই দুঃখিত এবং আরও জানালো অপারেশন ও হসপিটাল চার্জসহ সকল ব্যয়ভার ওরা বহন করতে চায়। তাহলে একটু হলেও ভারমুক্ত হবে। আরও দিন দুই পর অপারেশনের দিন ঠিক হল। আগের রাত থেকেই মাসুকের খাবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জেনারেল এ্যানাসথেসিয়া দিয়ে অপারেশন করবে অর্থাৎ পুরো শরীর বোধহীন করে নেবে। সকালে কয়েকজন মেল নার্স এসে মাসুকের বুকের পশমগুলো সেভ করে দিল, মাসুক বুকের দিকে তাকিয়ে ভাবল সীমারের বুকটা এমনই পশম শূন্য ছিল বোধহয়। ওকে অপারেশনের ড্রেস পরানো হল। অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানোর পর ডাক্তার নার্সরা বিভিন্ন কাজ করে যাচ্ছে, এরপর ওকে একটা ইনজেশন পুশ করল, আর তার পরপরই ভালোলাগার সেই ঘ্রাণটা ওকে আচ্ছন্ন করতে না করতেই ও ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল।

মাসুকের বোধগুলো যখন একটু একটু করে আবার ফিরে আসছে, চেতনা ওকে নাড়া দিচ্ছে, তখন তাকিয়ে দেখে ও পোষ্ট অপারেটিভ ইউনিটের খাটে শুয়ে আছে। চোখ খুলতে দেখে হাসি-হাসি মুখ ক’রে ফর্সা একজন নার্স মুখের কাছে মুখ এনে জানতে চাইছে যে কেমন বোধ হচ্ছে। মাসুকের কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, তবুও মুখটাকে যতটা সম্ভব হাসি-হাসি ভাব এনে ঘাড় কাত করল। নার্স বুঝল ভালোই আছে রোগী। সে তার রুটিন কাজগুলো করে যাচ্ছে, টেম্পারেচার দেখা, পালস্ চেক, মনিটর রিডিং ইত্যাদি। মাসুকের বোধগুলো ফিরে আসতে আসতেই সেই ঘ্রাণের ব্যাপারটিও ধাঁ করে মাথায় এসে ঘা মারল। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশে অনুসন্ধানী দৃষ্টিপাত করল, পেল না। সেই ঘ্রাণটা তো একবারই পেয়েছে যখন সে চেতন ও অচৈতন্যের মাঝামাঝি। মাসুক ভাবছে তার মানে ঘ্রাণটার কোনো বাস্তব উপস্থিতি নেই, এটা তার মনের অন্তর্নিহিত আবেগ থেকে তৈরি হয়েছে। আবার এও মনে আসে যে তখন তো আমার বোধ হাল্কাভাবে ছিল, ডাক্তার নার্সদের চলাফেরা, কথা, যন্ত্রপাতির নাড়াচাড়া সবই তো হাল্কাভাবে অনুভব করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এইগুলো যদি সত্যি হয় তাহলে ঘ্রাণটা হবে না কেন? মাসুকের মাথাটা যেন কেমন করছে, ঘুম ঘুম লাগছে, সমস্ত শরীরটা অবশ হয়ে আসছে।

 

দুই

মিনতী রায়, তুমি এত নিপাট, নিভাঁজ সৌন্দর্যময় কেন? কেন প্রথম দর্শনে তুমি আমায় আকৃষ্ট করেছিলে। তুমি তোমার চুম্বকীয় আকর্ষনের একটা বলয় তৈরি কর। আমি সেই বলয় থেকে বের হতে পারি না শুধু ছুটোছুটি করি আর ছটফট করি। তোমাকে দেখলে আমার স্বাভাবিক কর্মকা- থেমে যায়। তুমি এত নিখূঁত সুন্দর হলে কেন? বিধাতা মনে হয় নিজ হাতে প্রতিমা গড়েছেন। একই কলেজে পড়ত মাসুক আর মিনতী হঠাৎ করেই তাদের মাঝে ভালোলাগা থেকে ভালবাসা তৈরি হয়ে গেল ওদের অজান্তেই। যখন আবিষ্কার করল দু’জন দু’জনকে তীব্র ভালবাসে, তখন খেয়ালে আসলো ওদের মাঝে এক অদৃশ্য দেয়াল। সেই দেয়ালের নাম ধর্ম। যখন ওরা বুঝতে পারল মফস্বল শহরের দুটো ছেলে-মেয়ে দুজন দুজনকে যত তীব্র ভালবাসুক না কেন, ধর্ম ওদেরকে মিলতে দেবে না। তাতে ওরা নিজেরা আরও নৈকট্যের তৃষ্ণায় উন্মুখ রইল। ওদের মধ্যে লায়লি-মজনু, শিরি-ফরহাদ, আনারকলি-সেলিমের অমর প্রেম ভর করল। ওদের উন্মাতাল সেই দিনগুলোতে দুজন দুজনকে আবিষ্কারের নেশায় মাতাল হল। মিনতী রায়ের শরীরের এক মাতাল করা ঘ্রাণে মাসুক পাগল হয়ে যেত। এ ঘ্রাণ হাসনা হেনা, চামেলী, বকুল, দোলনচাঁপার গন্ধকেও হার মানায়। কি এক মাদকতায় মোড়ানো দিনগুলো। ওরা বাঁধনহারা, ওরা বাঁধভাঙা, ভালবাসার সর্বোচ্চ চূড়ায় ওরা অবস্থান নিয়েছে। কে ছোঁবে ওদেরকে? কিন্তু বিধি বাম, বিষয়টা এ কান ও কান করে পৌঁছে যায় দুদিকের বাবা মায়ের কানে। দু’পক্ষই তড়িৎ এ্যাকশনে নামে। তৎক্ষণাৎ মাসুককে ঢাকায় তার বড়ো ভাইয়ের কাছে পাঠান হল। ঢাকায় কোনো কলেজে বড়ো ভাই ভর্তি করে দেবে। কুমিল্লার কলেজ থেকে টি.সি নেওয়ার সময়টুকু মাসুক পায়নি। মাসুককে সেইদিন ঢাকা পাঠিয়ে দেয়া হল। মাসুকের বাবা-মা তো মাসুককে কুমিল্লা ছাড়া করল। আর মিনতীর বাবা-মা ওকে দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে ভারত পাঠিয়ে দিল। দেশ ছাড়া করে কোলকাতায় সেজ মামার কাছে। আপাতদৃষ্টিতে এখানেই যবনিকাপাত হল একটা অসাধরণ প্রেম কাহিনীর। যে প্রেম হয়তো ইতিহাসের নতুন অধ্যায় রচনা করতে পারত, আজও জগৎ বিখ্যাত প্রেম উপাখ্যানে যেসব প্রেমিক-প্রেমিকার নাম সকলের মুখে মুখে উচ্চারিত হয় সেই ধারাবাহিকতায় হয়তো মাসুক-মিনতী নামটা যোগ হয়ে অমর প্রেমের উদাহরণের দৈঘ্য বৃদ্ধি করতে পারত কিন্তু তা হল না।

শেষ পর্যন্ত বাবা-মা ভাইবোনদের ধারণা হল মাসুক প্রেম রোগ থেকে মুক্ত হয়েছে। কারণ সে পড়ালেখায় মনোযোগী হল, ভালো রেজাল্ট করল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল। ছেলের বিয়ের বয়স পেরিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে তার একটা অনিহা কাজ করে। তেমন আগ্রহ পায় না। তবুও বাবা মায়ের পীড়াপীড়িতে, ভাইবোনদের জোরাজুরিতে অবশেষে বিয়ে করতে রাজি হল মাসুক। মেয়ের ফটো, বায়োডাটা দেখানো হয়, এরপর সামনা-সামনি গিয়ে মেয়ে দেখাদেখি, কিন্তু ফলাফল শূন্য। বাবা-মা, ভাইবোনেরা চিন্তায় অস্থির। মাসুক বিয়ে করার জন্যই মেয়ে দেখতো, কোনো কোনো মেয়েকে ভালোও লাগত, বিয়ে করবে বলেও ভাবতো। কিন্তু সেই মাতাল মাতাল ঘ্রাণানুভূতি ওর সবকিছু এলোমেলো করে দিত। ও আর স্থির থাকতে পারত না। নিশি পাওয়া মানুষের মতো লাগত নিজেকে। কেমন ঘোর লাগত, সেই ঘোর থেকে বের হতে পারত না। তাই বিয়ের ব্যাপারে আর সিদ্ধান্ত নেওয়া হত না। এভাবেই মেয়ে দেখাদেখির বিষয়টা ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। বাবা-মা পৃথিবী থেকে চলে যাবার পর অন্য সবার মাথা থেকেও মাসুকের বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়টা দূর হয়ে যায়।

এত এতদিন পর সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে এসে আজ, মাসুক বিভ্রান্ত। পোষ্ট অপারেটিভ ইউনিটের বেডে শুয়েও পূর্ণ ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করছে। যেন গন্ধ শুঁকে শুঁকে ও ঠিক পৌঁছে যাবে একদিনের আরাধ্য প্রিয় মিনতী রায়ের কাছে। একবার ভেবেছে নার্সদের কাউকে জিজ্ঞেস করবে নাকি মিনতী রায়ের কথা। আবার ভাবছে ব্যাপারটা কেমন হাস্যকর হয়ে যাবে না। তাই সে পথে আর এগোয়নি। নিজেই স্মৃতি হাতড়িয়ে আবিষ্কার করে ছেজ্জমিনতী তো সাইন্স নিয়েই পড়েছিল ইলেভেন টুয়েলভ্ ক্লাস, সুতরাং ডাক্তার হলেও তো হতে পারে, নিদেনপক্ষে নার্স হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ডাক্তার কিংবা নার্স যাই হোক না কেন এই দূর দেশে ওর কথা ভাবা কি ঠিক হচ্ছে? কিন্তু সেই মনোমুগ্ধকর মাতাল করা গন্ধটা? তখনই তালগোল পাকিয়ে যায় সবকিছু। ডাক্তার-নার্স না হোক রোগী বা রোগীকে দেখতে আসা কেউও তো হতে পারে ঘ্রাণের উৎস। পরক্ষণেই ভাবে অপারেশন থিয়েটারে তো অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ। মাসুকের এই এলোমেলো ভাবনার মাঝে কাটলো একটা পুরো দিন। বিপদ মোটামুটি কেটে গেছে, ওকে কেবিনে শিফট করল। কেবিনের বিছানায় সময় আর কাটতে চায় না। মাসুককে ক্লোজ অবজারভেশনে রেখেছে হসপিটাল কতৃপক্ষ। সাতদিন পর রিলিজ দিল। রিপোর্ট, ঔষুধ, বিধি নিষেধ সম্বলিত কাগজপত্র সবই গুছিয়ে ওর সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে ডাক্তার এই কাগজ পত্র দেখলেই রোগী সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পেয়ে যাবে।

দুপুর গড়িয়েছে মাত্র, মাসুক বিছানায় গড়াগড়ি করছে ইন্দ্রিয় থেকে ঐ ঘ্রাণের ভুতটা কিছুতেই সরাতে পারছে না। হসপিটালে আরও থাকতে চেয়েছিল, ভেবেছিল এই ব্যাপারে একটা সুরাহা করে তবে হসপিটাল থেকে রিলিজ নেবে, তবে ডাক্তাররা বললেন তুমি এখন পুরোপুরি ঠিক আছ। শুধু শুধু এখানে থেকে লাভ কি? হোটেলে ফিরে যাও, প্রয়োজনে যোগাযোগ কর। ওর খুব ইচ্ছে হচ্ছে আবার যদি একই অসুখ হত, আবার অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হত। আবার সেই ঘ্রাণ, আবার আমোদিত হওয়া। এবার ও কিছুতেই ঘুমিয়ে পড়ত না, যত কষ্টই হোক জেগে থাকত, কিন্তু তাতো হওয়ার নয়। না, সব কিছু ঝেড়ে মুছে কাজে ডুবতে চাইলো। অসুখের জন্য সেমিনারে থাকতে পারেনি । তবে পুরো সেমিনারটা রেকর্ড করা হয়েছে এবং অন্যান্য সব তথ্যই মাসুকের মেইলে পাঠিয়ে দিয়েছে আয়োজকরা, কারণ কাজ তো থেমে নেই। এই সেমিনারের ফলোআপ আরেকটা সেমিনার হবে সামনের বছর সুইডেনে, সেটাতে এ বছরের সিদ্ধান্তগুলো কতটুকু কার্যকর হয়েছে পর্যালোচনা করা হবে। যে সকল সিদ্ধান্তগুলো কার্যকর করা হয়নি সেগুলো কিভাবে কার্যকর করা যায় তাই নিয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়া নতুন ইস্যু তো আছেই। না, আর শুয়ে শুয়ে ঘ্রাণের মায়াজালে আটকে না থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মেইল চেক করা হয় না কতদিন। আজ থেকে আবার নতুন করে কাজ শুরু করতে হবে। এক কাপ কফি খেয়ে ফ্রেশ হয়ে কাজে লাগবে ভেবে যেই মাথার কাছে টেলিফোনে হাত দিতে যাবে ঠিক তখনই সেই ঘ্রাণ তীব্র বেগে ওর ঘরে এসে ঢোকে। মাসুকের হাতটা থেমে গেল, চোখদুটো দরোজার দিকে, অকল্পনীয় দৃশ্য, হাসি হাসি মুখে শাড়ি পরিহিত একটা মেয়ে ওর রুমে ঢুকছে... কিন্তু মেয়েটা কে?

মিনতী রায়? হ্যাঁ মিনতী রায়।

ঘটনার আকস্মিকতায় মাসুক বাকহীন, কথা শুরু করল মিনতী রায়-ই। ওর কাছে চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।

কেমন আছ? এখন শরীর কেমন? উত্তর দেওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে মাসুক। নির্বাক বিমূঢ়! চিত্তে আনন্দধারা, মন ঘ্রাণে বিভোর। তাই আবারও মিনতী।

শরীরের দিকে খেয়াল কর না! সারাদিন বিশ্ব জলবায়ু নিয়ে কাজ করলেই হবে? নিষ্পলক মাসুক তখনও বাকহীন।

মিনতী রায়, অনেক ঘাটের জল খেয়ে, পোড় খেয়ে শেষে আমেরিকার বহু ধর্ম, বহু মত, বহু সমাজ, বহু বর্ণের দেশে থিতু হয়েছে। ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করলেই মনের সীমা অতিক্রম করা যায় না তার উদাহরণ মিনতী রায়। মিনতীর অভিভাবকরা বাংলাদেশ থেকে ভারত পাঠিয়েই ভেবেছে মাসুক নামটা শেষ হল। কিন্তু হল না, তাই তো পড়াশোনায় মন নেই। মামা চাচারা জোর করে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বসিয়েছে। কিন্তু ডিঙাতে পারল না পরীক্ষা পাশের দেওয়াল। এরপর বিয়ের চেষ্টা, মিনতী এ বিষয়ে অবশ্য অনড়। সে বিয়ে করবে না। এদিকে বয়স যাচ্ছে, কে আর বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে। অতঃপর অভিভাবকরা শেষ চেষ্টা হিসাবে নার্সিং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিল। এখান থেকে ট্রেনিং শেষে চাকুরি এরপর আর কারও মুখাপেক্ষী থাকতে হয়নি মিনতীকে। নার্সিং এ চাকুরির পাঁচ বছরের মাথায়, সৌদি আরবে ডাক্তার নার্স নিতে সৌদি টিম এল। মিনতী আবেদন করল, চাকুরি হল। সৌদি থাকল পাঁচ-ছয় বছরের মতো। বছরে একবার ছুটি, আসা-যাওয়ার টিকেট বরাদ্দ সৌদি সরকারের তরফ থেকে। তবু দেশে যেতে ইচ্ছে নেই মিনতীর। কাছাকাছি দেশগুলো ঘুরতে চায়, ছুটির সময়টা ,পারে না। সৌদি চাকুরির এই ঝামেলা মেয়েরা একা কোথাও যেতে পারে না। তবুও ছুটিটা সৌদিতে কাটাল, দেশে না গিয়ে। এরপর দুবাই এ চাকুরির চেষ্টা করল। দুবাইয়ে ছিল তিন বছরের মতো। এখানে মোটামুটি স্বাধীন জীবন। চলাচলে বাধা নেই, বেশ বেড়ালো ঘুরল নিজের মতো করে, অনেকগুলো টাকা জমে ছিল। প্রায় সবটায় শেষ হল, কষ্ট হল না। একটাইতো জীবন, তা ছাড়া রোজগার তো করেই চলেছে, অসুবিধা কি খরচে? দুবাই থেকেই ইন্টারনেটে লেখালেখি শুরু করল আমেরিকা যাবার জন্য। সৌদি, দুবাই ভালোই চলছিল তবে সেই ধর্মের বাধা এসে মাঝে মাঝেই কাজের গতি, জীবন চলার গতিকে শ্লথ করে দেয়। তাই যেতে চাইলো এমন কোথাও যেখানে ধর্ম কোনো বাধা না হয় জীবন চলায়। চাকুরি হয়ে গেল আমেরিকার একটা বড়ো হসপিটালে। এখানেই রয়ে গেল, এখন গ্রীণ কার্ড হয়ে গেছে। আর দেশে ফেরার কথা ভাবেনি। আমেরিকার ব্যস্ত জীবনে  চলতে চলতে একাকিত্ব অনুভব করল তাই সঙ্গী বেছে নিল। ওর সঙ্গেই হসপিটালে কাজ করত ধর্মে খ্রিষ্টান ছেলে, বিয়ে করল। যেই ধর্ম ওর ভালবাসা থেকে ওকে এত দূরে ঠেলে দিয়েছে আবারও সে ধর্ম । কিন্তু এখানে এই জাত-ধর্ম নিয়ে সমস্যা হয়নি। তবে বিয়েটা টেকেনি। এরপর আর ঐমুখো হয়নি। একাকী দিনাতিপাত করছে। খারাপ লাগে না হসপিটালের চাকুরি, কত ধরনের মানুষ দেখা, কত রকম তাদের সমস্যা, কত রকম তাদের আনন্দ-বেদনা। হসপিটালের পর ডরমেটরীতে গিয়ে বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে হৈ হল্লা, ঘুরে বেড়ানো ভালোই সময় কেটে যায়।

হসপিটালের নিয়ম অনুযায়ী অপারেশনের আগেই রোগীর সব তথ্য ফাইল, রিপোর্ট অপারেশন থিয়েটারে চলে আসে। মিনতী অপারেশন থিয়েটারের চার্জে আছে। ওর হাতেই পৌঁছায় সব তথ্য ফাইল। অন্য সব বারের মতোই নাম থেকেই শুরু করল দেখা। প্রথম ধাক্কা, নাম মাসুক হায়দার, এরপর দেশ, বাংলাদেশী, তারপর চোখটা আপনা আপনি চলে যায় ডান কোণায় সাঁটা ডিজিটাল ফটোটার দিকে, বয়স হয়েছে সারা মুখে খোঁচা খোঁচা সাদাপাকা দাড়ি। তবুও চিনতে একটুও ভুল হয় না মিনতীর। তীব্র আবেগে  থরথর করে কাঁপছে সিনিয়র স্টাফ নার্স মিনতী রায়। এত বছরের অভিজ্ঞতা, ঝটপট কাজ গুছিয়ে নেয়ায় পারদর্শী তাই দ্রুততার সাথেই প্রোমোশন পেয়ে এগিয়ে গেছে। কিন্তু আজ হাতগুলো যেন অবশ হয়ে পড়েছে। তবুও কর্তব্য ওকে অনেক কঠিন করে দিল। দ্রুত হাতে এনলিষ্টটেড ডাক্তারদের কল দেওয়া, ওটি রেডি করা, যন্ত্রপাতি, ঔষুধ, সব ধরণের মেশিন, অক্সিজেনের ব্যবস্থা, মনিটর সবই রুটিন মাফিক রোবটের মতো করে যাচ্ছে। জুনিয়রদের কাজের বিভিন্ন নির্দেশ দিচ্ছে। ওটি পুরোপুরি গুছিয়ে নার্সদেরকে কেবিন থেকে রোগী আনার নির্দেশ দিয়ে নিজের ছোট্ট রুমে ঢুকে পরের রোগীর সব প্রস্তুতি নিতে লাগল। এই ছোট্ট রুমে বসেই ঘড়ির আন্দাজে ওটির অবস্থা আন্দাজ ক’রে, এক সময় আস্তে করে ওটিতে ঢুকল। যা ভেবেছে তাই এ্যানাসথেসিয়ার কাজ শুরু হয়েছে মাসুকের চোখদুটো বুজে আসছে। মাসুকের দিকে খানিক অপলক চেয়ে থেকে বিধাতার কাছে ওর রোগমুক্তি কামনা করে প্রার্থনা করল নীরবে। অপারেশনের পুরো সময়টা ওটিতেই কাটালো। নিজের রুমে গিয়ে কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছিল না। তাই সাত দিনের ছুটি নিয়ে ডরমেটরীতে ফিরে গেল। টার্কিশ রুমমেট পালোমার কাছে লুকাতে পারল না কিছুই। মিনতীর জীবনের ট্রাজেডীর কিছু কথা আগেই জানত পালোমা। এখন দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নিয়ে বুঝল সবই। পালোমাই মাসুকের সুস্থতা, হসপিটাল ছাড়ার খবর এনে দিল মিনতীকে। হোটেলের ঠিকানাও জোগাড় করে দিয়েছে , মাসুকের পারসোনাল ফাইল থেকে।

মাসুকের আচ্ছন্ন ভাবটা কাটছে না, অগত্যা মিনতীর সরল প্রশ্ন, হসপিটালের খাতায় দেখলাম সিংগেল, বিয়ে করনি, নাকি এখন একা?

মাসুকের কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। শুধু চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণটা শুষে নিতে ইচ্ছে করছে, আর এর মাঝেই বিলীন হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কি মনে করে মিনতী চেয়ার ছেড়ে উঠে মাসুকের মাথার কাছে বসল, হাতটা মাসুকের চুলে বিলি কাটছে, মাসুক ফিরে গেছে পঁচিশ বছর আগের সেই রঙিন দিনগুলোতে। কৃষ্ণচুড়া গাছে গাছে ঢাকা উদ্যান, মিনতীর কোলে মাথা রেখে ওর শরীরের ঘ্রাণ নেওয়া, আকণ্ঠ ডুবে থাকা। আজ পাঁচতারা হোটেলের বিশাল কক্ষে মিনতীর ছোঁয়ায় মাসুক যেন নিজেকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে। ও কে? কোথায়? কেন? কিছুই মনে হচ্ছে না। শুধু মিনতী রায়ের শরীরের মাতাল ঘ্রাণ সরোবরে ডুব সাঁতার দেওয়া এর বাইরে কিছু নেই, কোথাও কিছু নেই।

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top