সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা : তাপস বড়ুয়া


প্রকাশিত:
১২ আগস্ট ২০২০ ২২:৩২

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৪৩

 

“তোমার ঘরে বাস করে কারা
ও মন জানো না।
তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা
মন জানো না।”
-লালন ফকির

১.
ঢাকা মেডিকেল থেকে ছাড়পত্র পেয়ে আজিজ সাহেব বাসায় এলেন বটে; কিন্তু কারো মুখেই আগের সেই হাসি ফুটলো না। যারা দিনরাত পরিশ্রম করে তার প্রতিটি মুহূর্তের সুবিধা অসুবিধায় পাশে থেকেছেন, সেই স্ত্রী শর্মী আর ছেলে আনিস একেবারে ভেঙে পড়েছেন। যে সুস্থতার জন্য তারা এই হাসপাতালে এসেছিলেন, আজিজ সাহেব সেই সুস্থতা পেয়েছেন। কিন্তু ডাক্তার তাকে রেফার করেছেন থাইল্যান্ডের এক মানসিক হাসপাতালে। তিনি অনবরত ভুল বকছেন। কিন্তু ছাড়া ছাড়া কোনো কথা হঠাৎ হঠাৎ বলে উঠছেন, তা নয়। এটাকে পাগলামী তাও বলা যাচ্ছে না। ঢাকা মেডিকেলের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ খুব মনোযোগ দিয়ে পাঁচদিন অবজারভ করার পর আজ ব্যাংককের মানারাম হসপিটালে রেফার করে ছেড়ে দিয়েছেন।
স্ট্রোক করেছিলো তার। তা আজকাল পঞ্চান্ন বছর বয়স তো স্ট্রোকের জন্য অস্বাভাবিক সময় নয়। দিন রাত দৌড়াচ্ছেন। কাজের পরে কাজ। সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরিয়ে আসেন বটে। রাতে খাওয়ার পর আবার ফাইলপত্র আর ল্যাপটপ নিয়ে বসেন। প্রায় বিশ বছর ধরে এটাই তার রুটিন। গত সাতাশ দিন ধরে তিনি রেস্ট পেয়েছেন। অর্ধেকটা সময় আইসিইউতে; বাকিটা কেবিনে। কেবিনে দেয়ার পরে প্রথম প্রথম তিনি আধা-অচেতনের মতো থাকতেন। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কীসব যেন বলতেন, কাকে কাকে ডাকতেন। খুব নিচু কণ্ঠের সেইসব কথাবার্তা অন্যরা ঠিক বুঝে উঠতে পারতেন না। ভাবতেন অর্ধ-অচেতনতাই তার এসবের কারণ। ওষুধের ইফেক্টও হতে পারে। কিন্তু চার পাঁচ দিন যেতে না যেতে তিনি পরিষ্কার কথা বলতে শুরু করলেন। সবার কাছে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হলো, উনি চারপাশের পরিচিত মানুষদেরকে চিনতে পারছেন না। স্মৃতিবিভ্রম হয়েছে তার। কিন্তু যে ব্যাপারটা অবোধ্য হয়ে দাঁড়ালো তা হচ্ছে উনি যাদের নাম বলছেন, যাদের ডাকছেন তারা কারা? নিউরোলজিস্ট দু’দিন এ অবস্থা দেখে সাইক্রিয়াটিস্টকে রেফার করেন। সাইক্রিয়াটিস্ট পাঁচদিন অবজারভেশনে রেখে আজ হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিলেন।
কোনো মানুষের আবোল তাবোল বকা এটা নয়; এটা কোনো পাগলামীও নয়। উনি যা বলছেন তা সব গোছানো। একটা কথার সাথে অন্যটার যৌক্তিক সংযোগ অত্যন্ত স্পষ্ট। কিন্তু যে সব কাজ করার কথা তিনি বলছেন তা তার পেশার সাথে মেলে না। যাদেরকে এসব কাজ করার কথা বলছেন তাদেরকে চেনে না আজিজ সাহেবের চারপাশের কেউ। এমনকি তার স্ত্রীও না।
আজিজ আর শর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসমেট ছিলেন। সেই থেকে পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছর তারা একে অন্যকে চেনেন-জানেন। এতো বছরে এসব নামের কাউকে শর্মী চেনেননি। এসব লোক সম্পর্কে কখনো গল্পও করেননি আজিজ। আজ তাদের কথা বলছেন তিনি; শর্মীকে চিনছেন না। প্রথম যখন এটা বুঝতে পেরেছিলেন তখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলেন শর্মী। দ্বিতীয় দিন খুব কেঁদেছিলেন। আর তারপর থেকে চুপ হয়ে গেছেন। তার মাথায় আর কিছু আসছে না।

২.
প্রতিদিনের মতোই সকালে এলার্ম মেনে সাতটায় ঘুম থেকে উঠেছেন আজিজ সাহেব। সাথে সাথে দিন শুরু হয়েছে শান্টুরও।
আজিজ সাহেব প্রাত্যহিক প্রাতঃকর্ম সেরে নাস্তার টেবিলে বসেছেন। অনেক বছর আগে তিনি দু’বছর লন্ডনে পড়ালেখা করেছিলেন। সেই থেকে বিলেতি কায়দায় ব্রেকফাস্ট করেন-পাউরুটি, মাখন, ডিম, ফ্রেশ ফ্রুট জুস আর ব্লাক টি। খেতে খেতে রবীন্দ্র সংগীত শোনেন ট্যাবে। সেদিনও ডাইনিং টেবিলে এসবই ছিলো। শর্মী আর তিনি একই সাথে নাস্তা রেডি করেন। একই সাথে টেবিলে বসে খান। তারপর যে যার গাড়িতে যার যার কর্মস্থলে রওনা হন। আজও তেমন হলো। তিনি গাড়ির কাছে আসতেই গেট খুলে ধরলো ড্রাইভার ইদ্রিস। তিনি উঠে বসলেন নতুন কেনা প্রিমিওতে। ইদ্রিস জানে কোন গান এখন বাজবে গাড়িতে। বাজতে থাকে, ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মন রে আমার...’।
শান্টু খেতে বসবেন। কিন্তু রেবেকাকে দেখছেন না। সে গেছে ছাগলের ছোট বাচ্চাকে ফিডারে করে দুধ খাইয়ে দিতে। একসাথে তিনটি বাচ্চা হলেই একটা দুধ পায় না। হয়ে পড়ে ‘ছাগলের তৃতীয় বাচ্চা’। এবার কালো ছাগলের বাচ্চা হয়েছে চারটি। অতএব তাদের মায়ের দুধের সমবন্টনের বিষয়টি রেবেকাকে দেখতে হচ্ছে। রেবেকাও এই দায়িত্ব পালন করছে মহা উৎসাহে। দু’জনে একসাথে খাবেন তা নয়। কিন্তু খাওয়ার সময় দু’জন কাছাকাছি থাকলে ভালো লাগে।
শান্টু খেতে বসেন। গরম ভাত। সঙ্গে আলু ভর্তা, ডাল, ঘরে পাতা কাঁচা দই। সকালে নিম ডালের দাঁতন দিয়ে ব্রাশ করতে করতে এক পাক ঘুরে এসেছেন পুকুরের চারপাশ দিয়ে। পুকুরের চারপাশে পাড়ের উপর লতা জাতীয় সবজি গাছ লাগানো। করলা, শশা এসব। পুকুরের উপর জালের মাচান। তার উপরে লতাগুলো। ফলও সেখানে। উপরে সবজি নিচে মাছ। সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যাবহার। শুধু পুঁইশাকটা লাগানো মুরগীর খামারের খড়ের চালের উপর। তার দৃঢ় বিশ্বাস, খড়ের চালের উপর হওয়া পুঁইশাকের ডগা যেমন মোটা হয় আর পাতা যেমন বড় হয়, স্বাদও হয় তেমনি অতুলনীয়। তেমনটা অন্য কোথাও সম্ভব নয়। এসব দেখতে দেখতে পুকুর ঘাটে এসে হাতমুখ ধুয়ে রান্নাঘরের বারান্দায় বসেছেন তিনি। রেবেকা খাবারের থালা এগিয়ে দিলে শান্টু কাঁসার গ্লাসটা নিয়ে নিচে নামেন। উঠোনে হাত ধোন, কুলি করেন। তারপর বারান্দায় উঠে খেতে বসেন।
আজিজ সাহেব যাবেন শাহবাগ। ইউনিসেফে আজ প্রেজেন্টেশন আছে। প্রায় এক কোটি টাকার কাজ। শিশু অধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দেশব্যাপী গবেষণা হবে। গবেষণা প্রোপোজালের ওপর টেকনিক্যাল প্রেজেন্টেশন দিতে হবে। ইউনিসেফের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়েরও দু’একজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তাও থাকবেন। তিনটি গবেষণা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে ডাকা হয়েছে। আজকে উৎরে যেতে পারলে কাজ পাওয়া প্রায় নিশ্চিত। তিনি যখন গবেষণার ঠিকাদারী শুরু করেন তখন বাজারে এত প্রতিযোগিতা ছিলো না। এখন অনেক প্রতিযোগিতা। নতুন অনেক মুখ। সাবধানে প্রপোজাল তৈরি করতে হয়।
শাহবাগ যাওয়ার আগে অফিসে যেতে হবে। অফিসের কর্মীদের কাছে তিনি প্রেজেন্টেশনটা প্যাকটিস করবেন। অফিসে গিয়ে দেখেন, সবাই এখনো পৌঁছেনি। মেজাজটা যায় বিগড়ে।
‘সুমন, আসেনি কে কে?’
‘ভাই, অনেকেই তো আসেনি। চলে আসবে। রাস্তায় জ্যাম হইতে পারে।’ এই অফিসে স্যার সম্মোধন নেই। সবাই ভাই আপা, মালিকসহ। আপাত হৃদ্যতা পূর্ণ সম্মোধন তা বলে হায়ারার্কিকে ছাপিয়ে যায় না।
‘তুমি আসতে পারো আর যাদের সাথে আমার মিটিং তারা আসতে পারে না। ডোনার তো আর জ্যাম শুনবে না। যারা আসেনি সবাইকে শোকজ করবে। আমি যেন এসে দেখি সবাই নোটিশ পেয়েছে।’
বলেই তিনি উঠলেন। যদিও সময় হয়নি এখনো, তিনি এখনই অফিস থেকে বেরোবেন। যাতে অন্যরা এসে পড়ার সুযোগ না পায়। ঝাড়ি দেয়ার এমন সুযোগ মিস করা যাবে না। বিকেলেই সবাইকে মিটিং-এ ডেকে ঝাড়ি দিতে হবে। মাঝে মাঝে কারণে অকারণে ঝাড়ি না দিলে কর্মীরা মাথায় উঠে যায়।
সকালের খাওয়া শেষে হুক্কা খাওয়া শান্টুর অভ্যাস। মনিবের এই অভ্যাসে সহকারী হচ্ছে সামাদ। বাছাই করা নারকেলের ছোবড়া শুকিয়ে রেডি করে রাখা থাকে। সামাদ নিপুণ হাতে তা দিয়ে গোল বল তৈরি করে ফেলে। হাতে-কাটা তামাক চিটাগুড় মাখিয়ে শুকানো আছে ডিব্বায়। কালকের ছাই ফেলে কল্কেটা একটা শিক দিয়ে ভাল করে খুচিয়ে খুচিয়ে পরিষ্কার করে সামাদ। গুটিটার উপর পরিমাণ মতো তামাক রাখে কল্কেতে। তারপর নারকেল ছোবড়ার বলে আগুন ধরিয়ে ফ্লেমটা ফু দিয়ে নিভিয়ে কল্কের তামাকের উপরে রাখে। হুক্কাটা এগিয়ে দেয় শান্টুর দিকে। হুক্কা টানতে টানতে হাঁটতে থাকে শান্টু। সামাদ তার পিছু নেয়। ভাদ্র মাস। তালপাকা গরম। ঘামতে থাকে তারা। আজ তাদের প্রথম কাজ পুকুরের পানিতে নেমে উপরের জালের মাচা থেকে সবজি তোলা। বিকেলে বাজারে পাঠাতে হবে। এক দিন দু’দিন অন্তর এসব ফসল তুলতেই হয়। না হলে বুড়ো হয়ে যায়। দু’জনে কাছা মেরে নেমে পড়েন পুকুরের জলে। পুকুরে ছোট্ট ডিঙ্গি রয়েছে। তার উপর ঝুড়ি রেখে তারা হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে করলা আর শশা পাড়ে।
আজিজ সাহেবের প্রেজেন্টেশনের সময় এলো বারোটার পরে। তিনি তার স্বভাবসুলভ উপস্থাপনা শুরু করেছেন। মনোযোগ দিয়ে শুনছে সবাই। নতুনরা বুঝতে চেষ্টা করছে এই মানুষটার উপস্থাপনায় কী আছে। এতবছর ধরে বাজারে আধিপত্য ধরে রেখেছেন কী করে তিনি। মেথোডোলজি শেষ করে ইম্পিলিমেন্টেশন স্ট্রাটেজি বলতে শুরু করেছেন, তখন আজান পড়ে গেল। তিনি থামলেন।
পুকুর ঘাটে গিয়ে অজু করে শান্টু। পুকুর পাড়ে একটা মসজিদ করেছে সে। গ্রামের একমাত্র পাকা মসজিদ। শান্টু নিজে খালি গলায় আজান দেয় প্রতি ওয়াক্তে। তারপর নামাজ পড়ে। বাড়ির কাজের লোকেরা আর দু’একজন প্রতিবেশি যোগ দেয় তার সাথে।
প্রজেক্ট ক্লোজিং-এর পার্টি থ্রো করেছেন বন্ধু প্রতিযোগী সাত্তার সাহেব। গুলশান যেতে হবে আজিজ সাহেবকে। প্রজেক্ট ক্লোজিং পার্টি আসলে সমাপ্তি উদযাপন নয়; বরং পরবর্তীতে আরো কাজ পাওয়ার জন্য ইনভেস্টমেন্ট। ব্যাবসার একটা অংশ এটা। দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, বিদেশি কনসালট্যান্টদের টিম সবাইকে দাওয়াত করা হয়েছে। সাথে রয়েছে অন্যান্য সম্ভাব্য দাতাদের প্রতিনিধিরা। দু’একজন প্রতিযোগীকে ডাকা হয় নিজের পসার দেখানোর জন্য। আর, ডোনারদের কাছে নিজেকে ‘ওয়েল কানেক্টেড’ প্রমাণ করতে। সেখানে যাওয়ার আগে ফ্রেশ হতে হবে। ডিনার জ্যাকেট নিতে হবে। কালো স্যুট ছাড়া এসব পার্টিতে আজিজ সাহেব সাধারণত যান না। তিনি বাসার দিকে রওনা হলেন।
পার্টি শুরু হয়েছে সাতটা থেকেই। আজিজ সাহেব পৌঁছালেন আটটার দিকে। জ্যামের ঢাকায় সন্ধ্যার সময় ধানমন্ডি থেকে গুলশান আসা সহজ নয়। পানীয়ের যথেষ্ট আয়োজন। প্রশিক্ষিত বেয়ারাদের সচেতন চোখ খুঁজে ফিরছে কার গ্লাস খালি হচ্ছে। নতুন গ্লাস চলে আসছে। সাথে বাদাম, চিপস বা সালাদ । আজিজ সাহেব বিয়ার খান, কোনো হার্ডড্রিংক নেন না। আরো নির্দিষ্ট করে বললে হেইনিক্যান বিয়ার। পার্টিতে ওটাই তাকে টানে। বোতলে নয়। ক্যান থেকে গ্লাসে ঢেলে খাওয়া তার পছন্দ। উনি শুরু করেন। আজিজ সাহেব এই দলটির সাথে একটা কাজের সংযোগ সৃষ্টি করতে চান। এগোলেন দলটির একজনের সাথে কথা বলতে।
সাত্তার সাহেব তার স্বাগত ভাষণ শুরু করলেন। খুব সংক্ষিপ্ত কিন্তু খুব গোছানো তার বক্তব্য। মূল কথা, এই ডোনারের সাথে তার কাজের শেষ নয়, এটা শুরুর শেষ। আরো অনেক কাজ তার ফার্ম করতে পারে। অপেক্ষা শুধু কাজ পাওয়ার। তার কথার কনফিডেন্স দেখে আজিজ সাহেব একটু হতাশ হলেন। এখানে জায়গা করে নেয়া কঠিন হবে। তা না হলে সাত্তার সাহেব তাকে দাওয়াত দিতেন না, তাও তিনি জানেন। কনসালট্যান্ট টিমের একজন, যিনি তার পাশে বসেছিলেন, রেড ওয়াইনের বোতল কাত করে আজিজ সাহেবের সামনের গ্লাসের কছে ধরলেন, ‘মে আই?’ ‘ও অফ কোর্স’। চিয়ার্স করে রেডওয়াইন ঠোঁটে ছোঁয়ালেন। মেইন ডিস সার্ভ করা হয়েছে। আজিজ সাহেব খুব সামান্য নিলেন।
রাতে খেতে বসে শান্টু মহা খুশি ফ্যাসা মাছের গা-মাখা তরকারি দেখে। সন্ধ্যার পর এই মাছ ধরা হয়েছে বাড়ির সামনের গাঙে কারেন্ট জাল পেতে। বাড়িটা গাঙের মোহনায়। গাঙ বললেও আসলে দুটো খালের মোহনা। যাহোক, খাবারের মূল আইটেম ফ্যাশা মাছ। একেবারে তাজা। সাথে ক্ষেতের করলা ভাজি। আর শেষ পাতে আমসীর টক পুঁটি মাছ দিয়ে। এই আমসীও বাড়িতে করা। ঝড়ের পরে ঝড়ে পড়া আম কুচিয়ে শুকিয়ে রাখা হয় সারা বছর টক খাওয়ার জন্য। আমসীর টক পাতে নিয়ে আরেকটা কাঁচা মরিচ নেয় সে। একগ্রাস টক স্বাদের ভাতের সাথে এক কামড় করে মরিচ খাবে। শান্টুর মতে অমৃত।
পার্টিতে শেষ দু’গ্লাস রেড ওয়াইন ‘অনুরোধে ঢেঁকি গেলা’র মতো বেশি হয়ে গেছে। গাড়িতে আসতে আসতে আচ্ছন্নতা কাটবে ভেবেছিলেন তিনি। গাড়ি থেকে নামার পর বুঝলেন, মাত্রাটা আসলেই একটু বেশি হয়েছে। দরজা খোলেন শর্মী, ‘কেমন হলো পার্টি?’ ‘ওই আরকি’। সোফার উপর নিজেকে এলিয়ে দিলেন। শর্মী বললেন, ‘হাতমুখ ধুয়ে এক কাপ ব্লাক কফি খাও। ভালো লাগবে।’ আজিজ সাহেব বললেন, ‘না কফি খাবো না, ঘুমাবো।’ কোনো মতে ফ্রেশ হয়ে তিনি বিছানায় গেলেন।
বারান্দায় মাদুর পেতে শুয়েছেন শান্টু। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। ভাদ্রমাসের পূর্ণিমা। জোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে বাড়ির উঠোন। আমগাছটার ছায়া পড়েছে রান্না ঘরের চালে। চাঁদের আলোতে তৈরি ছায়া সূর্যের আলোতে তৈরি ছায়ার মতো নিরেট নয়; বড় মায়াবী। কল্পনাপ্রবণ করে তোলে মানুষকে। বাদুড়ের ডানা ঝাপটানি, পেঁচার ডাক আর দূরে খালপাড়ের রাস্তার গর্ত থেকে থেকে শিয়ালের হুক্কাহুয়া। শান্টু প্রাণভরে চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি দেখেন। মেঘের আকৃতি বদলে যাওয়া দেখেন। কখনো পাহাড়, বন; কখনো ঘোড়া; কখনো যোদ্ধা। একই মেঘ ক্ষণে ক্ষণে বিভিন্ন কল্পনার উপলক্ষ এনে দেয়। চাঁদটা মেঘের আড়ালে ডুবতে ডুবতে ভেসে ওঠার ফাঁকে তার মনে পড়ে, শহরে গিয়ে পড়ালেখা করার স্বপ্ন ছিলো ছোটবেলায়; হয়ে ওঠেনি। তাতে লাভই হয়েছে; এই শান্ত, নিস্তরঙ্গ, ভাবনাহীন জীবন পেয়েছেন তিনি। এই ভাবনা মাথায় নিয়ে চোখ বুজে আসে তার।
শর্মী ড্রেসিং টেবিলের সামনে দিনশেষের প্রসাধনে ব্যাস্ত ছিলেন। হঠাৎ পিছনে ধপ করে একটা শব্দ; সাথে গোঙানি। তিনি ফিরে তাকান বিছানার দিকে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় বিছানাটা দেখা যায়। কিন্তু ওই মুহূর্তে তিনি ড্রয়ার খুলে এজ মিরাকেলের কৌটাটা বের করছিলেন। আয়না থেকে দৃষ্টি ফেরানো ছিলো নিচের দিকে। তিনি আয়নায় দেখতে পেলেন না; শব্দ শুনে পেছন ফিরলেন। সাথে সাথে চিৎকার করে উঠলেন তিনি। আজিজ সাহেবের জ্ঞান নেই। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে।
প্রথমে নেয়া হলো গ্রিন রোডের একটা ক্লিনিকে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারা রেফার করলেন ঢাকা মেডিকেলে। সেখানেই এতগুলো দিন।

৩.
এই কয়েকদিনে আজিজ সাহেব যত কথা বলেছেন, যেসব জায়গা বা মানুষের নাম বলেছেন তার কোনোটাই শর্মীর কাছে পরিচিত নয়। চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় তিনি বলতে শুনলেন ‘কাঞ্চননগর যাতি হবে নৌকো নিয়ে। রহিমরিতো আনতি হবে। এতদিন পরে বাড়ি আসতেছে ছাওয়ালডা।’ রহিম কে শর্মী জানেন না। কিন্তু কাঞ্চননগর নামটা তার কাছে পরিচিত। কাঞ্চননগর হচ্ছে আজিজ সাহেবদের এলাকার একটা গঞ্জ। এর সাথে আজিজ সাহেবের শৈশব কৈশোর ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। শর্মী এসব কথা শুনেছেন অনেক বছর আগে। ছাত্রজীবনে। লাইব্রেরির পাশে বসে বাদাম খেতে খেতে। শহুরে বন্ধুরা যখন নাগরিক জীবনের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে আলাপ করতো, গ্রাম থেকে সদ্য শহরে আসা তরুণ তখন চুপ করে থাকতো। শর্মীর সাথে একলা হলে গঞ্জের গল্প করতো, গাঙের গল্প করতো, ফ্যাসা মাছের গল্প করতো, বর্ষার কাদায় স্কুলে গিয়ে স্নান করে কাপড় পাল্টে ক্লাসে বসার গল্প করতো। শহরে বড় হওয়া শর্মীর কাছে এসব ছিলো গল্পের বইয়ে পড়া কাহিনীর মতো। শুনতো মন দিয়ে। তখন এসব অকারণ প্রগলভতাও ভালো লাগতো। অকাজের অনেক কথা হতো। আসলে সেই অকাজের কথাগুলো সব মিলে কাজের ভাব এনে দিলো তাদের মধ্যে।
গত পনেরো ষোলো বছরে আজিজ সাহেব ওমুখো হননি। আজ বলছেন, ‘কাঞ্চননগর যাতি হবে’। শর্মী আনিসকে ডাকেন। আনিস তখন ব্যাস্ত ব্যাংককে ফোন করতে।
‘তোর বাবা যে জায়গার কথা বলছে, সে জায়গার কথা আমি জানি।’
‘বল কি মা? কোথায়?’
‘ওদের এলাকার একটা গঞ্জের নাম বলছে। সেখানে যাওয়ার কথা বলছে।’
‘আর যাদের কথা বলছে তারা?’
‘জানি না। কিন্তু জায়গাটা তোর বাবার ছোটবেলায় খুব প্রিয় ছিলো। খালের মাথা বন্ধ করে রাস্তা হয় আর প্রায় আধা কিলোমিটার দূর থেকে আরেকটা খাল কেটে তার মুখে সøুইজ গেট বসানো হয়। দুই দিকে দুটো খাল আর অন্য দিকে একটা রাস্তা মিলে একটা ত্রিভূজ। তোর বাবার বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ ছয় কিলোমিটার দূরে। থানা সদর থেকে ওদের বাড়ি যেতে ওই পথে যেতে হয় না। তাই তোরা চিনিস না।’
‘কিন্তু লোকগুলো কারা?’
‘বুঝতে পারছি না, নামগুলো পরিচিত নয়।’
‘মা, তুমি কি নিশ্চিত, জায়গাটা তুমি ভুল করছো না?’
না, শর্মী ভুল করছেন না। হাসিখেলার সেই দিনে আজিজ ওই ত্রিভূজের মধ্যে বাড়ি করার স্বপ্নের কথা বলতেন। বাস্তবে সম্ভব নয় তা আজিজও জানতেন; শর্মীও জানতেন। কিন্তু সেই স্বপ্নের গল্পটা শুনতে ভালো লাগতো। উঠোনে একটা কাঠবাদামের গাছ লাগাবার সিন্ধান্তও নেয়া হয়েছিলো, শর্মীর মনে পড়ে। সেই কাঞ্চননগর!
শর্মী বলে, ‘একবার নিয়ে গেলে হয় না ওখানে! যদি কিছু মনে পড়ে!’
কাঞ্চননগরে গাড়ি থেকে নামতেই আমতলী খালের মোহনার সেই ত্রিভূজ চোখে পড়ে। অনেক বছরেও তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। শুধু গেটম্যানের বাড়িটা পোড়ো হয়ে গেছে।
প্লান ছিলো কাঞ্চননগর থেকে নৌকায় করে আজিজ সাহেবের গ্রামের বাড়ি যাওয়া হবে। কিন্তু আজিজ সাহেব হাঁটতে শুরু করলেন। একাই। বেশ জোরে জোরে। ঢাকা থেকে সাথে আসা প্যারামেডিক শর্মীর কানে কানে বললেন, ম্যাডাম রিস্ক হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।
কিছুদূর হাঁটার পরে তিনি বসলেন। একবারে গ্রামীণ কায়দায়। রাস্তার পাশের ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে। অন্যরা পিছন পিছন আসছিলেন। পিছনে থেকেই তারা শুনতে পারলেন, একজন পথচারী আজিজ সাহেবকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করছেন, ‘কাগে বাড়ি যাবেন আপনারা? কনতে আয়ছেন।’ আজিজ সাহেবের উত্তর, ‘বাড়ি যাবো; আমতলি। লোকটি আবার প্রশ্ন করেন, ‘আমতলি কোন বাড়ি? ’ আজিজ সাহেব উত্তর দেন, ‘আমতলি বড়বাড়ি। রহিমরি চেনো? আমি তার বাবা শান্টু।’ লোকটি এক মুহূর্ত কপাল কুচকে দাঁড়িয়ে বোধহয় রহিমকে চেনার চেষ্টা করেন; অথবা শান্টু নামটি মনে করার চেষ্টা করেন। তারপর নিজের মতো হাঁটতে শুরু করেন।
এইবার শর্মীর হাত পা অবশ হয়ে আসে। শান্টু যে আজিজ সাহেবের ছোটবেলার নাম সেকথা শর্মী শুনেছিলেন বিয়ের পর প্রথমবার এখানে এসে নানী শাশুড়ির কাছে। তিনি ডেকেছিলেন, ‘অ শান্টুর বউ, এদিকি আসো... সাহেব বউ দেহিনি কহোনো।’ শর্মী পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে জানতেন। নানী শাশুড়ির সাথে ভালোই ভাব হয়ে যায় তার। শোনেন, ওই নামে আজিজকে তার নানী ডাকতেন। দু’একজন আরো কেউ কেউ ডেকে থাকতে পারে একেবারে ছোটবেলায়। কিন্তু স্কুলে যখন শান্টু ভালো রেজাল্ট করতে লাগলো; আর শিক্ষকরা যখন প্রায় নিশ্চিত হলেন এ ছেলে বড় কিছু হবে, তখন আজিজুল হক নামের আড়ালে আস্তে আস্তে ঢাকা পড়ে যায় শান্টু। ম্যাট্রিক পাশ করার আগেই ঐ নাম হারিয়ে যায়। শুধু নানী তাকে ঐ নামে ডাকতেন। শর্মী ঐ একবার নামটা শুনেছেন। পরেরবার তিনি শশুরবাড়ি আসেন নানী শাশুড়ির মৃত্যু সংবাদ পেয়ে। এর মধ্য দিয়ে আজিজ সাহেবের শান্টু নামটি পুরোপুরি হারিয়ে যায়।
আজ নিজের সেই নাম বলছেন তিনি। সন্তানের নাম বলছেন। আজিজ কি তাকে না জানিয়ে সংসার করেছে গ্রামে? সেই ঘরে ছেলে আছে? এতদিন গোপন রেখেছে, এত বড় তঞ্চকতা? এখানে ওখানে কাজের জন্য মাসের মধ্যে আট দশ দিন ঢাকার বাইরে যান আজিজ। আসলে কি এত কাজ থাকে? নাকি এখানে আসেন কাজের নামে। এই সংসারে। এতবছর এভাবে চেপে রাখা যায়?
আনিস শর্মীর দিকে তাকায়। লজ্জায়, দুঃখে ছেলের চোখের থেকে চোখ সরিয়ে নেন শর্মী। মাটির দিকে তাকান। কী বলবেন! তিনি বললেই কি আনিস বিশ্বাস করবে! মা কিছুই জানতো না, বাবার আরেক সংসার সম্পর্কে!
আজিজ সাহেবকে ধরে নৌকায় তোলেন সবাই। নৌকা চলতে থাকে ‘আমতলি গাঙ’ নামের খাল ধরে।
৪.
কিছুদূর যাওয়ার পর খালটা মিশেছে উত্তর দিক থেকে আসা আরেকটা খালের সাথে। সেই মোহনায় নৌকা আসতেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন আজিজ সাহেব। চিৎকার করে করে ডাকতে থাকেন, ‘রেবেকা! রেবেকা!! সামাদ! রহিম! রহিম!!’ মোহনার কাছে যেখানে শান্টুর সংসার, ঘর-গেরস্থালী, সেখানে ধানের ক্ষেত; আদিগন্ত সবুজ। এ কি ভেল্কিবাজী! একি স্বপ্ন!! এ কি যাদু!!! কোথায় সব?
নৌকা এগোতে থাকে। আজিজ সাহেব চিৎকার করতে থাকেন। ‘কোথায় যাচ্ছিস।... নৌহো থামা। ... রেবেকা, ভাত তুলে দেওনি এহনো? ... রহিম খাবে কী? ... ছাওয়ালডা আসতেছে কতদিন পরে। ... সামাদ গেছে নৌকো নিয়ে ?’ ধান ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে আজিজ সাহেব আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়েন। নৌকা চলতে থাকে আজিজ সাহেবের বাড়ির দিকে।
শর্মীর কোলে আজিজ সাহেবের মাথা, মাথার মধ্যে শান্টু।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top