এক এক্কে এক : ঋভু চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশিত:
১৭ আগস্ট ২০২০ ২৩:৪৪
আপডেট:
২০ আগস্ট ২০২০ ২২:৩১
রিক্সাতে চাপবার পরেই ‘কোথায় যাবেন?’ শুনেই একটু থমকে গেল সঙ্গীতা।সত্যিই তো কি বলবে? এমনিতে ঘটনাটা বললেই হয়ত বাড়িটাতে ঠিক পৌঁছে দেবে। না হলে? কতটা বা কোনদিকে যেতে হবে জানা নেই।কোন লোকেশন না বললে ও বেচারা কোথায় বা নিয়ে যাবে? রুমা লোকেশনের কথা কোথাও কি কখনও বলেছিল, বা অন্য কিছু? একটু মনে করবার চেষ্টা করতেও কোন কূল খুঁজে পেল না।সেদিন থেকে রুমার ফোনটাও বন্ধ। সঙ্গীতার খুব অস্থির লাগল। রিক্সার ছেলেটি কিছু একটা বুঝে নিজের থেকেই জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি বাড়িটা জানেন না? নাম জানেন? নাম বললেই আমি নিয়ে চলে যাবো।’
এই জন্যেই হয়ত আবীর শুনেই এখানে আসতে বারণ করেছিল।কিন্তু এই অসময়ে তো না এসেও পারা যায় না। রুমা অবশ্য নিজে থেকে কিছু বলে নি। আগের দিনেও কাজে এসেছিল, সব কাজ করে প্রতিদিনের মতই দুপুরের দিকে চলেও গেল।তার পরের দিন সকাল নটা পর্যন্ত কাজে না আসাতে সঙ্গীতার একটু চিন্তা হয়। এমন তো কখনও করে না। কোন দিন কামাই করলেও আগে থেকে জানিয়ে দেয়।এমন কি কোন দিন দেরি হলেও ফোনে জানিয়ে দেয়। সঙ্গীতা নিজের থেকে ফোন করবার চেষ্টা করলেও ফোন বন্ধ পায়। কোন বিপদ হল না তো? আগের সপ্তাহেই কিছু টাকা ধার চাইল, ‘বৌদি, ছেলেটার শরীর খারাপ, ডাক্তার দেখাতে হবে, তুমি মাইনে থেকে কেটে নিও।’ এটা রুমা মাঝেই মাঝেই করে। ‘সেটা হতেই পারে।আমাদের প্রয়োজন হয় না ? এই ফ্ল্যাটটাই তো ধারের টাকায় কিনেছি।’ কথাগুলো আবীর উত্তরে বলে।আসলে রুমা মেয়েটা খুব ভালো। কোন দিন কোন কাজ করব না বা পারবো না বলে না। প্রথম যেদিন কাজে আসে সঙ্গীতা বলে,‘দ্যাখো আমরা দুজনায় কাজে বেরিয়ে যাই, তোমাকে এক বেলা কাজে আসতে হবে, কিন্তু তাড়াতাড়ি আসবে।’
-আমরা তো সবাই এখানে সকাল ছটার মধ্যেই চলে আসি।ফাস লুকালে আসি তো।
-তোমাদের ফাস লুকাল এখানে বুঝি ছ’টায় আসে।
-না গো বৌদি টেরেনটা সাড়ে পাঁচটায় ঢুকে যায়। স্টেশন থেকে হেঁটে আসতে হয় তো।
প্রথম দিনেই চমকে উঠে ভালো করে রুমার দিকে তাকাতেই পেটের নিচটা ফোলা ফোলা বুঝেই জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার কি বাচ্চা হবে?’
রুমা মাথাটা সঙ্গে সঙ্গে নিচের দিকে করে উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ গো বৌদি।’
–তুমি তাহলে কিভাবে কাজ করবে ?
–ও তুমি ভেবো না। কয়েক দিন ছুটি নেব। আর কামাই করব না।
চমকে ওঠে সঙ্গীতা। ওদের ফ্ল্যাট থেকে স্টেশন পাক্কা আড়াই কিমি রাস্তা। পাড়ার অনেকেই ভোরে হাঁটতে যান। আর এই রুমা এই আবস্থায় প্রতিদিন তার ফাস লুকাল ট্রেনে এসে আবার এই আড়াই কিমি রাস্তা দু’বার যাতায়াত করবে!।সঙ্গীতা হেসে হেসেই বলে,‘তোমার কোন দিন সুগার হবে না গো। তবে তোমার বাচ্চা হলে তুমি আসতে পারবে না, সে তুমি যতই বল।’
রুমা কাজে ঢোকে,সঙ্গীতার চোখের সামনে রুমার পেট বাড়তে থাকে। দেখে কষ্টও হত, মেয়েটা বরের কথাও কিছু বলে না। সঙ্গীতা সেই সময় ছাড়াতেও পারছিল না। আবীরের সাথে আলোচনা করে রেখেছিল, ‘বাচ্চটা হলে ছুটি নেবে তখন অন্য কাউকে রেখে নেব।’ সঙ্গীতাকে অবাক করে রুমা কিন্তু ঠিক তিন সপ্তাহ অন্য একজনকে ঠিক করে দিয়ে গেলেও তিন সপ্তাহ পরে কাজে এসে গেছিল।দরজা খুলেই অবাক ভাবে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিল, ‘কি গো তুমি এসে গেছ, বাচ্চা কেমন আছে? ও কই?’
–পাশে এক জনার কাছে রেখে এইচি।
-কি হল দিদি? কোথায় যাবেন বলুন।
সঙ্গীতা একটু অন্য মনস্ক হয়ে গেছিল। রিক্সাচালকের ভাইয়ের কথা শুনে কিছুটা সম্বিত ফিরে আসতেই বলে,‘আসলে আমি যেখানে যাবো তার বাড়ির অ্যাড্রেসটা ঠিক জানি না।’
-এ’বাবা, আমি কিভাবে নিয়ে যাবো ?
সঙ্গীতা আগের মতই আমতা আমতা করতে করতেই বলে, ‘তোমাকে নাম বললে নিয়ে যেতে পারবে তো?’
–বলেই দেখুন, এই জায়গার প্রতিটা গলি মুখস্ত, প্রতিটা লোককে চিনি।
–আমার ফ্ল্যাটে একটি মেয়ে এখান থেকে কাজ করতে যেত, কয়েক দিন ধরে যাচ্ছে না।
-কি নাম বলুন এক্ষুণি নিয়ে চলে যাচ্ছি।
-সঙ্গীতা একটা ঢোঁক গিলে উত্তর দেয়, ‘রুমা।’
–রমা! কেমন দেখতে বলুন তো, একটু রোগা, আমার মত, গালে একটা দাগ আছে ?
“ তোমার গালে এই দাগটা কিসের গো? জন্ম থেকেই ?’’ রুমাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল।
‘’না গো বৌদি, ছোট বেলাতে একটা পোকা চেটে দিয়েছিল।ঘা হয়ে গেছিল।অনেকদিন সাড়ে নি। অনেক ডাক্তার দেখাতে হয়েছিল। ”
সঙ্গীতার ঘায়ের কথা মনে পড়তেই ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলতেই উত্তর শুনল, ‘না বৌদি ওর বাড়ি যাবো না। আপনি অন্য ব্যবস্থা করুন।’
ছেলেটি কথাগুলো বেশ জোরেই বলে উঠল।
কথাগুলো আবীর শুনলেই এখুনি খিঁচখিঁচ আরম্ভ করবে।এখানে আসার কথা শুনেই বলছিল, ‘কটা ফ্ল্যাটে কাজ করে? সবাই যাবে? একটা মেয়ে কাজ করত এখন করছে না, মিটে গেছে। তাও যদি শরীর খারাপ হত কিছু বলবার থাকত। এই রকম একটা জায়গায় তুমি গিয়ে কি করবে? ওদিকে তো যাওনি, গেলে বুঝবে।’
কথাগুলো মনে পড়তেই সঙ্গীতা ভয়ে শিউরে উঠল। ততক্ষণে আশেপাশে বেশ কয়েকজন জড়ো হয়ে গেছে। রিক্সা চালক ছেলেটির মুখে সব শুনে এক জন বলে উঠল, ‘না দিদি মোহনের বাড়ি কেউ যাবে না।ও যা করেছে তারপর এখানকার সবাই ওকে এক ঘরে করে দিয়েছি।’
–আরে আমি তো আর আপনাদের মোহনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি না।রুমা আমার কাজ করত মাইনে বাকি আছে, তাই......।
কয়েকটা লোক একটু সরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে কি আলোচনা করল কে জানে, কিছুক্ষণ পর সঙ্গীতার কাছে এসে বলল, ‘বুঝতেই তো পারছেন দিদি, এরকম ঘটনা আমাদের এখানে এই প্রথম। যাকে ধরেছে আমাদের সাথে বসে তাস খেলত। কি যে করল। তাও তো ওটাকে পুলিশ ধরেছে, বাকি কয়েকজন পগাড় পাড়।সব সময় পুলিশ আসছে।ওর সাথে আমাদের কারোর যোগাযোগ ছিল জানতে পারলে আমাদের কেও তুলে নেবে।পুলিশের কথাতে ভয় লাগে।’
কোন কথা মুখে না বললেও সঙ্গীতার মনে আবীরের কথাগুলো ভেসে উঠল,‘ যাও, কিন্তু পুলিশ তোমাকেও ধরবে তখন বুঝবে।’
-ভেঙচি কেটে সঙ্গীতা উত্তর দিয়েছিল, ‘হ্যাঁ.., আমাকেও ধরবে, খ্যাপা পেয়েছ নাকি, যা বোঝাবে তাই বুঝবো।’
-শুনুন দিদি, ও যাবে কিন্তু একটু দূরে নামিয়ে দেবে।
তখন ‘ঠিক আছে।’ বলে রিক্সাতে চেপে গেলেও একটু দূর যে এতটা দূর বুঝতে পারল হাঁটার সময়। তাও যাকেই জিজ্ঞেস করছে কেমন যেন চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে।
দরজা খুলে সঙ্গীতাকে দেখে প্রথমে অবাক হলেও একটু পরে রুমার কান্না দেখে কি করবে বুঝতে পারছিল না। আস্তে আস্তে ঘরের ভিতরে ঢুকল।বাইরেটাতে তখন কয়েক জন ভিড় করতে আরম্ভ করে দিয়েছে।ঘরে ঢুকতেই রুমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,‘দরজাটা লাগিয়ে দাও।’
এক কামরার ছোট্ট একটা ঘর।বস্তি নয়, আবার তার থেকে ভালো ব্যবস্থাও নয়।প্রায় পুরো ঘরটা জুড়ে থাকা একটা তক্তার উপর পিঠে বালিশ দিয়ে বসে আছে রমার এক বছরের ছেলে।সামনে কয়েকটা কম দামি খেলনা পড়ে। বন্ধ দরজার এক কোণে মুখে কাপড় চেপে দাঁড়িয়ে থাকা রুমার দিকে তাকিয়ে সঙ্গীতা বলে উঠল,‘আমাকে তো একটা ফোন করে জানাতে পারতে।’
-কি জানাবো বৌদি, খুব খারাপ লাগছিল।
–আমাদের উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে কাজ করে মোটা করে বউটা, কি যেন নাম, ওকেই জিজ্ঞেস করলাম।
-তোমাদের খুব অসুবিধা হচ্ছে বল।
সঙ্গীতা একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলে উঠল, ‘আর অসুবিধা, রাতে বাসন মেজে নিতে হচ্ছে।’
-আজ তোমার ছুটি ?
-না গো ছুটি নিলাম।তোমার ব্যাপারটা সব কিছু না বুঝলে তো কিছু করতে পারছি না। তোমার দাদা বারণ করছিল। আমিই জোর করে এলাম।ভাবলাম তুমি তো কোন দোষ করনি।আর এই বাচ্চাটা? এর কি দোষ বল। কথাগুলো শুনেই রুমা আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতেই সঙ্গীতা তক্তা থেকে নেমে তার কাছে গিয়ে পিঠে হাত দিয়ে বলে উঠল,‘কেঁদো না, তোমার কোন দোষ নেই।শক্ত হও, এখানে বোসো।’
রুমা শাড়ির কোণটা দিয়ে চোখ দুটো মুছতে মুছতে বলল, ‘ওরা কিছু বলছিল ?’
-ওরা বলতে তোমার বাকি ঘরগুলো ? সবার সাথে তো দেখা হয় নি। শুধু বোসকাকিমার সাথে দেখা হয়েছিল। মাইনেটা পাঠিয়ে দেবে বলেছে। ওরা মনে হয় কাউকে রেখে দিয়েছে। তোমার বর কি কোনদিন ওদের ওখানে গেছিল ?
-কয়েক বার গেছিল।ঐ কাকিমার বাড়িতেই প্রথম ঢুকি তো।
সঙ্গীতা একটা লম্বা করে ‘ও’ বলল, আর তাতেই চাপা পড়ে গেল বোস কাকিমার বলা বাকি কথাগুলো, ‘ওর বরটার চোখমুখ কেমন যেন, দেখে সব সময় মনে হয় গিলে খেতে আসছে। কিছুই করে না তো, এর পয়সায় বসে বসে খায়, আর এর উপর মাতব্বরি করে। আমি তো প্রথম শুনেই বললাম।’
–তুমি আসবে জানে না ?
–আজকে আসবো বলিনি।তবে .....।
সঙ্গীতা চেপে যেতেই রুমা জিজ্ঞেস করে ‘ থামলে কেন?’
–বাদ দাও, তোমার ছেলেকে আজকেই প্রথম দেখলাম। বেশ মিষ্টি দেখতে।
রুমা কোন উত্তর না দিয়ে শুধু মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘বৌদি তোমার কোন কিছু খবর নেই? ’
কথাগুলো শুনেই সঙ্গীতা রুমার দিকে তাকিয়ে থেকে উত্তর দিল, ‘না গো, আমাদের তোমাদের মত নয়, সব কিছু পরিকল্পনা করে করতে হয়। আসলে বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিলাম তো, ভাড়া বাড়ি থেকে এই এক বছর হল ফ্ল্যাটে এলাম, সামনের বছর নেবো।’
তারপর নিজের ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে রমার হাতে দিয়ে বলল, ‘এই নাও তোমার মাইনেটা, আরো কিছু এক্সট্রা দেওয়া আছে। তোমার বরটাতো কিছুই করত না শুনলাম।’ রুমা কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকবার পর বলল,‘শুধু টাকা দিয়ে কি হবে বৌদি, টাকা তো আর খাওয়া যায় না।’
–কেন ?
–সেদিনের পর থেকে আমি এই ঘরের ভিতরেই বন্দি হয়ে পড়ে আছি। কোন দোকান মাল দিচ্ছিল না, বাইরের কলে জল নিতে দিচ্ছিল না, একটু দুধও কিনতে পারছিলাম না।
এরকম যে কিছু একটা হতে পারে সেটা এখানে রিক্সাতে চাপবার সময়েই অনুমান করেছিল। তাও বলল, ‘আমি কি দোকান থেকে এনে দেবো, কি কি লাগবে বল।’
-না গো বৌদি, কাল টিভির থেকে একজন এসেছিলেন, এই তোমারি মতন।আমার ব্যাটার বাবার ব্যাপারে কি সব জানতে এসেছিল, তাকে সব কিছু বলতে আমাকে সঙ্গে করে বাজার থেকে জিনিস কিনে এনে দিল।
একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সঙ্গীতা বলল, ‘যাক।’
কিছু সময় চুপ থেকে জিজ্ঞেস করে,‘ঐ মেয়েটা কোথাকার, খুব বেশি বয়স নয় সম্ভবত টিউসন পড়ে ফিরছিল। কোন এক পেপারেও নাকি দিয়েছে। তোমার দাদা বলছিল।’
–পাশের পাড়ায় থাকত। আমার ব্যাটার বাবা সন্ধেবেলায় জুয়া খেলতে যেত। খুব খারাপ করল বৌদি। বাচ্চা মেয়ে....।
রুমা কেঁদে উঠতেই সঙ্গীতা আবার তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ‘তুমি কেঁদে কি করবে? তুমি তো আর কোন দোষ করনি।’
–তুমি জানো না বৌদি, সবাই আমাকেই বলছে। মনে হচ্ছে এটাকে কোলে নিয়েই ঝাঁপিয়ে দি।
–ছিঃ ছিঃ, এরকম কথা মুখে এনো না। প্রয়োজনে তুমি আমাদের ওদিকে চলে এসো। ওখানেও তো তোমাদের থাকবার ব্যবস্থা আছে। সেখানে থাকবে।
বাইরে বেরোনোর সময় ব্যাগ থেকে আরেকটা পাঁচশ টাকা নোট রুমার হাতে দিয়ে সঙ্গীতা বলল, ‘তোমার ছেলেকে এই প্রথম দেখলাম তো, এটা ধর।’
শাড়ির আঁচল দিয়ে আবার চোখ দুটো মুছতে মুছতে রুমা বলে উঠল, ‘বৌদি, আমাকে আবার কাজে রাখবে তো?’
সঙ্গীতা রুমার দুটো হাত নিজের হাতের মধ্যে রেখে উত্তর দিল, ‘কাল থেকেই এসো।’
ঋভু চট্টোপাধ্যায়
পশ্চিম বর্ধমান, ভারত
ছবি স্বত্ত্বঃ আনিসুল কবীর
বিষয়: ঋভু চট্টোপাধ্যায়
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: