জীবন যখন যেমন : কাজী খাদিজা আক্তার
প্রকাশিত:
২৪ আগস্ট ২০২০ ২২:২৯
আপডেট:
২৪ আগস্ট ২০২০ ২২:৫৪
সেদিন রবিবার। ব্যাংক থেকে বেতন তুলে ঝটপট সিড়ি দিয়ে নেমে দ্রুত হাটা শুরু করলাম।দশ মিনিট হাঁটলেই সিএনজি স্টেশন। তড়িঘড়ি পা চালাচ্ছি আর ভাবছি, ভাগ্যিস ব্যাংকে লম্বা লাইন ছিলোনা, থাকলে অনেকটা সময় লেগে যেতো। এদিকে জোহরের নামাজটাও পড়া হয়নি। চারটা বেজে গেছে বাসায় একটা ফোনও করা হলো না।বাচ্চাগুলো খেয়েছে কিনা তাও জানিনা। এতোকিছু ভাবতে ভাবতে দশ মিনিট এর পথ আজকে বিশ মিনিট মনে হচ্ছে। কিছুটা পথ যেতেই দেখলাম রাস্তার পাশে হোটেলের সামনে একজন বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচের বাক্সের ভেতর হরেক রকম মিষ্টি, অন্যপাশে আরও একটা বাক্সে সিংগাড়া, পুরি। বৃদ্ধা চেয়ে চেয়ে দেখছেন। আমি কাছে দাঁড়ালাম, তাঁর পিঠে হাত রাখলাম।
বয়স আশি পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। শরীরের চামড়ায় ভাজ পরেছে অসংখ্য। বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে গেছে। আর সে ভার বহন করছে একমাত্র সম্বল হাতের লাঠিটা।পাটের আঁশের মতো ধারালো উশখু খুশকো চুল। গায়ে ব্লাউজ নেই। বারোহাত কাপড়টার শরীর ঢাকার নিস্ফল চেষ্টা। পিঠে হাত রাখতেই আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। মরা মাছের মতো চোখ দুটো দিয়ে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। জিজ্ঞেস করলাম,
- কিছু খাবেন চাচী?
অস্ফুট ভাবে বললেন,
- হ, খামু।
হোটেলের ছেলেটাকে বললাম এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে কিছু দাওনি কেন?
- দিছি আফা, সিংগাড়া দিছি, খাইছে।
- আর?
- আর কি দিমু? অহন মালিক নাই, এর থাইক্কা বেশি দেওনের সামথ্য আমাগো নাই।
- বললাম, ঠিক আছে ঠিক আছে।
- চাচী আসেন, ভিতরে আসেন। এই চেয়ারটায় বসেন।
বসতে গিয়ে পরেই যাচ্ছিলেন যদি না ধরতাম। সকল কিছুর পর লাঠিটার দিকে খেয়াল ঠিকই আছে, ওটাই যে একমাত্র ভরসা। জিজ্ঞেস করলাম,
- কি খাবেন? আমিও আপনার সাথে খাবো।
ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন 'ভাত'। আমি বললাম, আচ্ছা।
এদিক ওদিক তাকালাম। দেখলাম, ভাতও হয় এই হোটেলে। ভালোতো, একের ভেতর অনেক। একজনকে ডেকে বললাম,
- ভাত, মাছ, মাংস,ডাল যা আছে সব দাও এখানে। "জ্বি আফা এহনই দিতাছি "বলে ছেলেটা দ্রুত চলে গেলো। ছেলেটাকে খুশি খুশি দেখাচ্ছিলো। খেয়াল করলাম, ওর কাছেও ব্যাপারটা খুব ভালো লাগছে। এবং খুব তাড়াতাড়িই সবকিছু টেবিলে হাজির। মনে হচ্ছিলো যেনো ছেলেটা আগে থেকেই সব জানতো, তাই গুছিয়ে রেখেছে । বৃদ্ধা চাচী ভাতের দিকে তাকিয়ে আছেন। বললাম,
- নিন চাচী, এখন খাওয়া শুরু করেন।
বলার সাথে সাথেই পাগলের মতো খাওয়া শুরু করলো। মনে হয় দুতিনদিন পেট ভরে খাওয়া হয়নি। কুঁজো বুড়ি খাচ্ছে আর তৃপ্তি পাচ্ছি আমি। সেযে কি শান্তি বলে বোঝানো যাবেনা।ছেলেটাকে ডেকে বললাম,
- আমাকে এক কাপ চা দাও।
- আফা এহন চা হাইবেন এমুন দুফুর বেলা।
- হ্যাঁ, খাবো। আমার যখন ইচ্ছা হয় তখনই চা খাই। তুমি নিয়ে আসো। আর ওনাকে একটা ঠান্ডা দই দাও।
- জ্বি আফা, আন্তাছি।
এখনো খাচ্ছেন কুঁজো বুড়ি। আহা! কি মায়া হচ্ছে। বাহিরে অনেক কোলাহল। রিকশা, গাড়ির হর্ণ, পথচারীদের পথ চলা। আর ভেতরে, " এই কাসেম ইহানো চিনি ছাড়া একটা আর চিনিসহ দুইডা চা দে, এই টেবিলো ভাত লাগা। রতন, ঐ সবুজ তিন নাম্বার টেবিলো কতো অইছে? মাঝখানের টেবিলো মগলাই দে, আর হেই টেবিলডা অহনো পইস্কার করছতনা ক্যান।" চলমান জীবন। আর এখানে এই টেবিলে, একটি নিস্তব্ধ জীবন আবারও হামাগুড়ি দেয়, দাঁড়াতে চায়? নাকি মাথা নুয়ে মিশে যেতে চায়, সেটা বোঝার চেষ্টা করছি। আর ভাবছি, জীবন যখন যেমন। হঠাৎই ছেলেটা এসে বললো,
- নেন আফা, দই নেন।
দই দেখে বললাম,
- চাচী দইটা খেয়ে নিন। এই গরমে ভালো লাগবে। আর কিছু খাবেন?
- না, মায়ো,,,
-পেট ভরেছে?
-হ, মায়ো,,,,পেট ভইরা খাইছি। আল্লা তোমারে বালা রাহুক, দোয়া করি।
- এবার বলেন, কোথায় যাবেন? ছেলেমেয়ে কেউ আছে?
দেখলাম বৃদ্ধার চোখ জলে ভরে গেছে। ঝাপসা চোখে আরও ঝাপসা দেখছেন। বুঝলাম এ সম্পর্কে কিছুই বলবেননা তিনি। আপন ভেবে কেউ কাছে রাখলে তিনি হয়তো এই বয়সে পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন না। আমায় আবারও সারা শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ করতে লাগলেন। বললাম,
- চাচী এই কটা টাকা রাখেন। খিদে পেলে খাবেন।
হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন লাগবেনা। ফিরিয়ে দিলেন। বুঝতে পারলাম যথেষ্ট আত্মসম্মান বোধ রয়েছে। চলে গেলেন লাঠিতে ভর করে ধীরে ধীরে- অজানা গন্তব্যে। বিল পরিশোধ করে আমিও চললাম উল্টো পথে।
সেলিনা হোসেন তাঁর "পোকামাকড়ের ঘরবসতি" - তে বলেছিলেন, " মানুষগুলো আলোর দানা, জ্বলতেই থাকে- জ্বলতেই থাকে।"
হ্যাঁ সব মানুষই আলোর দানা, সেই আলো প্রাণ থাকতেই মাঝে মাঝে নিভে যায়। আর নিভে যাওয়া দানাগুলো আমাদের চারপাশের ধুলোয় লুটোপুটি খায় অহর্নিশ, শুধু আমরা দেখতে পাইনা বা দেখতে চাইনা।
কাজী খাদিজা আক্তার
লেখক ও প্রাবন্ধিক, প্রভাষক (ইংরেজি), সরাইল সরকারি কলেজ।
বিষয়: কাজী খাদিজা আক্তার
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: