সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

রেনেসাঁস বা মর্ডানিটির ক্ষয়িষ্ণু প্রতিভূ সুকান্ত : কুমারেশ সরদার


প্রকাশিত:
২৯ আগস্ট ২০২০ ২১:৪৭

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:৪২

ছবি : কবি সুকান্ত

'কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন 
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন
যে আছে মাটির কাছাকাছি 
সে- কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।' - (রবীন্দ্রনাথ/ জন্মদিন কাব্য ১০নং কবিতা) 

 

রবীন্দ্রনাথের কলমে এ  কবিতা জন্ম নিয়েছিল শুধু সুকান্তের জন্য। কারণ প্রতিভার স্ফুরণের আলোকিত তাঁর সাহিত্য প্রতিভা। বাংলা সাহিত্যে হয়তো তাঁর সাহিত্যের প্রত্যাশা আরও বেশি ছিল, কিন্তু তিনি যেটুকু দিয়েছেন তা অসাধারণ, বিস্মিত বলা হলেও ভুল বলা হবে না। ক্ষণজন্মা কিশোর কবি হিসাবে তিনি পরিচিতি লাভ করলেও ভাষা আর ছন্দের অনায়াস দক্ষতা ও বলিষ্ঠ প্রতিবাদী চেতনা তাঁর কবিতাকে পাঠকহৃদয়ের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। 

'ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্ণিমা- চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি...'  
এই যার প্রতিভা তাকে মূল্যায়ন মানচিত্রে ধরা দূরূহ শিখরের ন্যায়। সমাজ জীবনের নানা অসঙ্গতি অন্যায় অবিচারের প্রতিভূ হিসাবে তিনি হয়তো পিনাকপাণির ত্রিশূল হাতে সাহিত্যের মানচিত্রে এসেছিলেন ক্ষণিক মুহূর্তের জন্য, তবু তিনি ভুল করেননি তাঁর ত্রিশূল রূপী কলমের জাদু স্পর্শে  শিল্প মন্ডিত করেছেন পাঠক মনকে। তাঁর জীবনাদর্শের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল তাঁর লেখায়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুভূতিতে- 'সুকান্ত রাজনীতির কাঁধে চড়েনি। রাজনীতিকে নিজের করেছিল। রাজনৈতিক আন্দোলন ও সুকান্ত কে দিয়েছে তাই সানন্দ স্বীকৃতি।  নিজেকে নিঃশর্তে জীবনের হাতে  সঁপে দেওয়াতেই স্বতোৎসারিত হতে পেরেছিল সুকান্তর কবিতা।' 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ ভার্সাই এর সন্ধি ও শেষ সেই সময় যখন সূর্য আধারিত তখন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছে সময় এমন পরিস্থিতির রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে বাংলা ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ ৩০ শে শ্রাবণ, ইংরেজিতে ১৯২৬ সালের ১৬ই আগস্ট জন্ম দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাটের ৪৩ মহিম হালদার স্ট্রিটের মামার বাড়িতে অর্থাৎ মাতামহ সতীশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের বাড়িতে। বাবা নিবারণ চন্দ্র ভট্টাচার্য মা সুনীতি দেবী। কবির পিতার আদি বাড়ি ছিল বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়া গ্রামে। ছোটবেলা থেকে তাঁর কাব্যচর্চার স্ফুরণ ঘটে। একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে বড় হওয়া কিছুকাল পর শৈশবে মাকে হারান এরপর জ্যাঠতুতো দিদি রানীর কোলে পিঠে চড়ে বড় হতে থাকেন। আট বছর বয়সে লেখার জগতে আসেন। কবির এগারো বছর বয়সে আকস্মিকভাবে মৃত্যু হয় রানী দিদির। একাকিত্বের মধ্যে পড়ে যান কবি সেই সময় আলাপ হয় কবি বন্ধু অরুণাচল বসু এবং তাঁর মা সরলা বসুর সঙ্গে। সরলা বসু সুকান্ত কে নিজের ছেলের মত ভালোবাসতেন। আসতে আসতে কবির জীবনের শূন্যতা কেটে যায় এবং সাহিত্য চর্চায় ফিরে আসেন। 

মাত্র একুশ বছর বেঁচে ছিলেন কবি। তাঁর জীবন দর্শন ও কাব্যের বিষয় চিন্তা চেতনা মোটেও কিশোর মানসিকতার ছিল না। তিনি হয়তো কিশোর কবি হিসেবে পরিচিত। সমাজ জীবনের নানা অসংগতি অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে যুগপৎ কবি গণ মানুষের ভাষাকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাঁর কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ। সমালোচকদের কথায় তিনি কবিতাকে স্লোগানে উচ্চকিত করেছেন। কবিতার বিষয় বক্তব্য প্রসাদগুণ শব্দচয়ন উপস্থাপন ও আঙ্গিক জনমানুষের মনে প্রভাব ফেলেছিলেন তাই তিনি গণমানুষের কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। 

কাব্যচর্চার প্রেরণা হিসেবে পেয়েছিলেন অগ্রজ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় কে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণায় পাওয়া যায়-  'কীভাবে কবিতা লিখতে হবে তার জন্য সুকান্ত তাঁর কাছে আসতেন, কিন্তু কী লিখতে হবে সেই সংকট তার কখনোই ছিল না।' 

যখন পৃথিবী তথা ইউরোপে রেনেসাঁসের প্রভাবে বিপ্লব তৈরি হয়েছিল, শিল্প-সাহিত্য সমাজে তেমনই বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে ও রবীন্দ্রনাথ নজরুল পরবর্তীতে সুকান্ত নবজাগৃতি উদ্দীপনা উন্মাদনাকে বাড়িয়েছিলেন । বাংলা সাহিত্যে সমাজ জাতি গঠনের প্রতি রেনেসাঁসের অগ্রগতি নির্ভরশীলতা সেই সময় জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়তো সঠিকভাবে ধরা যাচ্ছিল না। উপনিবেশিক শাসন সেই আমলে পশ্চিমের বিন্যাস এক ধরনের রেনেসাঁস মর্ডানিজম, মার্কসবাদ কিংবা সোসালিজম, কমিউনিজমের রাজনীতি তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ উপনিবেশকতায়। পরে ১৯৪৬ সালে মুম্বাই এর নৌ- বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ শাসকদের উপর অত্যন্ত সিদ্ধান্তমূলক আঘাত এনেছিল রেনেসাঁস পন্থী কমিউনিস্টরা। পরবর্তীতে সংগঠন আয়োজনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা এবং কমিউনিস্ট পার্টির লাইমলাইট তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা মিত্রশক্তির ঘেঁষা লাইন ও বাম রেনেসাঁসের প্রতি সুকান্ত আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। তিনি নিজের চেষ্টায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের রেনেসাঁসের আবর্তণ ঘটাতে। 

১৯৪২ সালে তিনি সরাসরিভাবে রাজনীতির আঙিনায় পা রাখেন, এবং ১৯৪২ সালে ছাত্ররাজনীতির একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে আবির্ভূত হন।'জনরক্ষা সমিতিকে কেন্দ্র করে তিনি পার্টির প্রচার ও সাংগাঠনিক কাজে যুক্ত থাকতেন । ১৯৪৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগিতায় শিক্ষা- স্বাস্থ্য- সেবা - স্বাধীনতার আদর্শে তিনি 'কিশোর বাহিনী' নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। যার নিরলস সৈনিক ছিলেন। এর পাশাপাশি 'জনযুদ্ধ' পত্রিকায় নিয়মিত ভাবে লিখতেন।  মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি সেই সময় অর্থাৎ ১৯৪৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন‌। কিন্তু ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি তাতে কি ছাত্র ও বামপন্থী আন্দোলনের সাথে তিনি জড়িয়ে পড়েন। 

তিনি ছোটবেলা থেকে শুনছেন দেখেছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত মানুষের অবস্থা ইতালিতে ক্রমাগত শক্তিশালী নাস্তিবাদ, ফ্যাসিবাদের লড়াই । ১৯১৭ সালে কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে বিশ্বে প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে নিজেদের যোগ্যতা অর্জন করা। লেলিনের শোষণমুক্ত বিপ্লব গন মানুষের সমাজ কে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। উপনিবেশিক শক্তি গুলি মাথা নাড়িয়ে  উঠছিল ফলে তৈরি হচ্ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাব। সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো পৃথিবীর অন্যান্য দেশ গুলিতে গড়ে উঠেছিল কমিউনিস্ট পার্টি। এই সময় নিজের ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ উপনিবেশিকতার কবল থেকে মুক্তির স্বাদ আনতে চাই ছিলেন সুকান্ত। তিনি একলা চাইলে তো হবে না তাই কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সেতুবন্ধ তৈরি করেছিলেন । এর মধ্যে তিনি সমানতালে সৃষ্টি করলেন তাঁর সাহিত্য । ১৯৪৪ সালে তাঁর সম্পাদনায় 'অকাল' নামে একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। অনিবার্যভাবে গ্ৰন্থের উস্থাপিত হয় পঞ্চাশের মন্বন্তর অর্থাৎ ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, ১৯৪৭ সালের দেশভাগ , সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ফ্যাসিবাদ আগ্রাসন। তাঁর শানিত কলমে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে লিখলেন- 

'আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি 
প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি,
মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
আমার বসন্ত কাটে 
খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়।' 

ম্যাক্সিম গোর্কি যে বিপ্লবের রোমান্টিকতার কথা বলেছেন তার কিছু অংশের রোমান্টিকতার খোঁজ পাওয়া যায় সুকান্তর লেখায়। কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য কিন্তু তাঁর কবিতা কখনোই 'শৌখিন মজুরিতে' পরিণত হয়নি। তাঁর জীবনাভিঞ্জতার কোন অভাব ছিল না ফলে 'কৃষ্ণাণের জীবনে' নৈকট্য ও কর্ম তাকে নিয়ে গিয়েছিল সত্যতার সাফল্যে। ক্ষীণতর জীবনে তাঁর সাহিত্য যতসামান্য হলেও তিনি একটি সাহিত্যিক ধারার সর্বগন্য প্রতিনিধি। 

ইউরোপের ক্ষেত্রে রেনেসাঁসকে মর্ডানিটিও বলা হয়ে থাকে। এখানে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন আর বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের 'ছাড়পত্র' কাব্যগ্রন্থের "ইউরোপের উদ্দেশ্যে" কবিতায় ধরা পড়ে সমাজ সভ্যতার রীতিনীতি বিকাশের দিক-
'এখানে সেখানে ফুল ফোটে আজ তোমাদের দেশে 
কত রঙ কত বিচিত্র নিশি  দেখা দেয় এসে। 
ঘর ছেড়ে পথ বেরিয়ে পড়েছে কত ছেলেমেয়ে 
এই বসন্তে কত উৎসব কত গান গেয়ে।' 

সুকান্তের কবিতায় খেটে খাওয়া দিনমজুর মুটে শ্রেণীর মানুষের কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। তেমনই একটি কবিতায় বলেছেন- 
'শোনরে মালিক শোনরে মজুমদার!
তোদের প্রাসাদে জমা হল কত মৃত মানুষের 
হার- হিসাব কি দিবি তার?'  

সুকান্তের কবিতা ভূগোল কিংবা ইতিহাসের অন্ধ বিভ্রান্তির মধ্যে অবস্থান করে নি। কাল গণ্ডির সীমা ছাড়িয়ে পাঠক মনের দরবারে পৌঁছে গেছে। নিসর্গ সৌন্দর্য, কি প্রতিবাদ সব কিছুর মধ্যেই সময়ের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। ইউরোপের উদ্দেশ্যে সুকান্ত বলেছেন-
'অনেক খাটনি অনেক লড়াই করা শেষে
চারিদিকে ক্রমে ফুলের বাগান তোমার দেশে।' আবার তিনি ইউরোপের মে মাসের সঙ্গে বাংলার বৈশাখ মাস কে প্রতীকী হিসেবে ব্যবহার করেছেন সেখানে লিখেছেন-'এদেশে যুদ্ধ মহামারী ভুখাজ্বালো হারে হারে 
অগ্নি বর্ষী গ্রীষ্মের মাঠে তাই ঘুম কাড়ে
বেপরোয়া প্রাণ; জমে দিকে দিকে আজ লাখে লাখ
তোমাদের দেশে মে মাস, এখানে  ঝোড়ো বৈশাখ।' 

কবির স্বল্পায়ু জীবন সময় নষ্ট করতে চান নি, তিনি বুঝেছিলেন হয়তো তাঁর কাছে সময় কম। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে ১৩৫২ সালে তিনি যক্ষা রোগে আক্রান্ত হন, এবং ১৩৫৪ বঙ্গাব্দে ২৯ শে বৈশাখ, ইংরেজিতে ১৯৪৭ সালের ১৩মে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। দুর্ভাগ্য জীবিত কালে তাঁর কোন গ্ৰন্থ প্রকাশ হয়নি।  মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ছাড়পত্র' (১৩৫৪) তবে কবি যখন রোগশয্যায় তখন তার পক্ষে নাম দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না পরে গ্রন্থটির নাম 'ছাড়পত্র' দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে 'পূর্বাভাস' (১৩৫৭) 'ঘুম নেই' (১৩৫৭) 'মিঠে কড়া' ছড়া সংকলন (১৩৫৮) 'অভিযান' নাটক সংকলন (১৩৬০) অনুবাদ ও নাটিকা সংগ্রহ মূলক গ্রন্থ 'হরতাল' (১৩৬৯) এবং গীতিগুচ্ছ (১৩৭২) এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর ভূমিকা সম্বলিত সুকান্ত সমগ্র (১৩৭৪) সালে প্রকাশিত হয়। 

একদিকে মৃত্যু কীর্ণ যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষের পরিহাস, বন্যা আর মহামারী,  অপরদিকে জীবন প্রতিষ্ঠার মৃত্যুপণ, উত্থান পতন জয়-পরাজয়ের বাস্তবতায় সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশায় কোটি কোটি মানুষের বলিষ্ঠ আশা কবি কন্ঠে যেন উদ্ভাসিত হয়েছে। না হলে তিনি বলতে পারেন- 'এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়, 
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।' 

আমাদের জীবনে সংশয় হীন ভীরুতা দুর্নিবার গতি চালিত করে নবযৌবন শক্তিকে। 'আঠারো বছর বয়স' কবিতায় কবি বলেছেন- জীবনের তারুণ্যশক্তি উন্মোচিত হয় এই সময় যা, যৌবনের সিংহদ্বার। যৌবন প্রাপ্তির সঙ্গে শারীরিক চেতনার বিকাশ, দুরন্ত আবেগ দুর্জয় সাহস ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা সঞ্চারিত হয়। তিনি ছিলেন আদ্যোপান্ত বিপ্লবী মনোভাবাপন্ন রাজনীতিক। তাঁর শানিত কলমে কথা বলে- 

'এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য
বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে 
প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য
সপেঁ আত্মাকে শপথের কোলাহলে।'

অনেক ক্ষেত্রে নানান মনোভাব শুদ্ধ মার্কসবাদ জাতীয়তাবাদ কতগুলি বিষয় সুকান্তকে অনৈতিহাসিক করে তুলেছিল কিন্তু "সিপাহী বিদ্রোহ " কবিতায় তিনি দেখিয়ে দিলেন মার্ক্স প্রদত্ত ধারাটি-

'নানা জাতের নানা সেপাই গরীব এবং মূর্খঃ 
সবাই তারা বুঝে ছিল অধীনতার দুঃখ
তাইতো তারা স্বাধীনতার প্রথম লড়াই লড়তে 
এগিয়েছিলে এগিয়েছিল মরণ বরণ করতে।' 

ইউরোপ কিম্বা পশ্চিম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যেমন যুক্ত ছিলেন , সেই ঐতিহ্যমন্ডিত ধারাকে আত্মোপলব্ধি করেছিলেন সুকান্ত ।
'এখনো আমার মনে তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি 
প্রত্যেক নিভৃত ক্ষণে মত্ততা ছড়ায় যথারীতি 
এখনো তোমার গানে সহসা উদ্বেল হয়ে উঠি 
নির্ভয়ে উপেক্ষা করি জঠরের নিঃশব্দ ভ্রুকুটি।' 

রেনেসাঁস ধারণাটির ধারক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আর মর্ডানিটির সেই বৃহৎ পরিধির বৃত্ত নির্মাণ করেন যে সমস্ত সমাজতন্ত্রীরা তাদের প্রতিভূ সুকান্ত বৃত্ত বলয়।  'মিঠে কড়া' কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে 'এক যে ছিল' যে কবিতাটি লিখেছেন- 

'বড়ো মানুষীর মধ্যে গরীবের মতো মানুষ,
তাই বড়ো হয়ে সে বড়ো মানুষ না হয়ে 
মানুষ হিসেবে হলো অনেক বড়ো। 
কেমন করে? সে প্রশ্ন আমাকে করোনা ।'

তাঁর লেখার বিশ্লেষণ করলে আমাদের কাছে সবকিছুই ধোঁয়াশার মত। মর্ডানিটি পোস্টইজম  রাজনীতি ধর্মাশ্রিত ভাবনা সংস্কৃতি সবকিছুই কেমন যেন গোলক ধাঁধায় আবদ্ধ।  'ছাড়পত্র' কাব্যগ্রন্থে 'বিবৃতি' নামক কবিতায় দুটি শব্দ তার উদাহরণ । শব্দ দুটি 'জঙ্গীও জেহাদ'। তিনি কিভাবে প্রয়োগ করেছেন-  

'অভুক্ত কৃষক আজ সূচীমুখ লাঙলের মুখে
নির্ভয়ে রচনা করে জঙ্গী কাব্য এ মাটির বুকে।
আজকে আসন্ন মুক্তি দূর থেকে দৃষ্টি যেন শ্যেন।
এদেশের ভাড়া ভরে দেবে জানি নতুন য়ুক্রেন। 
নিরন্ন আমার দেশে আজ তাই উদ্ধত জেহাদ, 
টলোমলো এ দুর্দিন, থরোথরো জীর্ণ বনিয়াদ। 
তাইতো রক্তের স্রোতে শুনি পদধ্বনি
বিক্ষুব্ধ টাইফুন মত্ত চঞ্চল ধমনী:' 

এক সময় ও সমস্ত কবির  জীবন সত্ত্বায় ব্যর্থতা অসহায়ত্বের নৈরাশ্যতা আসে। সেখানে কোন ডাডাইজম, সুররিয়ালিজমের প্রভাব ক্ষয়িষ্ণুতা এসে ভর করে। মার্ক্স এর অনুভূতিতে ধর্ম হল- 'হৃদয় হীন পৃথিবীর হৃদয়', 'নিপীড়িত মানুষের দীর্ঘঃশ্বাস' এবং শেষপর্যায়ে 'জনগণের আফিম'। প্রতিটির আক্ষরিক অর্থ আছে। সুকান্ত ধর্ম নিয়ে কোন দিন বিতর্ক সৃষ্টি করেননি। কিন্তু এই তত্ত্বকে ফেলে দেননি, তিনি হৃদয়হীন পৃথিবীকে সহৃদয় করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর অনুভূতি শিহরে জন্ম নিয়েছিল হতাশার স্বরলিপি-  

'আমার মৃত্যুর পর কেটে গেল বৎসর বৎসর; 
ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতির ব্যর্থ প্রচেষ্টা ও আজ অগভীর, 
..........................
……………………… .....
আমার অজ্ঞাত দিন নগন্য উদার উপেক্ষাতে 
অগ্রগামী শূন্যতাকে লাঞ্ছিত করছে অবিরত।' 

তিনি আগে থেকেই অনুভব করেছিলেন এটাই হয়তো ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার নির্ধারণ। একসময় কবি বন্ধু অরুণাচল বসুর মা সরলা বসু কে ছিলেন- 'বাস্তবিক আমি কোথাও চলে যেতে চাই,  নিরুদ্দেশে হয়ে মিলিয়ে যেতে চাই … কোন গহন অরণ্যে কিংবা অন্য যে কোন নিভৃততম প্রদেশে;  যেখানে মানুষ নেই, কেবল সূর্যের আলোর মত স্পষ্ট-মনা হিংস্র আর নিরীহ জীবেরা, আর অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। এতোর ও দরকার নেই,  নিদেনপক্ষে আপনাদের ওখানে যেতে পারলেও গভীর আনন্দ পেতাম, নিস্কৃতির বন্য আনন্দ, সমস্ত জগতের সঙ্গে আমার নিবিড় অসহযোগ চলছে। এই পার্থিব কৌটিল্য আমার মনে এমন বিস্বাদনা এনে দিয়েছে,  যাতে আর আমার প্রলোভন নেই জীবনের উপর। …এ অননুভূত অবসাদ আমায় আচ্ছন্ন করেছে। সমস্ত পৃথিবীর উপর রুক্ষতায় ভরা বৈরাগ্য এসেছে বটে। কিন্তু ধর্মভাব জাগেনি। আমার রচনা শক্তি পর্যন্ত ক্ষীণ হয়ে এসেছে মনের এই শোচনীয় দুরবস্থায়। প্রত্যেককে ক্ষমা করে যাওয়া ছাড়া আজ আর আমার অন্য উপায় নেই। আচ্ছা, এই মনোভাব কি সবার মধ্যেই আসে এক বিশিষ্ট সময়ে?' 

তথ্যসূত্র:- 
১. সুকান্ত রচনা সমগ্র 
২. বিভিন্ন সাময়িক পত্রপত্রিকা।

 

কুমারেশ সরদার
সোনারপুর কলকাতা, ভারত

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top