সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

সেই রেল লাইনের ধারে : এনাম রাজু


প্রকাশিত:
১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৩৪

আপডেট:
১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৩৪

 

কাশির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় রহিমের। কাচাঘুম ভেঙে গেলেও খারাপ লাগে না আগের মতো। জানালা গলে দিনের আলো ঠিক যেনো বালিশের উপর এসে পড়েছে। চোখ কচলাতে কচলাতে হাই তুলে ছোটঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
নামাজে দাড়াতে আর ছোট ঘরেই যেতে এখন যতো ভয় রহিমের। ছোট ঘরের কর্ম সারতে সারতেই দুনিয়ার চিন্তা যে তাকে ঘিরে ধরে। চিন্তাগুলো আবার দুশ্চিন্তা হয়ে আগ্রাসন চালায় তার উপর। তখন মনে হয় ছোট বেলার কথা, একবার মৌমাছির চাকে ঢিল মারার ফলে যেভাবে তার পিছু ছুটেছে মৌমাছিরা ঠিক যেনো নামাজে দাড়ালে কিবা ছোটঘরে থাকলে এমনভাবেই পিছু ছোটে দুশ্চিন্তাগুলো।  বেকারত্বের জীবনকে প্রতি মুহুর্তেই এক একটা সৈনিক মাছি আঘাত করে, না কোনো সময় মেনে তারা এই আঘাত করে না। ছোট ঘর থেকে ফিরেই নামাজ পড়ে মায়ের রুমে গিয়ে দেখে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রহিমের। মানুষ ঘুমালে সত্যি খুব বিচ্ছিরি দেখতে লাগে। গভীর ঘুমেও তার মা অনবরত কাশি দিয়েই যাচ্ছে। এলার্জিক সমস্যা যেনো তার মাকে ধীরে ধীরে পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মায়ের কপালে হাত বুলাতে বুলাতে ভাবে রহিম, সারাজীবন যে মায়ের কোরান তেলওয়াতের সুর শুনে ঘুম ভাঙতো আজও একই সময়ে ঘুম ভাঙলেও পরিস্থিতি ভিন্ন। দাদী আর বাবা যে কতো কষ্ট দিতো তার মা কে, সেটা শুধু মা বলতে পারবে। যদিও কিছু কিছু প্রতিবেশিদেরও জানা। রহিমের নানার বাড়ির সম্পত্তির ভাগ মামাদের দিয়ে দেওয়াতে কতো কি যে তার উপর দিয়ে গেলো, আহা! এসব ভাবতেই চোখ ভিজে যায় রহিমের। ফোটা চোখের পানি তার মায়ের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। চোখ মেলে ছেলেকে পাশে দেখে মায়ের মুখটা উজ্জ্বলতায় ভরে যায়। সম্ভবত অসুস্থ অবস্থায় মায়েরা সবচেয়ে বেশি কাছে পেতে চায় সন্তানকে। এই সময় মায়েরা সন্তানদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ভুলে গিয়ে শুধু কাছেই টানতে চায়। সেটা অবশ্য রহিমের নিজস্ব চিন্তা মাত্র। মায়ের সাথে খুনসুটি করতে করতে মাকে বলে দেয় তার চাকুরীর পরীক্ষা দিতে ঢাকায় যেতে হবে আগামী বৃহস্পতিবার । মাথা নাড়িয়ে তিনি সম্মতি দেয়।

দেখতে দেখতেই বৃহস্পতিবার চলে এলো। গ্রাম থেকে এই প্রথম শহরের বাইরে যাচ্ছে রহিম, বাড়িতে মাকে একা রেখে যেতে মনই চাচ্ছে না। তবুও জীবনের তাগিদে একা যেতে হয়। পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষই মূলত একা। স্বার্থের প্রয়োজনে মানুষ কিছুটা সময় সঙ্গি পায় তবুও একাকীত্ব ঘোচাতে পারে না।

খুব সকালেই স্টেশনে পৌছায় রহিম। চারিদিক সুন্দর আর সুন্দরের মহড়া চলছে যেনো। স্টেশনের একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে ভেসে আসছে কবুতরের বাকবাকুম বাকবাকুম শব্দ। বেশ কিছু কবুতর উড়াউড়ি করছে। আধারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের উদারতাকে গুছিয়ে নিয়ে রাতকে পরিণত করছে দিনে। সবকিছুরই আগমনী একটা বার্তা থাকে। আর তাকে স্বাগতম জানাতে চারিদিক থেকে অনুসারীও যেনো তার আগমনের পরিবেশ তৈরি করে। সেটা ভালো হউক আর খারাপ। পাপের হউক আর পূণ্যের। চাঁদকে আড়াল করে সূর্যের এই আগমনকে সম্ভবত সম্ভাষণ জানাচ্ছে কবুতর। একটু দূরেই পুকুরের জলে ভেসে উঠা কলাগাছে নীরব মনে বসে আছে মাছরাঙা।
এই স্টেশনে খুব বেশি ট্রেন আসে না। তবুও মানুষের যাতায়াত কম নয়। যতোই দিনের আলো উদ্ভাসিত হচ্ছে ততোই চারিদিকের পরিবেশ মানবমুখর হচ্ছে। প্রকৃতি নিজেকে সাজাচ্ছে নানান ঢঙে খানিক পরে পরেই। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। এতো সুন্দরের মাঝেও নিজের মন পড়ে আছে মায়ের কাছে। রহিম ভাবছে, মা নিজে নিজে ঔষধ খেতে পারবে কিনা ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করবে কিনা।
এমন চিন্তায় যখন মগ্ন ঠিক তখনই বারো তেরো বছরের একটা শিশু বাদাম নিয়ে এসে বলছে, স্যার বাদাম নিবেন। খুবই টেস্ট। নগদই ভাজা।  
দাও তো দশ টাকার। লবণও দিও।
 এই লন ভাইজান।
আচ্ছা বাবা, তোমার নাম কী? আর তুমি তো এখানে বাদাম বিক্রি করো, বলতে পারো কতোক্ষণ লাগবে ট্রেন আসতে?
এ টা তো কেউ কইতে পারবে না। কোনোদিন ছয়টায় আসে, কোনোদিন সাতটায়। আজকে কখন আসবে তা তো বলতে  পারবো না।
আচ্ছা ঠিক আছে। এখন বলোতো তোমার নাম কী?
শরীফ। তবে কেউ কেউ শরীফবিল্লাহ কয়। টাকা দেন যেতে হবে।
তা তো দেবো বাবা, একটা কথা বলি?
বলেন।
তুমি এতো অল্প বয়সে বাদাম বিক্রি করো কেনো? তোমার মা বাবা নেই?
বাবায় মায়রে অকাম কইরা আমারে পয়দা করছে। তয় মায়ে বুঝতে পাইছে আমি বাইচা থাকলে হেতির বিয়ে হবে না। তাই ঐযে ডাস্টবিনটা দেখেন, সেখানে ফালাই দিছে। পরে আমি এখানে বড় হইছি। আগে ভিক্ষা করতাম, চুরি করতাম। অনেক টাকা পেতাম, সেই টাকায় ড্যান্ডি খেতাম। পরে একজন স্যার, আমারে পাঁচশ টাকা দিয়ে এগুলো কিনে দিছে। এখন এগুলো বিক্রি করে খাই। আর কিছু জানতে চাইলে বলেন, তাড়া আছে।
যাও বাবা বলেই রহিম অন্যমনস্ক হয়ে যায়। মায়ের কথা মনে পড়ে রহিমের, তার জন্মের পরেই বাবা মারা গেছে। অথচ, তাকে মানুষ করতে কতো কষ্ট পেতে হয়েছে। যে কষ্টের কারণেই আজ তার মা অসুস্থ। সেই মাকে ছেড়ে শহরে কিভাবে সে কয়েক রাত কাটাবে!

প্রচুর বৃষ্টি শুরু হয়, ট্রেন আসে। দৌড়ে ট্রেনে ওঠে রহিম। তারই পেছনে পেছনে শরীফও ট্রেনে ওঠার জন্য লাফ দেয়,পিচ্ছিল ও পাতলা দেহে ঠিকভাবে ট্রেনে ওঠতে না পেরে নিচে পড়ে যায়। মুহূর্তেই খন্ড খন্ড হয় শরীফের দেহ। ট্রেন এগিয়ে যায়। জানালা দিয়ে যতোদূর দেখা যায় দেখতে থাকে জনতার ভীর।
পরের স্টেশনেই নেমে পরে রহিম। রেল লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে শরীফের কাছে ফিরতে...



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top