সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

রাখীবন্ধন : মনিদীপা দাশগুপ্ত


প্রকাশিত:
৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:৩৮

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৮:২৯

ছবিঃ মনিদীপা দাশগুপ্ত

 

স্কুল থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় পড়লেই সৌমীর ভয় বাড়তে শুরু করে। তিরতিরে বুকে ধীরে ধীরে হাঁটে সৌমী। যদিও সাথে আরও পাঁচজন থাকে তবুও বড্ড ভয় হয় ওর। বড় রাস্তা ধরে কিছু এগোলেই - বুড়ো বটতলা। ওখানে  চারটে রাস্তা। অরুণিমা আর বৃন্দার রিক্সা ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। ওরা রিক্সা চেপেই সোজা বড় রাস্তা ধরে চলে যায়। ইন্দ্রাণী রিমা অজন্তা বাঁদিকের রাস্তাটা ধরে আর সৌমী একা ডানদিকের রাস্তা। দু মিনিটের পথ বাড়ির। কিন্তু ভয় করে। প্রতিদিন ছেলেটা সাইকেল নিয়ে কোথা থেকে এসে ঐ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। চুপচাপ সৌমীকে অনুসরণ করে শুধু। নির্জন রাস্তাটা তখন যেনও সৌমীর কাছে দীর্ঘ মনে হয়। পিছনে না তাকালেও ও বুঝতে পারে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে পিছন পিছন ছেলেটি অনুসরণ করছে সৌমীকে।

গত চারমাস ধরে এই ঘটনা হচ্ছে। সৌমী কাউকে বলতে পারেনি। জানে বন্ধুদের বললে ওরা এই নিয়ে মজা করবে। আর বাড়িতে তো বলার কেউ নেই। আসলে সৌমীরা এই পাড়ায় নতুন। ওদের আদত বাড়ি বর্ধমানে। বাবার বদলির চাকরির জন্য  বিভিন্ন স্থানে থাকতে হয়। মাত্র দেড় বছর ওরা এই রামরাজাতলায় এসেছে। এখনো ভালো করে সবার সাথে আলাপই হয়নি শুধু ক্লাসের বন্ধুদের ছাড়া। সৌমীর মা গতবছর হঠাৎ ই স্ট্রোকে মারা যান। বাড়িতে লোক বলতে বাবা আর চন্দন পিসি।

চন্দন পিসি বাবার একমাত্র বোন। খুব অল্পবয়সে বিয়ে হয় আর দুমাসের মাথায় বাইক অ্যাক্সিডেন্টে পিসুন মারা যান। শ্বশুর বাড়িতে তারপর থেকে খুব নির্যাতন করত তাই সৌমীর মা ওকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। তখন সৌমী অনেক ছোট। বলতে গেলে চন্দন পিসি সৌমীকে চোখে হারান। মা যখন বকতেন সৌমীকে পিসিই হাউহাউ করে কাঁদত, আর মা তাই দেখে হেসে ফেলতেন। তাই মা মারা যাবার পর আত্মীয়রা বলেন যে ভাগ্যিস চন্দন ছিল। আর বাবা তো মা মারা যাবার পর ভীষণ চুপচাপ থাকেন। খুব কম কথা বলেন। ছুটির দিনে বই নিয়ে সময় কাটান। সৌমী তাই বাড়িতেও এই ঘটনা জানাতে পারেনা।

অভীক স্যারের কোচিং ক্লাসে যাবার সময় একদিন ছেলেটাকে দেখে পিয়া কে জিজ্ঞেস করেছিল ছেলেটার কথা। পিয়া বলেছিল, প্রেমে পড়েছিস বুঝি? আরে ও তো আমাদের এম এল এ বিজয় কাকুর ভাইপো, অসীমদা।

-লেখা পড়া করে না?
-না না লেখাপড়া না করলেও ওদের চলে। কাকুর দৌলতে একটা কিছু তো হবেই আর তাছাড়া ওদের মাছের ব্যবসা।

ইস কেমন যেনও গা গুলিয়ে ওঠে সৌমীর। কোনও কথা না বলে বাড়ি চলে আসে। কিন্তু এভাবে আর কদিন? একটা উপায়তো বের করতে হবে।

-তোদের রাখীপূর্ণিমায় ছুটি দেয়নি? চন্দন পিসি জিজ্ঞেস করেন।
-না তো। কবে রাখি?
-এই তো আগামী পরশু মঙ্গলবার।

  হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে যায় সৌমীর।

পরেরদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় বেশ বড় দেখে সুন্দর ময়ূর পাখা লাগানো রাখী কেনে সৌমী। উত্তেজনায় বুকটা দুরুদুরু করে। একটা রঙিন কাগজে একটা শব্দ লিখে সুন্দর করে মুড়িয়ে রাখে রাখীটাকে।

রাখীপূর্ণিমার দিন স্কুল ছুটির পর যথারীতি দেখে বাড়ির রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে অসীম।

সৌমীর পিছনে পিছনে সাইকেল নিয়ে এগোতে থাকে অসীম। হঠাৎ ই ঘুরে দাঁড়ায় সৌমী, অসীমকে হাত নেড়ে ডাকে। খানিক হতভম্ব হয়ে অসীম কাছে এলেই রঙিন কাগজটা অসীমের হাতে তুলে দেয়। স্তম্ভিত অসীম বলে, কি এটা?

-আরে খুলেই তো দেখো।

অসীম মোড়কটা খুলে দেখে সুন্দর একটা রাখী আর কাগজটায় বড় করে লেখা "ভাই"

-মানে? বোকার মতো মুখে জিজ্ঞেস করে অসীম।
-মানে? মানে আজ থেকে তুমি আমার একমাত্র দাদা। দ্যাখো না আমার তো কোনও ভাই নেই। মা ও নেই। খুব কষ্ট । তা তুমি যদি আমার দাদা হও তবে আমি ভাইফোঁটা দিতে পারি। সবাই কি সুন্দর ফোঁটা দেয় ভাইকে। আমারও তো ইচ্ছে করে। আমার কান্না পায় বিশ্বাস করো। আমার বিপদে আমাকে রক্ষা করার কেউ নেই। তুমি আমার দাদা হবে অসীমদা?

বলতে বলতে সৌমী কেঁদে ফেলে। অসীমেরও দুচোখ জলে ভরে আসে। সৌমীর সামনে বাঁ হাত বাড়িয়ে বলে,

-কাঁদিস না রে বোন, রাখীটা পরিয়ে দে। তোর কোনও ভয় নেই। অসুবিধা হলেই আমাকে বলবি। দেখি তোকে কে কি করে!

হেসে ফেলে সৌমী। বলে, আর আমার ক্যাডবেরি?

-ওহো, কাল পেয়ে যাবি। আরে ফাঁকি দেবো না রে বোন। যা এখন বাড়ি যা। আর হ্যাঁ ঐ পশ্চিমপাড়ার ছেলেগুলোকে পাত্তা দিবিনা কিন্তু। ওরা ডিস্টার্ব করলেই আমার নাম বলবি। তোর জন্য সবসময়ই এই দাদা হাজির।

বলে সাইকেল নিয়ে ঘুরে চলে যায়। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বিজয়িনীর মতো সৌমী বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। আজ থেকে আর ওর ভয় করবে না।

 

মনিদীপা দাশগুপ্ত
কলকাতা, ভারত



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top