সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

মায়ার বাঁধন : কণিকা দাস 


প্রকাশিত:
৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৫৩

আপডেট:
৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৫৫

 

"জানি তুই হারিয়ে যাবি ঘুমের রাজ্যে আমার শেষ লেখাটা দেখার আগেই।"—

এই বাক্যটা দিয়েই শুরু হয়েছিল সুনন্দার চিঠিটা। যেটাকে পুলিশ সুইসাইড নোট বলছে। পলাশ সে রাতের শেষের দিকের লেখাগুলো মনে করার চেষ্টা করে। কী ছিল শেষ লেখাটায়। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না। 

প্রতি রাতেই পলাশ আর সুনন্দার কথোপকথন হত মেসেঞ্জারে। কত কথা! সংসারের অভাব অভিযোগের কথা, সুখ দুঃখের, মান অভিমানের কথা। তারপর এক সময় বিদায় নিয়ে অফ হয়ে যেতো। কিন্তু যে রাতে সুনন্দা সুইসাইড করে সে রাতে কী কথা হয়েছিল? কী লিখতে পারে সু! সে রাতে চ্যাটিং করতে করতে হঠাৎ মোবাইলটা বন্ধ হয়ে যায়। সারাদিনের কাজের চাপে কখন চার্জ ফুরিয়ে গেছে খেয়ালই করেনি পলাশ। এদিকে ক্লান্তিতে চোখের পাতা জুড়ে আসে।মোবাইল চার্জে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে। সকালে উঠে মোবাইল অন করেই প্রথমে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে উইশ করে। কিন্তু দু'ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও কোন রিপ্লাই না আসায় ফোন করে। ওপাশ থেকে সুইচড অফ ছাড়া আর কিছু শোনা যায়না। আবার টাইপ করে পলাশ

 

-সুইচড অফ করে রেখেছিস কেন?

 

নাহ্ কোন উত্তর নেই। এবার চিন্তার পারদ বাড়তে থাকে। কী হল সুনন্দার? এদিকে অফিসে যাওয়ার তাড়া। খেতে বসে আরেকবার ট্রাই করে ফোনে। নাহ্ এবারেও সুইচড অফ! তক্ষুনি আননোন নাম্বার ভেসে ওঠে মোবাইলের স্ক্রিনে।

 

-হ্যালো আমি শিলিগুড়ি থানা থেকে বলছি। আপনি পলাশ অধিকারী তো? আপনাকে একবার থানায় আসতে হবে। সুনন্দা বিশ্বাস সুইসাইড করেছে। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ আছে। তাড়াতাড়ি চলে আসুন।

 

পলাশের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। অকস্মাৎ অপ্রত্যাশিত খবরে বিমূঢ় হয়ে পড়ে পলাশ। না না পুলিশ সত্যি কথা বলছে না। ভাতের থালার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বমি ভাব হতে বেসিনে গিয়ে বমি করে। পলাশের আচরণ দেখে অবাক হয় রমলা। কী হল তোমার? এমন করছ কেন? কার ফোন ছিল?

একটু ধাতস্থ হয়ে বলে-- সুনন্দা সুইসাইড করেছে রমা। আমি থানায় যাচ্ছি। পুলিশ ডেকেছে। 

কী! সুনন্দাদি সুইসাইড করেছে!কখন করল? কাল রাতেই তো আমার সাথে কথা হল! দাঁড়াও,তোমার শরীর ভালো নেই। আমিও যাবো তোমার সাথে।

-চলো, তাই চলো।

-এই হল সুনন্দার সুইসাইড নোট। কাকে যে নোটিশ করেছে কথাগুলো বুঝতে পারছি না। ওর বাড়ির লোকের কাছে শুনলাম আপনার সথে খুব বন্ধুত্ব ছিল। দেখুন তো বুঝতে পারেন কী না?

 

কাঁপা হাতে চিঠিটা হাতে নিয়ে দেখে পলাশ। এই কথাটা সে অনেকবার পলাশকে লিখেছে। তাই বুঝতে অসুবিধা হয়না। প্রতিবারই কিছু মান অভিমানের পর আবার স্বাভাবিক হয়েছে। এভাবেই ওদের বন্ধুত্বের বন্ধন আরো দৃঢ় হয়েছে। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা বুঝতে পারেনা পলাশ। চিঠিটা বড়বাবুর হাতে দিলে তিনিই বলেন- জানি আপনিও বুঝতে পারেননি। কী আর বলব বলুন, আমাদের কর্তব্য তো করতেই হবে। তাই আপনার কাজে ব্যাঘাত ঘটালাম।কিছু মনে করবেন না। 

 

পলাশের মনে পড়ে যায় একদিন সু বলেছিল, "জীবনের চাকা কখন উল্টো দিকে ঘুরবে তা কেউ জানে না।" পলাশ বলেছিল, হঠাৎ একথা বলছিস যে? 

-নাহ্ এমনিই বললাম। কোনো কারন নেই।

জীবনের চাকা যে এভাবে সত্যিই উল্টোদিকে ঘুরবে যদি সে একবার বুঝতে পারতো তাহলে কিছুতেই ওর বন্ধুকে এভাবে মরতে দিত না। 

শেষ কথাগুলোয় সুনন্দা কী কিছু বলতে চেয়েছিল পলাশকে? ইস্ কেন যে এমন কাল ঘুম এলো, আর মোবাইলটার তখনই পাওয়ার অফ হতে হলো!  অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হতে থাকে পলাশ। 

       

কেন এমন করলি সু? কেন, কেন? তোর বন্ধুকে কী আরেকবার ক্ষমা করতে পারলি না? তুই তো সব কথা আমাকে বলতিস। আরেকটু ধৈর্য ধরতে পারলি না? আমি তোর সব কথা শুনতাম। তোর দুঃখের লাঘব না করতে পারি, সান্ত্বনার প্রলেপ তো দিতে পারতাম। 

          

পিঠে হাত রাখে রমলা। সান্ত্বনা দেওয়ার কোন ভাষা যে ওর মুখেও আসছে না। রমলাদির মতো শক্ত মনের মানুষ কেন সুইসাইড করতে গেল? তবে কি আঘাতের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে তা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি!

      

আজ পলাশ আর রমলা বুঝতে পারে অপবাদটা সুনন্দা মেনে নিতে পারেনি। বিশেষ করে পলাশ যেখানে জড়িয়ে গেছে। আর এখানেই পলাশ সুনন্দাকে ক্ষমা করতে পারে না ওর ভুল সিদ্ধান্তের জন্য। একা একা লড়াই করা যে খুবই কষ্টকর সেটা মরে প্রমাণ করতে হল তোকে? রমলা আর আমি তো ছিলাম রে তোর পাশে। 

 

কণিকা দাস
কবি ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top