সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

জগৎজননী অন্নপূর্ণার প্রতিমূর্তি মাদার টেরেসা : কুমারেশ সরদার


প্রকাশিত:
১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৪৫

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৫:২৮

  

"নয়ন সম্মুখে তুমি নাই
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।
নেই তুমি তবু আছো অন্তরে অন্তরে।" _

সকল শান্তির নিবিড় আশয় রূপে, সকল আঁতুড়জনের পরম হৃদপদ্মে উষ্ণ ওম হয়ে, প্রাণের আশ্বাস বহন করে, সর্বদা মনের আনন্দে হৃদআত্মার শান্তি নিয়ে বিরাজমান, তবু ও মাতৃ স্বরূপা সনাতনী আটপৌরে অন্তরে চিন্তা-চেতনার সেবা যিনি বহন করতেন তিনি হলেন জগৎমহী সকলের মা, করুণাময়ী টেরিসা। যুগের পর যুগ বহে নিয়ে যায় উত্তরাধিকারের স্বপ্ন তাই-

"বিশ্বজগৎ আমারে মাগিলে কোথায় আমার ঘর, 
আমার বিধাতা আমাতে জাগিলে কে মোরে আত্মপর।" 

আর্ত  দীর্নাত দারিদ্র্যপীড়িত অসহায় মানুষের সেবাই ঈশ্বরের সেবা এই আদর্শ ভালোবেসে আত্মোৎসর্গ করে যিনি ধন্য হয়েছিলেন সেই স্মরণীয় হৃদয়াবান বিংশ শতাব্দীর জননী করুণাময়ী মাদার টেরেসার আসল নাম মেরি টেরিজা বোজাঝিউ বা অ্যাগনিস গঞ্জা বোজাঝিউ।আলবেনীয় ভাষায় গঞ্জা শব্দের অর্থ গোলাপ কুঁড়ি । ২৬ শে আগস্ট ১৯১০ সালে ইউস্কুপ অটোম্যানে । বর্তমানে স্কোপিয়ে উত্তর মেসিডোনিয়ায় এক সচ্চল কৃষক পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। মাদার ছিলেন নিকালো ও দ্রানা বয়াজুর কনিষ্ঠ সন্তান।তাদের সুখের সংসার ছিল বাবা-মা ভাই-বোন কে নিয়ে। তিনি ছিলেন একজন আলবেনীয় বংশোদ্ভূত, ভারতীয় ক্যাথলিক সন্ন্যাসিনী ও ধর্ম প্রচারক। তিনি আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত আলবেনিয়ায় কাটান।

১৯২৮ সালে তিনি আয়ারল্যান্ড হয়ে তৎকালীন  ব্রিটিশ অধীনস্থ ভারতে আসেন খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য আসেন। হয়তো দারিদ্র্য যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের অসহায় আর্তনাদ তাঁর কানে পৌঁছে ছিল । এই সমস্ত অসহায় দারিদ্র যন্ত্রনা আঁধারিত মানুষের মুখের দিকে চেয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছিলেন করুণা দয়াময়ী জননী মাদার। তাঁর জীবনের ব্রত ছিল অসহায় মানুষের সেবা। কলকাতার ফুটপাথে সহায়-সম্বলহীন অসুস্থ মৃত্যু পথযাত্রী নতুবা মরণাপন্ন মানুষকে বুকে তুলে নেওয়া। তাদের সেবা যত্নের, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন দেবী অন্নপূর্ণার ভান্ডারের চাবি নিয়ে। তিনি ছিলেন স্বয়ং দেবী অন্নপূর্ণা , জগৎজননী জগধাত্রী । অন্নসংস্থান থেকে নিজ হাতে কুষ্ঠ রোগীর খাইয়ে দেওয়া, ঘা ধুইয়ে স্নান করিয়ে দেওয়া , ভালোবাসা দিয়ে মানুষের জীবনকে শান্তিময় করে তোলা ছিল তাঁর প্রধান কাজ ।

পৃথিবীতে যারা অসহায় তাদের প্রতি গভীর ভালোবাসা হয়তো কোন দেশ ও কালের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে নি। দীর্ঘদিন ধরে ইংরেজ শোষন বিদ্ধ মানুষের  দুঃখ-কষ্টের সীমাকে মুছিয়ে দিতে শ্রীমা, সারদা মা, বিদেশিনী ভগিনী নিবেদিতা, লেলি সেনগুপ্ত তারা নিজেদেরকে আর্তের সেবায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, আর এদের উত্তরসূরী হিসেবে তাদের অসম্পূর্ণ কাজ কে পূর্ণতা দান করেছিলেন মাদার তেরেসা।

"কেবল সেবা নয় মানুষকে দাও 
তোমার হৃদয়। হৃদয়হীন সেবা নয়,
তারা চায় তোমার অন্তর
 স্পর্শ ।" 

তাঁর পিতা  আলবেনিয়া রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে ছোট বয়স থেকে সমাজ, সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে তাঁর মনের মধ্যে একটা ছবি তৈরি হয়।  ১৯১৯ সালে মাত্র আট বছর বয়সে তাঁর পিতা মারা গেলে, মা দ্রানা বয়াজু রোমান ক্যাথলিক আদর্শে তাকে মানুষ করেন। জোয়ান গ্ৰ্যাফ ক্লুকাস রচিত তেরেসার জীবনী থেকে জানা যায় ছোট অ্যাগনেস ধর্মপ্রচারকদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে গল্প শুনতে ভালোবাসতেন। বারো বছর বয়সে তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নেন সন্ন্যাসিনী হবেন। কথা মত কাজ আঠারো বছর বয়সে গৃহত্যাগ করে ধর্ম প্রচারক হিসেবে সিস্টার্স অফ লোরেটো সংস্থায় যোগদান করেন, এবং পরিবারের লোকজন ভাই দিদি মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে চলে আসেন। তিনি ইংরেজি ভাষা জানতেন না। ফলে আয়ারল্যান্ডের রথফার্নহ্যামে লোরেটো অ্যাবেতে ইংরেজি ভাষা শেখেন। এরপর  ১৯২৯ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং এ নবদীক্ষিত হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৩১ সালের ২৪ শে মে তিনি সন্ন্যাসিনী হিসেবে শপথ নেন। ধর্মপ্রচারকদের সহযোগিতায় সন্ত Therese de Lisieux এর নামানুসারে "টেরিজা" নামে পরিচিত হন।  ১৯৩৭ সালের ১৪ মে কলকাতায় একটি লোরেটো কনভেন্ট স্কুলে পড়ানোর দায়িত্ব নেন। 

কলকাতায় পঞ্চাশের মন্বন্তর, ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা তে তাঁর মন কেঁদে উঠেছিল। ১৯৫০ সালে কলকাতায় তিনি দ্য মিশনারিজ অফ চ্যারিটি নামে একটি খ্রিস্টধর্ম প্রচার সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে ভারত তারপর সমগ্র পৃথিবীতে তার কর্মকাণ্ড প্রকাশ পায় । এর স্বীকৃতি স্বরূপ 2016 সালে পোপ ফ্রান্সিস তাকে সন্ত হিসেবে ঘোষণা করেন । এবং ক্যাথলিক গির্জায় তিনি কলকাতার সন্ত টেরিজা নামে পরিচিতি লাভ করেন। 

১৯৪৬ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর ধর্মীয় নির্জনে একা থাকায় দার্জিলিঙে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তাঁর অন্তরে যেন অন্য সুর কাজ করল। তাঁর ভিতরের চোখ দিয়ে দেখতে পেলেন তার দায়িত্ব কর্তব্য পালনের দায়বদ্ধতা। এই বিষয় নিয়ে তিনি বলেছিলেন- "কনভেন্ট ত্যাগ করে দারিদ্রদের মাঝে বাস করা এবং তাদের সহায়তা করা আমার জন্য আবশ্যক ছিল। এটা ছিল এক সরাসরি আদেশ । এই আদেশ পালনে ব্যর্থ হওয়ার অর্থ ছিল বিশ্বাস ভেঙ্গে ফেলা।" 

"আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে 
এ জীবন পুণ্য করো দহন- দানে।।"_

তাই হয়তো অন্তরাত্মার ইচ্ছাকে লালিত করে ১৯৪৮ সালে দারিদ্র্যের মাঝে ধর্ম প্রচারে ভিড়ে গেলেন। তিনি ত্যাগ করলেন প্রথাগত লোরেটো অভ্যাস । চির জীবনের সঙ্গী হয়ে গেল নীল পাড়ের সাধারণ সাদা সুতির বস্ত্র। ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে ক্ষুধার্ত নিঃস্ব শিশুদের নিয়ে কলকাতায় মতিঝিলে বস্তিতে একটি ছোট্ট স্কুল তৈরি করেন। এই কাজে ভারতীয় কর্তাদের  নজরে আসেন এবং তাদের সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর কাজের স্বীকৃতি দেন। প্রথমদিকে এই দায়িত্ব পালন করতে খুব কষ্ট হয়েছিল । গরিব অনাহারী মানুষের খাদ্য অন্বেষণ করতে লোকের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছিল। অনেকের কাছ থেকে দূরব্যবহার পেয়েছেন। মাঝে মাঝে একাকীত্বে তিনি নিজের ডায়েরিতে লিখতেন-" ঈশ্বর চান যে, আমি এক বন্ধনমুক্ত সন্ন্যাসিনীই থাকি, ক্রুশ চিহ্নের দীনতা আমাকে আবৃত করে থাক । আজ একটা ভালো শিক্ষা পেলাম । গরিব লোক দের দারিদ্র্য কত কষ্টকর। যখন বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি, হেঁটে হেঁটে আমরা গা- হাত- পা ব্যথা হয়ে যেত। আমি ভেবে দেখলাম, বাসস্থান, খাদ্য সাহায্য কোথায় পাব,  তার চেষ্টাতেই গরীব মানুষদের দেহ এবং আত্মা কি যন্ত্রণা ভোগ করে। তখন প্রবল হয়ে উঠলো লোভ। লোরেটো প্রাসাদোপম গৃহগুলির কথা মনে উদয় হল। সুন্দরী, কি আরামদায়ক! আর কি চাই? কে যেন আমায় লোভ দেখাতে লাগল, একবার মুখ ফুটে চাইলেই সে- সবাই আবার ফিরে পাব। আমার প্রভু নিজের ইচ্ছায় তোমার প্রতি প্রেমে, আমি তাই করতে চাই, যা আমাকে দিয়ে তুমি করাতে চাও। এক বিন্দু অশ্রু ও আমার চোখ থেকে আমি পড়তে দিলাম না?"

 ১৯৬৯ সালে বিবিসিতে 'সামথিং বিউটিফুল ফর গড' শিরোনামে ম্যালকম মাদারিজের তথ্যচিত্র সারাবিশ্বে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং টেরিজা খ্যাতি শিখরে পৌঁছে যান। 

"আমার এ ধূপ না পোড়ালে 
গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে,
 আমার এ দীপ না জ্বালালে 
দেয় না কিছুই আলো"

কম সময়ই মানুষের জীবন। আর তিনি কাজের মধ্যে ঈশ্বর দর্শন করতে পেরেছেন। তিনি হয়তো কলিযুগের ঈশ্বরের প্রতিনিধি ছিলেন তা না হলে তার সৃষ্টির ক্ষেত্রে সারা পৃথিবী জুড়ে! ১২৩ টি রাষ্ট্রে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ, কুষ্ঠ, যক্ষা, এইডস রোগীদের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্র, ভোজনশালা, শিশু ও পরিবার পরামর্শ কেন্দ্র, বিদ্যালয় অনাথ আশ্রম– 'দা মিশনারীস অফ চ্যারিটির' ৬১০টি কেন্দ্র তৈরি করেন। ১৯৫২ সালে কলকাতায় কলকাতা নগর কর্তৃপক্ষের দেওয়া জমিতে মুমূর্ষু দের জন্য প্রথম আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলেন একটি হিন্দু পরিত্যক্ত মন্দির কে নিয়ে। 'কালীঘাট  হোম পর ড্রাইং' নামে দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলে। পরে এর নাম রাখা হয়– 'নির্মল হৃদয়'  এই কেন্দ্রে যারা চিকিৎসা করাতে আসতেন তাদের থাকা ও সম্মানের সাথে মৃত্যুবরণের সুযোগ করে দেওয়া হতো।মাদারের কথায়– : A beautiful death is for people who lived like animals to die like angels loved and warted.'

 এরপর কুষ্ঠ আক্রান্ত রোগীদের জন্য শান্তিনগর নামে একটি সেবা কেন্দ্র খোলা হয়। পরে ১৯৫৫ সালে নির্যাতিত অসহায় পথ শিশুদের জন্য নির্মল শিশু ভবন স্থাপন করেন। 

সম্ভবত ১৯৬৫ সালে ভারতের বাইরে ভেনিজুয়েলায় পাঁচজন সন্ন্যাসিনী কে নিয়ে একটি কেন্দ্র খোলেন।১৯৬৮ সালে রোম, তানজানিয়া এবং অস্ট্রিয়াতে, ১৯৭০ সালে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকাতে প্রচুর সেবাকেন্দ্র খোলেন। লেখক গবেষক ডেভিড স্কট এর মত অনুসারে– 'মাদার টেরেসা স্বয়ং দারিদ্র্য বিমোচনের বদলে একটি মানুষকে জীবিত রাখার উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।' 

 অন্য আর এক গবেষক এলবার্টার তাঁর প্রতিবেদনে বলেছেন – 'তিনি মনে করতেন কষ্ট ভোগ এর মাধ্যমে যীশুর কাছা কাছি যাওয়া যায়।'

 এই সেবামূলক কাজ করতে গিয়ে তাকে বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।  ১৯৮২ সালে বৈরুত অবরোধের সময় মাদার যুদ্ধবিধ্বস্ত ফ্রন্টলাইনের হাসপাতালে আটকে পড়া ৩৭ জন শিশু উদ্ধার করে এরপরে আন্তর্জাতিক রেডক্রস এর সহযোগিতায় ইসরায়েল সেনা বাহিনী ও ফিলিস্তিনী গেরিলাদের মধ্যে যুদ্ধবিরোধী সময় বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে কমবয়সী রোগীদের উদ্ধার করেন । ১৯৮০ সালে ইউরোপের কিছু অংশের মানুষদের মধ্যে তাদের কাজকর্ম পৌঁছাতে সফল হন । এই সময় মাদার টেরেসা যে সমস্ত প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন তার মধ্যে গর্ভপাত ও বিবাহ বিচ্ছেদের মত  বিষয়। অনেকে মাদার কে নিয়ে সমালোচনা করতেন কিন্তু মাদার সবসময় বলতেন– ' No matter who says what you should accept it with a smile and do your own work.'

টেরিজা ধর্ষিতাদের গর্ভপাত করাতে অনীহা ছিল কারণ তিনি সৃষ্ট প্রাণ হত্যা করতে পছন্দ করতেন না। টেরিজা নোবেল ভাষণে বলেন– 'গর্ভপাত বিশ্বশান্তির সবচেয়ে বড় শত্রু।' 

মাদার ছিলেন দশোভূজা জগধাত্রী তিনি যেমন ইথিওপিয়ার ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে যেতেন তেমনি চেরনোবিল বিকিরণে আক্রান্ত অঞ্চলে যেতেন। আমেরিকার ভূকম্পন আক্রান্ত মানুষের মধ্যে সেবা দেওয়ার জন্য তাদের কাছে পৌঁছে যেতেন। ১৯১৯ সালে প্রথমবারের জন্য নিজের জন্মভূমি আলবেনিয়া তে যান এবং তিরানা শহরে একটি 'মিশনারিজ অফ চ্যারিটি ব্রাদার্স' প্রতিষ্ঠা করেন।  ১৯৮৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের  ব্রঙ্কস বরোর দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম চ্যারিটি খোলা হয়।  এরপর আরও ১৯ চ্যারেটির সক্রিয় শাখা খোলা হয়, যারা এখনো পর্যন্ত কাজ করে যাচ্ছে। 

এইসব কাজের জন্য মাদার বিভিন্ন সমস্যা সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে তবুও তার কর্ম থামেনি ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ও দ্য ল্যান্সেট পত্রিকায়– ' তাঁর সেবা কেন্দ্র গুলির চিকিৎসা ও সেবার মান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। অনেকেই এক হাইপোডার্মিক সূচ একাধিক বার,  বার বার ব্যবহারের কথা বলেছেন। কেন্দ্র গুলোর জীবন-যাত্রার নিম্নমান ও সমালোচিত হয়েছে। তার উপরে সংঘের অ-বস্তু দৃষ্টিভঙ্গির পদ্ধতি গত  রোগ নিরুপনকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছিল।'

 এছাড়া ও ক্রিস্টোফার হিচেন্স ও স্টার্ন সাময়িকী সমালোচনা করে বলেছেন– 'গরিবদের উন্নয়নের কাজে চ্যারিটিতে যত অর্থ আসে তার কিছু অংশ অন্যান্য কাজেও ব্যয় করা হয়।' 

এত কিছুর মধ্যে তিনি কোন দিকে কান না দিয়ে ১৯৯৬ সালে পৃথিবীর ১০০ টির বেশি দেশে মোট ৫১৭ টি ধর্ম প্রচার অভিযান পরিচালনা করেন। এছাড়া তৈরি করেন ৪৫০ টি মানব সেবা কেন্দ্র। শুরু করেছিলেন ১২ জন সদস্য নিয়ে তারপরে এর সংখ্যা দাঁড়ায় কয়েক হাজার। 

বিশ্বে বিভিন্ন ব্যক্তি, একাধিক সংস্থা বা রাষ্ট্র কাজের মাধ্যমে কোথাও নন্দিত হয়েছে আবার কোথাও নিন্দিত হয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দাতব্য ধর্ম প্রচার কেন্দ্র বিভিন্ন বিতর্কে জন্ম দিয়েছে কোথাও বলপূর্বক আবার কোথাও মৃত্যু পথযাত্রীদের জোরপূর্বক খ্রিস্টধর্ম দেওয়া। বিশ্ব বিখ্যাত চিন্তাবিদ জার্মেইন গ্ৰিয়ার টেরিজাকে 'ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদী' বলে সমালোচনা করেছেন। 

'অনেকে তাকে উন্মত্ত উগ্রবাদী মৌলবাদী তথা ভন্ড বলে আখ্যায়িত করে বলেছেন যে তিনি নিজের ধর্মীয় আদর্শ তথা ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে দুস্থ বঞ্চিতদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।'  

মাদারটেরেজা কে উপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের ধ্বজাধারী বলেছেন সমালোচক বিজয় প্রসাদ। তাঁর লেখায় পাওয়া যায়– "টেরিজা উপনিবেশিত দেশে ধর্মপ্রচারক শ্বেতাঙ্গ নারীদের প্রতিভূ রূপে ক্রিয়া রত ছিলেন,  যেন তিনি কালো মানুষদের স্বীয় কামনা ও অপারগতা থেকে রক্ষা করতে এসেছেন। এখন ও উপনিবেশবাদী কুচিন্তা ধারণ করে যাওয়া ইউরো মার্কিন মিডিয়া মনে করে যে কালো মানুষদের বদলাবার বিশেষ ক্ষমতা শ্বেতাঙ্গদের রয়েছে। অশ্বেতাঙ্গ কালোরা  নিজেরা নিজেদের উন্নতিতে সচেষ্ট হলেও ইউরোপ মার্কিন মিডিয়া তার মাঝে কোন শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিকে খুঁজে পায় শিক্ষক বা অভিভাবক রূপে যেন কালোরা  নিজেরা নিজেদের উন্নতি করতে অপারগ শ্বেতাঙ্গদের ছাড়া। টেরিজার কর্ম পশ্চিমা বৈশ্বিক প্রকল্পেরই অংশ যা বুর্জোয়া পাপবোধ কে প্রশমন করতে দাতব্য চালিয়ে যায় কিন্তু যে সমাজ কাঠামো কে না বদলিয়ে টিকিয়ে রাখে।" 

গবেষক চিকিৎসক অরূপ চট্টোপাধ্যায় বলেন– "ভারত থেকে এখনো উপনিবেশি মানসিকতা দূর হয়নি তাই সাধারণ মানুষ টেরিজার মত সাদা মহিলাকে সমালোচনা করতে ভয় পায়।" 

অরূপ বাবু আরো লিখেছেন– "১৯৯২ সালে মাদার টেরিজা নিজেই স্বীকার করেন, তিনি প্রায় ২৯ হাজার লোককে মৃত্যুকালে তাদের না জানিয়ে খৃষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করেছেন।"

এই একই অভিযোগ করেছেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও তাদের দাবি –"মাদার টেরিজা হিন্দু ধর্মকে শয়তানের ধর্ম বলে চিহ্নিত করেন। যদিও একজন মানুষ কিভাবে অজান্তে তাকে ধর্মান্তরিত করা যায় সেটাই প্রশ্ন বিদ্ধ।" 

কলকাতা পৌরসংস্থার মহানাগরিক ও বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেছেন– "কলকাতার দারিদ্র লোকেদের উপর টেরিজার কোন উল্লেখযোগ্য কর্ম নেই; টেরিজার রোগের চিকিৎসা করাচ্ছে রোগকে মহিমাহ্নিত করেছেন বেশি এবং সর্বোপরি সারা বিশ্বে কলকাতার নেতিবাচক দারিদ্র ময় ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন।" এই মত কে সমর্থন করেছেন লেখক গবেষক সমালোচক চিকিৎসক অরূপ চট্টোপাধ্যায় যিনি একসময় টেরিজার সেবা প্রতিষ্ঠানে ডাক্তার ছিলেন। সব কিছুই তিনি কাছ থেকে অনুধাবন করেছেন। 

১৯৯৪ সালে সাংবাদিক পরিচালক ক্রিস্টোফার হিচেন্স ও তারিক আলি টেরিজার উপর "হেলস এঞ্জেল" যার অর্থ আক্ষরিক অর্থ "নরকের দেবদূত" নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন। এছাড়াও হিচেন্স ১৯৯৫  সালে "'দা মিশনারি পজিশন মাদার টেরিজা ইন থিওরি অন্ড প্রাকটিস" নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন।  তিনি সেই গ্রন্থে দেখান ক্ষমতাহীনদের সাথে ক্ষমতাবানের  লড়াইয়ে সর্বদা তিনি অর্থাৎ মাদার ক্ষমতাবানের পক্ষ নিয়েছিলেন। মাদার যেমন ভোপালের বিপর্যয়ে ইউনিয়ন কার্বাইড এর পক্ষ নিয়েছেন তেমনি রোনাল্ডো রিগানের সমর্থন করেছেন। এছাড়া নিকারাগুয়ায় গিয়ে সন্ডিস্টাদের  বিরুদ্ধে টেরিজা সিআইএ সমর্থিত  কন্ট্রাদের  সমর্থন করেছেন।

 ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল দা ল্যাঞ্চেটের সম্পাদক রবিন ফক্স ১৯৯১ সালে কলকাতায় টেরিজা সেবা কেন্দ্র সেবাদান প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে "চিকিৎসার মানকে অগ্ৰহন যোগ্য ও অপরিস্কাচ্ছন্ন বলে সমালোচনা করেন ফলে রোগী ও মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি হতে পারে।"

 মন্ট্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এই মত দান করেন। মাদার মনে করতেন-

"প্রণাম দিতে চরণতলে 
ধুলায় কাঙাল যাত্রী দলে
চলে যারা, আপন ব'লে 
চিনবে আমায় সবে ।" 

–হয়তো তাই। তিনি যে আধ্যাত্মিক চেতনায় থাকতেন এবং আচার ধর্ম পালন করতেন। কিন্তু তাঁর বিভিন্ন চিঠিপত্র থেকে জানা যায় জীবনের শেষ পঞ্চাশ বছর অন্তরের অন্তস্থলে ঈশ্বরের অনুভব করেননি, আসলে ঈশ্বর তাকে পরিত্যাগ করেছেন। তিনি লিখেছেন –

 "Where is my faith? Even deep 
Down... There is nothing but 
Emptiness and dark ness- it there 

Be God- please forgive me." অর্থাৎ -কোথায় আমার বিশ্বাস? এমনকি হৃদয়ের গভীরে শূন্যতা আর অন্ধকার ছাড়া কিছুই নেই, যদি ঈশ্বর তুমি থাকো, আমাকে ক্ষমা করো।

জীবনে তিনি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন এর মধ্যে নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯৭৯, ভারতরত্ন ১৯৮০, প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম ১৯৮৫  বালজান পুরস্কার ইত্যাদি। ১৯৮৩ সালে দ্বিতীয় পোপ জন পলের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে রোমে যান এবং সেখানে তার প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়।  ১৯৮৯ সালে কৃত্রিম পেসমেকার বসানো হয় এরপর ১৯৯১ সালে মেক্সিকোতে থাকার সময় নিউমোনিয়া জন্য আরো  হার্টের অবস্থা খারাপ হয়। ১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসে পড়ে গিয়ে তার কলার বোন ভেঙ্গে যায় এর পরবর্তী সময় কালে ১৯৯৭ সালের ১৩ ই মার্চ 'মিশনারিজ অফ চ্যারিটি' প্রধান পদ থেকে সরে যান ওই বছরই, ৫ ই সেপ্টেম্বর তিনি আমাদের ছেড়ে অনন্তলোকে যাত্রা করেন।

 তবুও আমাদের হৃদয়ে তিনি বিরাজমান। মাদার টেরেসাকে 'সন্ত' ঘোষণার দুটি কারণ, ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। পরে পোপ তদন্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দেন ।

ঘটনা ১. ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ১৯৯৮ সালে দক্ষিণ দিনাজপুরের অন্তর্গত হরিরামপুরের নাকোড় গ্রামের মনিকা বেসরায় ওভারির ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন, মাদার টেরেসার আশীর্বাদে তা সেরে যায়। ভ্যাটিকান ২০০২ সালে এই ঘটনাটি অলৌকিক বলে অনুমোদন করেন। 

ঘটনা ২. ব্রাজিলের এক ব্যক্তি তার মাথায় একাধিক টিউমার হয়েছিল, কিন্তু তিনি আশ্চর্যজনকভাবে সেরে ওঠেন। তাই এই সেরে ওঠা নিশ্চিত করেন ভ্যাটিকান। এটিও মাদারের আশীর্বাদ। তবে এই ব্রাজিলবাসী কোনদিন তাঁকে দেখেন নি।

 এই দুই অলৌকিক ঘটনা মাদারকে 'সন্ত' করে তোলে।সন্ত হওয়ার যোগ্য কোন ব্যক্তির সন্তায়নের প্রক্রিয়াটি শুরু হয় মৃত্যুর ৫ বছর পর থেকে কিন্তু মাদার এর ক্ষেত্রে পোপ দ্বিতীয় জন পল নিয়ম শিথিল করে ৩ বছর করে দেন। 

তিনি ১৯১৯ সালে মাদার কে সন্তায়নের প্রক্রিয়ার অনুমতি দেন। সন্ত হওয়ার পর তিনি 'সন্ত টেরিজা' নামে পরিচিত হবেন। পরে তাঁর নামের পাশে হোলি মাস হতে পারবে এছাড়াও চার্চ নামাঙ্কিত হতে পারবে। ও টেরিজার ছবির মাথার পিছনে হ্যালো বা জ্যোতির্বলয় থাকতে পারবে।  

রবীন্দ্রনাথের কথায়– 

"ওগো, তোমার চক্ষু দিয়ে মেলে সত্য দৃষ্টি
 আমার সত্যরূপ প্রথম করেছে সৃষ্টি।। 
তোমায় প্রনাম, তোমায় প্রনাম 
তোমায় প্রনাম শতবার।।"  

 

তথ্যসূত্র–১. মাদার টেরেসা- নবীন চাওলা 
২. টেরিজা আলোয় বিশ্বপথে- জয়ন্ত ঘোষাল 
৩. Mother Teresa's Crisis of Failt- David Can Biema.
৪. Saints Blessing- Meera Lester. 
৫. শ্রী মোহন ভাগবত নির্জলা সত্য বলে মৌচাকে ঢিল মেরেছেন- অমলেশ মিশ্র
৬. বিভিন্ন সাময়িক পত্র পত্রিকা
৭. 'গীতবিতান'- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে

 

কুমারেশ সরদার
কলকাতা, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top