সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

বিস্মরণের শেষে : গৌতম দে সরকার


প্রকাশিত:
১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:১৬

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:৪৬

 

"কোনো বিস্মরণের শেষে যদি ফিরে আসি,
আমাকে বর্ণমালা ফিরিয়ে দিও
আমি নিজের মতো সাজিয়ে নেব আবার

চেতনায় ফিরে না এলে, আমার কবিতার
নির্মাণগুলি, পথের দুপাশে সাজিয়ে রেখো
শব্দময় দুপাশে আমি নিঃশব্দে মিশে যাব
জোনাকির ঝাঁকে।"

ধূপের গন্ধ ভেসে আসছে। এই গন্ধটাই বলে দেয় ঠিক পুজোর আসর, না কি মৃতের বাড়ির ভীড়।

রাস্তার ওপারে ছোট্ট বাড়িটায় আজ আশ্চর্য নিরবতা। মানুষের ভীড় আছে। এখানে ওখানে ছোটো ছোটো জটলা। কেউ কেউ বলে যাচ্ছে, বাকিরা চুপ করে শুনছে। সবই নিচুস্বরে।
ঘরের ভিতর বাড়ির মেয়েরা, আত্মীয়-পরিজন ঘিরে আছে মৃতদেহ। কোনো উচ্চস্বরে কান্নাও নেই। অত্যন্ত সংযত কান্নার আবেগটিও। খবর পেয়ে একে একে ভীড় বাড়ছে মানুষের।
অল্প বয়সি ছেলে ও মেয়েদের একটি ভীড়ে আলোচনা চলছে, ওরা বোধ সবাই-ই কলেজে বা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।
"এভাবে একা একা থাকা যায়! তবুও শেষ জীবনটায়  নিহারদি এসে চব্বিশ ঘন্টা থাকতো।"
"নিহারদি কে?
"সমরদাকে যে দেখাশোনা করতো। সমরদার দূর সম্পর্কের নাকি আত্মীয়া। উইডো। তিনিও খুব স্কলার। কিন্তু কি হলো সমরদার মতোই, দাম পেল না।"
"সত্যিই। সমরদা আজ কোথায় থাকতেন!"
"ঠিকই। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে কখনো সেকেন্ড হন নি। বিদেশ থেকে ডাক এলো। তিনি গেলেন না। কি না? দেশে থাকবেন। আর কবিতা লিখবেন।"
"তাও আবার বাংলা কবিতা!"
"হ্যাঁ। তাই।" ভীড়ে একটা হাসির রোল ওঠে।
আর একজন বললো, "না রে, সমরদার কবিতা নিয়ে কোনো কথা হবে না। ক্লাস লেখা। এমন বিদ্যুতের আগুন নিয়ে বাংলা ভাষায় কেউ লেখেনি। কী জোর প্রতিটি শব্দ প্রয়োগে। কী প্রত্যয়!"
"তাই তো এত মানুষ ভালোবেসে এসেছে সমরদার মৃত্যুর খবর পেয়েই। অপেক্ষা করছে তার শেষ যাত্রায় যাবে বলে।"
"সমরদার ওই কবিতাটি পড়েছিস, "আগুনেরও অভিরুচি আছে, অভিমানও প্রবল"?
" পড়ি নি!  খুব দারুণ কবিতা। ছোট্ট কবিতা, অথচ তাতেই প্রেম আছে, বিচ্ছেদ যন্ত্রণা আছে, আবার সামাজিক প্রতিবাদও আছে।"

সকলের সমরদা। কবি সমর বন্দ্যোপাধ্যায়, আজ ভোরে নিজ বাসভবনে পরলোকগমন করেছেন।
খবরটি জানার পরেই তার গুণগ্রাহী সব বয়সের মানুষরা এসে ভীড় করেছে তার বাড়ির সামনে।

একজন কালো রঙ দিয়ে লিখে এনেছে ইতিমধ্যেই "কবি সমর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।" কেউ কেউ ওটা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অবশেষে উঠোনের মাঝখানে সেটা বসানো হলো। ঘরের সামনে একফালি জায়গা সেখানেই কবিকে শেষবারের মতো রাখা হবে।

বাড়ির উল্টোদিকে যে রাধাচূড়ার গাছটি, হলুদ ফুলে ছেয়ে আছে, তারই ছায়ায় বসে মাঝ বয়সের কিছু মানুষের জটলা।
একজন ডেকে উঠলো, "এই সুনন্দা। এইদিকে।"
সুনন্দা উদ্বেগে ও অন্যমনস্কতায় হেঁটে যাচ্ছিল। শুনেই থমকে দাঁড়ালো, "ও বিমানদা। আপনারা এখানে। কি হলো বলুন তো! পরশু দিনও কথা বললাম কত।"
"আর কি! এর ওপরে আর কারো হাত নেই। চিকিৎসার সুযোগই পেল না। সিভিয়ার এটাক্।"
"তাই বলে এইভাবে? সত্যিই ভাবতেও পারছি না।"
"নতুন লেখাটা আর শেষ করতে পারলো না।"
"তাই? কি লিখছিলেন? অনেকদিন বলছিল, একটা মহাকাব্য লিখব সুনন্দা।"
"হ্যাঁ। সেই আত্মজীবনীর অংশই। অসমাপ্তই থেকে গেল।"
সুনন্দা তার নিজের চেনা পরিমন্ডলে মিশে গেল।

প্রান্তিক সাহিত্য গোষ্ঠীর আর একটি জটলা ঠিক বাড়ির গেটের সামনেই। সারা মুখ দাঁড়িতে ভর্তি যুবকটি এসে আর একটি যুবককে বললো, "এই তুই কি সমরদার এই কবিতাটি পড়েছিস?"
"কোনটা বলতো?"
"ওই যে,.."চেতনায় ফিরে না এলে,আমার কবিতার /
নির্মাণগুলি, পথের দুপাশে সাজিয়ে রেখো / শব্দময় দুপাশে আমি নিঃশব্দে মিশে যাব / জোনাকির ঝাঁকে।"
"কী অসাধারণ, তাই না!"
" না না আমি বলছি সমরদা বোধহয় কবিতাটি আজকের দিনের জন্যই লিখেছিলেন।"
"সত্যিই তো! এক কাজ করি সমরদার কবিতাগুলো প্রিন্ট নিয়ে চল রাস্তার দুপাশে লাগিয়ে দিই।"

নিহারদি বাড়ির ভিতরে সকলের সাথে ধীরে ধীরে কথা বলছে।বাঙালির নিন্দুক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই আড়ালে সমরদা ও নিহারদির সম্পর্কের জল খুঁজত। এখনো খুঁজবে হয়তো।
"আত্মীয় না ছাই। দুজনেরই দুজনের খুব প্রয়োজন ছিল।"
এদিকটায়, গলির মুখে, পাড়ার মহিলাদের জটলা।
"হলোই বা। তবুও মানুষটা একটু রান্না করা খাবার দুবেলা পেত।"
"এখন তো মেয়েটাও সেই একলাই হয়ে গেল।"
"ওই তো ওর ছেলেও এসেছে। খবর পেয়ে।"
নিহারদির ছেলে কলকাতায় প্রেস-এ কাজ করে। মাঝে মাঝে এখানে আসে। আবার ফিরে যায়। সারাজীবন মফস্বল টাউনে থেকেও বেশ নামকরা কবি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে সমরদা। সাম্প্রতিক সময়ে টিভি-র একটি চ্যানেলও সমরদার কবিতা নিয়ে একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান করেছে। অকৃতদার সমর বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনি দেহ রাখলেন। পড়ে রইল তার অনেকগুলি কাব্যগ্রন্থ। প্রান্তিক সাহিত্য গোষ্ঠী তার নিজের হাতে গড়া। আর অসংখ্য অনুরাগী পাঠক।
ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আসতো, তাদের কবিতা নিয়ে। সমরদা সকলকেই কাছে টেনে নিতেন, লেখায় উৎসাহ দিতেন। নতুনদের কবিতার সাথে নিয়মিত যুক্ত করার কাজটি করেই তিনি  নিজেও আনন্দ পেতেন। শুধুমাত্র কবিতাকে নিয়েই বেঁচে থাকা যায়, সমর বন্দ্যোপাধ্যায় তা-ই করলেন।

নিহারদির ছেলের নাম বিজু। ও-ই বাইরেটা সামলাচ্ছে। সকলের সাথে কথা বলছে, উত্তর দিচ্ছে। একজন বললো, "সমরদাকে বাইরে আনা হবে না?"
বিজু বললো, "চেয়ারম্যান বাইরে আছেন। ফিরবেন দুপুরের দিকে। অপেক্ষা করতে বলেছেন। তাই এতক্ষণ বাইরেই থাকবেন?"
একজন জিজ্ঞেস করলেন, "রানুকে কি খবর দেওয়া হয়েছে?"
বিজু বললো,"মা বলতে পারবে।"
পাশ থেকে নিহারদি বললো,"হ্যাঁ। আমি নিজে ফোন করেছিলাম।"
"কি বললো?"
"আসবে না বলেছে।"
"এমা, কেন?"
"ও বলেছে, এই রূপ ও দেখতে পারবে না।"
কথোপকথনটি থেমে গেল এখানেই।
সকালে নিহারদির ফোন আসার পরেই কলকাতা লেক রোডের এ বাড়িও ছেয়ে গেছে নিরবতায়। অথচ এ বাড়িতে কখনো আসেন নি কবি সমর বন্দ্যোপাধ্যায়। আসার কথাও নয়। রানুর সাথেই একমাত্র যোগসূত্রতা। রানু মাঝে মাঝে নিজেই চলে আসতো তার ছেলেবেলার শহরটিতে। নিজেদের বাড়িতে তো আসতই, পরে শুধু কবির সাথে দেখা করতেই আসত। কবির নিদারুণ অর্থ কষ্টের প্রেক্ষিতে তার সব খরচ ও চিকিৎসার যাবতীয় দ্বায়িত্ব সে-ই নিয়েছিল। যদিও তা কবির অজান্তেই। নিহারদি থাকাতে রানুর সুবিধা হয়েছিল। রানু নিয়মিত টাকা পাঠায়। সে টাকার পরিমাণ নেহাৎ কম নয়। নিহারদিরও ভালোভাবে যাতে চলে যায় সেটাও ভেবেছে রানু। কয়েক মাস আগেও কবির ঘরটিকে মেরামত করে দিয়ে গেছে।

রানুর আজ মন খারাপ। এবাড়ির সকলেই জানে রানুর সাথে কবি সমর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্কের কথা। রানুই বলেছে।
কলকাতার ধনী পরিবারে বাবা বিয়ে ঠিক করেই ফেললো। অথচ স্কলার সমর বন্দ্যোপাধ্যায় তখন গোঁ ধরে বসেই আছে সে কবিতাই লিখবে। সে চাকরি তো করবেই না, উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশেও যাবে না। বহু অনুনয়েও বিফল হয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল রানুকে। শেষ পর্যন্ত বাড়ির সকলের ইচ্ছেতে বিয়েটাও হয়ে গেল।
বহুদিন আসেনি রানু তার নিজের শহরে আর। সেই সময় সমর লিখে যাচ্ছে, এক একটি কাব্য গ্রন্থ। বিদ্যুৎ দিয়ে লেখা সেইসব কবিতা, যন্ত্রণা রয়েছে, রয়েছে নিজেকে আরও ক্ষত বিক্ষত করে আরও আত্মপীড়নের সংলাপ।
রানু লেখাগুলো পড়তো নিয়মিত। একদিন দেখা হলো কলকাতাতেই। তারপর থেকেই আবার নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হলো।
রানুর শ্বশুর বাড়ির সকলেই উচ্চ শিক্ষিত। ধন ও শিক্ষার আশ্চর্য মেলবন্ধন। রুচি ও ব্যবহারে বনেদি বাঙালিয়ানার সাথে মিশেছে আধুনিকতা। তাই রানুরও জানাতে অসুবিধে হয় নি সমরের কথা। এদের পরিবারের অনেকেই সেই মেধাবী ছাত্র সমর বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনেও।
এই পরিবারে সকলেরই আর্থিক স্বাধীনতা আছে। তাই রানুর পক্ষেও সুবিধা হয়েছে সমরের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে।
ছেলে-মেয়েরা আজ সারাটা দিন কিই না করলো। কবির লেখা কবিতার লাইনগুলো বড় বড় করে লিখে সারা রাস্তার দুপাশে টাঙিয়ে দিল। এত ছেলেমেয়ে বাঙলা কবিতাকে ভালোবাসে! কবি সমর বন্দ্যোপাধ্যায় নিজ হাতে এই প্রজন্মকে তৈরি করেছেন। শুধু অর্থ দিয়েই মূল্যায়ন করাটা নিরর্থক। তিনি এই কথাটিই বারে বারেই বলতেন।

কবির মরদেহ বাইরে আনা হয়েছে। লোকের ভীড়ও বেড়েছে বাইরে। চেয়ারম্যানও এসে পড়েছেন। তিনি ফুলের মালা দিলেন। কবিকে এইবার নিয়ে যাওয়া হবে অন্তিম যাত্রায়। একটি দুধসাদা গাড়ি এসে দাঁড়ালো বাড়ির সামনে। ক্ষণিকের নিরবতা। সকলেই উচ্চকিত গাড়ির দিকে। রানুই এলো বুঝি। গাড়ি থেকে সেই মুহুর্তেই নেমে এলো একটি মেয়ে। সে সোজা হেঁটে গেল কবির কাছে। পিছনে এলো ফুলের স্তবক নিয়ে তার গাড়ির ড্রাইভার। মেয়েটি ফুল দিয়ে ঢেকে দিল কবির সারা দেহ।
নিস্তব্ধতা ভেঙে নিহারদি জিজ্ঞেস করলো, “তোমাকে তো চিনলাম না।"
মেয়েটি ফিরল নিহারদির দিকে। বললো," মা, আসতে পারে নি। আমাকেই পাঠিয়েছে।"
নিহারদি কাছে এল ওর, "ও আচ্ছা! তুমি রানুর মেয়ে!"
কবি সমর বন্দ্যোপাধ্যায়কে শেষ যাত্রায় তুলে নিল সবাই। সকলেই শোকাহত। কেউ কান্নার জন্য নেই।

হঠাৎ যেন কান্নার শব্দ শোনা গেল। একাই কাঁদলো লুকিয়ে, সে নিহারদি।

 

গৌতম দে সরকার
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top