সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

ধীরাজবাবু আর সত্যেনবাবু : তাপস বড়ুয়া


প্রকাশিত:
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:৪৬

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৫৭


ধীরাজবাবুর ফাইলটা পাওয়া যাচ্ছিলো না। এ নিয়ে বিচিত্রগুপ্তের প্রায় চাকরি যায় যায় অবস্থা। এমনিতে বেচারার চাকরি পাকা হয় নি। কোটি বছরেও। বস চিত্রগুপ্ত শুধু খাটিয়েই নিচ্ছে। চাকরি স্থায়ী হওয়ার সুপারিশ করছে না।
তারই বা কি দোষ! যমরাজের বিচার সভায় এত ফাইল জমে আছে বছরের পর বছর যে আমাজনের কম্পিউটার আর রোবট নিয়ন্ত্রিত সিস্টেম ছাড়া সঠিক সময়ে সঠিক ফাইল খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। একথা বিচিত্রগুপ্ত জেনে গেছে সদ্য হাতে আসা কতকগুলো কেসের সুবাদে। আমাজনের মার্কেটিং-এ কাজ করা দু’একজনও সম্প্রতি গত হয়েছেন। তাদের কেসও যমরাজের বিচার সভায় পেন্ডিং। তাদের সাথে আলাপে আলাপে অনেক কিছু জেনেছে সে। কিন্তু মুখ ফুটে বলছে না। তাহলে বারকোডিং-এর দায়িত্ব এসে পড়বে তার কাঁধে। জমে থাকা এত ফাইলের ডাটা এন্ট্রির দায়িত্ব নিতে হবে। সে খুব আরামের কাজ হবে না। তাই চুপচাপ থাকছে। ম্যানুয়ালী ফাইল পত্র রাখছে, খুঁজছে। পেলে ভাল, না পেলেও ক্ষতি নেই।
ধীরাজবাবুর কেসটা একটু অন্যরকম। বিচার প্রায় প াশ বছর আগে শেষ হয়েছিলো। পাবলিক ফিগার হিসেবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। পুরষ্কার তিরষ্কারেরও একটা রফা হয়েছিলো। কিন্তু এতদিন পরে হাইকোর্টের একজন আইনজীবী জনস্বার্থ মামলা ঠুকে দিয়ে বলছেন, “ধীরাজবাবু সুবিচার পান নি। যার আবক্ষ মূর্তিতে জন্মদিনে পুষ্পস্তবক দেয়া হয় তার কর্মস্থলে, সেই মানুষ শেষ বিচারে আরো পুরষ্কার পাওয়ার যোগ্য।” এই কেস যদি মর্ত্যে হয়, তাহলে তা অনুসন্ধানের দায় যমরাজের আদালতের উপরও বর্তায়। কেস এখনো ফরওয়ার্ড হয়ে আসে নি, কিন্তু আগাম প্রস্তুতি তো নিতে হবে। যমরাজ চিত্রগুপ্তকে বলেছিলেন ব্যাকগ্রাউন্ড পেপার সব তৈরি করতে। চিত্রগুপ্ত জিনিসটা পাস করে দিয়েছেন বিচিত্রগুপ্তকে। সে মাস্টার রোলের কর্মী। যত ইচ্ছা খাটানো যায়। তার অভিযোগ কেউ শুনবে না।
যতটুকু জানা যাচ্ছে, ধীরাজবাবু ছিলেন অভিনেতা। অনেক সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন। কলকাতা কেন্দ্রিক সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে তার কদর ছিলো এক সময়। তার আগে তিনি পুলিশ বিভাগে কিছুদিন চাকরি করেন। তখন তার পোস্টিং ছিলো বর্মামুলুকের সীমানার কাছে টেকনাফ থানায়। ওই একবার বছর দু’য়েক ছাড়া তিনি মোটামুটিভাবে সারাজীবন কলকাতাতেই কাটিয়েছেন।
বিচিত্রগুপ্ত খেটেখুটে মোটামুটি একটা ফাইল তৈরি করেছে। আরো কিছু তথ্য জোগাড় করতে হবে। প্রায় দুই লক্ষ পৃষ্ঠার সেই প্রাথমিক ফাইল সে এগিয়ে দেয় চিত্রগুপ্তের দিকে। তার অনুমোদন পাওয়া না গেলে অফিসিয়ালী নথিবদ্ধ করা যাচ্ছে না। চিত্রগুপ্ত তক্কে তক্কে থাকেন কখন কিভাবে কাকে ধরা যায়। তা না হলে সেকশন চিফ হিসেবে তার সম্মান থাকে না। অন্যদের চাইতে তিনি যে বেশি বোঝেন এটা বোঝাবার একটা সুযোগ এটা। এই সুযোগটি নিতে তিনি কখনো ভুল করেন না। তিনি একটা ফন্দি সাধারণত করেন। তিনি গুগলে সার্চ দিয়ে কতকটা আনকমন কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য খুঁজে রাখেন আগে থেকেই। কোন ফাইল তার কাছে পেশ করলে সেসব আনকমন তথ্য ফাইলে আছে কি না তা জানতে চান। অনেক ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তা হতচকিয়ে যান। তখন সুযোগ বুঝে চিত্রগুপ্ত তাকে তুলোধুনো করেন।
এবারও তাই করলেন। বললেন, “আমার কাছে খবর আছে জন্মদিনে তার আবক্ষ মুর্তিতে পুষ্পস্তবক অর্পন করা হয়েছে। সেই তথ্য কই? তোমরা আধা আধা তথ্য দেবে আর পূর্ণাঙ্গ বিচার হবে কি করে?” মুখ কাচুমাচু করা আর হাত কচলানো ছাড়া বিচিত্রগুপ্তের আর কিছু করার থাকে না। চিত্রগুপ্ত ফাইলটা এক প্রকার ছুড়ে ফেলেন, “আরো কাজ করতে হবে। তারপর এনো।” “এর মধ্যে ধর্মাবতার যদি চেয়ে বসেন?” ভীত কন্ঠে প্রশ্ন করে বিচিত্রগুপ্ত।
ব্যাঙ্গ করে বলেন চিত্রগুপ্ত, “ধর্মাবতার যদি চেয়ে বসেন! চেয়ে বসলে তার হাতে দেবে কি? ওই ইনকমপ্লিট রিপোর্ট? যমরাজের মানসম্মান আর তোমরা রাখবে না। যতসব অর্বাচীনের দল।” বিচিত্রগুপ্ত বেরিয়ে আসে কামরা থেকে। আবার লোক পাঠাতে হবে মর্ত্য।ে কোথায় তার আবক্ষ মূর্তি আছে আর কে-ই বা তাতে ফুল দিলো বোঝা যাচ্ছে না। আগেরবার তার তদন্তকারীরা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে ধীরাজবাবুর জীবনের প্রায় সব ঘটনা ও স্থান। তার জীবনের উল্লেখযোগ্য সময়টা কেটেছে কলকাতায়। শুধু মাঝে কিছুদিন টেকনাফে গিয়েছিলেন চাকরি করতে। অল্পসময়ের জন্য। সেখানে তেমন ভাল কিছু তিনি করেছেন বলে রিপোর্টে উল্লেখ নেই।
একটি মেয়ের প্রেমে পড়েন তিনি। নাম মাথিন। স্থানীয় গোত্রপতির মেয়ে। মেয়েটিও তাকে ভালবাসে। নানা বাধা অতিক্রম করে বিয়ের কথা যখন ঠিকঠাক, তখন তিনি এক প্রকার পালিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। আর ফিরে যান নি। মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। এবং এক সময় মারা যায়। ধীরাজ মেতে থাকে তার কলকাতার জীবন নিয়ে। নায়ক হয় সে। একটি মেয়েকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার বিষয়ে তাকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো প্রাথমিক বিচারের সময়ে। তিনি বিভিন্ন যুক্তি দেখান। কোনটাই টিকছিলো না। সবশেষে পিতা মাতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধার কথা উল্লেখ করেন। যে কারণে পিতার চিঠি পেয়ে তাকে চলে আসতেই হয়েছিলো। মিথ্যে করে বলেছিলেন, তিনি ভেবেছিলেন যে তখন না গেলে পিতার সাথে শেষ দেখা বুঝি আর হয় না। এতেই মন ভেজে যমরাজের। এতবড় একটা কান্ডের হোতা হয়েও ছাড় পেয়ে যান তিনি। প্রসিকিউটররাও তেমন আপত্তি করেন নি। অকাট্য কোন তথ্য প্রমাণ তাদের হাতে তখন ছিলোও না। ফরেনসিক এভিডেন্স ছাড়া তারা বেশিদূর এগোতে পারেন নি এটাই বাহ্যত মনে হবে। কিন্তু এর ভিতরে অন্য কারণ ছিলো। যে থানায় ধীরাজবাবু চাকরি করতেন, সেটা পড়েছে এখনকার বাংলাদেশে। আর বাংলাদেশে সুরা পানকে নিষিদ্ধ নেশার মধ্যে ধরা হয়েছে। আইনত: সুরা পান এবং গাঁজা সেবন নিষিদ্ধ। অমন একটি জায়গায় সরেজমিন তদন্তে যাওয়ার কোন আগ্রহ তদন্তকারী দলের ছিলো না। স্বর্গীয় মদিরায় অভ্যস্ত তদন্তকারীদের ঠিক পোষাতো না এখানকার ডাবের জলে। আর ঊর্বশী মেনকাদের নাচ তাও ততটা সুলভ নয় বাংলাদেশে। পাশাখেলার জন্য আবার পারমিশন লাগে। এমন একটি জায়গায় কে যাবে তদন্তে। তাতে আসামী যদি ছাড়া পায় পাক। তারা বরং উৎসাহী ছিলো তার কলকাতা জীবন নিয়ে তদন্ত করতে। সেখানে সবকিছু সহজলভ্য। তাছাড়া এই সুবাদে টালিউডটা একটু ঘুরে দেখার স্বাদ কে না নেয়। একালের ঊর্বশীরা সব ঘোরাফেরা করছে সেখানে রাত্রিদিন।
যদিও তাদের ধারণা ছিলো ভুল। তাদের যা কিছু চাহিদা, তার কোনটাই দুর্লভ নয় বাংলাদেশে। সে মদিরাই হোক বা ঊর্বশী অথবা হাউজির পারমিশন। সাথে ইয়াবা, ফেনসিডিল আরো কত কি। আইনে নিষিদ্ধ। তো কি হয়েছে। কিন্তু চোখের আড়ালও তো আছে। যা হোক, এসব কারণে তখন তার বর্মামুলুকে চাকরির পর্বটির ভালোমত তদন্ত হয়নি। এবার লোক পাঠাতেই হবে।
তদন্তের মূল বিষয় হচ্ছে ধীরাজবাবুর আবক্ষ মূর্তি স্থাপন কতটা যুক্তিযুক্ত। এবং এটা প্রমাণ করে কি না যে তিনি ভাল কাজ করেছেন, যা পরকালে পুরষ্কারযোগ্য কিন্তু প্রাথমিক বিচারের সময় যমরাজের দরবারে উপস্থাপিত হয় নি। কী কী ভাল কাজ তিনি সেখানে করেছেন সেগুলোর বর্ণনা উপস্থাপন করতে হবে এবং সেগুলোর ভাল-র মাত্রা নিরূপণ করতে হবে। একই সাথে পুণ:তদন্ত যেহেতু হচ্ছে, তিনি এমন কোন খারাপ কাজ করেছিলেন কি না যা প্রাথমিক বিচারের সময় যমরাজের দরবারে উপস্থাপিত হয় নি, তাও খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখানে ধীরাজবাবু কিি ত আপত্তি করেন। তিনি আবেদন জানান শুধুমাত্র জনস্বার্থ মামলায় উল্লেখিত বিষয়ে অনুসন্ধান করা হোক। তখন প্রসিকিউটর ডাউট দেন এই বলে যে, ‘আপনি শুধু সুবিধা লাভের জন্য হাইকোর্টে মামলাটি করিয়েছেন। সেখানে তো অন্যদিক আপনি তুলবেন না।’ কিন্তু পুণ:বির্চার হলে পুরষ্কার তিরষ্কার দুটোই পুন:বিবেচিত হবে। এইবার ধীরাজবাবু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলেন, “ধর্মাবতার, আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন মামলাটি আমি করাই নি। এমন কি আমার জ্ঞাতসারেও হয় নি। ওই আইনজীবীর নিয়মিত কাজই হচ্ছে হাইকোর্টে জনস্বার্থে রিট করা। আপনি তার করা অন্যান্য মামলার বিষয়ে অবগত হলে দেখবেন রিট তিনি এমনিই করেন। এবার অন্য ইস্যু না পেয়ে আমার মূর্তির প্রসঙ্গ এনেছে। এতে যমরাজের মূল্যবান সময় ব্যায় হচ্ছে বলে আমি দু:খিত। ধর্মাবতার ইচ্ছে করলে আমি আগের বিচার মেনে নিতে রাজি আছি।” যমরাজ তার কথায় খুশি হলেন। কিন্তু অভিনেতার মত গলা কাঁপিয়ে বলা তার ঠিক পছন্দ হলো না। এটা তো টালিগঞ্জ নয়; যমলোক। আর রিট যেহেতু হয়েছে, বিচার তো হবেই। রিটের মেরিট নেই বলতে গেলেও একটা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে রায় দিতে হয়। শর্টকাট নেই এখানে। যমরাজ কোর্ট মুলতুবি করলেন। কিন্তু আসন ছেড়ে উঠলেন না। চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলেন, একজন মানুষ শুধু শুধু রিট করে আদালতের সময় নষ্ট করে কেন? এমন কি কোন ইস্যু না থাকলে জোর করে ইস্যু বানিয়ে রিট করতে হবে? না কি এমন কিছু আছে যা তিনি ধরতে পারছেন না। যমরাজের হিসাব মেলে না।
যথারীতি তদন্তদল মর্ত্যলোকে এলো। ধীরাজবাবুর সাবেক কর্মস্থল টেকনাফে তখন হুলুস্থুল অবস্থা। এখান থেকে মানুষ পাচার করে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মুক্তিপন দাবী করা হচ্ছে। না পেলে মেরে মালয়েশিয়া আর থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবর দেয়া হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষের লাশ পাওয়া যাচ্ছে সেখানে। সাগরে খাদ্য পানীয় ছাড়া ভাসছে আরো কয়েক হাজার। তদন্তদলের নেতা সহকারীকে বললেন, “লেখো, ধীরাজের সময় অবস্থা এত খারাপ ছিলো না।” এখানকার পত্রপত্রিকায় ইয়াবা চালানের কথা পড়ে তিনি আবার বললেন, “লেখো, এইসব প্রাণঘাতি বস্তু তখন এখানে আসতে পারে নি।”
তদন্ত শেষ করবার আগে তদন্ত দলের দলনেতা ঠিক করেন, বিষয়টাকে জাস্টিফাই করতে তিনি ঐ সময়ে একইভাবে কলকাতা থেকে বর্তমান বাংলাদেশের ভ‚খন্ডে এসে কাজ করেছিলেন এবং পরবর্তীতে আবার কলকাতা ফিরে গিয়েছেন এমন দু’একজনের কীর্তির সাথে ধীরাজবাবুর তুলনা করবেন। যাতে তার মূর্তি স্থাপন কতটা স্বভাবিক তা প্রতিভাত হয়। তিনি গুগল সার্চ দিলেন। বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল। নেটের স্পিড যমলোকের মত না হলেও বেশ ভালো। ১৯২২-২৩ সালে ধীরাজবাবু টেকনাফ থানায় চাকরি করতে আসেন। ভাল হতো ঐ সময় ঐ একই বিভাগে কাজ করা কারো সাথে তুলনা করতে পারলে। তিনি সার্চ ক্রাইটেরিয়া চেঞ্জ করে বার বার চেষ্টা করতে লাগলেন। একেবারে সমান সমান কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। অগত্যা তিনি খুঁজতে থাকেন অন্যাণ্য ক্ষেত্রে যারা কাজ করছেন তাদেরকেও। কিন্তু সময়টা এক হতে হবে অর্থাৎ গত শতকের বিশের দশকের প্রথমার্ধ। এতে ঐতিহাসিক ট্রেন্ডটা বোঝা যাবে। আর কলকাতা থেকে এসে কিছুদিন চাকরি করে আবার কলকাতায় ফিরে যেতে হবে। শর্ত এগুলোই।
সার্চ করে একজনকে পাওয়া গেল। সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তিনি ১৯২১ সালে কলকাতা থেকে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতে শুরু করেন। পদের নাম রিডার অর্থাৎ গবেষক, পদার্থবিদ্যা বিভাগ। পরববর্তীতে অধ্যাপকও হয়েছিলেন। কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যায় তার অবদান পৃথিবী বিখ্যাত। এমন কি আইনস্টাইনের সাথে তার নাম জুড়ে আছে বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিটিকস-এর কারণে। বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তার নাম অনুসারে ‘বোসন’ কণার নামকরণ করা হয়। যাকে অনেকে ‘গড পার্টিকেল’ বা ‘ঈশ্বর কণা’ বলে থাকেন। পরর্তীতে এর সাথে আরেকজন বিজ্ঞানীর আবিষ্কার মিলে আবিষ্কৃত হয় ‘হিগস-বোসন’ কণা। ‘হিগস-বোসন’ কণা নিয়ে গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৩ সালে দু’জন বিজ্ঞানী নোবেল পুরষ্কারও পেয়েছেন। সত্যেনবাবুও ধীরাজবাবুর মতো পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। গত শতকের বিশের দশকের শুরুতে পূর্ববঙ্গে কাজ করতে আসেন। পরে আবার ফিরেও যান।
তদন্তদলের নেতা সহকারীকে ডাকলেন, “তোমার কী মনে হয়? দু’জনের অবদান তুলনা করা চলে তো? কাজের ক্ষেত্র এক নয়। তাই একবারে মিলবে না। কিন্তু তুলনা করার মত কাজ চলবে না?” সহকারী চেয়ে থাকে। বিজ্ঞানের একজনের নাম আইনস্টাইনের সাথে যুক্ত হলে পুলিশের অন্য জনের নাম তো অন্তত: স্যার রবার্ট পিলের নামের সাথে যুক্ত হওয়ার মত হতে হবে। তা না হলে সমান হবে কেমন করে? কিন্তু সহকারী হয়ে তো বসের বিবেচনা কে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় না। তিনি বলেন, “ অবশ্যই স্যার। কিছুটা ডেভিয়েশন তো থাকতেই পারে। কতদিনের পুরোনো কেস!” “তুমি ডাটা শীটে এন্ট্রি দাও। আমরা এ দু’জনের কীর্তির তুলনামূলক বিশ্লেষণ করবো।” দলনেতা বলেন।
তদন্ত দলটি ঢাকায় যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যেনের কী স্মৃতি আছে সেটা সরেজমিন তদন্ত করতে হবে। টেকনাফ থেকে ভাড়া গাড়ীতে কক্সবাজার। সেখান থেকে প্লেনে ঢাকা। কক্সবাজার আসার পথে চকরিয়ায় মাঠের মধ্যে লবনের ক্ষেত দেখে অবাক হয়ে যায় তারা। সাগরের জল পাম্প করে ক্ষেতের মধ্যে ঢুকানো হচ্ছে, সেই জল রোদে বাস্প হয়ে উড়ে যাবার পর থাকছে লবন। স্বর্গলোকে হাত পাতলে আঙুর পড়ে হাতে, দরকারে পাত পাতলে লবন সেখানে পড়ে। এভাবে লবন উৎপাদন করতে হয় না। একজন লবনের ক্ষেতে ছড়ানো লবনের স্তুপ করছিলেন। সহকারী ডাক দেন, “লবনের দাম কেমন?” উত্তর আসে, “কোন লবন? আমরা যেটা কিনি সেটার, নাকি আমরা যেটা বেঁচি সেটার?” এ আবার কেমন প্রশ্ন! দুটোর দামে কতটাই বা পার্থক্য হবে। ব্যাটা ধঁধাঁ দিচ্ছে যমলোকের তদন্তকারীদেরকে! বিরক্ত হয়ে সহকারী গাড়িতে ওঠেন।
এয়ারপোর্টে যেতে যেতে তার মনে তবু খচখচ করতে থাকে, এরা যে লবন উৎপাদন করে বস্তা ভরে বিক্রি করে আর সেই লবনই প্যাকেটে করে যখন এরা কেনে দুটোর দামের মধ্যে কি অনেক তফাৎ হতে পারে! হলে কতোটা হতে পারে।
প্লেন ঢাকায় নামার পরে ভালভাবেই তারা এয়ারপোর্টের বাইরে আসলেন। কিন্তু এয়ারপোর্ট রোডে উঠতে না উঠতেই পড়লেন মারাত্মক জ্যামে। প্রায় আধাঘন্টা এক জায়গায় বসে থাকার পর তারা দেখলেন রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে ভেঁপু বাজাতে বাজাতে কয়েকটা গাড়ী ছুটে গেল। হোমরা চোমরা কেউ হবে। তারপর থেকে তাদের গাড়ী একটু একটু করে এগোচ্ছে। প্রায় তিন ঘন্টা পরে তারা পৌঁছুলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সোজা চলে গেলেন কার্জন হলে। সত্যেনবাবুর সময়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগ কোথায় ছিলো তা উপস্থিত কেউই বলতে পারলেন না। তবে বর্তমানে কার্জন হলের পাশের সাদা বিল্ডিং-এ পদার্থবিদ্যা বিভাগ। এখন আবার ফলিত পদার্থবিদ্যা, শুধু পদার্থবিদ্যা অনেকগুলো বিভাগ হয়েছে। সময়ের চাহিদা।
আনন্দবাজার থেকে শাহবাগ, পলাশী থেকে কাঁটাবন, পুরো ক্যাম্পাসে ছাত্র শিক্ষক পথচারী মিলিয়ে জনা-পঁচিশেক লোককে জিজ্ঞাসা করেও নিশ্চিত হওয়া গেলো না তিনি এখানে শিক্ষকতা করেছিলেন কিনা; তার কোনো স্মৃতিচিহ্ন ক্যাম্পাসে আছে কিনা। কিছুদিন আগের কিছু সংবাদপত্র কাটিং বলছে, তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিয়ে একটা মিউজিয়াম করেছে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। খোঁজাখুঁজি করে একটা ঘরে কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা অবস্থায় পাওয়াও গেলো। কিন্তু টেকনাফ থানায় ধীরাজবাবুর আবক্ষমূর্তি ও মার্বেল পাথরে তার সম্পর্কে খোদাই করা বর্ননার মতো জৌলুস নেই সেখানে। জন্মদিনে তাতে পুষ্পস্তবক দিয়ে সাড়ম্বরে জন্মদিন পালন তো দূরে থাক। তদন্তকারীদল হতাশ হলেন। তাহলে কি রিটকারীর দাবী সঠিক, ধীরাজবাবুর অবদান অপরিসীম। যার তত্ব নিয়ে গবেষণা করে নোবেল পুরষ্কার পাচ্ছে মানুষ, তার চেয়ে বড় করে যার স্মৃতিকে উদযাপন করা হয়, তার তো পুরষ্কার পাওনাই আছে শেষ বিচারে।
সহকারী রিপোর্টের ড্রাফট করেছেন। তাতে আদ্যপান্ত বর্ণনা আছে। টেকনাফে ধীরাজবাবুর আবক্ষ মুর্তির যে উল্লেখ রিট আবেদনে করা হয়েছে, তা সত্য। তদন্তদল সেখানে পুষ্পস্তবক অর্পনের প্রমাণও পেয়েছে। তদন্তকারী দল যখন পরিদর্শনে গেছে তখনো শুকনো ফুল সেখানে ছিলো। আর সেখানে ধীরাজবাবুর কর্মময় জীবনের একটা ফিরিস্তিও দেয়া হয়েছে মার্বেল পাথরে খোদাই করে। সেখানে ধীরাজবাবুর প্রসংশাই করা হয়েছে। তার বিরহে মাথিনের মৃত্যুর প্রসঙ্গ থাকলেও সেখানে তার দিকে অভিযোগের কোনো তীর তাক করা হয়নি। এর বিপরীতে যাকে স্যাম্পল হিসেবে নেয়া হয়েছিলো, সেই সত্যেনবাবুর আবক্ষ মূর্তি দূরে থাক, নামও জানে না ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ আবাসিক। অথচ তিনি বিশ্বে পদার্থবিজ্ঞান গবেষণায় মৌলিক অবদান রেখেছেন। সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীর সাথে তার যৌথ থিয়রী আছে।
তুলনায় এটা প্রতীয়মান হয় যে, সত্যেনবাবু বড় বিজ্ঞানী হলেও সেই মানের অবদান রাখতে পারেন নি, যতটা করলে তার আবক্ষমূর্তি স্থাপন করা যেতো; তার কীর্তি মার্বেল পাথরেখোদাই করা যেতো; বছর বছর সেখানে সাড়ম্বরে পুষ্পস্তবক অর্পন করা হতো। ধীরাজবাবু নিশ্চয়ই অনেক বড় অবদান রেখেছেন। তাই তাকে প্রাপ্য সম্মান দেয়া হয়েছে আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করে এবং পুষ্পস্তবক অর্পন করে।
তদন্তকারী দলের নেতা রিপোর্টটি পড়লেন। তারপর চুপ হয়ে বসে থাকলেন। মিনিট দুই পরে সবুজ কালির কলম খুলে টাইপ করা রিপোর্টের শেষে নিজ হাতে লিখলেন, “আমাদের দেখা দরকার সত্যেনবাবুর কোন আবক্ষ মূর্তি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বা প্রাকুতিক দুর্যোগে অথবা অন্য কোন কারণে নষ্ট হয়েছে কিনা। অর্থাৎ অতীতে কথনো ছিলো কি না। আর ধীরাজবাবু আবক্ষ মূর্তি স্থাপনের মত ঠিক কী করেছেন তা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা দরকার। যা সময়াভাবে এই তদন্তে অন্তর্ভূক্ত করা যায় নি। তাছাড়া, তাদের দু’জনেরই জীবনের একটা অংশ যেহেতু ভারতে কেটেছে, সেখানে তাদের কাকে কীভাবে স্মরণ করা হচ্ছে, সেটাও আরেকবার দেখা দরকার। অতএব অধিকতর তদন্তের সুপারিশ করা হচ্ছে।”
তিনি খসখস করে সাইন করলেন রিপোর্টের শেষে।
#
(১৯৫৮ সালে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত প্রফুল্ল চক্রবর্তীর ছবি ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ এর গল্প থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে গল্পটির কিছু চরিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে।)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top