সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

বিষাদের ছোপ : ইশতিয়াক রূপু


প্রকাশিত:
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:১৬

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:৫০

 

নিউইয়র্ক নগরীর প্রথম সারির হোটেলে কাজ করছি বছর তিনেক যাবত। একমাত্র বোনের আবেদনে আইনসিদ্ধ অভিবাসী হয়ে নিউইয়র্কে এসেছি চার বছর পূর্বে। দুই বছর ছিলাম বোনের বাসায়। আমার দুলাভাইয়ের সামাজিক যোগাযোগ ভালো থাকায় নিউইয়র্ক আসার তিন মাসের মাথায় পেয়ে গেলাম ভালো হোটেলে ভালো বেতনের চাকুরি। একদিন বোনকে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'আপা আমি তোমাদের বাসায় থাকি, খাওয়া দাওয়া করি, কিছু দিতে হবে না?' উত্তরে বোন বলেন, 'লাগবে না। আমাদের খরছ তেমন নেই। এছাড়া আমি কাজ করি। এদিকে টেক্সি চালিয়ে তোর দুলাভাই ভালো আয় করেন। চলে যায়। তুই এ নিয়ে চিন্তা করিস না। তোকে কিছুই দিতে হবে না। আমি না থাকলে মেয়েটিকে দেখে রাখিস।' দেশ থেকে প্রেমিকার চাপ আসছে জোরেসোরে। পরিবার ছেলে দেখছে, বিয়ে দিয়ে দেবে। আপার কানে যেতেই দুলাভাইসহ দুজনে জোর করে দেশে পাঠালেন। কনের অলঙ্কার সহ দামী প্রসাধনী সঙ্গে আরো উপহার দিয়ে দুটো সুটকেস ভর্তি করে দিলেন। দুলাভাই ডলার ভর্তি খাম হাতে তুলে দিয়ে বললেন, 'পাঁচ হাজার আছে। বিয়ে করে নতুন বউকে নিয়ে হানিমুন করিও।পারলে ফেরত দিও। না পারলেও কোন অসুবিধা নেই।'

বিয়ের ঠিক দশ মাস পর আমার নতুন বউ সুমি নিউইয়র্কে এসে হাজির। ভালো কাজের সুবিধায় সহজে মিলে গেলো এক বেড রুমের এপ্যার্টম্যান্ট। বোনকে নিয়ে বউ সুন্দর করে সাজালো নতুন সংসার। বছর না যেতেই আমাদের পরিবারে এলো নতুন অতিথি একমাত্র ছেলে নিয়ন। ওর জন্য আপা-দুলাভাইয়ের আদরের শেষ নেই। ওর জন্মের পূর্ব থেকে সুমীকে আপা মায়ের আদরে দেখভাল করলেন ১০টি মাস। নিয়নের জন্মের এক ঘন্টা পর তোলা ছবিটি সুমি বড় করে বাঁধিয়ে রেখেছে বসার ঘরের দেয়ালে। শুক্র ও শনি আমার ছুটির দিন। করোনার তান্ডবের শুরু থেকেই লম্বা ছুটিতে বাসায় আছি। বসার ঘর থেকে শুনছি সুমি কথা বলছে আপার সঙ্গে। ফোনালাপ শেষ করে সুমি জানালো, 'আপার শরীরটা ভালো না। বেশ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে টান, যন্ত্রনা দিচ্ছে খুউব। যাবে নাকি আগামিকাল? চল একবার দেখে আসি।' নিয়নকে আপা দেখতে চাইছেন। রাতে দুলাভাই করলেন ফোন। শ্বাস নিতে অসুবিধা হওয়াতে আপাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। আরো পরিক্ষার জন্য রেখে দিয়েছে। সারারাত ঘুমাতে পারিনি।

দেশে আম্মাকে জানাতেই হাউ মাউ করে কেঁদে বলছেন, 'আমার মেয়েটা যে ভালো নেই, এটা আমি জানি বাবা। কয়দিন যাবত কি সব উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখছি।' বললাম টাকা পাঠাচ্ছি। একটি গরু সদকা দিয়ে দিও আপার ভালোর জন্য। আম্মা তখনো কাঁদছেন আর বলছেন, 'দিমু রে বাবা দিমু। আজই দিমু।' হাসপাতালে গেলেন রোববার। রাতেই হাসপাতাল থেকে জানালো আপা করোনায় আক্রান্ত। তবে বিপদজনক নয়। সোমবার বিকালে দুলাভাইয়ে সঙ্গে কথা বলেছেন। ভাগ্নি হাসপাতালে গিয়েছিল মায়ের খবর নিতে। সেও জানালো আপা আজ মোটামুটি ভালোই আছেন। দেশে মাকে জানালাম আপার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা। মা কোন জবাব দিলেন না। শুধু কান্নার আওয়াজই শুনলাম। মঙ্গলবার সন্ধায় হাসপাতাল থেকে ভাগ্নির নিকট এলো চরম বার্তা নিয়ে ফোন কল। সরি, তোমার মা আর রেসপন্স করছেন না। আমরা চেষ্টা করছি। সব শেষ।

বাসায় দুলাভাই আর ভাগ্নি একা। আমরা কেউই যেতে পারছিনা। হাসপাতাল থেকে পরদিন ফোনে একটি নাম্বার দিয়ে জানালো দাফনের জন্য ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। পরিচিত জুয়েল ভাই দাফনের দ্বায়িত্ব নিলেন। মারা যাবার দুদিন পর মঙ্গলবার জানালেন বেলা দুটায় ওয়াশিংটন মেমোরিয়াল পার্কে দাফন হবে। জানাজা থেকে শুরু করে পুরো দাফন কাজের দ্বায়িত্ব ফিউনারেল হোমের। স্বল্প কয়জন নিকট আত্মীয় ইচ্ছে করলে যেতে পারেন। মেমোরিয়াল পার্কে পৌঁছতে বেলা দুটো বেজে গেলো। দূরে দেখা গেলো কবরস্থানের ভিতরে রাস্তার পাশেই একটি বড় সয়েল ডিগার কবর খুঁড়তে ব্যস্ত। জুয়েল ভাইকে ফোন দিয়ে জানলাম ওখানেই যেতে হবে। ড্রাইভিং এ আমি। একটু জোরে চালিয়ে দাফনের জায়গায় পৌঁছানোর পূর্বেই থেমে গেলাম। দেখি সামনে রাস্তার উপর স্টান্ডের উপর রাখা দুটো কফিন। কোনটিতে আপার লাশ তা তো জানি না। আশে পাশে কেউ নেই যে জিজ্ঞেস করবো দুটো কফিনের কোনটিতে শুয়ে আছেন আপা।

বেশ দূরে কিছু মানুষের জটলা। আন্দাজ করলাম দুলাভাই ওখানে আছেন। বিশাল প্রান্তর জুড়ে ওয়াশিংটন মেমোরিয়াল পার্কের এই মুসলিম কবরস্তান। সকাল থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির শুরু। কখনো থামছে। এরপরআবার শুরু। গাড়িকে এক পাশে রেখে বৃষ্টির ছটা আর বেশ জোরে বয়ে যাওয়া বাতাসের মধ্যে নেমে পড়লাম রাস্তায়। এক পাশ দিয়ে হেটে আসছি। হঠাৎ চোখে পড়লো কফিনের সঙ্গে সুতা দিয়ে ঝুলানো পলিথিন মুড়ানো কাগজ বাতাসে দুলছে। ভাবলাম পাশে গিয়ে দূর থেকে নাম দেখে বের করবো কোনটি আপার কফিন। এরই মধ্যে বৃষ্টির ছটা বেড়েছে অনেকটা আর সেই সঙ্গে বাতাস। কফিন দুটোর সঙ্গে সুতা দিয়ে সাটানো কাগজ দুটো দুলছে ভীষণভাবে। কফিন থেকে মাত্র দুহাত দূরে দাড়িয়ে চোখে মুখে বৃষ্টির জল নিয়ে হাত বাড়িয়ে প্রথম কাগজটি উল্টে দেখা মাত্র আমার পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। তবুও লম্বাটে শক্ত কাগজে কালো কালি দিয়ে লেখা আপার নামটি স্পষ্ট পড়তে পারছি- নাশীদা চৌধুরী, ১১০ গ্রান্ড টেরেস, এস্টোরিয়া, নিউইয়র্ক।

 

ইশতিয়াক রূপু
কবি, গীতিকার ও গল্পকার

কুইন্স, নিউইয়র্ক, আমেরিকা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top