সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

ছট্ সূর্যদেবের পূজা, তবুও "ছট্ মাঈয়া" কেন বলে? : অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ


প্রকাশিত:
২৮ নভেম্বর ২০২০ ২১:০৬

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৪:২৫

ছবিঃ অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ

 

নবরাত্রী ও কালীপুজোর ঠিক পরেই আরেকটি অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ পুজো হল ছট। নেপালি, মৈথিলী ও ভোজপুরি ভাষা অনুযায়ী ছট কথাটির অর্থ হলো ষষ্ঠ। হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী কার্তিক মাসের ছয় তারিখ থেকে শুরু হয় ছট পুজো। উত্তর ভারতের একটি বিখ্যাত পুজো এটি। উত্তর প্রদেশের কিছু অংশ ছাড়াও, বিহার, ঝাড়খন্ড ও নেপালের মিথিলা অঞ্চলে এই পুজোর প্রচলন আছে। পরিবারের সদস্য, আত্মীয়, বন্ধু, ও অন্যান্য পরিজনদের মঙ্গল কামনায় পুণ্যার্থীরা এই পুজো করেন। প্রায় চারদিন ব্যাপী চলতে থাকে এই পুজো। বেশ কঠোর নিয়মের সঙ্গে এটি পালিত হয়। খাদ্য এবং জলস্পর্শ থেকে বিরত থাকেন উপোসীরা। এসময় সূর্যদেব ও তাঁর স্ত্রী ঊষার ( মতান্তরে ,  সূর্যের ভগিনী ) আরাধনা করা হয়। উপবাসের সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গার পবিত্র জলে স্নানের প্রথাও রয়েছে। এছাড়া মহিলারা স্নান সেরে কমলা রঙের সিঁদুর পরে থাকেন।

ছবিঃ ছট্ পুজো

ছট পুজোর উৎপত্তি নিয়ে স্পষ্ট ভাবে বা খুব বিশদে জানা যায়নি। একদল ঐতিহাসিক মনে করেন এর ইতিহাস লুকিয়ে আছে রামায়ণ ও মহাভারতের পাতায়। রামায়ণে কথিত আছে, রামচন্দ্র ছিলেন সূর্যদেবের বংশধর। চৌদ্দ বৎসর বনবাসে কাটিয়ে তিনি অযোধ্যায় ফেরেন। ফিরে এসে তিনি এবং সীতা দুজনেই সূর্য দেবের তপস্যায় উপবাস রাখেন। পরদিন ভোরে সেই উপবাস ভঙ্গ করেন। পরবর্তীতে এই রীতিই ছট পুজোর রূপ নেয়।

মহাভারতের বিশিষ্ট চরিত্র কর্ণ ছিলেন সূর্যদেব ও কুন্তীর পুত্র। বলা হয় কর্ণ একবুক জলে দাঁড়িয়ে সূর্য দেবের আরাধনা করতেন। প্রার্থনার শেষে তিনি গরীবদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করতেন। কালক্রমে এভাবেই ছট পুজোর প্রচলন হয়। 

বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব: কিছু বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই পুজো বেশ বিজ্ঞানসম্মত। দেহ থেকে ক্ষতিকর টক্সিন এর বহিস্কার করতে বেশ সাহায্য করে এই পূজোর প্রথা। সূর্যের সামনে উন্মুক্ত অবস্থায় জলে দাড়িয়ে থাকাকালীন দেহে সৌর তড়িৎ প্রবাহিত হয়। এটি মানব দেহের কর্ম ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আবার, একদল বৈজ্ঞানিক মনে করেন দেহ থেকে ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাস তাড়াতেও এটি সক্ষম। আসন্ন শীতের জন্য দেহকে তৈরী করে দেয় এই প্রথা। 

কিভাবে হয়? প্রথম দিন: এই দিন পুণ্যার্থীরা স্নানের আগে পর্যন্ত কোনো খাদ্য গ্রহণ করেন না। স্নানের পর সবাই মিলে বসে একসঙ্গে ছোলার ডাল,পায়েস, লাউয়ের তরকারি প্রভৃতি রান্না করে। একটা গোটা কলার কাঁদি উৎসর্গ করা হয় সূর্যদেবকে। দ্বিতীয় দিন: এই দিন খরনা পুজোর আগে অবধি উপবাস করা হয়। গুড়ের পায়েস ও পুরি দেবতাকে নিবেদন করা হয়। এরপর উপোসীরা নিয়মভঙ্গ করেন। তৃতীয় দিন:তৃতীয় দিন হল কঠোরতম দিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েরাই এই দিনটি পালন করে থাকেন। এই দিন খাদ্য ও জল ছাড়া উপবাস করতে হয়। সূর্য দেবের স্ত্রী ছঠি মাইয়া (ঊষা) কে উৎসর্গ করা হয় এই দিনটি। লোকসংগীতের সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গা, কোশী, কার্নালী, এই নদীগুলিতে চলতে থাকে পুণ্যস্নান। সূর্যাস্তের আগে পর্যন্ত স্নান চলতে থাকে। চতুর্থ দিন: এই দিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যদেবের কাছে প্রার্থনা সেরে অবশেষে এই ব্রতের সমাপ্তি হয়।

 

দীপাবলীর ৬ দিন পরে উত্তর ভারত বিশেষতঃ বিহার, ঝাড়খন্ড ও উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলে পালিত হয় ছট পূজা । কলকাতাতেও বিহার-উত্তরপ্রদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা ছট পূজা উদযাপন করেন । 

 

চারদিন ধরে হয় ছট পূজা। উপবাস রেখে এই পূজা করতে বেশ কষ্টসাধ্য কাজ । প্রচুর রীতি- আচার মেনে  এই ছট পূজা করতে হয় । যেমন--- সূর্যোদয়ের আগে স্নান সেরে ফেলা, সারাদিন নিরম্বু উপবাস থাকা এবং সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় ঠান্ডা জলে দাঁড়িয়ে থাকা। বিশেষ করে ছট পুজো শেষ দুই দিনে অত্যন্ত কঠোর রীতি আচার  পালন করতে হয় মহিলাদের । প্রতিবছর ছট পূজার নির্ঘন্ট স্থির করে নেপালের নিথিলা অঞ্চল এর জনকপুরধামের সেন্ট্রাল ডিভিশন। সেটাই সর্বত্র মান্য করা হয়। 

 

ছট পূজা প্রকৃতপক্ষে সূর্য দেবতার আরাধনা । গোটা বাড়ী  জল ও গোবর দিয়ে পরিষ্কার করে সূর্যোদয়ের আগে নদী বা পুকুরের স্নান করে চার দিন উপবাস রেখে সূর্য দেবতার আরাধনা শপথ নেওয়া হয়। ভোরবেলা নুন পেঁয়াজ রসুন ছাড়া ঘি দিয়ে রান্না করা খাবার খেয়ে বাকি দিন উপবাস রাখা হয় । সূর্যাস্তের পর শুধু মিষ্টি খাওয়া যায়। ছট পুজোর সময় সারাদিন শোওয়া যায়না। এমনকি শুনেছি, নিজের থুথু গিলতে পারা যায় না। 

 

 পুরান মতে, সৃষ্টির মূলে থাকে যে প্রকৃতি , তিনি নিজেকে ছয় ভাগে ভাগ করেছেন। উক্ত ভাগের ষষ্ঠ অংশেই পূজা হয় মাতৃরূপে। ঠিক এই তিথিতেই বেদমাতা গায়েত্রীর জন্ম হয় বলে মানা হয়। তিনি সমস্ত শিশুদের অসুখের হাত থেকে, মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করেন বলে বিশ্বাস। প্রিয়ব্রত নামক এক রাজার মৃত্যুমুখে পতিত সন্তানকে রক্ষা করেছিলেন এই গায়ত্রী দেবী। সেখান থেকেই পূজার উৎপত্তি বলে প্রচলিত বিশ্বাস । ছট পূজার উৎপত্তির ইতিহাস সুস্পষ্ট নয় । বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত আছে। 

 ভারতবর্ষে হিন্দিভাষী হিন্দুদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পূজা ছট পূজা। ছট অর্থাৎ ছটা বা রশ্মির পূজা। এই রশমি সূর্য থেকে পৃথিবীর বুকে আসে। সুতরাং এই পূজা প্রকৃতপক্ষে সূর্য দেবতার পূজা। এই পূজার সঙ্গে জড়িত আছেন স্বয়ং সূর্যদেব, আছেন মা গঙ্গা এবং দেবী অন্নপূর্ণা। 

 পৌরাণিক কাহিনী মতে - অনাবৃষ্টির ফলে যখন চাষীদের মাথায় হাত।  ফসলের মাঠ শস্যহীন। নিদারুণ খাদ্যাভাবের সংকট প্রকট। মা অন্নপূর্ণা ক্রমশঃ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকেন। তখন দেবলোকে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দেবতারা সম্মিলিতভাবে  সূর্যদেবের কাছে গেলে, তিনি দেবী অন্নপূর্ণাকে গঙ্গাদেবীর আশ্রয় নিতে পরামর্শ দেন। সূর্যদেব বলেন, কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে এবং সপ্তমীর উদয়কালে মা অন্নপূর্ণা গঙ্গাদেবীর আশ্রয় থেকে উদীয়মান ছটা বা রশ্মিকে দেখে তাঁর স্তব বা ১২টা নাম উচ্চারণ করলে সমস্ত পৃথিবী অন্নপূর্ণ হবে। 

পুরান, পৌরাণিক, লোকমত, বৈজ্ঞানিক সমস্ত ব্যাখ্যার মধ্যে সারতত্ত্ব যেটা আমরা পাই, তা হল- মানবসমাজের সমৃদ্ধি ও মৃত্যু অতিক্রম করার বার্তা। 

 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ছট পুজা যখন একান্তভাবেই সূর্য দেবতার পূজা  এবং সূর্যদেব একজন পুরুষ দেবতা। তখন "ছট মাঈয়া" বলা হয় কেন ? এখানে লুকিয়ে আছে, ভারতবর্ষের আদি অনন্ত ইতিহাস। যা বেদ এর থেকেও পুরানো। 

    

আর্যরা ভারতে প্রবেশ ও নিজেদের বিস্তার করার পূর্বে ভারতে যে অনার্য সভ্যতা ছিল, সেই সভ্যতা ছিল--- মাতৃতান্ত্রিক। সেই সময় বহু লৌকিক দেবতার পূজা অর্চনা হত।  সেখানে বেদজ্ঞ বা ব্রাহ্মণের স্থান একেবারেই নেই। ছট পূজা লৌকিক দেবতা পূজা। এবং অবশ্যই অনার্য সভ্যতার পূজা। অনার্য উৎসব এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে নারীদের প্রাধান্য। তাই লৌকিক পূজা হিসেবে ছট পূজায় মেয়েরাই সকল পূজা-অর্চনা করে থাকেন। তাঁরাই সর্বেসবা। এতে আরও একটি লক্ষণীয় বিষয়, বৈদিক দেবতা সূর্য দেবতা হলেও অনার্য দেবতা সূর্য কিন্তু স্ত্রী- দেবতা। পূর্ব ভারতের ছট পূজাতে  তাই দেখা যায়, সূর্যকে ছট পিতা নামের সম্বোধন না করে,  ছটমায়ী বা ছট মাঈয়া বলা হয়ে থাকে। ছট পূজায় ব্যবহৃত ইক্ষু, নারিকেল, মহালঙ্গ, বাতাবি লেবু, কলা ও তন্ডুল চূর্ণ প্রভৃতি ব্যবহৃত বস্তুগুলি দ্রাবিড় উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যা আর্যদের মধ্যে ছিল না। তাই আর্যদের  ভারতবর্ষে আগমনের বহু পূর্ব থেকেই  অনার্য লৌকিক পূজা হিসাবে ছট পুজোর প্রচলন ছিল বলে  বিশ্বাস করেন একাংশ।

মিথ, বিশ্বাস, ধর্মীয় আচরণ সব মিলেমিশে ছট পূজার বা ছটমাঈয়া র পূজায় সূর্যদেবের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি আমাদের মানবসমাজের জীবনে যেমন বিঘ্ননাশক, দুঃখনাশক, তেমনি সুখদায়ক ও অর্থ-বৈভবদায়ক।

 

অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ
হুগলী, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top