সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

পূর্বজন্মের স্মৃতি কেন থাকে না? : অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ


প্রকাশিত:
২১ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:২৬

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৪:৫৩

 

জাতিস্মরের কথা আমরা শুনে থাকি প্রায়শই । যার পূর্বজন্মের কথা মনে থাকে তাকেই জাতিস্মর বলে। অনেক সময় আমরা শুনে থাকি, বাচ্চা ছেলে গড় গড় করে বিভিন্ন দেশের নাম, সেই দেশের রাজধানী, কারেন্সি, রাষ্ট্রপতি, প্রধান মন্ত্রীদের নাম অনায়াসে বলে দিচ্ছে। আবার শুনি বাচ্চা মেয়েটি সুরেলা কন্ঠে অপূর্ব সংগীত পরিবেশন করছে । বা কোন বাচ্চা তার পূর্ব জন্মের ঠিকানা বলে দিচ্ছে  ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে কি এটা সম্ভব? এসব কি সত্যিই, নাকি নেহাতই গুজব! সংশয় আমাদের মনে লেগে থাকে। সেই সংশয় দূর করার জন্য শরণাপন্ন হলাম শ্রীশ্রীগীতার আশ্রয়ে ।

 

এ কথা আমরা অনেকেই জানি, দেহ যখন জীর্ণ হয় তখনই আমাদের মৃত্যু হয় এবং আবার আমরা নতুন দেহ ধারন করি। ঠিক যেমন আমরা জীর্ণ-বস্ত্র ত্যাগ করে নতুন বস্ত্র গ্রহণ করে থাকি। শ্রীশ্রীগীতায়  বলেছে ----

 

"বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহূতি নরোহপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী ।" (শ্লোক ২/২২)

 

আমাদের কর্ম অনুযায়ী জন্ম হয়। ভালো কর্ম করলেই ভালো জায়গায় জন্ম হয়; খারাপ কাজ করলে জন্ম হয় নিকৃষ্ট জায়গায়। অর্থাৎ আমরা বারবার মরছি এবং বারবার জন্মেছি। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং অর্জুনকে বলছেন -----

 

"জাতস্য হি ধ্রুব মৃত্যুরধ্রুবং জন্ম মৃত্যুস্য চ ।" (২/২৭)

যে জন্মায় তার মরণ নিশ্চিত আবার যে মরে তার জন্ম নিশ্চিত। জীবসকল জন্মের আগে অব্যক্ত থাকে, মৃত্যুর পরও অব্যক্ত থাকে । শুধু জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়ে ব্যক্ত থাকে ।

"অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত ।
অব্যক্তনিধনান্যেব "।             (২/২৮)

এখানেই আমার প্রশ্ন উঠে আসে, তাহলে আমরা সবাই পূর্ব জন্মের কথা স্মরণ রাখতে পারি না কেন? আমি পূর্বেও ছিলাম, ভবিষ্যতেও থাকব। আমার জন্ম হচ্ছে, মৃত্যু হচ্ছে, আবার পুনরায় জন্ম হচ্ছে। এক আবর্তকালের মধ্যে চক্রাকারে ঘূর্ণবৎ। সেক্ষেত্রে মনের মধ্যে তৈরি হয় সংশয় ! আর সেই সংশয় হল, আমরা পূর্ব জন্মের কথা কেন মনে করতে পারি না?
গীতায়  শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন -----

"বহূনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব অর্জুন ।
তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেথথ পরন্তপঃ ।" (৪/৫)

বিনাশশীল বস্তুর প্রতি আকর্ষণ থাকার জন্যই মানুষ তার পূর্বজন্ম জানতে পারেনা। আমরা মায়াজালে জড়িত এবং মোহান্ধ হয়ে ঘুরছি তাই পূর্ব জন্মের কথা স্মরণ করতে পারিনা।

সুতরাং আমাদের জীবনে শুভাশুভ যাই ঘটুক না কেন তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমাদের হাতে নেই। আমরা সকলে জন্মান্তরীণ কর্মফল ভোগ করে থাকি । যা অবশ্যম্ভাবী তাকে রোধ করার ক্ষমতা আমাদের কারোর নেই।

বিজ্ঞান বা মনস্তত্ত্ব শাস্ত্রে বলা হয়েছে, কোন জিনিসকে স্মৃতিতে ধরে রাখতে হলে বারবার তার অনুশীলন করতে হয়। মনের মধ্যে একান্তে সেটিকে নিয়ে ভাবতে হয়। বারবার অনুশীলন এবং রোমন্থনের ফলে তা স্মৃতিতে বিধৃত হয়ে থাকে। যিনি সঙ্গীত চর্চা করেন, তিনি যদি সারা জীবন সঙ্গীত নিয়ে অনুশীলন করেন তাহলে তার স্মৃতিতে সংগীতের মূর্ছনা অনুরণিত হতে থাকে। পড়াশুনার ক্ষেত্রে সেই একই তত্ত্ব প্রযোজ্য । তাই আমাদের মায়েরা ছোটবেলা থেকে আমাদের এই কথা বলতেন, বারবার পড়ো , আর সেটা লেখ । তাহলেই তোমার মনে থাকবে। একথা প্রত্যেক পাঠকের শৈশবের স্মৃতি। 

মননকর্তার মনন কখনো বিলুপ্ত হয় না। কারণ ইহা অবিনাশী।  গীতায় বলা আছে ------

" শরীরং যদবাপ্নোতি যচ্চাপুৎক্রামতীশ্বরঃ 
গৃহীত্বৈতানি সংযাতি বায়ুর্গন্ধানিবাশয়াৎ ।  (১৫/৮)

  অর্থাৎ বায়ু যেমন পুষ্পাদি থেকে গন্ধ আহরণ করে নিয়ে যায়, তেমনি জীবাত্মাও শরীর ত্যাগ করে যাওয়ার সময় মনসহ ইন্দ্রিয়গুলিকে সঙ্গে নিয়ে যায়। তাহলে জানতে পারছি, আমরা যদি স্মৃতিবাহী চেতনাকে নিয়ে নতুন দেহ ধারণ করতে পারি, সেক্ষেত্রে আমরা জাতিস্মর হতে পারব। 

এ বিষয়ে শ্রীশ্রী গীতায় স্বয়ং ভগবান বলেছেন ----

" যং যং স্মরণ ভাবং ত্যজত্যন্তে কলেররম্ ।
তং তমৈবেতি কৌন্তেয় সদা তদ্ভাবভাবিতঃ ।। (৮/৬)

স্বয়ং ভগবান বলছেন,  " হে কৌন্তেয়, মানুষ মৃত্যু কালে যে যে ভাবে স্মরণ করতে করতে দেহত্যাগ করে সেই সেই ভাবেই সে প্রাপ্ত হয়; কারন সে সর্বদা সেইভাবেই ভাবিত। কিন্তু একদিনে এটা করা সম্ভব নয়। সারাজীবন ধরে ইষ্টের প্রতি মনপ্রাণ ঢেলে দিলে তবেই মৃত্যুকালে তাঁকে স্মরণ করা যায় । তা নাহলে মৃত্যুকালে ঈশ্বরচিন্তা মনে উদিত হয় না। জাতিস্মরতা অমরত্ব লাভের একটি ধাপ বলা যায়। বহু জন্ম ধরে চেষ্টার ফলেই এটা অর্জিত হয়। তাই আমরা দেখি মনীষী ও মহাপুরুষেরা ইহজন্মে শিখতে আসেন না। আগে যা শিখে এসেছেন তা উদগীরণ করে মানুষকে শিক্ষা দিয়ে যান।

            

বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে-----  আত্মা দেহ থেকে বের হলে প্রাণ তার অনুগমন করে। প্রাণ অনুগমন করলে অন্য সকল ইন্দ্রিয় তার অনুগমন করে। তখন আত্মা বিজ্ঞানময় হয় এবং প্রাণ এই বিজ্ঞানময় পুরুষের অনুগমন করে। বিদ্যা-কর্ম-জ্ঞান এবং পূর্ব সংস্কার তার অনুগমন করে ।

 

"সর্বে প্রাণা অন্যুৎক্রামন্তি সবিজ্ঞানো ভবতি সবিজ্ঞানমেবান্ধব
ক্রামতি তং বিদ্যাকর্মশী সমন্বারভেতে পূর্বপ্রজ্ঞা চ।" (৪/২৮৯)

 

অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ
লেখক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top