সংসার : ডঃ গৌতম সরকার
প্রকাশিত:
৪ জানুয়ারী ২০২১ ২২:৩৮
আপডেট:
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৭:২৫
“আচ্ছা, একজন নারী একজন পুরুষ পাশাপাশি বসে কতযুগ ধরে কথা বললে পরস্পরের বন্ধু হতে পারে?”
পুরুষটির প্রশ্নে নারীটির সারা মুখে হাঁসি খেলে গেল৷
“সেটা পুরুষটি কে আর নারীটিই বা কোনজন তার ওর নিভর্র করবে, মশাই !”
“তার মানে ?”
“মানেটা তাই ! দেখুন, দুটি শিশুর ক্ষেত্রে সময়টি কয়েক মূহুর্ত; কিশোর-কিশোরীর ক্ষেত্রে পরষ্পরের লজ্জা ভাঙাতে যতটুকু সময় লাগে ; তবে যুবক-যুবতীর ক্ষেত্রে সময় একটু বেশি লাগে, তারা কিছুটা সময় নেয় পরষ্পরকে মেপে নিতে; আর বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ক্ষেত্রে………”
স্বরক্ষেপে অভিমান মিশিয়ে পুরুষটি বলে ওঠে, থাক, “থাক, বলতে হবেনা৷”
নারীটি পুরুষটির দিকে আরেকটু সরে বসে মূদু স্বরে জিজ্ঞাসা করে , “কি হয়েছে? বাড়িতে আবার সমস্যা!”
ঘটনাকাল ২০২০ সাল, আগস্ট মাস, সময়-অপরাহ্ন, স্হান-একটি প্রকৃতি উদ্যান, বৃহত্তর কলকাতা৷
“রাগ করলেন?”
পুরুষটি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো , “না”
“তবে যে আপনার রগের শিরাগুলো তিরতির করে কাঁপছে, আর মুখটাও কেমন আস্তে আস্তে লাল হয়ে উঠছে !”
পুরুষটি রাগতে গিয়েও হেঁসে ফেললো৷
“আপনি না !”
“কি আমি !”
“একটা ইমপসিবল !”
“তাই সই, কি হয়েছে বলুন ?”
“নতুন কি আর হবে, সেই একই…….”
দুজনের মধ্যে কিছু শীতল সময় বয়ে যায়৷
“সকাল থেকে নাতনিটা ‘দাদু যাবো দাদু যাবো’ বলে কেঁদেছে, ওর মা কিছুতেই আসতে দিল না৷”
“শিক্ষিত মানুষ যখন অবুঝের মতো আচরণ করে তখন সমস্যা শতগুনে বেড়ে যায়৷”
“আরে ওরা কি এই মহামারীর ভয় দেখিয়ে বাড়িতে আটকে রেখে আমাকে মেরে ফেলতে চায় ! দুমাস ঘরে আটকে পড়ে আমি স্বাভাবিক ভাবে নিঃশ্বাস পর্যন্ত নিতে পারিনি৷”
“সত্যি তাই, আমাদের মতো বুড়োবুড়িদের বহু ব্যবহারে জীর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো একটু বিশুদ্ধ অক্সিজেন না পেলে……”
“আরে আমি তো সবরকম সতর্কতা মেনেই বাইরে বেরোচ্ছি ! ওর বাবাও তো সপ্তাহে তিনদিন অফিস করে, সেক্ষেত্রে তো মেয়ে বাবার মেলামেশাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছেনা !”
কথাকটি শেষ করতে পুরুষটির গলা ধরে এলো৷ মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো, হয়তো চোখের জল লুকালো৷
দুজনে চুপচাপ পাশাপাশি বসে রইলো৷ শেষ বিকেলের রোদ কৃষ্ণচূড়া গাছের মাথায়৷ একটু পরেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নামবে৷ বেশ কিছুক্ষন পর পুরুষটি গাঢ় স্বরে বলে ওঠে,
“আমরা দুজনে যদি পরস্পরের বন্ধু হই ক্ষতি কি ? দুজনেই তো নিজের নিজের সংসারে বাড়তি হয়ে পড়ে আছি৷ এখন বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে আমরা পরস্পরের কাছে যদি নির্ভরতা খুঁজি তাতে দোষের কি আছে !”
নারীটি চুপ করে থাকে৷ দূরে একটা শঙ্খচিল রাধাচূড়া গাছের মাথায় পাক খেয়েই চলেছে৷ পাখিটা কি রাধাচূড়া গাছের কাছে তার কোনো ডালে বসার জন্য কাতর প্রার্থনা জানাচ্ছে !
নারীটি উত্তর দেয়, “না দোষের কিছু নেই, তবে যেটা স্বাভাবিক নয় সেটা সঠিক কোনো
কারণেই স্বাভাবিক নয়৷”
“কি স্বাভাবিক নয় ? পুরুষটি উত্তেজি হয়ে ওঠে৷”
“একটি প্রবীণ আর প্রবীণার মধ্যে বন্ধুত্ব৷”
“কেন নয়?”
“কারণ তারা পরস্পরের শীতলতা বাড়িয়ে তুলবে৷”
“আপনার এসব মনগড়া কথা, ভি্ত্তিহীন৷”
“আপনি কোনোদিন কোনো বৃদ্ধাশ্রমে গেছেন ? একটা বাড়িতে কত মানুষজন ! কিন্তু কি ভীষন শান্ত, শব্দহীন, নিরালা, নির্জন !”
“ওসব পুরনো ধারনা, এখনকার বৃদ্ধাশ্রমে প্রচুর অ্যাক্টিভিটিস৷”
“হ্যাঁ, তার জন্যে নিরন্তর বাইরে থেকে উত্তাপ সরবরাহ করতে হয়, মশাই৷ আবাসিকদের শৈত্য অতিক্রম করার জন্যে কৃত্রিমভাবে উত্তাপ ইনজেক্ট করতে হয় !”
অবাক চোখে পুরুষটি নারীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে৷
“শুনুন একটি শিশুর কলকাকলি না থাকলে কোনো ঘর ঘর হয়ে ওঠেনা৷ আবার স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, কথাকাটাকাটি, প্রেম ঘরটাকে প্রাণ দেয়, আর আমাদের মতো বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সেই ঘরটার কাঠামো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি৷”
“কিন্তু আমরাও তো দুজনে দুজনার বন্ধু ! কাতর কন্ঠে পুরুষটি বলে ওঠে৷”
“যে বাড়িতে আপনার নাতনির আধো আধো কথা শুনতে পাবেন না, দাদু যাবো দাদু যাবো বলে কান্নার শব্দ থাকবেনা, মায়ের মারের ভয়ে আমার নাতি দৌড়ে এসে আমার দু-হাঁটুর মাঝে মুখ লুকোবেনা, সেই বাড়িকে আপনার নিজের বাড়ি বলে মনে হবে !”
কোনো উত্তর না দিয়ে পুরুষটি মাথা নিচু করে বসে থাকে৷
“আমরা দুজনে নতুন করে ঘর বাধঁলে সেই ঘরে শুধু শৈত্যপ্রবাহই খেলে যাবে৷ বাঁচার জন্যে উষ্ণতা কিন্তু খুব জরুরি !”
বাচ্চাছেলেকে বোঝানোর মতো করে গভীর দুচোখে তাকিয়ে পুরুষটির হাতে হাত রাখে নারীটি৷ আচমকা ঠান্ডা ছোঁয়ায় পুরুষটি চকিতে হাত সরিয়ে নেয়৷ তারপর লজ্জা পেয়ে আবার হাতটা হাতের ওপর রাখে৷ পুরুষটি এবার আবেগহীন গলায় বলে, “আর আমাদের বন্ধুত্ব!”
“এই তো এই পার্ক, সিমেন্টের বেঞ্চ, বিকেলের হলুদ রঙা রোদ, কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া গাছ, আর মাথার ওপর উড়তে থাকা ওই শঙ্খচিল সাক্ষী থাকবে আমাদের অটুট বন্ধুত্বের৷”
নারীটির অজান্তে পুরুষটির এক দীর্ঘশ্বাস শেষ বিকেলের ঝিরঝরে হাওয়ায় মিশে যায়৷
ডঃ গৌতম সরকার
লেখক, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত
বিষয়: গৌতম সরকার
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: