সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

যেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই (রম্য রচনা) : রহমান তৌহিদ


প্রকাশিত:
১৯ এপ্রিল ২০২১ ২২:১৫

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:২৪

 

বোবার শত্রু নেই - প্রবচণটার বিপক্ষে অনেক যুক্তি আছে জানি। আপনারা আমার বাল্য বন্ধু মোবারকের মত এ ব্যাপারে হাজারটা যুক্তি দেখাতে পারবেন, তাও জানি। তারপরও বলি বাংলা প্রবচণের জগতে উজ্জ্বল নক্ষত্র এটা। তবে আফসোস, এটা বুঝতে বাঙালি পুরুষ বয়স হাফ সেঞ্চুরি পার করে দেয়। আর হাফ সেঞ্চুরি পার করার আগে যারা বোঝে, তাদের হৃদরোগের ঝুকি বেড়ে যায়। বুঝলেন না তো?

বুঝিয়ে বলি। প্রশ্নের উত্তর জানা সত্ত্বেও আপনি চুপ করে থাকলে আপনার রাগ বাড়বে আর তাতে রক্তচাপ বেড়ে যাবে। এটা চল্লিশ বছর থেকে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে হলে হৃদরোগের সম্ভাবনা বাড়বে। আর আপনি যদি চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ পর্যন্ত উড়াধুড়া উত্তর দিয়ে যেতে পারেন, সমানে চার ছক্কা পিটিয়ে যেতে পারেন, তবে আশেপাশের মানুষ আপনাকে আর ঘাটাবে না। এরপর আপনি উত্তর জানা সত্ত্বেও চুপ থাকুন। আপনি ততদিনে বুঝে গেছেন, বোবার শত্রু নেই । আপনার মতামতে বিশ্ব সংসারের কিছু আসে যায় না।

ভনিতা বাদ দিয়ে গল্পে আসি।

শীতের ভোরে সিগারেট ছাড়াই মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আমাদের বাল্যবন্ধু বদরুল বই খাতা নিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে যাচ্ছে অংক স্যারের বাড়ির দিকে। ব্যাচে প্রাইভেট পড়তে। পথে মোকলেস চাচার সাথে দেখা। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে, তারপর চাচার পথ রোধ।

: ভাতিজা, কই যাও?

: অসিত স্যারের বাড়ি। অংক শিখতে।

: ভাল, ভাল। অসিত তো ছোটকালে গবেট ছিল। সে হইছে অংক মাস্টার। কলিকাল। যাও, যাও। মন দিয়ে পড়াশুনা কর। তো তোমার বাপ ভাল তো?

: ভাল, ভাল

দ্রুত  পা চালায় বদরুল।

প্রতিদিনই দেখা মোকলেস চাচার সাথে। হয় দশ কদম আগে, না হয় বিশ কদম পিছনে। বদরুলের না হয় ব্যাচে পড়া। মোকলেস চাচার কি? প্রাতঃভ্রমণ? ভেবে কূল পায় না বদরুল।

আর মজার ব্যাপার হল, প্রতিদিনই একই প্রশ্ন, কই যাও?

মানুষের মেজাজ বলে কথা। তার উপর মানুষটা হল আমাদের বদরুল। একদিন -

: ভাতিজা, কই যাও?

প্রশ্নে উত্তরে বলেই ফেলল:

: চাচা, সাজ সকালে বই খাতা নিয়ে ফুটবল খেলতে যাচ্ছি স্কুলের মাঠে। আর কিছু বলবেন?

মানুষ তখন তিলকে তাল করতে পছন্দ করতো। এর জের বহুদূর গড়িয়েছিল। বদরুলে বেয়াদবির গল্প কিংবদন্তী রুপ নিয়েছিল। আর এতদিন পরও এ গল্প লেখা দেখে পাঠক তার সত্যতা প্রমান পেলেন।

এবার মোবারকের গল্প। বদরুল একটু চুপচাপ হয়ে যাওয়াতে মোবারক শুরু করলো বকবক। বন্ধু মহলে সব কথাতেই তাকে একটা মন্তব্য করতেই হবে। এমনকি সে আর্টসের ছাত্র হয়েও সাইন্সের টার্মের ব্যাপারে না বুঝে মন্তব্য করতে দেখে পঙ্কজ বলল,

: এখন থেকে তুই শুধু হ্যাঁ আর না দিয়ে উত্তর দিতে চেষ্টা কর।

: তা হয় না, সব কিছুর উত্তর হ্যাঁ না দিয়ে দেওয়া যায় না।

মোবারকের দার্শনিকসূলভ মন্তব্য।

: যেমন?

: যেমন ধর, কেউ যদি তোকে প্রশ্ন করে, তুমি কি আগের মতই বাটপারি করো, তাহলে কি উত্তর দিবি?

যাহোক, বাল্যকাল ছেড়ে পরিণত বয়সে এসে দেখলাম, কথা বলা যেমন দরকার, আবার সময় মতো চুপ থাকাটাও তেমন দরকার।

এমন কিছু প্রশ্ন করা হয়, যার উত্তর প্রশ্ন কর্তার জানা। কিন্তু তারপরও তিনি প্রশ্ন করেন। তিনি হয়ত নিজকে ইন্টারভিউ বোর্ডের সভাপতি মনে করেন। যেমন মনে করেছিলেন আমাদের মোকলেস চাচা। তিনি প্রতিদিনই একই প্রশ্ন বদরুলকে করবেন আর বদরুল একই উত্তর দেবে। যেদিন রেগে উল্টাপাল্টা উত্তর দেবে, সেদিন থেকে বদরুল বেয়াদব। বদরুলের বেয়াদবীটা মানুষ দেখলো কিন্তু মোকলেস চাচার উত্যক্ত করাটা কারো চোখে পড়লো না।

সংসারে এটাকেই মানুষ সহজভাবে নিয়েছে। তারা বলে, মোকলেস চাচা একটু আলাপ করতে চেয়েছিল, তুমি কেন বাপু বেয়াদবি করবে। একই প্রশ্নের উত্তর তুমি জীবনে কতবার দিয়েছো? দেয় নাই? ক্ষমতাবান লোক তোমাকে একই প্রশ্ন কতবার করেছে, তুমি হাত কচলিয়ে একই উত্তর দিয়েছো। শুধু মোকলেস চাচা হোপলেস বলে দোষ?

এবারের গল্পটা আদ্যিকালে।

ইন্টারভিউ বোর্ডে জাদরেল সভাপতি একের পর এক জটিল প্রশ্ন করে যাচ্ছে আর প্রার্থী শুধু বলে যাচ্ছে, আমি জানি না, স্যার।

একসময় সভাপতি রেগে গিয়ে বললেন, এসব সহজ প্রশ্নে উত্তর না জেনে কেন তুমি ভাইভা বোর্ডে এসেছো?

এবার প্রার্থী ভাবলো হারানোর তো কিছু নেই, চাকরি তো হবেই না, দেখি একটু অপমানের জ্বালাটা কমাতে পারি কিনা। বলে বসল,

স্যার, আপনার কথা ঠিক আছে। তবে, পৃথিবীতে অনেক প্রশ্ন আছে যার উত্তর আপনি জানেন কিন্তু আমি জানি না। আবার এমনও প্রশ্ন আছে যার উত্তর আমি জানি কিন্তু আপনি জানেন না।

এবার তো সভাপতি মহোদয়ের আক্কেল গুডুম। বোর্ডে সদস্যরা মুখ টিপে হাসে। ব্যাটা জায়গামতো পড়েছে।

: তুমি জানো অথচ আমি জানি না? ঠিক আছে, এমন একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেই ফেল।

: স্যার, বলেন তো আমার পিতামহের নাম কি?

সভাপতি মহোদয় হন্তদন্ত হয়ে প্রার্থীর আবেদনপত্র ঘাটাঘাটি শুরু করলেন।

প্রার্থী খুব নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল, স্যার ওখানে আমার পিতার নাম পাবেন, পিতামহের নাম নেই। আর আমার পিতামহ এমন বিখ্যাত কেউ নয় যে, আপনাকে তার নাম জানতে হবে।

এই ইন্টারভিউ শেষে প্রার্থীর নাকি চাকরি হয়েছিল। নাকি বললাম এই কারণে যে, যার কাছে এই গল্প শুনেছিলাম, তিনি এমনটাই বলেছিলেন। এ গল্প আমি অনেককে বলেছি। চাকরি হওয়ার কথাটা অনেকে বিশ্বাস  করেছেন, অনেকে করেন নি। তবে, আমাদের বদরুলের মন্তব্যটা আমার মনে আছে, যে পাগলের পাগল হতেও পারে।

যাহোক, আদ্যিকালের গল্প ছেড়ে একালে আসি।

প্রতিনিয়ত আপনাকে প্রশ্ন শুনতে হয় আর তার উত্তর দিতে হয়।

কে আপনি, কোথায় যাবেন, কার কাছে যাবেন ?

বাবারে, বন্ধুর অফিসে একটু আড্ডা মারতে যাবেন , তাও কত প্রশ্ন।

দেশের মধ্যে এক এয়ারপোর্ট থেকে অন্য এয়ারপোর্টে যাবেন, তাও সিকিউরিটি চেক তো আছেই, তারপরও চাইবে ফটো আইডি। দিতে আপত্তি নেই, কিন্তু তারা পারে নীরিহ ভদ্রলোকের সাথে। যাদের  বিনা চেকে পার হওয়ার দরকার তারা দিব্যি পার হয়ে যাচ্ছে।

এক ভদ্রলোকের  একটা ক্রেডিট কার্ড আছে। মাঝে মধ্যে তাকে  কল সেন্টারে কথা বলতে হয়। রেজিস্ট্রার্ড মোবাইল নম্বর থেকে ফোন করেন । তিনি লক্ষ্য করেছেন প্রতিবারেই  যান্ত্রিক গলায় তাকে জিজ্ঞাসা করে :

অমুক স্যার বলছেন?

ভবিষ্যতে সংরক্ষণের জন্য আপনি কলটি রেকর্ড করা হচ্ছে। কিছু তথ্য দিয়ে সহায়তা করুন।

আপনার কার্ডের ক্রেডিট লিমিট কত?

আপনার মায়ের নাম কি?

ভদ্রলোক নির্লিপ্ত কন্ঠে প্রশ্নগুলোর জবাব দেন। শুনতে শুনতে মুখস্ত হয়ে গেছে।

তো, একদিন ভদ্রলোকের খুব তাড়া। তিনি কল সেন্টারে ফোন করে কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধির গলা শুনেই বললেন, আমি অমুক, কার্ডের ক্রেডিট লিমিট অত আর আমার মায়ের নাম অমুক।

: স্যার, আপনাকে তো আমি কোন প্রশ্ন করি নি।

: অভিজ্ঞতা বলে, প্রশ্নগুলো আপনি করবেন, তাই সময় নষ্ট করলাম না। আর কোন প্রশ্ন থাকলে করুন।

প্রশ্ন করার প্রয়োজন আছে, আপনার নিরাপত্তার জন্যই আছে। কিন্তু সেটা স্টেরিও টাইপ হলে এধরণের ঘটনা ঘটতেই পারে।

একসময় মানুষের মুঠোর মধ্যে ফোন ছিল না। সেটা থাকতো টেবিলে। তাও সবার টেবিলে নয়। আর ছিল পিএবিএক্স। তাও অটোমেটিক নয়, অপারেটরের মাধ্যমে লাইন পেতে হতো।

তো, ব্যবসায়িক প্রয়োজনে আমাদের বদরুলকে প্রায়ই সাব্বির সাহেবকে ফোন করতে হতো। আর যতবারই বদরুল ফোন করে সাহেবকে লাইন দিতে বলে, ততবারই নারীকন্ঠের অপারেটর বলে, একটু ধরবেন। বদরুল ঐ অপারেটরের  কন্ঠস্বর শুনে এতই মোহিত হল যে, এ গল্প বন্ধুমহলে প্রচারিত হয়ে গেল।

তখন বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করলো, যখন টেলিফোন অপারেটর বলে, একটু ধরবেন, তখন তোর কি বলতে ইচ্ছে করে?

বলতে তো ইচ্ছে করে, ধরতে তো চাই, কিন্তু এত দূরে কিভাবে ধরি।

বদরুলের জবাব শুনে বন্ধুমহল একবাক্যে রায় দিল, বদরুলের সাব্বির সাহেবের অফিসে যাওয়া উচিৎ।

বদরুল গিয়েছিল। এবং গল্প উপন্যাসে যা ঘটে তার উল্টোটাই হয়েছিল। হতাশ হয়ে ফিরেছিল।

তখন থেকে বদরুলের বন্ধুরা শিখল, সব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই। সব প্রশ্ন উত্তরের আশায় করা হয় না। এটাকে বলে প্রশ্নের জন্য প্রশ্ন করা।

নমুনা দিয়ে শেষ করি:

আপনি ভাল আছেন ?

রাতে ভাল ঘুম হয়েছিল?

পথে কোন কষ্ট হয়নি তো?

ঠিকানা চিনতে সমস্যা হয়নি তো?

বাড়ির সবাই ভাল?

লেখাটা কেমন লাগলো?

 

রহমান তৌহিদ
রম্য লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top