সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

ভালবাসার গল্প : শাহানারা পারভীন


প্রকাশিত:
২৪ এপ্রিল ২০২১ ২১:৫৬

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:৩১

 

বেলকুনিতে বসে চা খেতে খেতে ওদের দুজনকে দেখি।
নতুন ভাড়াটে ।আমার সামনের বাসাতেই আসছে ওরা। বেশ নতুন দম্পত্তি মনে হলো। দুজনের উচ্ছলতা দেখে খুব ভাললাগে।
চোখাচোখি হলেই লজ্জা পায় মেয়েটি। মেয়েটা সারাদিন একাই থাকে। ছেলেটা অফিস থেকে ফিরলেই যেন ওদের ঘরে প্রান জেগে ওঠে। দুজন মিলে বারান্দার গাছগুলোতে পানি দেয়। চা নিয়ে বেলকুনিতে বসে চলে দুজনের খুনসুটি। আমাকে দেখলেই চমৎকার একটা হাসি দেয় দুজনে খুব ভাল লাগে তখন।
আলাপ পরিচয় তখনও হয়নি। একদিন বিকেলে মেয়েটিকে দেখলাম একা একা দাড়িয়ে আছে। একটু বিষন্ন মনে হলো।
'মহুয়া কেমন আছ?'
অপরিচিতের মুখে নাম শুনে বললো 'আপনি আমার নামও জানেন!'
বললাম, 'নামটা খুব সুন্দর। এখানে দাড়িয়েই শুনেছি। তোমাকে আজ একা দেখছি যে  মাহিন বুঝি এখনও ফেরেনি?'
মেয়েটার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক খেলে গেল আমার মুখে ওর নাম শুনে।

‘তোমাদেরকে আমার খুব ভালো লাগে। তাইতো মাঝে মাঝেই চোখ চলে যায় ওদিকে। নতুন সংসার বুঝি?’
বললো, ‘খুব নতুন না। দু বছর হতে চললো’।
আমি তো ভাবলাম তোমাদের বুঝি নতুন সংসার।
তোমার সাথে আলাপ করার খুব ইচ্ছে ছিল আমার। প্রতিদিন ভাবি তোমাকে ডাক দিয়ে তোমার সাথে পরিচিত হয়। কিন্তু তোমাকে যখনই একা দেখি। তখন তোমাকে কেমন বিষন্ন লাগে। কি যেন ভাবো সবসময়। তাই আর বিরক্ত করতে ইচ্ছে হয় না। একদিন চলে আস আমার বাসায়। একাই তো থাকো সবসময়। তোমার সাথে অনেক গল্প করা যাবে। বেল বাজতেই মেয়েটা দৌড়ে চলে গেল।
পরদিন বারান্দায় যেতেই মেয়েটি আমাকে ডেকে বললো 'কেমন আছেন? কাল কথা বলাই তো হলো না। ও চলে আসলো। আজ অনেক গল্প করা যাবে। ওর ফিরতে একটু দেরি হবে বলেছে। জানেন আমি আপনার কথা বলেছি। খুব খুশি হয়েছে ও। আমার নিঃসঙ্গতা কাটবে আপনার সাথে কথা বলে। তাহলে আর আমার মন খারাপ হবে না।
আমার মন ভাল করার কত চেষ্টায় না ও করে। জানেন আমাকে ও ভীষন ভালবাসে।
বলেই লজ্জা পেয়ে গেল। কিছু মনে করবেন না। এমনিই বলে ফেললাম।
আমি হেসে বললাম, তোমাদের দুজনকে দেখেই সেটা বুঝতে পারি। কিন্তু তুমি যেন সবসময় আনমনে কি চিন্তা কর! যদি কিছু মনে না কর। তোমার বিষন্নতার কষ্টের কথা কি আমায় বলবে ?
কিছুক্ষণ নিরব কাটে আমাদের। ওর চোখদুটো ছলছলে।
দুঃখিত! তোমায় কষ্ট দিয়ে ফেললাম হয়তো।ঠিক আছে তোমায় বলতে হবে না।
মেয়েটা ওর একহাতের ওড়নাটা একটু সরিয়ে দেয়। বিস্মিত আমি। ওর একটা হাত নেই।
মেয়েটির চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝড়তে থাকে।
কিছু বলতে যাবে। ঘরের বেলটা বেজে উঠতেই মহুয়া চোখের পানি মুছে ফেলে বলে, এখন যাই। ও চলে এসেছে।
রুমে চলে আসলাম। কিন্তু নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে। কেন যে মহুয়াকে জিজ্ঞেস করতে গেলাম। উচ্ছল মেয়েটির কথা বারবার মনে হতে লাগলো আমার।
পরদিন বিকেলে আমি চলে গেলাম মহুয়াদের বাসায়। দরজা খুলে আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো। খুব খুশি হয়েছে আমাকে দেখে।
ছিমছাম সাজানো সংসার।
ছোটটো দু রুমের বাসাটাতে যত্ন আর ভালবাসার ছাপ।
দুজন দুকাপ চা নিয়ে বসে আছি।
সরি বলবো ভাবছিলাম। তার আগেই মহুয়া ওর জীবনের কাহিনী বলা শুরু করলো।
মহুয়া আর মাহিনের বাসা একই এলাকায়। কলেজে পড়ার সময় থেকেই দু ক্লাস বড় মাহিনের সাথে সম্পর্ক হয মহুয়ার। দুজনের সম্পর্কের কথা মোটামুটি সবাই জানতো। পড়া শেষ করে চাকুরি নিয়ে মাহিন ঢাকা চলে আসে। দূরে থাকলেও দুজনের ভালবাসা এতটুকুও কমেনি। ছুটিতে বাড়ি আসলে দুজনের দেখা হোত। কত স্বপ্নের জাল বুনতো দুজনে। পারিবারিক ভাবেই দুজনের বিয়ে ঠিক হয়।
মহুয়ার দুচোখে নতুন স্বপ্ন। ঘর বাঁধার স্বপ্ন পূরণের পথে। বিয়ের তারিখ ঠিক হয়। মহুয়াকে মাহিনের পরিবারের খুব পছন্দ। দুমাস পরেই ওদের বিয়ে। দিন গুনতে থাকে দুজনে।
বিয়ের মাস খানিক আগে বান্ধবীদের সাথে পিকনিকে যায় মহুয়া। বিয়ের পর পরই তো ঢাকাতে চলে যাবে। তখনতো আর এভাবে ওদেরকে পাবেনা। তাই এই আয়োজন।
সারাদিন হৈ হুল্লোর করে ফেরার পথে দূর্ঘটনা ঘটে। ওদের বহনকারী গাড়িটা রাস্তার পাশের গাছের সাথে ধাক্কা খায়। সবাই কমবেশি আঘাত পেলেও মহুয়ার অবস্থা বেশি খারাপ। এই দূর্ঘটনায় ওর ডান হাতটা কেটে ফেলতে হয়।
আমি অবাক হয়ে শুনতে থাকি ওর কথা।
ও বলে চলেছে একমনে।
বাড়ি ফিরে আসার পর বদলে যায় ওর জীবন। মাহিনের পরিবার থেকে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়া হয়। অসহায় মহুয়ার পরিবার কিছুই বলতে পারে না।
কিন্তু মাহিন ! ও খবর পেয়ে পাগলের মতো ছুটে আসে। ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দেয়।
বিয়ে করলে সে মহুয়াকেই করবে। বাড়ির কারো কথা সে শুনবে না জানিয়ে দেয়। স্বপ্ন হারানো মহুয়ার চোখে স্বপ্ন বুনে ফিরে যায় মাহিন।
পুরোপুরি সুস্হ্য হওয়ার পর মহুয়া আর মাহিন পরিবারের অমতে বিয়ে করে। চলে আসে এই শহরে।
প্রথম প্রথম একহাত নিয়ে কাজে খুব সমস্যা হোত। কিন্তু মাহিন ওর ভালবাসা দিয়ে সব সময় ওর পাশে থাকে। ওর কাজে কর্মে সাহায্য করে। ওর চুল বেঁধে দেয়। এই ক মাসে অবশ্য মহুয়া অনেক কিছুতেই অভ্যস্থ হয়ে গেছে।
ছুটির দিনে দুজনে ঘুরতে বের হয় । ওর চুলে ফুল গুজে দেয় মাহিন।
আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি ওদের দুজনের জীবনের ভালবাসার গল্প। কখন যে সময়টা পার হয়ে যায় খেয়ালই নেই।
মাহিনেরও ফেরার সময় হয়ে গেল। আমি ওর কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
দরজার কাছে এসে একটু ইতস্তত করে বললো । আমাদের জন্য দোয়া করবেন।
একটু লাজুক স্বরে বললো আমাদের ভালবাসার স্বপ্ন নিয়ে যে আসছে তার জন্যও দোয়া করবেন। আমি ওর দিকে তাকাতেই হেসে ফেললো মহুয়া। এই হাসিতে কোন কষ্ট নেই। নতুন আর এক স্বপ্নের পথে হেটে চলা দুজনের জন্য শুভকামনা জানিয়ে ফিরে এলাম



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top