সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

প্রাপ্তির অন্তরালে : শেলী সেনগুপ্তা


প্রকাশিত:
১১ মে ২০২১ ২১:২৫

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:৫১

 

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে আছে অনুরাধা। আসলে সে কিছুই দেখছে না। শূন্য দৃষ্টিতে বাইরে নয়,নিজের ভেতরেই দেখছে।

অনুরাধা  হিমালয়কন্যা নেপালে  দ্বিতীয়বার এসেছে। এর আগে এসেছিলো দশবছর আগে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্টাডি ট্যুর এ। বয়সের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বলতা ছিলো তখন । পঁচিশ জন  শিক্ষার্থী আর সাথে ছিলো শিক্ষকরা। সেবার খুব আনন্দ করেছিলো ওর। নেপাল দেশটাকে সেবার খুব ভালো লেগেছিলো অনুরাধার। হিমালয়ের সাথে তার একটা প্রাণের বন্ধন হয়ে গিয়েছিলো। সাতদিন থেকে ফিরে গেল নিজের দেশে আর সাথে করে নিয়ে গেল ফিরে আসার অদম্য  আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু আর আসা হলোনা।

এর মধ্যে বাবা মারা গেছে। বিধবা মা তাড়াহুড়া করে ওর বিয়ে দিলো। পাত্র ব্যাঙ্কে চাকরি করে, পরিবারে মা আর ছোট এক ভাই ছাড়া আর কেউ নেই। নিজের ফ্ল্যাটে থাকে। ছোটভাই সরকারী চাকরি করে। এমন পরিবার পেয়ে মা যেন হাতে চাঁদ পেলো। অনুরাধা এরমধ্যে একটা সরকারি কলেজে চাকরি পেয়েছে। একটা শুভলগ্ন দেখে মা ওর বিয়ে দিয়ে দিলো।

বিয়ের পরের দিনগুলো খুব তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু কিছুদিন পর অনুরাধার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরলো। জানতে পারলো ওর স্বামী সন্তান জন্মদানে অক্ষম। ছোটবেলায় প্রবীরের মামস হয়েছিলো কিন্তু অজ্ঞানতার জন্য ঠিকমতো চিকিৎসা নেয়া হয়নি।

বিয়ের আমেজ কেটে  যাওয়ার পরপরই অনুরাধা সন্তান ধারণে আগ্রহী হলো। একটা ছোট্ট মানুষ তার গুটিগুটি পা ফেলে অনুরাধার মনের উঠোনে হেঁটে বেড়াচ্ছে,এবার তাকে নিজের কোলে আনার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলো সে।অনেকদিন অপেক্ষা করার পর যখন কোন সম্ভাবনা দেখা গেলো না তখন সে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করলো। ডাক্তার জানিয়ে দিলো  অনুরাধার কোন সমস্যা নেই। এরপর ডাক্তার প্রবীরকে দেখতে চাইলো। কিন্তু প্রবীর ডাক্তারের কাছে যেতে চাইলো না। অনেকদিন  চেষ্টা করে প্রবীরকে ডাক্তারের কাছে নেয়া গেলো। ডাক্তার দু’চারটা পরীক্ষানীরিক্ষা করে জানিয়ে দিলো প্রবীরের পক্ষে কখনোই সন্তান জন্ম দেয়া সম্ভব না। অনুরাধার চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। একনিমিষেই স্বপ্ন ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেলো। বুকের মধ্যে হাহাকার। মা ডাক শোনার আকুল তৃষ্ণা ওকে প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।

প্রবীর হয়ে গেলো দূরের মানুষ। ব্যর্থতা তাকে অনুরাধার কাছ থেকে সরিয়ে নিলো। একই বাড়িতে থেকেও দু’জন দু’গ্রহের বাসিন্দা। খুব দরকার ছাড়া কথা হয়না।

এরমধ্যে প্রবীর এর ছোটভাই সুবীর বিয়ে করে আলাদা সংসার করে বাসা নিয়ে চলে গেলো। কিছুদিন পর জানা গেলো সুবীরের স্ত্রী জয়া সন্তানসম্ভবা শাশুড়ি  আর এ বাড়িতে আসতে পারেনা। এ বাড়িতে শুধু অনুরাধা আর প্রবীর। দু’জনের কাজের পরিধি আরো বেড়ে গেছে।

অনুরাধার হাহাকার বেড়েই চলেছে। কারো কোলে সন্তান দেখলে নিজের শুন্য কোলের কথা মনে হয়।

ঢাকায় অনুষ্টিত হচ্ছে সার্ক সাহিত্য সম্মেলন। শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে ওর ডেপুটেশন দিয়েছে দিয়েছে সার্ক সম্মেলনে। ওর বিশাল দায়িত্ব। এ সম্মেলন সফল করতে হবে। রাতদিন পরিশ্রম করে সবকিছুর আয়োজন করছে। সার্কভুক্ত বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিধিরা আসতে শুরু করেছে। শহরের দু’টি পাঁচতারা হোটেলে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনুরাধা সারাদিন ছোটাছুটি করে সবকিছু সামাল দিচ্ছে। রাতদিন বিশ্রাম নেই। অথচ শত কাজের মাঝেও মুখের হাসি একটুও ম্লান হয়নি। সারাক্ষণ হাসছে। এতদিনে যেন ওর মনের মতো কাজ পেয়েছে।

দেখতে দেখতে দু’দিনের সম্মেলন শেষ হয়ে গেলো। এবার ডেলিগেটদের ফিরে যাবার পালা। রাতদিন পরিশ্রম করে যেভাবে অনুষ্ঠান সফল করেছে ঠিক তেমনি ভাবে সব ডেলিগেটদের যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। একে একে সবাই চলে গেছে শুধু নেপালের একজন রয়ে গেছে। কীর্তিপ্রসাদ ঘিমিরি।

কীর্তিপ্রসাদের কিছু কাজ আছে ঢাকাতে তাই আরো কিছু দিন থাকতে চায়। তাই তার জন্য  আর একটা ভালো হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিলো। উপরমহলের নির্দেশে ওর দেখাশুনার দায়িত্ব অর্পিত হলো অনুরাধার উপর।

কীর্তিপ্রসাদ একটা গবেষণার কাজ করছে। কাজটা প্রত্নতত্ত্বের উপর। বগুড়ার মহাস্থানগড় আর রাজশাহীর বরেন্দ্র মিউজিয়ামে ওর কাজ। অনুরাধা ওকে গবেষণার কাজে  সহযোগিতা করবে।

ওরা চলে গেলো বগুড়ার মহাস্থানগড়,বেশ কিছু দিন সেখানে থেকে ওর গবেষনার উপাত্ত সংগ্রহের কাজ করলো। সাতদিন সেখানে কাজ করলো তারপর ওরা রাজশাহী চলে গেলো।

রাজশাহীতে  এসেই কীর্তি অসুস্থ হয়ে গেলো। প্রচন্ড জ্বর আর মাথা ব্যথা। অনুরাধা রীতিমতো বিব্রতকর অবস্থায় পরে গেলো। প্রচন্ড জ্বরে প্রায় অজ্ঞান কীর্তি একমুহূর্তের জন্য অনুরাধার কাছ থেকে দূরে থাকতে চায় না। রেষ্ট হাউজের  ম্যানেজারের সাহায্য নিয়ে ডাক্তারের ব্যবস্থা করে কীর্তিকে সুস্থ করে তুললো। ততদিনে অনুরাধার উপর ওর একটা  অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। কীর্তি ভাবে এই পৃথিবীতে সে আর অনুরাধা ছাড়া আর কেউ নেই। তাই ওকে সবসময় কীর্তির সাথে থাকতে হবে।

অনুরাধাও যেন একটা আশ্রয় খুঁজে পেলো। অনেক দিন ধরে নিজেকে বিলীন করার ইচ্ছা প্রবলভাবে  জাগ্রত ছিলো। কীর্তির মধ্যে  নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেলো। গত কয়েকটা দিন ছিলো শুধুই তাদের।

দেখতে দেখতে দশ দিন পার হয়ে গেলো। কীর্তিপ্রসাদের কাজ শেষ। এখন সে ফিরে যাবে নেপালে। দুজনের মধ্যে বিষন্নতা ভর করেছে। কিন্তু কেউ তা প্রকাশ করতে চাইছে না। তাই ওদের মধ্যে কথা অনেক কমে গেছে।

একরকম নিরবেই ঢাকা ফিরে এলো। পরদিনই কীর্তির ফ্লাইট। অনুরাধা কীর্তির সাথে এয়ারপোর্টে এসেছে। অপেক্ষার সময় খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেলো। যাওয়ার সময় দু’হাত বাড়িয়ে অনুরাধাকে বুকের মধ্যে টেনে নিলো। সবশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে যেন কেউ কেড়ে নিতে না পারে। বারবার এনাউন্সমেন্ট। একসময় অনুরাধাকে ছেড়ে প্লেনের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। একবারও পিছন ফিরে দেখলো না। প্লেনের দরজা বন্ধ হয়ে গেলো।

অনুরাধা বাড়ি ফিরে গেলো। আজ আর অফিসে যাবেনা ।

আজকাল ওর বিষন্ন সময় কাটছে। এক মুহূর্তের জন্য কীর্তিকে ভুলতে পারছে না। কয়েকবার ই মেইল করেছে অনুরাধা কিন্তু কীর্তির  কোন জবাব নেই।

মাসখানেক হয়ে গেলো। অনুরাধা নিজের শরীরের মধ্যে পরিবর্তন বুঝতে পারছে। দেহের মধ্যে আরেকটা দেহের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। প্রথমেই খুব আনন্দিত হলো। কিন্তু পরে যখন পরিচয় এর চিন্তা এলো তখন মনে হলো কীর্তির সাথে কথা বলা দরকার।

অনুরাধা এখন চেষ্টা করছে, বিষয়টা গোপন রাখতে। খুব তাড়াতাড়ি নেপাল এসে কীর্তির সাথে কথা বলা জরুরী মনে হলো। তাই ছুটি নিয়ে চলে এলো। এসেই উঠলো হোটেল ক্রাউন প্লাজাতে।

লিটেরারী টিমের লোক দিয়ে খবর দিলো কীর্তিকে। একদিন পর জানতে পারলো কীর্তিপ্রসাদ এখন নেপালের বাইরে। অনেক দিনের জন্য কেনাডা চলে গেছে। কবে আসবে বা কোথায় আছে কেউ জানেনা।

অনুরাধা পাথর এর মতো বসে আছে।  জানালার পাশে বসে আছে। কিন্তু কিছুই দেখছে না। চারপাশের শুন্যতা ওকে গ্রাস করতে চাইছে। পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। কী করবে তাও ভাবতে ইচ্ছা করছে না। নিজের অজান্তে হাত চলে গেলো পেটের উপর। ভেতর থেকে যেন কেউ ওকে মা বলে ডেকে উঠলো। অনুরাধা আলতো করে আদর করে দিলো।

সারারাত কেটে গেলো জানালার পাশে বসে। প্রতিজ্ঞা দৃঢ় হলো, আসবে এ সন্তান, পৃথিবীর মুখ দেখবে এ সন্তান। এ সন্তান আর কারো না হোক শুধু অনুরাধার সন্তান হিসেবে বড় হবে।

সন্ধ্যা ৫টা ৩০ মিনিটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে প্ল্যান ল্যান্ড করলো। অনুরাধা ওর ট্রলী ব্যাগ টেনে বের হয়ে এলো। পা চলছে না। দু’দিন দেশের বাইরে ছিলো। ওর উপর দিয়ে বিশাল এক ঝড় বয়ে গেছে। নিজেকে মনে হচ্ছে ঝড়ে ভেঙ্গে পড়া বৃক্ষ।

ট্রলিব্যাগ টেনে টেনে বাইরে এসে অবাক। এয়ারপোর্টের বাইরে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রবীর। হাসিমুখে কাছে এগিয়ে এলো। অনুরাধা আর এক পাও এগোতে পারছে না। প্রবীর এগিয়ে এলো কাছে, দু’হাত বাড়িয়ে অনুরাধাকে বুকের মধ্যে টেনে নিলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, ‘আমি আমার স্ত্রী আর সন্তানকে বরণ করে নিতে এসেছি’।

অবাক অনুরাধাকে প্রায় বুকের মধ্যে করে গাড়িতে তুলে নিয়ে বললো, ‘আমি তোমার রিপোর্টগুলো দেখেছি, তখনই তাকে নিজের করে গ্রহণ করেছি। ওকে আমরা দু’জন একসাথে বড় করে তুলবো। ও আমাদের সন্তান’।

অনুরাধার মাথাটা প্রবীরের কাঁধের উপর রেখে দিলো। চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে প্রবীরের কাঁধ ভিজে গেলো। গাড়ি ছুটে চলছে  ভবিষ্যতকে সাথে নিয়ে।

 

শেলী সেনগুপ্তা
কবি ও সাহিত্যিক



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top