সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

হাসন রাজা পরিষদ (অস্ট্রেলিয়া) এবং আমাদের ইতিহাস : এম এইচ পলাশ


প্রকাশিত:
২৯ মে ২০২১ ১৯:২৬

আপডেট:
২ জুন ২০২১ ১৮:১৫

ছবিঃ দেওয়ান হাসন রাজা এবং অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী

 

প্রথমেই একটা ইতিহাস দিয়ে শুরু করি। এই ইতিহাসের সাথে আমাদের সিডনিও যেন জড়িয়ে গেছে। পনের শতকের মধ্যভাগের কথা। মিথিলা রাজ্যের রাজা তখন রাজপুত শ্রীমন্ত রায় (বর্তমানে এটি সম্ভবত বিহার এবং উড়িষ্যার অংশ)। এই সময় গৌরাধিপতি সুবুদ্ধি রায়কে যুদ্ধে সৈন্য ও রজসপত্র পাঠিয়ে সহায়তা করার কারনে রাজা শ্রীমন্ত রায় বঙ্গের শাসন কর্তা হুসেন শাহের কোপানলে পড়েন। হুসেন শাহ, রাজা শ্রীমন্ত রায়ের বিরুদ্ধে যখন আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে্ন‌, তখন নিজের পরিবারের নারীদের সম্ভ্রম এবং ধর্ম রক্ষার্থে রাজা শ্রীমন্ত রায় বাধ্য হয়ে নিজের সৈন্য সামন্ত নিয়ে সিলেট-আসাম অঞ্চলে সুরমা নদীর তীরে দুহালিয়াতে রাজধানী নির্মান করেন এবং স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা ও ধর্ম কর্ম করতে থাকেন। আকবার তখন ভারত বর্ষে একের পর এক রাজ্য জয় করে চলেছেন। একসময় দিল্লীশ্বর সম্রাট আকবর রাজা শ্রীমন্ত রায়ের নাতি পুরুষোত্তম রায়কে আপন দরবারে মনসবদারের পদে নিযুক্ত করেছিলেন। যে রাজা ধর্মান্তর হওয়ার ভয়ে নিজের রাজ্য ছেড়ে নতুন দেশে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, অদৃষ্টের পরিহাস এই যে, তাঁরই পরিবারের এক বংশধর রাজ্য রক্ষার্থে মোঘল সাম্রাজ্যের বশ্যতা স্বীকার করে নেন এবং ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দু ধর্ম ছেড়ে মুসলমান ধর্ম গ্রহন করেন। স্বামীর ধর্মান্তরিত হওয়া আর মুসলমান মেয়েকে দ্বিতীয় বিয়ে করা, তাঁর স্ত্রী রানী মাতা মেনে নিতে পারেন নি। তাই স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের দিন তিনি বিষ্ পানে আত্মহত্যা করেন।

ছবিঃ দুহালিয়া রাজবাড়ির প্রধান ফটক যা ভূমিকম্পের কারণে বিধধস্ত হয়ে যায়

অন্যদিকে রামচন্দ্র সিংহদেব ছিলেন অযোধ্যার বিশাল জমিদার। ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে তাঁরই বংশধর বিজয় সিংহ সিলেট জেলাতে এসে বসতি শুরু করেন এবং পরবর্তীতে তাদেরই একজন বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব (বাবু রায় চৌধুরী) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এই বীরচন্দ্র সিংহদেবের বংশেই জন্মগ্রহন করেন প্রতাপশালী জমিদার এবং মরমী কবি দেওয়ান হাসন রাজা।

ছবিঃ দেওয়ান হাসন রাজার তলোয়ার এবং মাথার পাগড়ী

বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেবের বংশধর দেওয়ান হাসন রাজা তাঁর আদরের বড় মেয়ে রওশন হুসন বানুর বিয়ে দেন এই প্রতাপশালী রাজা শ্রীমন্ত রায়ের পরিবারের সাথে।

 

ছবিঃ দুহালিয়ার রাজা শ্রীমন্ত রায় এবং হাসন রাজার বংশ তালিকা

আদরের মেয়ে সন্তানসম্ভাবা হলে প্রথা অনুযায়ি তিনি মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। ১৯০৮ সালের ১ জানুয়ারী সুনামগঞ্জের হাসন রাজার বাড়িতে জন্ম গ্রহন করেন দেওয়ান হাসন রাজার আদরের নাতি আরেক ক্ষন জন্মা পুরুষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, যিনি ছিলেন উপমাহাদেশের বিখ্যাত ইসলামিক দার্শনিক, আবুজর গিফফারী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এবং অধ্যক্ষ সহ বেশ কিছু স্কুল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং সভাপতি এবং ভাষা আন্দোলনের প্রথম নেতৃত্বদানকারী তমুদ্দিন মজলিশের সভাপতি এবং প্রথম অরাজনৈতিক এবং বেসরকারী ব্যক্তিত্ব যিনি ১৯৮২ সালে খ্রীস্টানদের বড় ধর্ম যাজক পপ জন পলের সহায়তায় ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের যুদ্ধ বিরতিতে ভূমিকা রেখেছিলেন।

ছবিঃ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এবং পপ জন পল

এখানে উল্লেখ্য যে তাঁর বোনের ছেলে (ভাগ্না) হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার ছিলেন।

ছবিঃ হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী

পরবর্তীতে দেওয়ান হাসন রাজা তাঁর বড় ছেলে দেওয়ান গনিউর রাজার মেয়ে এবং তাঁর আদরের নাতনি দেওয়ান সাজেদ্দুন্নেছার চৌধুরানীর সাথে, নিজের নাতি দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের বিয়ে দেন। এই বংশেই জন্ম গ্রহন করেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের বড় নাতি দেওয়ান সোলায়মান আশরাফী, যিনি অস্ট্রেলিয়ার উলংগন ইউনিভার্সিটি এবং সেন্ট্রাল কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে যথাক্রমে মাস্টার্স অফ ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস এবং এমবিএ করে সিডনিতে একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত।

ছবিঃ সিডনিতে দেওয়ান হাসন রাজার পরিবারের সদস্যবৃন্দ এহসান রেজা, সোলায়মান দেওয়ান, শ্রাবন্তী কাজী, সায়রা মীর্জা এবং দয়িতা দেওয়ান

সুনামগঞ্জে হাসন রাজা মিউজিয়ামের প্রতিষ্ঠাতা এবং হাসন রাজা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হচ্ছেন এই পরিবারেরই এক কৃতী সন্তান শামারিন দেওয়ান যিনি সোলায়মান দেওয়ানের চাচা।

ছবিঃ মাননীয় রাষ্ট্রপতির সাথে শামারিন দেওয়ান এবং শিক্ষাবিদ ও লেখক ডঃ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল

এই পরিবারের আরেক সন্তান যিনি সিডনির সাংস্কৃতিক মন্ডলে অত্যন্ত পরিচিত মুখ, তিনি হচ্ছেন বিশিষ্ট নজরুল সংগীত শিল্পী এহসান রেজা। এহসান রেজা এবং সোলায়মান দেওয়ানের যৌথ উদ্দ্যোগে অস্ট্রেলিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হল হাসন রাজা পরিষদ (অস্ট্রেলিয়া) যা শামারিন দেওয়ানের প্রতিষ্ঠিত হাসন রাজা পরিষদের একটা শাখা। 

বাংলার মরমি ও লোক সংগীত বিশ্ব দরবারে সমাদৃত হওয়ার পেছনে যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য, তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন হাসন রাজা। তিনি তাঁর জীবনের প্রথম দিকে ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী জমিদার।

 

ছবিঃ হাসন রাজা মিউজিয়াম

একময় তিনি তাঁর এই বিশাল জমিদারি ত্যাগ করে, গ্রহণ করেন অতি সাধারণ জীবন। আভিজাত্যের চাকচিক্যতা ভুলে সাদাসিধে বৈরাগ্য জীবনে মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তাঁরই উদ্যোগে সুনামগঞ্জ হাসন এম ই স্কুল সহ অনেক ধর্ম-প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও তিনি করেন। দরিদ্র মানুষদের জন্য বিলিয়ে দেন নিজের ধন সম্পত্তি।

ছবিঃ হাসন রাজাকে নিয়ে সিনেমা

এই সময় স্রষ্টার সন্ধানে নির্জন সাধনায় আত্মনিয়োগ করে জগত সংসার নিয়ে উদাসীন হয়ে যান এবং একের পর এক আধ্যাত্মিক গান রচনা করতে থাকেন, যার সংখ্যাটা প্রায় সহস্রাধিক। তাঁর গানগুলি যেন হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের একটি মিলন ক্ষেত্র। তাঁর জীবন ছিল অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়, যা অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের বিশেষভাবে আকর্ষিত করে ছিল। বিশেষ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ সহ আরও অনেকেই তাঁর জীবন দর্শনে প্রভাবিত হয়ে ছিলেন। এমনকি ইংল্যান্ডের রাজ দরবারেও এই মরমী সাধকের বৈচিত্র্যময় জীবনের গল্পটা পৌঁছে গিয়েছিল।

ছবিঃ মিঠুন চক্রবর্তী এবং রাইমা সেন অভিনীত হাসন রাজার সিনেমা

হাসন রাজার দর্শন, গান, সুর, ভাবধারা, প্রচার এবং সংরক্ষনের পাশাপাশি সিলেটের আঞ্চলিক গান, লোকগীতি, পল্লীগীতি সমূহকে সংরক্ষন, প্রচার এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত ভবিষ্যত প্রজন্মের বাংলাদেশীদের কাছে পৌঁছে দেওয়াই হচ্ছে হাসন রাজা পরিষদের মূল উদ্দেশ্য।

সূত্রঃ উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, ইন্টারনেট এবং বিভিন্ন বই থেকে



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top