সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

কর্ণ ও দ্রৌপদী কি পরস্পরের প্রেমে পড়েছিলেন? : অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ


প্রকাশিত:
৩১ মে ২০২১ ২০:৩৫

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৪:৪৭

ছবিঃ : অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ

 

মহাভারতের কেন্দ্রীয় চরিত্র গুলির মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী চরিত্র কর্ণ। তিনি রূপে-গুণে, বুদ্ধিতে ও অস্ত্র বিদ্যায় অনেকের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিলেন‌। কিন্তু সুতপুত্র হওয়ার অপরাধে জীবনে বারবার তাকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। অপমানিত হতে হয়েছে। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভা মাছের চোখ বিদ্ধ করে দ্রৌপদীকে জয় করার অন্যতম দাবিদার ছিলেন কর্ণ। কিন্তু দ্রৌপদীকে বোঝানো হয়েছিল কর্ণ নিচু জাতের। তাই স্বয়ম্বরসভায় দ্রৌপদী কর্ণকে অপমান করে প্রত্যাখ্যান করেন। এই অপমানের প্রতিশোধ হিসেবে দুর্যোধনের রাজসভায় পাশা খেলায় সর্বোচ্চ হারিয়ে পাণ্ডবরা যখন নতমস্তক, তখন দ্রৌপদীকে প্রকাশ্যে বেশ্যা-বারঙ্গনা বলে অভিহিত করেন কর্ণ।

কর্নের প্রথম স্ত্রী ছিলেন ভ্রুশালী। তিনি ছিলেন দুর্যোধনের সারথির ভগ্নি। পালক পিতা অধিরথের ইচ্ছানুসারে ভ্রুশালীকে বিয়ে করেছিলেন কর্ণ। 

মূল প্রশ্নটি হল, কর্ণ এবং দ্রৌপদীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি কি কোন দুর্বলতা ছিল? দুর্বলতা থাকা অস্বাভাবিক নয়। বাসুকীর হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার মুহূর্তে দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করেছিলেন কর্ণ। এছাড়া যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কর্ণ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ভীমকে বধ করেননি। বাসুকির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে কর্ণকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ছিলেন দ্রৌপদী। সেই সঙ্গে স্বয়ম্বরসভায় করা সেই অপমানের জন্য তিনি ক্ষমা চেয়ে নেন। অন্যদিকে কর্ণ দ্রৌপদীকে 'দেবী' সম্বোধন করে রাজসভায় 'বেশ্যা' বলার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। এছাড়া দ্রৌপদী যখন কৃষ্ণের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন, কর্ণ আসলে কুন্তীর জ্যেষ্ঠ পুত্র, তখন তিনি অনুতপ্ত হয়েছিলেন। নিজেদের কোনো দোষ না থাকা সত্বেও মহাভারতের যে দুটি চরিত্র সবচেয়ে বেশি হেনস্তার শিকার হয়েছিলেন, তারা হলেন দ্রৌপদী ও কর্ণ। হয়তো এটাই ছিল কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের মহাকাব্যিক নাটকীয়তা।

 

পাঞ্চালদেশে দ্রৌপদীর জন্ম কিনা তা নিয়ে সংশয়ের কথা মন দিয়ে মহাভারত পড়লেই জানা যায়। দ্রৌপদী কি আদৌ 'পাঞ্চালী'? পাঞ্চালদেশে  তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ, তাঁর কন্যার পরিচয়ে। যজ্ঞাগ্নিসম্ভূতা বানিয়ে ইন্দ্রজালের মোহে, ধোঁয়ার আড়ালে যজ্ঞের আগুণের মধ্যে থেকে তাঁকে বেরিয়ে আসতে বলা হয়েছিল আর সাথে বেরিয়ে এসেছিল তাঁর দাদা ধৃষ্টদ্যুম্ন। জনসাধারণ জানত না এত সব । দ্রৌপদীর নাম হল যাজ্ঞসেনী,  হলেন দ্রুপদরাজের অগ্নিকন্যা দ্রৌপদী, কৃষ্ণরূপা, কৃষ্ণকলি, আর সমগ্র জম্বুদ্বীপের কৃষ্ণা। যজ্ঞের অলৌকিক শক্তির মাহাত্ম্যে তাঁর গোধূমবর্ণ পুড়ে এই হাল হল, জানল সকলে, দেখল সকলে। আর পুড়েছিল তাঁর অদৃষ্ট।  রাজা দ্রুপদ কেন কৃষ্ণাকে দত্তক নিয়েছিলেন? এটা ছিল রাজামশায়ের ধুরন্ধর রাজনৈতিক চাল। ধনুর্ধর দ্রোণ আর পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কোঁদল অনেককালের। একসময়ে তারা ছিলেন হরিহর আত্মা । কিন্তু দ্রুপদ প্রতিপত্তিময় হয়ে ওঠার পর অভাবের তাড়নায় আশ্রয়প্রার্থী বাল্যবন্ধু দ্রোণকে সপরিবারে আশ্রয় দেননি সেই কারণে অপমানিত দ্রোণ আশ্রয় নিয়েছিলেন হস্তিনাপুরে, ধৃতরাষ্ট্রের রাজপ্রাসাদে। বুকে ছিল তাঁর একরাশ ক্ষত, চোখে ছিল প্রতিশোধের আগুন । কৌরবদের অস্ত্রশিক্ষাগুরু দ্রোণ আক্রমণ করলেন পাঞ্চাল, বন্দী করলেন দ্রুপদকে। দ্রুপদও সেই রাগে দ্রোণকে বধ করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। কুরু-পাঞ্চাল বিবাদ আজও মেটেনি, কর্ণ এখনও ধিকি ধিকি জ্বলছে, জম্বুদ্বীপের অভ্যন্তরেও সেই আগুণের ফুলকি এসে লেগেছে। মহারাজ দ্রুপদ শুধুই দ্রোণের ওপরে প্রতিশোধ নিলেন না দ্রোণকে উপলক্ষ করে সমগ্র কুরুবংশের ওপরে প্রতিশোধ নিলেন।  হস্তিনাপুরের কুরু-পান্ডবদের অন্তর্দ্বন্দ কথা যারা মহাভারত পড়েনি , তারাও জানে। রাজনীতির এ জট খুলতে  কৃষ্ণও পদে পদে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

কৃষ্ণার স্বয়ংবর সভা রচনা করাও ছিল পাঞ্চালরাজের গভীর রাজনৈতিক কূটচাল। দ্রোণাচার্য যখন পাঞ্চাল আক্রমণ করলেন তখন দুর্যোধন আর তার ভাইদের,  প্রতিহত করেছিলেন মহারাজ দ্রুপদ। কিন্তু আক্রমন করতে গিয়ে যে তরুণ বীর যোদ্ধার হাতে দ্রুপদ বন্দী হয়েছিলেন সেই তরুণটি দ্রুপদকে রাজোচিত মর্যাদার সঙ্গে সসম্মানে নিয়ে গেছিলেন দ্রোণের সামনে । দ্রুপদ মুগ্ধ হয়েছিলেন সম্বর্ধনায়। স্বপ্নের আবেশে আবিষ্ট হয়ে সেই তরুণটিকেই মনে মনে চেয়েছিলেন,   যে কিনা তাকে সাহায্য করতে পারবে যদি কুরু-পাঞ্চাল যুদ্ধ হয়। রাজনীতির এক অসামান্য দূরদৃষ্টি ।এই তরুণটিই ছিল অর্জুন যার জন্য আয়োজন হল স্বয়ংবর সভার । কৌরবরা কখনো পান্ডবদের পক্ষে যুদ্ধ করবে না আর কৌরবরাই দ্রুপদের শত্রু। অতএব এই তরুণ পান্ডব অর্জুনকেই চাইলেন দ্রুপদ।

এদিকে যখন দুর্যোধনের চক্রান্তে সারাদেশের মানুষ জানল যে অজ্ঞাতবাসের প্রথম পর্যায়ে এক‌ই গৃহের মধ্যে আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত পঞ্চপান্ডব সহ কুন্তী। দ্রুপদ সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন এক  রাজনৈতিক চাল চেলে যার প্রথম পদক্ষেপই ছিল স্বয়ংবর সভা। আসলে দ্রুপদের নিকট খবর ছিল যে পান্ডবরা বারণাবতে পুড়ে মরেননি। তাই শূণ্য থেকে ঝোলানো মাছের চোখে লক্ষ্যভেদের মত কঠিন পরীক্ষার আয়োজন করলেন যা ঊত্তীর্ণ হবার যোগ্যতা একমাত্র অর্জুনের‌ই আছে। আর কৃষ্ণা তথা দ্রৌপদী হলেন সেই তুরুপের তাস যাকে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে অর্জুনের গলায় মাল্যদান করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। এটা তাঁকে শেখানো হয়েছিল।  মূল চার প্রোথিতযশা বীর ছিলেন স্বয়ংবর সভায় কর্ণ , দ্রোণপুত্র অশ্বথামা, যাদব কৃষ্ণ আর অর্জুন। প্রতিশোধী পিতা দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা তার মাতুল কৃপাচর্যের মত চিরকৌমার্যব্রত পালন করছেন অতএব তিনি প্রতিযোগী নন |কৃষ্ণ নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন প্রতিযোগী হিসেবে নয় । অতএব কর্ণ  আর অর্জুন ছিলো সেদিনের দুই প্রধান প্রতিযোগী। দ্রুপদ পাখিপড়া করে দ্রৌপদীকে শিখিয়ে ছিলেন অর্জুনকে মাল্যদান করতেই হবে। দ্রৌপদীর চোখের সামনে দুই পুরুষ; দুজনেই বীর, যোদ্ধা, সুন্দর পুরুষ ;  কর্ণ ছিল অধিক সুদর্শন ও বীর। কর্ণকে দেখেই দ্রৌপদীর মনে হয়েছিল এই পুরুষই তাঁর প্রথম প্রেম ! কর্ণের ডান মণিবন্ধে তখন শানিত তরবারি, বামহস্তে পাণিগ্রহণের অঙ্গীকার! বিহ্বলা, চঞ্চলা নবযৌবনা কৃষ্ণা তখন ষোড়শী শ্রীময়ী। যজ্ঞাগ্নিসম্ভূতার চোখে তখন একরাশ কামনা। কৃষ্ণা লক্ষী মেয়ের মত কর্ণকে সূতপুত্র বলে অভিহিত করে অপমান করে, গান্ডীব ধরতে নিরস্ত করে, সেও দ্রুপদের আদেশে। যুগ যুগ ধরে জম্বুদ্বীপের ইতিহাসে কালো মেয়েকে এই ভাবেই কাজে লাগিয়ে আসছে, অবলা করে রেখে দিয়েছে। অর্জুনের অপলক দৃষ্টি ছিল মীনের অক্ষিগোলক আর দ্রৌপদীর দৃষ্টি ছিলো কর্ণের শৌর্যের প্রতি । ক্ষণেকের জন্যে কর্ণের বলিষ্ঠতা, পৌরুষে আকৃষ্ট হয়েও নিজেকে সংযত করেছিলন অনেক কষ্টে।

দ্রৌপদী কখনও স্বামী সোহাগিনী, আদর্শ বধূ হতে চায়নি, চেয়েছিল ইতিহাস রচনা করতে, দেশ গড়তে, ইতিহাসের পাতায় পঞ্চকন্যার সাথে স্মরনীয়া ও বরনীয়া হতে; তার জন্য যা করতে হয় সেই উচ্চাশার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার আশায়..সেই স্বপ্নকে সার্থক রূপ দেবার আশায়। যদিও সাধারন পাতিব্রত্য আর ঘরগেরস্থালিও তাঁর মাথায় ছিল। তাই কর্ণকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো নিমেষেই।  যে স্বপ্ন নিয়ে পাঞ্চালদেশে এসেছিলেন, স্বপ্ন নিয়েই চলে নিয়েই চলে যেতে হয় মহাপ্রস্থানের দুর্গম পথে। স্বপ্ন পূরণ  হয় নি। পেয়েছিলেন জীবনভর অপমান-লাঞ্ছানা- উপেক্ষা ও  নারীত্বের অবমাননা।  তিল তিল করে নারীত্বের সবটুকু দিয়ে সর্বগুণান্বিতা, তিলোত্তমা করে পাঠিয়েছিলেন বিধাতা তাঁকে। রূপে লক্ষী, গুণে সরস্বতী, রন্ধনে পটিয়সী, চলনে বলনে, চিন্তা শক্তির দূরদশিতায় দ্রৌপদী হয়ে উঠেছিলো যুগশ্রেষ্ঠা।  সেই কালো মেয়ে দ্রৌপদী যার নাম, নারী থেকে পূর্ণ মানবী হতে চেয়েছিল যে, তাই সেদিন স্বয়ংবরা হয়ে দ্রুপদের কথায় বাধ্য মেয়ের মত মালা পরিয়েছিলো অর্জুনকে আর প্রত্যাখান করেছিলো বীরশ্রেষ্ঠ কর্ণকে। 

ধৃষ্টদ্যুম্ন আর দ্রৌপদী এক সাথে যজ্ঞের আগুণ থেকে উঠে এসেছিল দ্রুপদের বাসনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে। ধৃষ্টদ্যুম্নকে ব্যবহার করা হয়েছিল দ্রোণকে বধের করার জন্য আর দ্রৌপদী অর্জুনের ঘরণী হয়ে পান্ডবপক্ষে থাকলে দ্রুপদের‌ই সুবিধে সেই কারণে। অর্জুনের মত বীর জামাইকে পাশে নিয়ে রাজা দ্রুপদ শক্তিবৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন। বিবাহ না করলে কুরুবংশের অন্দরমহলে প্রবেশ করে তথ্য সংগ্রহ করবে কে? পান্ডব গৃহবধূ দ্রৌপদীকে ব্যবহার করা হয়েছিল কৌবর অন্দর মহলের গোপন তথ্য সংগ্ৰহের। সবটাই ছিল কূট-রাজনীতিক দ্রুপদের ষড়যন্ত্র। দ্রৌপদীই ছিল  উপযুক্ত নারী যার চালনা শক্তি আছে তার ঠিকুচি-কুষ্ঠি সব বিচার করেই খুঁজে আনা হয়েছিল পাঞ্চালদেশে । স্বয়ংবরসভা রচনা করল ইতিহাস আর সকলের অলক্ষ্যে ঘটে গেল কত কিছু।  দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভাকে ঘিরে পাঞ্চাল নগরীর আকাশে বর্নালীর ছটা ! ফুলেল বাতাস সংপৃক্ত কেওড়া-কস্তুরী-আতরের গন্ধে; একনারীকে জয়ের জন্য কত পুরুষের আগমন। সেই কালো মেয়ে পুতুলের মত মালা হাতে জীবনের সর্বপ্রথম রাজনীতির অচেনা, অদেখা সুপরিকল্পিত এক মঞ্চে হাজির ! কৃষ্ণার মত কালো মেয়ের এত দাম? তাঁকে লাভ করার জন্য এত বড় বড় বীরেরা, রাজপুত্রেরা পরীক্ষা দেবেন? কৃষ্ণার অদম্য ইচ্ছা ছিল নারীত্বের পূর্ণতা পেতে সেটা বধূ বা মাতারূপে নয়, সমগ্র জম্বুদ্বীপের ইতিহাসে মানবী রূপে প্রতিষ্ঠা পেতে।আদর্শ দেশ গড়ার ব্রতে ব্রতী হতে চেয়েছিলেন। সেই কারণেই রাজী হয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ংবর সভার প্রস্তাবে। আর তখন থেকেই তাঁর জীবন বাঁক নিল অন্যধারায়, জীবনধারা ব‌ইতে শুরু করল অন্যখাতে, জীবনদর্শন বদলে গেল নিমেষে।

কর্ণকে সূতপুত্র বলে অপমান করার পরও কর্ণ পরিস্থিতি সামলে নিয়েছিলেন যদিও তা ছিল তাঁর কাছে অপ্রত্যাশিত; কর্ণের বক্র হাসিতে সেদিন ঝরে পড়েছিলো  প্রচ্ছন্ন ক্রোধাগ্নি, অপমানের নীরব অশ্রু;  কিন্তু রাজনীতির মারপ্যাঁচে দ্রৌপদী  কর্ণের সঙ্গসুখ থেকে চিরকালের মত বঞ্চিত হলো।

আর সেই সাথে জননী কুন্তীর আদেশে দ্রৌপদী হলো পাঁচস্বামীর অধীনস্থ। কৃষ্ণা হলো ভাগের স্ত্রীরত্ন । উৎকৃষ্ট ভোগ্যবস্তু, লোভনীয় বিলাসিতার দ্রব্য যেমন মিলেমিশে ভাগ করতে হয়... তেমন এক ভোগ্যপণ্যে পর্যবাসিত হল দ্রৌপদীর মেয়েবেলা । দ্রুপদ ব্যবহার করলেন তাঁকে নিজ রাজনীতির স্বার্থে।

অর্জুনকে পাওয়া তো হয়েই গেছে, এখন আরো চারজনকে বিনামূল্যে জামাই রূপে পাওয়া... সে তো তাঁর‌ই দলের শক্তিবৃদ্ধি ঘটাবে আর স্বার্থসিদ্ধির ব্যাঘাত ঘটাবে না। অতএব মোটেই উদ্বেগ প্রকাশ করলেন না পালিতা কন্যার এমন বহুস্বামিনী হওয়ার দুর্ঘটনায় । ধৃষ্টদ্যুম্ন আপত্তি করেছিলেন, বলেছিলেন খুব অধর্ম এটা..একপুরুষের অনেক স্ত্রী থাকে কিন্তু একনারীর অনেক স্বামী ? প্রবাদপুরুষ কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ বেদব্যস দিয়েছিলেন ধর্মের প্রতিবিধান বলেছিলেন এ নাকি দ্রৌপদীর ভাগ্যলিপি! মোটকথা কৃষ্ণা হলো রাজমহিষী, পঞ্চস্বামীর ভার্য্যা-ভোগ্যা।

 রাজ অন্তঃপুরের কথা। ইন্দ্রপ্রস্থের পাঁচকুমারের ভোগ্যবস্তু হলেন ঠিক‌ই কিন্তু যাকে বলে ভালবাসা, সেই ভালোবাসার মর্যাদা-সন্মান কোনদিনও তিনি পাননি।

স্বয়ম্বর সভায় বিজয়ী হয়ে পাঞ্চালীকে স্ত্রী রূপে জয় করেছিলেন যিনি, সেই অর্জুনের প্রতি কৃষ্ণার প্রেম ছিল অধিক। কিন্তু বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন দ্রৌপদীর প্রতি তেমন আকৃষ্ট ছিলেন না। তিনি বহু নারীতে গমন করেছেন। বহু নারীর গর্ভে তাঁর সন্তান।

যুধিষ্ঠিরের জ্ঞানবত্তা শ্রদ্ধাজনক, কিন্তু দ্রৌপদী পতিরূপে তাঁকে ভাবিনি কখনো। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হিসেবে,

জ্ঞানী মানুষ হিসাবে তাকে শ্রদ্ধা করেছিলেন মর্যাদা দিয়েছিলেন, কিন্তু স্বামীত্বের আসনে কখনো বসাননি। তথাপি সেই জ্যেষ্ঠ মানুষটার লালসা তাঁকে মেটাতে হয়েছিল শরীর দিয়ে। 

ভীমসেন  পাঞ্চালদেশে যাবার পূর্বেই আরণ্যক কন্যা হিড়িম্বাকে গান্ধর্ব মতে বিবাহ করেছিলেন এবং ঘটোৎকচ নামে তাদের একটি পুত্রও ছিল । তবে যতবার দ্রৌপদী বিপদে পড়েছিলেন , এই মধ্যম পান্ডবই একমাত্র তাঁর সন্মান রক্ষা করেছিলেন। অন্য চার স্বামী নয়। সর্বস্বান্ত হয়ে  বনবাসে যখন দ্রৌপদী সহ পঞ্চপান্ডব একসাথে, একদিন যুধিষ্ঠির ধর্মের অমোঘ বাণী শুনিয়ে দ্রৌপদীকে ঈশ্বর সম্পর্কে তাত্ত্বিক আলোচনা ব্যাখ্যা করতে বসলেন। ভীমসেন থাকতে না পেরে সেদিন বলেছিলেন "এত তত্ত্ব কথা তোমার কোথায় ছিল সেদিন, যেদিন তুমি পাশা খেলতে বসেছিলে আর স্ত্রীসহ সবকিছু পণ রাখলে, আর আজ তোমার জন্য আমাদের রাজসুখ ছেড়ে বনে বাদাড়ে ঘুরতে হচ্ছে"?

দ্যূতসভায় সর্বস্ব খুইয়ে যুধিষ্ঠির যখন দ্রৌপদীকে পণ রাখলেন তখন সে একবস্ত্রা, রজ:স্বলা ; লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়ে তাঁকে আসতে হল সেখানে, যেখানে একপাল নীতিবাগীশ, নপুংসকের দল বসে উপভোগ করছেন  তাঁর লজ্জায় ডুবে যাওয়ার চরম মূহুর্ত,  লাঞ্ছনার প্রতিটি দন্ড, প্রতিটি পল।   সেই অপমান  রাজবধূ, রাজনন্দিনীর কি  প্রাপ্য ছিল? চুলোয় গেল রাজেন্দ্রাণীর পদমর্যাদা, ঘুচে গেল স্বপ্ন, রসাতলে গেল তাঁর ইজ্জত। পদ্মপলাশ অক্ষি, কুঞ্চিত দীর্ঘ কেশ, সর্বাঙ্গসুন্দরী  কৃষ্ণাকে নিয়ে জম্বুদীপের ইতিহাসে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মত টানা হেঁজড়া করা হল । সেই কালোমেয়েটার রূপের অহঙ্কার মাটিতে মিশে গেল । একদল অতি বৃদ্ধ, বৃদ্ধ, প্রৌঢ়, যুবক তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন তাঁর লাঞ্ছনার সে সব দৃশ্য। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ, আর ভীষ্ম, বিদূর, দ্রোণেরা মনে প্রাণে ছিলেন চির-অন্ধ। ঘৃণায় ভরিয়ে দিলেন যুধিষ্ঠিরকে আরো একবার।  নারী চোখের চিরায়ত ইশারায় সাড়া দিলেন না অর্জুন। মনে মনে ধিক্কার দিলেন তাঁকেও।

 ভীমসেন মূহুর্তের জন্যে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন। বারে বারে মন ছুঁয়ে গেলেন। কৌরবদের অট্টহাসিতে দাসীরূপে বন্দী হল  কৃষ্ণা আর কর্ণ নিলো প্রতিশোধ! স্খলিত ঊর্ধাঙ্গের বসন, লজ্জারূপ ভূষণ, জলাঞ্জলি ততক্ষণে। একপাল লোলুপ লোভাতুর চোখ তাঁকে গিলছে তখন। ক্লীবেদের বোধবুদ্ধি তখন ভেসে চলে গেছে নদীমাতৃক জম্বুদ্বীপের মোহানায়, গড্ডলিকা প্রবাহে। এমনকি দানবীর মহামতি কর্ণ, তাঁরও ব্যতিক্রম ছিলো না। নতুন সমাজ গড়বে কারা? সেদিনই কৃষ্ণার মোহ ভঙ্গ হয়। নতুন দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়বে এই মানুষগুলো? ধর্ম-অধর্ম, ইহকাল-পরকাল সবকিছুর বিসর্জন সেই মূহুর্তে। দুঃশাসন দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ করে সকলের সম্মুখে নিয়ে এসে একে একে তাঁর বস্ত্র উন্মোচিত করতে শুরু করলেন ...  আর সেই স্বয়ংবরসভার প্রতিশোধ সেদিন নিলো কর্ণ? দ্রৌপদীকে বেশ্যা-বারাঙ্গনা বলে কারণ  দ্রৌপদী তো "নাথবতী অনাথবৎ"। বিরাটের রাজসভায়  যখন ছদ্মবেশে সেদিনও কীচকের লোভাতুর চোখ থেকে দ্রৌপদীকে বাঁচিয়েছিলেন ভীম।

নকুল-সহদেব তো বড়দের ছত্রছায়ায় আজন্মকাল অতিবাহিত করলেন নাবালক ভ্রাতার মতো।

কাব্যে উপেক্ষিতর মত‌ই রয়ে গেলো তাঁরা। কৃষ্ণা তাদের ভ্রাতৃসম দেবররূপেই দেখতো। কিন্তু নকুল ও সহদেবেরও যৌন-লালসা মেটাতে হয়েছিল দ্রৌপদীকে তাঁর শরীর দিয়ে । তাঁর নারীত্বের চরম লজ্জা সত্বেও মেনে নিয়েছিলেন ।

অর্জুন হয়ত চেয়েছিল কৃষ্ণাকে ভালোবাসতে একান্ত নিজের করে নিতে কিন্তু চার ভাইয়ের লোভ তিনি চাক্ষুষ দেখেছিলেন। সেই অভিমানে পাঞ্চালীর প্রতি নীরব ঔদাসিন্য দেখিয়েছিলেন বরাবর। যুধিষ্ঠিরের সাথে অস্ত্রাগারে যেদিন  দ্রৌপদী বক্ষলগ্না মৈথুনরত ; রতিক্রীড়ায় উন্মত্ত যুধিষ্ঠির সেদিন তাঁকে নিয়ে মেতে রয়েছেন রাজপুরীর নিভৃতে। নারদমুনির নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ধনুর্বান আনার অছিলায় অর্জুন প্রবেশ করলেন সেখানে। ফলস্বরূপ নিয়মভঙ্গ হেতু বারোবছরের বনবাস আর ব্রহ্মচর্য যাপন। সেই মূহুর্তে অর্জুনের পরম কাঙ্খিত ছিল। যাতে রাজপুরী ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে তিনি যৌবনের স্বাদ গ্রহন করতে পারেন। যৌবনের উন্মাদনায় বহুস্বামিনী কৃষ্ণাকে সেদিন ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না করে চলে গেছিলেন রাজপুরী ছেড়ে বহুদূরে। পাঞ্চালীর একেশ্বরাধিপতি না হতে পারার ক্রোধে আর কামাগ্নি নির্বাপনের জন্য একে একে নাগরাজ কন্যা উলুপী, মণিপুরের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা আর সব শেষে দ্বারকায় কৃষ্ণের ভগিনী সুভদ্রাকে বিবাহ করে হস্তিনাপুরের প্রাসাদে এনেই তুললেন।  উলুপীকে তিনি দিয়েছেন ইরাবান নামে এক সন্তান, চিত্রাঙ্গদার শরীর চিনে তাকে গোপনে দিয়েছেন বভ্রূবাহন আর  সুভদ্রার কোলে এল অভিমন্যু। তিন নারীর উদ্দাম শরীরী ঝঞ্ঝায় উড়ে গেছিল অর্জুনের প্রতিজ্ঞা । এর পরেও দ্রৌপদীর মতো আত্মসম্মান-চেতনা সম্পন্ন নারীর পক্ষে কি  অর্জুনকে  ভালবাসা সম্ভব?

কিন্তু যাকে বলে ভালবাসা, সেই ভালোবাসার মর্যাদা-সন্মান কোনদিনও তিনি পাননি।

 

অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ
চুঁচুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top