সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

প্রভু জগন্নাথকে বাড়ি পাঠাতে লুঠ করা হত তাঁর খাবার"-  গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা : সৌম্য ঘোষ


প্রকাশিত:
১২ জুলাই ২০২১ ২০:৫৬

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৪:৩৮

 

পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ার সুবিখ্যাত রথযাত্রা উৎসবের প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রভু জগন্নাথের ভান্ডার লুঠ। বাংলার রথের মধ্যে প্রাচীনতম হিসেবে মাহেশের পরই যার নাম ভেসে আসে সেটা হল গুপ্তিপাড়ার রথ। এই রথ প্রতিষ্ঠা হয় আনুমানিক ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে।              

গঙ্গার তীরে গুপ্তিপাড়া এক সুপ্রাচীন জনপদ। হুগলী জেলার সীমান্তে থেকে পূর্ব বর্ধমানকে আলিঙ্গন করে নেয় এই গুপ্তিপাড়া। গঙ্গার অপরপ্রান্তে নদীয়া জেলার শান্তিপুর। কাজেই এই রথকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় লক্ষাধিক ভক্তের সমাগম হয়। গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রায় পরতে পরতে চমক। ঠিক উল্টোরথ অর্থাৎ মহাপ্রভু শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি থেকে পুনর্যাত্রার আগের দিন হয় ভান্ডার লুঠ উৎসব। ভান্ডারে থাকে ১০৮ রকমের নিরামিষ পদ। 

স্বামী পিতাম্বরানন্দ মহারাজ এই সুপ্রাচীন রথের প্রতিষ্ঠাতা। ১৩ চূড়া বিশিষ্ট এই রথ ছিল ঠাকুরের স্বপ্নাদেশে। তখনকার দিনে জগন্নাথ দর্শন করতে পুরীতে যেতে হতো অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে যাওয়া, অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়তেন, কেউ রাস্তায় লুটেরাদের হাতে পড়ে সর্বস্ব খোয়াতেন। কেউ ফিরতেন, কেউ ফিরতেন না। তবুও ভক্তরা প্রভু জগন্নাথদেবের টানে সুদূর পুরীর শ্রীক্ষেত্র গমন করতেন। 

ভক্তদের এই দুর্দশা দেখে গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র জিউ মঠের মহন্ত পিতাম্বরানন্দ মহারাজ খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনিই তখন এই রথের প্রতিষ্ঠা করেন। এই রথের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা সারা দেশে খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন, এই রথ দীর্ঘতম পথ অতিক্রম করে। চারদিকেই তার গতি। প্রথমে পূর্ব, সেখান থেকে পশ্চিমে; তারপর উত্তর দিক ধরে সোজা মাসির বাড়ি। আবার উল্টোরথের দিন দক্ষিণ দিক ধরে আবার যথাস্থানে ফিরে আসে রথ।

এই ভান্ডার লুঠ নিয়ে দুটি প্রবাদ আছে। প্রাচীন মতে বলা হয়, জগন্নাথদেব মাসির বাড়িতে এসে এত খাবারের আয়োজন দেখে কিছুতেই বাড়ি ফিরতে চাননা। এতে সন্দেহ হয় লক্ষীর। তাই প্রথমে সর্ষে পোড়ানো হয়। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না দেখে ঠিক করা হয় 'ভান্ডার লুঠ' করা হবে। তাই পুনর্যাত্রার আগের দিন প্রভু বৃন্দাবনচন্দ্র এবং কৃষ্ণচন্দ্রর নির্দেশে প্রথমে পুজোপাঠ করে শঙ্খ ধ্বনির মাধ্যমে মাসির বাড়ির যে ঘরে প্রভু থাকেন, সেই ঘরের তিনদিকের তিনটি দরজা একে একে খুলে দেওয়া হয়। 

বাইরে তখন লেঠেলরা দাঁড়িয়ে। তারা এসে ওই ১০৮ রকমের পদ, যেখানে অন্ন থেকে পরমান্ন সঙ্গে মিষ্টান্ন সবই থাকে, তা লুঠ করেন। সব লুঠ হয়ে যাওয়ার পর জগন্নাথদেবের আর বাড়ি ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। কি খাবেন শুধু খই মুড়ি? তাই বিমর্ষ মুখে তিনি বাড়ি ফিরে যান। লক্ষীও মহা খুশি। 

 অপর প্রবাদটি হলো, সেকালে জমিদারদের লেঠেল নিয়োগের পদ্ধতি ছিল এই ভান্ডারলুঠ। যে সমস্ত লেঠেলরা ভান্ডার লুঠ করতে পারবেন তাদেরই নিয়োগ করা হতো। এই জনশ্রুতি আজও সেখানকার লোকের মুখে মুখে ঘোরে। রথযাত্রার চারদিনের মাথায় মাসির বাড়িতে সর্ষে পোড়ানো উৎসবও হয়, যাকে চলতি কথায় বলা হয় লক্ষী বিজয় উৎসব। এই গর্বগাঁথা নিয়েই বেঁচে থাকেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ার বাসিন্দারা। 

 

সৌম্য ঘোষ
চুঁচুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top