সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

গরম ভাত : শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
১২ জুলাই ২০২১ ২১:৪৭

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৬:২৭

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে সমস্ত ছোটখাটো ব্যবসায়ীর কপাল খুলেছিল সেরকম একটা মস্ত গৃহস্থ বাড়ির শান বাঁধানো প্রশস্ত উঠোনে বসে কাঁদছিল একটি বছর সাতেকের মেয়ে। কাঁদতে কাঁদতে ক্রমাগত নিজের ছড়ানো পা দু’খানা ঘষে যাচ্ছিল উঠোনে। ঘষা খেতে খেতে গোছের বাইরের দিকের চামড়া ছড়ে বিন্দু-বিন্দু রক্ত ফুটে উঠেছিল। সেই জ্বালাই হয়ত কান্নার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে যাচ্ছিল। তবে কান্নার আসল কারণটা শারীরিক নয়।

উঠোন দিয়ে অনেকেই পার হচ্ছিল। হেঁসেলের দিকে মধ্যাহ্নভোজনের ডাক পাওয়া ছেলেমেয়ের দল চলে গেল। মাও বার কয় এদিক-ওদিক কাজের তাগিদে মেয়ের পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলছে, হিক্কা উঠছে। অথচ কারও ভ্রূক্ষেপ নেই। তবু সামান্য ভ্রূক্ষেপ পাওয়ার চেষ্টার বিরাম নেই।

না, মা এলেন। যে পিঠখানা স্নেহস্পর্শের অপেক্ষায় ছিল, তাতে একটা বিরাশি সিক্কা বসিয়ে হাত ধরে হ্যাঁচকে টান, “চল খেতে চল। আদিখ্যেতা না? রোজ রোজ ন্যাকামো। যমের অরুচি সব! ভাত জুড়িয়ে গেল।”

এটা প্রায় প্রাত্যহিক ঘটনা। মেয়েটির বড় বৌদি তথা সে যাবৎ একমাত্র বৌদি চাঁপা দুপুরের ভাত বেড়ে বাড়ির সমস্ত ছোটদের “মেজ ঠাকুরপো, সেজ ঠাকুরপো, হেবো, অপু, বাবলু, রবি” ইত্যাদি সম্বোধনে ডাক দেয়। একমাত্র সাবিত্রীর নামটা প্রতিদিনই উহ্য থেকে যায়। সে বৌদির সঙ্গে ভাব জমানোর অনেক চেষ্টা করেছে। তবু কেন যে বৌদি সাবুর ওপর প্রসন্ন নয় বোঝা দায়। এটাই তার অভিমানের কারণ। একবার নাম ধরে ডাকলে যেখানে সে খুশি হয়ে ছুটে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েই থাকে, সেখানে “সাবু তোরা আয়” বাক্যটি কোনওদিনই উচ্চারিত হয় না। তাই পায়ের ছাল না ছাড়িয়ে, মায়ের মার বকুনি না খেয়ে এবং মাঝেমাঝে বাবার রক্তচক্ষু না দেখে কোনওদিনই বলতে গেলে সাবিত্রীর দ্বিপ্রাহরিক আহার উদরস্থ হয় না।

গরম ভাত বড় প্রিয় সাবুর। গরম ভাতের পাতে নুন ঘি আর মুচমুচে পোস্তর বড়া পড়লে আর কিছু না হলেও চলে। অথচ রোজই মান-অভিমানের পালা শেষে যখন খেতে বসে তখন বেড়ে রাখা ভাত জুড়িয়ে জল হয়ে যায়। ঐ বস্তুই বাবা বাড়ি ফেরার আগে শেষ করতে হয়। বাবা আর বড়দা কারখানা থেকে দুপুরে ফেরার আগে বাড়ির ছোটদের খাওয়া-দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে রাখা দস্তুর। বাবা এসে সাবিত্রীর দেরি করে খাওয়ার বৃত্তান্ত শুনলে তক্ষুণি চটি হাতে তুলবেন। ছোট্ট সাবুর বুকটা শেষটায় তাই অভিমানের বদলে ভয়ে ঢিপ্‌-ঢিপ্‌ করতে থাকে। আদিখ্যেতা পছন্দ না করলেও শেষ কটা গ্রাস তাই অনেক সময় বিপত্তারিণী মাকেই গিলিয়ে দিতে হয়।

দুপুরে খাওয়ার পর ছুটির দিনে ঘুমোনোর কথা। কিন্তু দুপুরবেলাটা নষ্টামি না করলে তো বাচ্চা নামের কলঙ্ক। ফলাফল সন্ধ্যার কোলে চোখ ঢুলুঢুলু। পড়তে বসে মেজদা আর ছোড়দার বাচনিক ও শারীরিক শাস্তি। রাতে খেতে যাওয়ার ছুটি পাওয়ার জন্য তখন উন্মুখ হয়ে থাকে সাবিত্রীরা। পড়াশুনো আর শাসন থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার তাড়নায় নাম ধরে ডাকা না ডাকা নিয়ে মাথা ঘামানোর উপায় থাকে না। তাছাড়া কোনও কোনও দিন রাতের খাবার পরিবেশিত হওয়ার আগে ছোটরা ঘুমিয়েই পড়ে। ঘুম থেকে টেনে তুলে তাদের রান্নাঘরে সার বেঁধে বসিয়ে দেওয়া হয়। বড় বৌদি কার নাম করল বা করল না সেটা অমীমাংসিতই থেকে যায়।

আট সন্তানের জননী স্নেহলতাদেবী। আর একটা পেটে। সবকটি বেঁচে থাকলে এতদিনে ষোলোজন হোত। মা ষষ্ঠীর কৃপায় পেটেরটা ঠিকঠাক ভূমিষ্ঠ হলে নবরত্নসভা পূর্ণ হয়। আগামীটি তার ভাইপো বা ভাইজির চেয়ে মাস তিন-চার ছোটই হবে, কারণ স্নেহলতার সতেরো বছরের বড় পুত্রবধূটিও আসন্নপ্রসবা।

বছর বছর সন্তানধারণ হেতু বমি করতে করতে স্নেহলতা রুচি করে খাওয়া ব্যাপারটা ভুলেই গেছেন। পেটের শত্রুগুলোর কথা ভেবে যা একটু গলদ্ধকরণ করে থাকেন। খাওয়া দাওয়া নিয়ে তাঁর কোনও শৌখিনতা নেই, থাকার উপায়ও নেই। তাই খাওয়ার মতো আবশ্যিক স্থূল ব্যাপার নিয়ে ধাষ্টামো, তাও আবার মেয়েমানুষের, তাঁর সহ্য হয় না। বড় বৌ চাঁপার গোঁ-টা যে তিনি সমর্থন করেন তা নয়, কিন্তু কিছু বলতে বাধো বাধো লাগে। কারণ বড় পেট নিয়ে হেঁসেলের তদারকিটা চাঁপাই করে। যদিও ঠাকুর যোগানদার সবই আছে, তবু ব্যবস্থাপনা তো রয়েছে। তাছাড়া শাশুড়ি আর বৌ একসাথে পোয়াতি হলে লজ্জাটা শাশুড়িরই।

সকাল সকাল জলখবার খেয়ে খেলতে বেরিয়ে প্রাণের বন্ধুকে না পেয়ে সাবিত্রী বাড়ির পেছন দিকের ফটক খুলে পাড়াতুতো এক কাকিমার কাছে আড্ডা মারতে গেছে। কাকিমার তিন ছেলে। সাবুর খেলার সাথী কেউ নয়। তবে কাকিমা নিজেই সাবুর গল্প করার সঙ্গী। ছোট্ট কুঁড়ে ঘর। গোবর-মাটিতে লেপা উঠোন। চ্যাটার্জী বাড়ির সঙ্গে বৈপরীত্য দারুণ প্রকট। তবু দাওয়ায় বসে পা ঝুলিয়ে বসে গল্প করাটা যে সাবিত্রী কী উপভোগ করে! বাড়িতে চপচপে তেল আর ভাজাভুজি ছাড়া মুড়ি রোচে না। আর এখানে শুকনো মুড়িও একদানা একদানা করে তারিয়ে তারিয়ে খায় যাতে ঝট করে ফুরিয়ে না যায়। আসলে বাটির মুড়িটা অলিখিত বালিঘড়ি কিংবা স্টপ ওয়াচের মতো। ওটা ফুরোলেই যেন সাবিত্রীর গল্প করার সময় অতিক্রান্ত হবে।

গৃহকর্ত্রী একটা বছর খানেকের শিশু কোলে নিয়ে উনুনের সামনে কাজ করছে। বাচ্চাটি কর্মরতা মেয়ের আঁচলের আড়ালে মুখ ঢুকিয়ে চুক-চুক করে রসদ সংগ্রহ করছে। সেই অবস্থাতেই মা একটা ভারি হাঁড়ি নামাল উনুন থেকে। বাহুদুটির শক্তি আছে বলতে হবে। কোলে বাচ্চা নিয়ে অত বড় হাঁড়ি মাটিতে বসে বসে নামানো চাট্টিখানি কথা নয়।

একটু পচা পচা গন্ধ পাচ্ছিল সাবিত্রী। কাকিমা ভাতের ফ্যান গালার সময় বুঝতে পারল ঐ বিশ্রী গন্ধটা আসছে ভাত থেকেই। সাবিত্রীর বাড়িতে একবার এমন গন্ধযুক্ত চাল এসেছিল। মা বলেছিল ধান সেদ্ধ করার গলদ থেকেই নাকি এমন বদখচ গন্ধ হয় চালে। সেই ভাত কেউ মুখে তোলেনি। সঙ্গে সঙ্গে বস্তাশুদ্ধ চাল ফেরত গিয়েছিল দোকানে। দুপুরটা অতঃপর গোবিন্দভোগ দিয়ে কোনওরকমে চালানো হয়েছিল।

গিন্নি কোলের শিশুটিকে ভেতরে শুইয়ে এসে ভাত বাড়তে বসল।

“এখন কটা বাজে? তোমরা এখনই ভাত খাও বুঝি?” সাবিত্রীর জিজ্ঞাসা।

কাকিমা তিনটে থালায় চুপচাপ ভাত বাড়তে লাগল।

“তোমরা জলখাবার খাও কখন? চা করো না? আমাদের বাড়িতে তো সকালবেলা তিনবার চা হয়। লোকজন এলে আরও কতবার হয় তার ঠিক নেই।”

“তোমাদের হল রাজা উজিরের বাড়ি। আমাদের সঙ্গে তুলনা চলে?” কাকিমার উত্তর।

“আমার বাবা মোটেই রাজা উজির নয়, ব্যবসায়ী। আচ্ছা, ঐ পচা গন্ধওয়ালা ভাত তোমরা খেতে পারবে? চালটা বদলাতে পারো না?”

কাকিমা উত্তর না দিয়ে থালা তিনটি ভাতে চূড় করে সাবিত্রীকে একটা অ্যালিমিনিয়ামের বাটিতে শুকনো মুড়ি দিল।

খাওয়ার জন্য কাউকেই ডাকতে হল না। কাকু উঠোনেই একটা খাটিয়ায় চোখ বুজে শুয়েছিল। ভাতের গন্ধে নিজেই উঠে এল। ছেলেদুটো উঠোনে মার্বেল খেলছিল। খেলা ফেলে দাওয়ায় উঠে পড়ল। তাদের ভাত একই থালায় বাড়া হয়েছে।

মুড়ি চিবোতে চিবোতে সাবিত্রী দেখল ওরা চারজন খেতে বসেছে। সবকটি থালায় একেবারে বেড়াল ডিঙোনো পরিমাণ ভাত স্তূপীকৃত। পাতের পাশে নুন কাঁচালঙ্কা। সঙ্গে উচ্ছে কিংবা করলা ভাজা, প্রথম পাতের পক্ষে অনেকটাই। নিশ্চই এরপর আরও তরকারি ডাল মাছ কিছু আসবে, যদিও দাওয়ার এক কোণের ঐ হেঁসেলে সে রকম আয়োজন চোখে পড়ল না।

সাবু দেখল ওরা উচ্ছেভাজা দিয়ে ভাত মাখছে না, মাখছে কেবল নুন দিয়ে। আর একদলা ভাতের সঙ্গে এক কুচি উচ্ছেভাজা মুখে পুরছে। তারপর কাঁচালঙ্কায় কামড়। পরবর্তী পদ কী দেখার জন্য সাবু মুড়ির বাটি হাতে তাকিয়ে রইল। কিন্তু অবাক হয়ে দেখল মা-বাবা থেকে দু-আড়াই বছরের বাচ্চাটা পর্যন্ত পরম তৃপ্তি সহকারে অতখানি করে ভাত শুধু তেতোর টাকনা আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে। একই পাতে খাওয়া বাচ্চাদুটোর মধ্যে আবার টাকনার ভাগ নিয়ে কাড়াকাড়িও লাগছিল মাঝেমধ্যে। সাবুর মনে হল পোলাও কোর্মাও বোধহয় মানুষ এত পরিপাটি করে খেতে পারে না।

নিজের খাওয়া ভুলে ঐ পরিবারটির ভোজনতৃপ্তি হাঁ করে দেখতে দেখতে কেমন আচ্ছন্ন মতো হয়ে গিয়েছিল সাবিত্রী। অজান্তেই চোখদুটো আর্দ্র হয়ে এসেছিল। ঘোর কাটল মাথায় গাঁট্টা খেয়ে। ছোড়দি।

“কী রে, পরের বাড়ি বেলা বারোটা পর্যন্ত বসে থাকলে চলবে? তোর নিজের নাওয়া খাওয়া নেই?”

“মাথায় মারলি কেন? এখন কি বারোটা বাজে?”

“বেশ করেছি। সারা বাড়ি খোঁজ খোঁজ, সাবু কই? না তেনার এখনও পাড়া বেড়ানো শেষ হয়নি। চল।” বোনের মাথায় ফুঁ দিল গায়িত্রী, নইলে রাতে বিছানা ভেজার আশঙ্কা।

সাবিত্রীরও খোঁজ রাখা হয় তাহলে। সে চুপচাপ দিদিকে অনুসরণ করল। সারা রাস্তা একটাও কথা বলেনি। অত অকিঞ্চিতকর উপকরণে, এমন একটা পদ – তেতো যা কিনা ওদের বাড়ির ছোটদের প্রথম পাতে জোর করে খাওয়ানো হয় পরে মাছ মাংস চাটনির লোভ দেখিয়ে, তাই দিয়ে একটা দু’ বছরের শিশুও বিনা বাক্যব্যয়ে পুরো ভাতটা খেতে পারে! এবং খেয়ে তৃপ্তও হতে পারে? নিজের অভিমান আর বায়নার জন্য কেমন যেন অপরাধবোধ হচ্ছিল। কান্নার চোরা দমকে চোয়াল ও গলা ব্যথা করছিল।

বাড়ি ফিরে প্রথমে খুব সংক্ষেপে পুকুরে স্নান সারল। এটা ব্যতিক্রম। অন্যদিন ঝাঁপাইযুদ্ধ শেষই হতে চায় না। হাতে বেড়াল ঠেঙানো লাঠি নিয়ে পিসিমা ঘাটে হাজির না হওয়া পর্যন্ত ছোটদের সাঁতার কাটা, জলকেলির বিরাম থাকে না। স্নান সেরে কাচা জামাপাপড় পরে নিজেই রান্নাঘরে ঢুকল বৌদির ডাকাডাকি শুরু হওয়ার আগে। সবার জন্য আসন পেতে জল গড়াল। তারপর নিজের জায়গায় বসে পড়ল, “বৌদি ভাত দাও।”

পল্টুরা যদি শুধু তেতো দিয়ে সোনা হেন মুখ করে ঐ দুর্গন্ধযুক্ত ভাত খেয়ে পেট ভরাতে পারে, তাহলে গরম ভাতের সঙ্গে শুক্তো, পোস্তর বড়া, মাছের ঝোল, চাটনি, পাঁপড়, দই ইত্যাদি পরিবেশিত হলে নাম ধরে না ডাকলেও খেয়ে নেওয়া কর্তব্য। সাবুর ক্ষুদ্র হৃদয় এই নতুন উপলব্ধিতে দ্রব হয়ে আছে। চোখ তার অনিচ্ছাতেও বারবার ছলছলে হয়ে যাছে।

বড় বৌ দেখল অভিমানিনী ননদটি তার কৌশল বদলেছে। বৌদির ডাকাডাকির তোয়াক্কা না করে আগে থেকে বসে ভাবছে খুব জিতে গেছে? আচ্ছা!

তখনও বাকিরা এসে পৌঁছয়নি। চাঁপা অন্যান্যদের উদ্দেশ্যে হাঁক পেড়ে সবার ভাতের থালা সাজাতে বসল। বাকি ননদ দেওররা এল। বড় বৌ একে একে সবাইকে পরিবেশন করতে লাগল ধীরে ধীরে। সাবিত্রীর থালাটা শুধু ভাত বেড়ে ফেলে রাখল। সবাইকে দিয়ে-থুয়ে সাবুর পাতে বাকি পদগুলো সাজিয়ে যখন থালা বাড়িয়ে দিল, ভাতের ভাপ ওঠা গরমটা ততক্ষণে কেটে গেছে।

সাবিত্রীর ছলছলে চোখে এবার বাণ ডাকল।     

 

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top