সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

ডিঙ্গি নৌকো এবং দুটি প্রাণ : মাহবুব সুফিয়ান


প্রকাশিত:
১৫ জুলাই ২০২১ ২০:০৯

আপডেট:
১৭ জুলাই ২০২১ ০২:৪১

ছবিঃ মাহবুব সুফিয়ান

 

আজ শাপলার মনটা বেশ অন্যরকম। কেন অন্যরকম লাগছে, তা শাপলা নিজেও বুঝতে পারছে না। তাই শাপলার বেশ অস্বস্তি লাগছে। টেবিলে বেশ কয়টা জরুরী ফাইল পরে আছে। তথাপি শাপলার আজ ইচ্ছে করছে না ফাইলগুলো দেখতে। এর মধ্যে বেশ ক’বার ফোন এসেছে। কেন জানি, ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না শাপলার। মনে মনে শাপলা ভাবছে আজ কাউকে ফোনে এন্টারটেইন করবে না। খুব প্রয়োজন থাকলে অফিসে এসে দেখা করুক, এমন মনোভাব। এরই মধ্যে আবারো ফোন আসে। ফোনটা রিসিভ করতে গিয়েও ফোনটা ধরলো না শাপলা। বেশ অস্বস্তি পেয়েছে তাকে। মনটা কেন যে বিষন্ন, তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা কররো সে।  তাই ভাবছে কি করলে মনটা তার ভালো হয়ে যাবে। আচ্ছা, একটা কাজ করেল কেমন হয়, মার্কেটে গিয়ে কিছু কেটা কাটা করলে নিশ্চয়ই মনটা ভালো হতে পারে। ভাবলো, অফিস শেষে সোজা নিউমার্কেটে গিয়ে দেখবে নতুন কিছু কাপড় আসলো কিনা। কয়েকটা থ্রিপিছ কেনা যেতে পারে। আবার মনে হলো এতগুলো টাকা খরচ করে কি লাভ হবে। শাপলা অবাক হয়ে খেয়াল করলো, বেশ কিছুদিন হলো মনের অবস্থা ভালো নেই। কেন ভালো নেই তারও কোন উত্তর খোজে পাচ্ছে না শাপলা। উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় কাটছে বেশ কিছু দিন। বিষন্নতাও পেয়ে গেছে তাকে। আচ্ছা একজন মনোচিকিৎসককে দেখালে কেমন হয়, মনে মনে ভাবলো শাপলা। এভাবে মন খারাপ থাকলে তো শরীরও খারাপ করবে। শরীরটাকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে কি কোথাও মনোচিকিৎসক বসেন, কোথাও তো কোনদিন সাইনবোর্ড দেখিনি। মানুষ তো এখনো মানসিকভাবে অসুস্থ হলে চিকিৎসকের স্মরনাপন্ন হন না। সে জন্য অবশ্য অজ্ঞতা দায়ি। অবশ্য অর্থনৈতিক অবস্থাও সে জন্য বেশ দায়ি। আচ্ছা ঠিক আছে, আজ শপিং করেই চেষ্টা করি মন ভালো করার। শপিং করে মনটা ভালো হলে তো বেশ। কিছু কাপড়ও কিনা হলো, মাঝখান থেকে মনটা ভালো হয়ে গেলো। তবে মনের অবস্থা বেশি খারাপ হলে পরে একদিন ঢাকায় গিয়ে একজন মনোচিকিৎসককে দেখালেই হবে। এমন ভাবনার মধ্যেই আবারো ফোন বেজে উঠে। এবার ফোনটা রিসিভ করলো শাপলা-

হ্যালো, কে বলছেন প্লিজ? অপর পাশ থেকে উত্তর আসে, আমি লাবীব।

শাপলা: ও আচ্ছা। তা তুমি কেমন আছো? বলো কেন ফোন দিলে?

এমন প্রশ্নে লাবীব কিছুটা হতচকিত হলো; বললো, না, এমনিই, তুমি কি এখন ব্যস্ত?

শাপলা উত্তর দিল, না না, কেন? এমন প্রশ্ন করে শাপলা নিজেই খুব অবাক হয়ে গেলো। মনে মনে ভাবলো, লাবীব অপরিচিত কেউ না। অতি কাছের একজন বন্ধু। সে নিজ থেকে ফোন দিল, আর আমি তাকে এমন প্রশ্ন করলাম। আমার কি যে হলো! হে সৃষ্টিকর্তা, তুমি আমাকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করো শীঘ্রই। না হলে আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাবো। এখন নিজের প্রতি তার বিরক্তি এলো। ছিঃ, আমি কি করছি। দিন দিন আমার আচার আচরণ নিচ হয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুদিন হলো স্বাভাবিক কোন আচরণ করতে পারছি না। সব সময়ই মনে হয়, নিজেকে সবার কাছ থেকে আড়াল করে রাখি।

লাবীব একটু হেসে উত্তর দিল, বন্ধু তুমি মনে হয় আজ বেশ চাপের মধ্যে আছো। থাক, ফোন রাখি। পরে কথা বলবো। শাপলা বন্ধুর এমন কথায় কিছুটা আহত হয় এবং বন্ধুকে নিজের এমন প্রশ্ন করার হেতু না পেয়ে নিজেই নিজের উপর মনে মনে ধিক্কার দেয়। নিজেকে কিছুটা সংবরণ করে স্বভাবসুলভ মিষ্টি হেসে বলে, না বন্ধু, কাজের তেমন চাপ নেই। তবে মনটা ভাল নেই। বেশ কিছুদিন মানিসিক চাপে ভুগছি। আর নিজেকে নিজেই সে বললো, লাবীব তুমি ফোন দিলে তো আমি এই শাপলার মনের চাপটা আরো বেড়ে যায়।

 তারপর শাপলা লাবীবকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা বলো, তুমি কেমন আছো? অনেকদিন তোমার সাথে কথা হয় না। আর দেখা হচ্ছে না তো বেশ কিছুদিন। লাবীব বললো, আমি ভালো আছি। তবে সামনের দিনগুলোতে কতটা ভাল থাকতে পারবো জানি না। আর ফোন দিয়েছি বন্ধু এমনি। কিছুদিন থেকে আমারও মনটা ভালো যাচ্ছে না। তাই তোমাকে ফোন দেয়া। মনে হলো একই শহরে থাকছি, অথচ আমাদের দেখা সাক্ষাত হচ্ছে না। দেখা না হোক, অন্তঃত কথা তো বলতে পারি, নাকি বল? শোন শাপলা, আজ সকাল থেকেই মনটা আজ বেশ উদাস উদাস লাগছে। তাই মনে হলো কোথাও গিয়ে বেড়ালে বোধ হয় মনটা ভালো হতে পারে। আর তুমি যখন এই শহরেই আছো, তাই তোমাকে জানানো। তোমার সময় থাকলে আসো কোথাও বেড়িয়ে আসি। বিকেলটা একসঙ্গে কাটাবো। তাছাড়া বর্ষাটাকে এবার সেইভাবে দেখা হয়ে উঠেনি। এই ধরো নদী, পাল তোলা নৌকা, বিলে ফোটা পদ্ম বা শাপলা ফুল, জেলেদের মাছ ধরা, আরো কত কি? বিশেষ করে শিশু কিশোরদের পানিতে জলকেলি আমার বেশ ভালো লাগে। শহর থেকে দূরে কোথাও গেলে বর্ষার এমন রূপ, সৌন্দযটা ভালভাবে উপভোগ করা যায়। তুমি কি বলো?

আমারো একই মত। আমারো ইচ্ছে করছে দূরে কোথাও বেড়াতে। তোমার এই প্রস্তাব আমার মনের চাহিদার সাথে একেবারে মিলে গেছে। আর তোমার সাথে বেড়াবার ইচ্ছাটাও অনেকদিন ধরে মনের মাঝে আলোড়ন তুলছিলো, তুমি বলাতে সেটা আরো প্রগাঢ় হয়েছে। চলো, আজই বের হই। কোথায় যাবে ঠিক করেছো কি?

লাবীব বললো, আজই? আচ্ছা ঠিক আছে। কোথায় যাবো এখনও ঠিক করিনি। তোমার কি কোন জায়গা পছন্দ আছে, থাকলে বলতো পারো। সুবিধাজনক হলে আজই যাওয়া যায়।

আজই যাবো। হঠাৎ শাপলার মুখ থেকে কথাটা বের হয়ে পরে। লাবীব বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। আমি বিকেল সাড়ে চারটার মধ্যে সব কাজ শেষ করে তৈরি থাকবো। তুমি এসো। দুজন একসাথে বের হবো। কিছুক্ষণ পর আবার বলে, না না, তুমি নিয়াজ পার্কের সামনে বিকেল ৪-৩০ নাগাদ থেকো। আমিও এই সময়ের মধ্যে পৌছে যাবো। ওখান থেকে আমরা দুজন কুরুলিয়া নদীতে নৌকায় করে বেড়াবো, তারপর কোন একটা ভাল রেস্টোরেন্টে রাতের খাবার খাবো, কি বলো? আমার প্লেনটা কি ঠিক আছে? শাপলা বললো, বেশ তাই হবে। আমার মনে মনেও এইরকম একটা প্লেন ছিলো। তোমার সাথে প্রায় ১০০ভাগ কিভাবে মিলে গেলো বলো তো? লাবীব বললো, দেখো আমরা সেই কবে থেকে বন্ধু। তোমার আর আমার বন্ধুত্ব বেশ পুরনো। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ার সময় থেকেই তো এই বন্ধুত্ব। তারপর আমি ভর্তি হলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। আর তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীনও আমাদের বন্ধুত্বের মধ্যে কোন টানাপোড়েন সৃস্টি হয়নি। এতকিছুর মিল থাকার পরও কিন্তু একটা জায়গায়…..। এই তুমি থামলে কেন-শাপলা জিজ্ঞাসা করলো। বলো বন্ধুত্বে আমাদের কোন ঘাটিতি আছে কি? লাবীব কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললো, ফোনে এত কথা বলা যাবে না। আমাদের তো বিকেলে দেখা হচ্ছে। সেই সময়েই বিশদ বলো। শাপলা প্রসঙ্গ আর না বাড়িয়ে বললো, আচ্ছা ঠিক আছে, বিকেল সাড়ে ৪টায় আমাদের দেখা হচ্ছে। তুমি কিন্তু আগে থেকেই এখানে থেকো।

লাবীব বললো, আচ্ছা বন্ধু ঠিক আছে। আমি আগেই চলে যাবো। শাপলা ফোন রেখে কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর হাতের সামনের ফাইলগুলোতে নজর দিলো। ফাইলগুলো দেখতে দেখতে কখন যে চারটা বিশ বেজে গেছে, তার দিকে খেয়ালই ছিল না। ঘড়ির দিকে তাকাতেই তার সম্বিৎ ফিরে এলো, আমার তো বিকেলে লাবীবের সাথে দেখা করার কথা। মনে হতেই সে দ্রুত সব গুছিয়ে পিয়নকে বললো, সামসুল আমি বেরচ্ছি। তুই ৫টার সময় সব গুছিয়ে ভালভাবে তালা মেরে বাড়ি চলে যাস।

সামসুল বলো, জ্বি ম্যাডাম। ঠিক আছে।

 

রিক্সায় উঠেই শাপলার মনটা ভালো হয়ে গেল। রিক্সায় বসেই সে আয়নাটা বের করে নিজের চেহারাটা দেখার চেষ্টা করলো। মুখের অবস্থা দেখে চট জলদি পার্স থেকে ফেস পাউডার মেখে নিল। ভাবলো অনেকদিন পরে লাবীবের সামনে যাচ্ছি, অথচ নিজেকে একটু পরিপাটি করেও এলাম না। তারপর সে গাঢ় করে লাল রঙের লিপিস্টিকটা ঠোঁটে মেখে নিল। আয়না দিয়ে আবার দেখলো নিজেকে, দেখে এবার তার মনে হলো, আগের চেয়ে এখন তাকে ভালো লাগছে। ভালো লাগার পর থেকেই কিছু একটা করতে ইচ্ছে করছে। কি করবে, কি করবে ভাবতেই তার মনে হলো কবিতা আবৃত্তি করা যাক। আচ্ছা কোন্ কবিতাটা আবৃত্তি করা যায়, নিজেকে নিজেই বললো? কোন কবিতাট আমার পুরো মনে আছে? খুজতে খুজতে তার মনে হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতাই বেশ ভালো মনে আছে। তাহলে হয়ে যাক আবৃত্তি, এই বলেই আবৃত্তি শুরু করলো-

আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে
হে সুন্দরী ?
বলো কোন্‌ পার ভিড়িবে তোমার
সোনার তরী ।
যখনি শুধাই , ওগো বিদেশিনী ,
তুমি হাস শুধু , মধুরহাসিনী —
বুঝিতে না পারি , কী জানি কী আছে
তোমার মনে ।
নীরবে দেখাও অঙ্গুলি তুলি
অকূল সিন্ধু উঠিছে আকুলি,
দূরে পশ্চিমে ডুবিছে তপন
গগনকোণে ।
কী আছে হোথায়— চলেছি কিসের
অন্বেষণে ?

আবৃত্তি করতে করতে তার মনে হলো-বেশ শব্দ করেই সে আবৃত্তি করছে। এমন মনে হবার কারণ, রিক্সাওয়ালা কিছুক্ষণ পর পরই তার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। নিয়াজ মোহাম্মদ পার্ক আসতেই রিক্সাওয়ালা যখন বলেলো আফা, কোথায় নামবেন? এই প্রশ্নে তার সম্বিৎ ফিলে এলো। আমরা কি পার্কে এসে পড়েছি? পাবলিক লাইব্রেরিটা কি এখানে? রিক্সাওয়ালাকে সে পর পর জিজ্ঞাসা করলো। রিক্সাওয়ালা বললো, এই যে আফা, এটাই পাবলিক লাইরেবি, অনেক মানুষ পত্তেকদিন বিহালে এহানে আসে। ঐযে দেহেন, কেডা জানি আপনেরে দেইক্কা কাছে আসতাছে। মনে হয় আপনের চেনা-জানা। শাপলা ঐদিকে তাকাতেই দেখে লাবীব তার দিকেই আসছে। সে মনে হয় অনেক আগেই এখানে এসে অপেক্ষা করছে। শাপলা রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে লাবীবের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু যেতে কিছুটা আরষ্টতা দেখা দিলো তার মাঝে। তারপরও এগিয়ে গেল। যেতে যেতে তার মনে হলো লাবীবকে আজ বেশ লাগছে। পাঞ্জাবিতে লাবীবকে আজ দারুন মানিয়েছে।

 

নদী, তার চারপাশের গ্রাম সব মিলিয়ে বেশ ভালো লাগেছে লাবীবের। বর্ষার পুরো সৌন্দর‌্য ধরা দিয়েছে গ্রাম বাংলায়। গাছগুলো বেশ সতেজ। নদীর পানি বেশ টলটলে, পানির দিকে তাকালে নিজের ছবি দারুনভাবে দেখা যাচ্ছে। এমনসব প্রাকৃতিক সৌন্দর‌্য দেখতে দেখতেই শাপলাকে সে বলে, এই শাপলা দেখো, দেখো, কি সুন্দর নীল শাপলা! যেন তোমার মত সুন্দর। শেষের কথাটা নিজে নিজে বললো। শাপলা বললো, দারুন। এই লাবীব শাপলার সৌন্দয্যের কথা বলার পরে তুমি কি জানি বললে, বুঝতে পারিনি। আবার বলো। না না, তেমন কিছু না। লাবীব নিজেকে আড়াল করলো। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললো, শাপলার যতগুলো প্রজাতি বাংলাদেশে পাওয়া যায়, তার সবগুলোই সুন্দর। শাপলা বললো, লাবীব তুমি এ পর্যন্ত কতরকম শাপলা দেখেছো? আমি সাদা, নীল আর লাল শাপলা দেখেছি, উত্তরে লাবীব বললো। আর তুমি কতরকম দেখেছো-লাবীব প্রশ্ন করলো শাপলাকে। উত্তরে শাপলা বললো, যেহেতু আমার নামই শাপলা; তাই এই ফুলের প্রতি আমার আলাদা ফেসিনেশন আছে। এই ফুলকে ভালোবাসার জন্য আমি জলকে পছন্দ করি, জলের মধ্যে যত রকম গাছ জন্মায়, তাদের প্রতিও আমার সম ভালোবাসা। বিশেষ করে শাপলা ফুল। আমি আমার এই জীবনে ৬ রকমের শাপলা দেখতে পেয়েছি। তোমার দেখা তিন ধরণের শাপলা ছাড়াও আমি বেগুনি, গোলাপি এবং হলুদ শাপলা দেখেছি। লাবীব ঐ দেখো পানকৌড়ি, পাখিটা কত সুন্দর না? হা দারুন সুন্দর পাখি, গ্রাম-বাংলার পরিচিত পাখি- বললো লাবীব। আরো বললো, তবে এদের বেঁচে থাকার প্রয়াসটা কিন্তু বেশ জটিল। তারপরও দেখো কত কষ্ট করে ওরা বেশ ভালোভাবে বেঁচে আছে। এই তুমি বেশ ভালোভাবে বলছো কেন, ওরাতো ভাল নেই; শাপলা তার মত দিল। আহার, বাসস্থানের অভাব আর অবাদে শিকারের ফলে আজ ওরা বিপন্ন। এই আলোচনার ফাঁকেই শাপলা দেখতে পেল, তার অতি পরিচিত এবং স্মৃতি বিজরিত রেলব্রীজের কাছে চলে এসেছে নৌকা। তখনই শাপলা বললো, এই যে মাঝি ভাই আপনি ঐযে রেলের ব্রিজটা দেখছেন; সেখানে আমাদের নিয়ে যান। আমি সেখানে একটু যেতে চাই। লাবীব তুমিও চলো। এই কথা বলার সাথে সাথে শাপলার গলাটা ধরে আসছিলো। চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো নিচে। বেশ উৎফুল্ল শাপলা কিছুক্ষণের মধ্যেই কেমন জানি আনমনা হয়ে গেল। লাবীব এমন পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। হতবিহ্বল হয়ে জিজ্ঞেস করলো, আমি দুঃখিত। শাপলা, আমি তো বুঝতে পারছি না, কেন তুমি এতটা ইমোশনাল হয়ে পরলে? আমি কি তেমন কিছু বলেছি, নাকি তোমার শরীরটা ভালো নেই। শাপলা নিজেকে সংবরণ করে বললো, না না, তোমার কোন দোষ নেই, আমার শরীরও ভালো আছে। স্থানটি দেখে আমি একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছি। কারণ ঐ যে রেলব্রীজটি দেখছো, মুক্তিযুদ্ধের সময় ঐখানেই আমার ঠিকানা পাল্টে যায়। নিজের পরিচয়ও প্রায় পাল্টে যায়। কি বলছো বুঝতে পারিনি, বললো লাবীব। শাপলা বললো, না বুঝারই কথা। কেননা এমন ঘটনা বাংলাদেশে বেশ বিরল। তবে আমার এই ঘটনা আমার বাবা-মা ছাড়া কেউ জানে না। আর জানি আমি। তাও বছর কয়েক আগে। যেদিন তুমি আমাকে বন্ধুর চেয়েও বেশি করে পাবার আশা করেছিলে। সে বছর। তাই তোমার প্রস্তাবে আমি তেমন সাড়া দিতে পারিনি। তবে তুমিও নাছোড় বান্দা। এখনো তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করে আছো। লাবীব খানিকক্ষণ শাপলার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে বুঝার চেষ্টা করলো, কিন্তু তেমন কিছু বুঝতে পারলো না। তাই বললো, তুমি যে কি কথা বলছো- তার আগা মাথা আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। একটু কি বুঝিয়ে বলবে। শাপলা বললো, চলো নৌকা থেকে নামি। তুমি আমাকে ভালো করে নৌকা থেকে নামিও। হতবিহ্বল মনের সাথে আমার শরীরটাও খারাপ হয়ে গেছে। মনে মনে ভাবলো- কেন যে এখানে বেড়াতে এলাম! লাবীবকে বললো, মনটা সকাল থেকেই খারাপ, কেন খারাপ বুঝতে পারছি না। লাবীব বললো, আচ্ছা আমি আগে নামছি, তুমি আমায় ভালো করে ধরো। এইযে মাঝি ভাই, নৌকাটা আরেকটু তীরে চাপানতো। মাঝি যথাসম্ভব নৌকাটা তীর ঘেষে রাখলো। লাবীব দেখলো, শাপলা নৌকা থেকে নামার পর থেকে সেই যে হাত চেপে ধরেছে আর ছাড়ছে না। লাবীব ভাবলো, কি হয়েছে আজ শাপলার। অফিসে বা বাড়িতে তাকে কেউ বকলো না তো? হেটে হেটে একটু এগিয়ে যেতেই শাপলা সবুজ ঘাসের উপর বসে পড়লো। আর চিৎকার করে বললো, হে সৃষ্টিকর্তা তুমি যদি আমাকে সৃষ্টিই করেছিলে, কেন এমন চড়াই উৎরাই দিলে আমার জীবনে। জীবনের এই সময়ে আমি কেন কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারছিনা। কোন দিকে যাবো আমি, হে খোদা, হে ভগবান, হে সৃষ্টিকর্তা!!!

শাপলার এমন আচরণে লাবীব বেশ কিছুটা ঘাবরে গেল। শাপলার হাত দুটি চেপে জিজ্ঞেস করলো, আমার মনে হয় তোমার জীবনের অনেক কিছুই আমি জানি না বা তুমি বলোনি। না বলার কারণ তুমি হয়তো আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছো না। শাপলা তুমি কি এতদিন পরেও আমাকে বিশ্বাস করতে পারছো না? তুমি কি আমার উপর ডিপেন্ড করতে পার না? বলো শাপলা, কেন তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এলে, এই জায়গার সাথে তোমার কি সম্পর্ক? শাপলা কিছুক্ষণ কেঁদে নিজেকে খানিক হালকা করে পার্স থেকে পানির বোতল বের করে কিছুটা পানি পান করলো। পানি চোখে মুখেও দিল। দিয়ে হঠাৎ  বেশ কঠিনভাবে লাবীবের দুহাত চেপে ধরে আবার কান্না শুরু করলো। বললো, জানো আমি হিন্দু না মুসলিম তা এখনো জানি না। জন্ম আমার হিন্দু না মুসলিম ঘরে হয়েছে সেটা সৃষ্টিকর্তা জানেন। কিন্তু আমার বর্তমান বাবা বলেছেন, আমাকে নাকি তিনি এই স্থান থেকে পেয়েছেন। জানো তো এই স্থানটি একটি বধ্যভূমি। মুক্তিযুদ্ধকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যে কয়টা স্থানে পাক হানাদার আর এদেশীয় দোসররা বাঙালীদের ধরে ধরে এনে মারতো, সেটা এই জায়গা। ব্রাহ্মণবাড়িযা শহরের বেশকিছু জায়গা বধ্যভূমি। সব মিলিয়ে এ জেলায় ৩৫-৪০টি বধ্যভূমি আছে। তুমি জানো যে, এ জেলায় মোট ৩৪৩টি গনহত্যার ঘটনা ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধকালীন। বেশির ভাগ গণহত্যা ঘটেছে বিজয় ছিনিয়ে আনার পাক্কালে। আমার মা-বাবা, ভাই-বোনসহ আত্মীয় স্বজন সেই সময়ের গণহত্যায় শহীদ হন। আমার বর্তমান বাবা তার বাবা, চাচা, ভাইদের খোঁজ করতে গিয়ে এই যে দেখছো বধ্যভূমি, এখানে এসে আমাকে খুঁজে পান। আমি নাকি তখন এক হিন্দু মহিলার শরীরের উপর হাউমাউ করে কেঁদে যাচ্ছিলাম। তখন  আমি ছিলাম দুধের শিশু্, কিছুই নাকি বলতে পারতাম না। জন্মদাতা বাবার নাম, মার নাম কারোরই নাম জানা নেই আমার। মৃতদের মাঝে আমার সেই কান্নায় আমার প্রতি দরদ হয় বাবার। তিনি আমাকে তার পরিবারে নিয়ে আসেন। আমি সেই থেকে খান পরিবারের সদস্য। সদস্য বললে বেশি হয়ে যায়, বলা যায় আশ্রিত। তবে আমি ধন্য এই জন্য যে, আমার বর্তমান বাবার মতো মহান একজন বাবাকে পেয়েছি। আমার বর্তমান মাও খুব ভালো। তিনি এখনো স্বীকার করেন না যে, আমি তার গর্ভস্থ সন্তান নন। তিনি আমাকে আমার সব ভাই-বোনের মতই ভালবাসেন। তারপরও….। তারপরও কি? জিজ্ঞাসা করে লাবীব। শাপলা উত্তরে ফলে, বাবা তার মহানুভবতা দেখাতে গিয়ে আমার নাম রেখেছেন শাপলা চৌধুরী। কারণ বাবা চেয়েছেন, মুসলিম পরিবারে বড় হলেও আমি যেন নিজ ধর্ম ত্যাগ না করি। কিন্তু আমার অন্য দুই ভাই-বোনের কারোরই নামের টাইটেল চৌধুরী নয়। তারা খান। খান পরিবারের রিপ্রেজেনটেটিভ তারা। আর আমি চৌধুরী পরিবারের। এক ঘরে দুই পরিবারের রিপ্রেজেনটেটিভ। হঠাৎ একদিন এই বিষয়টা আমার মাথায় আসতেই আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা কি বিষয় বলুন তো? তিনি বেশ কিছুদিন আমার এসব প্রশ্নকে এড়িয়ে গেছেন। বলা যায়, এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চাননি। আমি বড় হয়ে যখন প্রতিদিনই ঘ্যানর ঘ্যানর করতে থাকি, তখন একদিন আমাকে নিয়ে তিনি এই জায়গায় নিয়ে আসেন। সব খুলে বলেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পাক হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেশকিছু গণহত্যা চালায়। আমি সেই ব্যক্তি যে, গণহত্যার সময় শিশু হওয়ার সুবাদে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম। এই আমার অতীত। সেদিন থেকেই আমি বুঝে যাই, এই পৃথিবীতে আমি একা। আমার পায়ের তলায় এতদিন যে নরম মাটি ছিল, সেদিনের ঝরে তাও সরে যায়। সেদিন থেকে আমাকে টুকাই টুকাই মনে হয়। তাদেরও কেউ নেই। আমারও নেই। আর শোন, এই ঘটনা ঘটার কিছুদিন পরেই তুমি আমাকে প্রপোজ করেছিলে।

লাবীব দেখো, আমি স্বাধীন বাংলাদেশের একজন নাগরিক। কিন্তু কি অভাগা। আমিএকজন অভাগা নাগরিক। যার আপন বাবা নেই, যার আপন মা নেই, যার সহোদর ভাই-বোন নেই, আত্মীয়-স্বজন কেউ পৃথিবীতে নেই। দূর সম্পর্কের কেউ থাকলেও আমার জানা নেই, তারা আছেন কিনা। মহান স্বাধীনতা বা বিজয় এসেছে, কিন্তু তাতে আমার মতো মানুষরা কি পেলো বলো? একজন মহানুভব বাবা জনাব আজগর আলী খান যদি আমাকে সেদিন সেখান থেকে না নিয়ে আসতো, আমার কি হতো একটু চিন্তা করো? মাঝে মাঝে আমার এই দৃশ্য মনে হলে ঘুম আসে না, আমি অস্থিরতায় ভুগি। বাবার বলা এই গল্পের পর আমি আরো নিঃসঙ্গ হয়ে পরি। আমার কোন্ দোষে এই গ্লানি আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে, বলো? তারপরও আমি গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছি। যার ধর্মের কোন পরিচয় নেই, আশ্রয় দেয়া বাবার মনে হওয়ার কারণে আমি আজ হিন্দু। কিন্তু বুঝ জ্ঞান হবার পর থেকে তো আমি মুসলিম পরিবারে বড় হয়েছি। তারপরও বাবার মনে হবার কারণে আমি মুসলিম পরিবারে থেকেও স্কুলে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত হয়েছি। হিন্দু রীতি নীতিকে যতাসম্ভব আত্মস্থ করতে হয়েছে। এ ব্যাপারে বাবা আমাকে সবসময় সাহায্য করেছেন। তিনি আবার আমাকে ইসলাম ধর্মেরও নানা রীতি-নীতি গুলো শিখিয়েছেন, যাতে ভাই বোনরা এ নিয়ে কোন অযথা বিতর্ক না করতে পারে। এখন তিনি আমাকে বলে দিয়েছেন, আমি নাকি ইচ্ছে করলে যেকোন ধর্ম বেছে নিতে পারবো। তাতে তার কোন আপত্তি থাকবে না। এমন অভিপ্রায়ে আমি কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছি।  তিনি আমার নামে আলাদা করে জমি উইল করে দিয়েছেন। কিছু টাকাও আমার নামে ফিক্সড ডিপোজিট করে দিয়েছেন। যাতে আমি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। তারপরও আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। সিদ্ধান্তহীনতার কারণ সমাজ, এই সমাজের ভয়ে। সমাজ কি আমাকে সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পেরেছে বা পারবে? তুমি কি বলো? লাবীব তুমি নিশ্চয় আমাকে নিয়ে এমন গল্প কোনদিন ভাবতে বা কল্পনাও করতে পারনি। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শাপলা লাবীবকে বলে, আমার জীবনের সবতো শুনলে। এবার বলো, আমার বিষয়ে তোমার এখনকার ভাবনা কি? যেভাবে লাবীব বসেছিল, সে আরো কিছুক্ষণ স্থির মূর্তির ন্যায় সেভাবেই বসে থাকলো। কিছু সময় পরে বললো, এই প্রশ্নের উত্তর এখনই দেয়া সম্ভব নয়। কিছুদিন যখন আমরা অপেক্ষা করেছি, পরবর্তি জীবনের বিশেষ সিদ্ধান্তটা আরেকটু বুঝে-শুনেই নেয়া প্রয়োজন। কি বলো শাপলা? শাপলা কিছু সময় ভেবে বললো, সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চলো নৌকায় চলো। এই যে মাঝি ভাই এদিকে নৌকাটা নিয়ে আসুন। বাড়ির সবাই নিশ্চয়ই এরই মধ্যে চিন্তা করছে। লাবীব বললো, চলো।

 

মাহবুব সুফিয়ান
(মূল নাম: এ, বি, এম, মাহবুবুর রহমান)
উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ বেতার



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top