ছেঁড়া পান্ডুলিপি : কৃষ্ণা গুহ রায়
প্রকাশিত:
৭ আগস্ট ২০২১ ১৯:২৭
আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ০৮:৩৮
ছেঁড়া পান্ডুলিপি- ১
ফাল্গুন মাসের এক অলস দুপুরে তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা সাত্যকী৷ কলকাতা শহরের প্রথম সারির প্রকাশণা সংস্থা তোমার৷ একজন স্বনামধন্য চিত্রশিল্পীর কথায় তুমি আমার পান্ডুলিপিটি দেখবে বলেছিলে৷
প্রথম দর্শণে ঠিক যতটা ভালো লাগা যায় ততটাই ভালো লেগেছিল তোমাকে, এর বেশী কিছু নয়৷
কফির কাপে চুমুক দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটেছিল সেদিন ফেলে আসা জীবনের মুহূর্তগুলোকে বিনি সুতোর মালায় গেঁথে৷
আজও মনে আছে তুমি সেদিন চুপ করে সব শুনেছিলে৷ তোমার অভিজ্ঞ চোখ সেদিন কি বুঝেছিল কে জানে ? আমি যে কারণে সেদিন তোমার কাছে গিয়েছিলাম, সেই পান্ডুলিপিটা তোমার টেবিলের উপরে রাখাই ছিল৷
তুমি একবারও সেটার পাতা না উল্টে মন্ত্রমুগ্ধর মতন আমার কথা শুনে চলছিলে৷
যাবার সময় পান্ডুলিপিটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে বলেছিলাম এটার জেরক্স পরে করে এনে দেবো৷
তুমি পান্ডুলিপিটা আমার হাত থেকে নিয়ে বলেছিলে, এটা এখন থাক, আমি পড়ে নিই, তারপর জানাবো৷
বিশ্বাস করো সাত্যকী সেদিন তোমার ওখান থেকে ফিরে আসার পর রাতের বেলায় যখন আমাদের পরিচয়ের মাধ্যমটিকে সব কথা সবিস্তারে জানিয়েছিলাম ৷ তার কিছু অপ্রীতিকর কথা আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল৷
রাতের বেলায় বালিশে চোখের জলে ভেসে গিয়ে ভেবেছিলাম ইশশশ কেন যে পান্ডুলিপিটা রেখে এলাম৷
তুমি যদি পান্ডুলিপিটা আমার হাত থেকে না রাখতে তাহলে হয়তো আর দেখাই হতো না৷
"যদি তারে নাই চিনি গো, সে কি ..."
ছেঁড়া পান্ডুলিপি- দুই
সাত্যকি বড্ড অগোছালো একটা সময়ে তুমি এসেছিলে আমার জীবনে৷ অগোছালো আমিটাকে তুমি গুছিয়েছিলে আস্তে আস্তে৷ বলেছিলে, রুক্ষ মাটিকে যে উর্বরা করতে হবে তৃণা৷
তোমার কথাগুলো ভেতর থেকে গ্রহণ করেছিলাম বলেই আস্তে আস্তে নিজেকে সাজিয়েছিলাম৷ সুগন্ধী মেশানো প্রসাধনীতে নিজেকে করে তুলেছিলাম ক্রমশঃ উজ্বল৷
আমার কপালে কুচো চুলের দস্যিপনা আর চুঁইয়ে পরা তেল ত্বক দেখে গাল ছুঁয়ে আদর করে বলেছিলে, বেশ লাগছে ৷
জানো সাত্যকী সেদিন বেশ ভালো লেগেছিল৷ নারীরা যতই পুরুষের সমান অধিকার দাবী করুক না কেন ? তবুও আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, কোনও নারীর সৌন্দর্য্য তখনই সার্থক হয় যখন তার ভালবাসার পুরুষটির কাছে সে অনন্যা হয়ে ওঠে৷
আমার দুচোখ সেদিন কুসুম কুসুম লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছিল৷ তুমি অনুভব করেছিলে আমার রক্তিম অনুভূতিগুলোকে৷ তাই তো শেষ বিকেলের অস্তরাগে এস্রাজের তারে অনুরনিত হয়েছিল সাত্যকী তোমার সুললিত কন্ঠ
"ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি তোমার প্রাসাদ প্রাঙ্গণে,
মনে করে সখী বাঁধিয়া রাখিয়ো
আমার হাতের রাখী তোমার কনককঙ্কণে,
ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে ৷"
ছেঁড়া পান্ডুলিপি- ৩
রাতের পর রাত আমার কর্ণকুহরে সাত্যকী শুধুই তোমার শব্দর সঙ্গে মধু যামিনী৷
আমার টুকরো টুকরো সুখগুলো যেন লুকিয়ে ছিল তোমার মধুমাখা কথা মঞ্জরীতে৷
আমার অপেক্ষা, ভয় ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে সাত্যকী তুমি বলেছিলে, আমি আছি তোমার পাশে৷ চিন্তা কোরো না৷ তোমার পান্ডুলিপিটা আমি পড়েছি৷ ওটা বই আকারে বেড়োবে৷
সেদিন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে আমি ভেসে গিয়েছিলাম৷ মনে হয়েছিল ওই রাতের আকাশের তারাগুলো জ্বল জ্বল চোখে আমার সখী হয়ে গাইছে চিরদিনের সেই গান
"সখী ভাবনা কাহারে বলে, সখী যাতণা কাহারে বলে,
তোমরা যে বলো দিবস রজনী ভালবাসা, ভালবাসা ..."
ছেঁড়া পান্ডুলিপি- ৪
মানুষ সংবেদনশীল৷ মানুষ অনুভূতিপ্রবণ৷ এক দেখাতে না চিনলেও মানুষ আস্তে আস্তে বুঝতে পারে তার অত্যন্ত কাছের মানুষের অনুভূতিগুলোকে৷
ঠিক যেমনটা আমি চিনেছিলাম তোমাকে সাত্যকী৷ এতদিনের চেনা মানুষটা ধীরে ধীরে অচেনা হতে শুরু করলে তুমি আমার কাছে৷
একদিন তুমি আমাকে বলেছিলে সাত্যকী, দূরত্ব সম্পর্কের সৌন্দর্য্য বাড়ায়৷
আমি হেসে বলেছিলাম, দূরত্বে সম্পর্কে ধুলো জন্মায় ৷
শেষ যে দিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তুমি ছিলে অন্য কারুর সঙ্গে সুরের সাধনায় মগ্ন৷ সেদিনের তোমাকে আমার খুব অচেনা মনে হয়েছিল৷ মনে হয়েছিল হৃদয়ের দূরত্বটা কয়েক যোজন দূরে গিয়ে হারিয়ে গেছে৷ কেন এরকম করলে আমার সঙ্গে সাত্যকী ? তুমিই আমাকে কাছে নিয়ে আজকে দূরে ঠেলে দিলে৷
আকাশ জুড়ে চৈত্রর ঝড় উঠেছিল৷ তার সঙ্গে টিপ টিপ বৃষ্টি৷ তুমি খেয়ালই করোনি, তোমার বইয়ের তাক থেকে আমার পান্ডুলিপিটা কখন আমার ঝোলা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম৷
তোমার বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বেড়িয়ে কিছুটা গিয়ে বা দিকের যে রাস্তাটা গিয়ে সদর রাস্তায় পরেছে, সেই রাস্তায় পান্ডুলিপিটাকে ছিঁড়ে টুকরো করে ফেলে দিয়েছিলাম৷ সেদিনের চৈতি হাওয়ায় উড়ে গিয়েছিল আমার ছেঁড়া পান্ডুলিপি৷
আর মনের সারিন্দার তাঁরের ছঁড়ে তখন আমার ভেজা কষ্টগুলোকে জড়ো করে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম এক বাঁধনহীন আমাকে৷
"কাঁদালে তুমি মোরে ভালবাসারই ঘায়ে,
নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে,
কাঁদালে তুমি মোরে৷"
কৃষ্ণা গুহ রায়
সাহিত্যকর্মী, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
বিষয়: কৃষ্ণা গুহ রায়
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: