সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

ভিক্ষে : স্বপন নাগ


প্রকাশিত:
১০ নভেম্বর ২০২২ ০২:৫০

আপডেট:
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৬:৫৮

ছবিঃ স্বপন নাগ

 

ভিক্ষের জন্যে কত বিভিন্ন রকমের পন্থা বের করে মানুষ। সদ্য বাবা বা মা হারানো কেউ ভিক্ষে করছে, অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেই অসহায়তাকে চিহ্নিত করতে মিছিমিছি ধরাচুড়ো পরে ভিক্ষে চাওয়াকেও পন্থা হিসেবে বেছে নেয় কেউ কেউ। কোথাও বা একটি ঠাকুরের ছবি দেখিয়ে, কোথাও গান গেয়ে, কোথাও নানান কিসিমের শারীরিক কসরতের দক্ষতা দেখিয়ে, কোথাও বা কঠিন রোগের চিকিৎসার খরচের কথা জানিয়ে। কেউ বিশ্বাস করে, সাহায্যও করে। কেউ কেউ দেয় না, তাদের বিশ্বাস, ভিক্ষের বাহানায় এ সবই আসলে ধান্দাবাজি।
সত্য অর্ধসত্য কিংবা সম্পূর্ণ মিথ্যা, যা-ই হোক মাত্র একটি দিনে ভিক্ষায় সংগৃহীত অর্থসাহায্যের মোট হিসাবটি কিন্তু চোখ কপালে তোলবার মত। 'গরিবি হঠাও' নামের যে স্বপ্নটি একদিন আমাদের নেতারা দেখিয়েছিল দেশের মানুষকে, তা যদি সত্যিই বাস্তবায়িত হয় কোনদিন, তাহলে অবশ্য হিসেবটা আমূল বদলে যাবে। আমাদের কল্পনা করতেও বেশ বেগ পেতে হয় তেমন দিনের কথা ভেবে। গরিবি সত্যি সত্যি গায়েব হয়ে যাওয়া মানে ভিক্ষে আর ভিখারিও ঠাকুমার ঝুলির ভূতপ্রেতরাক্ষসদের মত গল্পকথার বিষয় হয়ে ওঠা। ভিক্ষাবৃত্তিতে কী বিপুল অর্থের লেনদেন তা কল্পনা করে শিহরিত হয়ে ওঠা।
ভিক্ষে দিয়ে কাউকে বশে রাখা কারো কারোর লক্ষ্য। আবার, একটা নিশ্চিত ভিক্ষের আশ্বাসনে কারোর কর্মক্ষমতা ও ইচ্ছেকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার মত জটিল এক দুরভিসন্ধিও যে আমাদের সমাজে সক্রিয়, চোখকান খোলা রাখলেই তার হদিস পাওয়া খুব পরিশ্রমসাধ্য নয়।
'ভিখারিকে ভিক্ষে দেওয়া উচিত কিনা' এই প্রশ্নকে সামনে রেখে লেখা একটি কবিতা পড়েছিলাম অনেকদিন আগে। সন্দেহ নেই, সে প্রশ্নের উত্তরে, পক্ষে কিংবা বিপক্ষে বলতে গেলেই অবধারিতভাবে আসবে সমাজ ও অর্থনীতির প্রসঙ্গ। সেসব নিয়ে নয়, বরং ভিক্ষে আর ভিখারি নিয়ে কিছু ঘটনার কথা বলার জন্যেই এত কথার অবতারণা।
একবার ট্রেনে করে দিল্লি যাচ্ছি। একটা ডেপুটেশনের কাজে। মোগলসরাইয়ে ট্রেন। আধঘন্টার স্টপেজ। সাইড লোয়ার বার্থের একজন যাত্রী সঙ্গে আনা খাবার বের করে প্রাতঃরাশ সারছিলেন। ঠিক তখনই জানলার ওপারে দশ-এগারো বছরের একটি ছেলে হাত পেতে দাঁড়াল। ভদ্রলোক একটি রুটি তুলে দিলেন ছেলেটির হাতে। ছেলেটিও রুটিতে কামড় বসাল। তারপর হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি। ছেলেটি ছটফট করছে প্লাটফর্মে। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে। মৃগি রুগীর মত আছাড় খাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে কোথা থেকে আরও অনেক লোক এসে ঘিরে ধরলো ভদ্রলোককে। ঘটনার আকস্মিকতায় ভদ্রলোক কিছু বুঝে ওঠার আগেই সমবেত দাবি উঠল হাজার টাকার। চিকিৎসা করাতে হবে। এদিকে ট্রেন ছাড়ার সময়ও হয়ে গেছে। নিরুপায় ভদ্রলোক শেষমেশ পাঁচ শ' টাকা দিয়ে নিষ্কৃতি পেলেন।

ট্রেন ছাড়ল। যেমন হয়, নানাজন নানা উপদেশ দিতে শুরু করল। ভদ্রলোক শুধু বিহ্বল হয়ে বসে রইলেন। সত্যিই কি ছেলেটির অসুস্থতার কারণ ঐ রুটি ! তা কী করে হবে ! সেই রুটি তো ভদ্রলোকও খাচ্ছিলেন। তাহলে কি পুরো ঘটনাই সাজানো ? বিহ্বলতা যে আমারও কাটছিল না।
আরো একটা অনেক আগের ট্রেনসফরের স্মৃতি। ট্রেনটা যখন গমগমে আওয়াজে এলাহাবাদ ব্রিজ পার হচ্ছিল, আরও অনেকের মত মেজো মামীও জানলা দিয়ে খুচরো পয়সা ছুঁড়ে প্রণাম করছিল গঙ্গাকে। সেই সব পয়সা ব্রিজের গায়ে লেগে ধাতব শব্দ করে পড়ছিল নদীর জলে। অথচ খানিক আগেই বছর পনেরো-ষোলোর একটা খোঁড়া ছেলে ধূলো, যাত্রীদের পরিত্যক্ত খাবারের প্যাকেট ঝাড়ু দিয়ে ট্রেনের মেঝে পরিষ্কার করার পর দুটো পয়সার জন্যে হাত পেতেছিল যখন, মামী কিন্তু একটা পয়সাও দেয়নি ছেলেটিকে। জলে না ফেলে পয়সাটা তো দিতে পারত ছেলেটাকে ! অত কম বয়সেও বিষয়টি বড় অদ্ভুত ঠেকেছিল আমার।
আমার খুব কমবয়সে দেখা এক ভিখারির কথা মনে পড়ছে। গ্রীষ্মের এক দুপুরে একজন ভিখারি আমাদের গ্রামের বাড়িতে এসে চাল বা পয়সা নয়, 'একটু খেতে দেবে মা' বলে কাতর আর্জি জানিয়ে মায়ের কাছে আবদার করল। আমাদের অনেক ভাইবোনের সংসারে মা তখন তুমুল ব্যস্ত। 'মাফ করো' বলে ডুবে গিয়েছিল অন্য কাজে। দু'ঘন্টা পরেও যখন দেখল লোকটি বাইরের দরজার পাশে ঠায় বসে। তার আবারও আর্জি, 'আজ দুটো ভাত খেতে দাও মা। আর কুনোদিন আমি চাইবুনি।'
মনে আছে, মা যত্ন করে কলাপাতায় ভাত বেড়ে দিয়েছিল লোকটাকে। নিতান্ত শৈশবের কৌতূহলে আমরা ভাইবোনেরা তখন সেই মানুষটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। নিঃশব্দে সমস্ত ভাত উদরস্থ করে বাড়ির পেছনের লাগোয়া কাঁঠাল গাছের নিচে ছায়ায় বসে অনুচ্চস্বরে গান গাইতে গাইতে ঘুমিয়ে পড়েছিল সেই ভিখারি।
সে কথা রেখেছিল। কোনদিন আর ফিরে আসেনি। মা বলত, 'ভিকিরির বেশে লোকটা ভগবান ছিল।'
ভিক্ষে করেই দিন গুজরান হত মালোপাড়ার নিরাপদ দলুইয়ের। নোংরা কাপড়ছেঁড়ায় ডান হাঁটু বেঁধে নিয়ে সকাল সকাল বসে পড়ত গুসকরা স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফর্মের সামনে। সারাদিনে যা পেত, কোনরকমে চলে যেত। একবার ভয়ঙ্কর চুলকানির জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে নিরাপদ যেদিন ব্যান্ডেজ ডান হাঁটুর বদলে বাঁ হাঁটুতে বেঁধে ভিক্ষে করতে বাধ্য হয়েছিল, পাবলিকের কাছে ধরা পড়ে যায়। তারপর থেকে নিরাপদের জীবন আর নিরাপদ থাকল না। ভিক্ষেই বন্ধ হয়ে গেল।
দজ্জাল শাশুড়ি পুকুর থেকে স্নান সেরে ঘরের দিকে যেতে যেতে দেখলেন একজন ভিখারি ফিরে আসছে গজগজ করতে করতে। জিজ্ঞেস করলেন, 'কী হয়েছে বাছা ?' ভিখারি তার ক্ষোভের কারণ জানিয়ে সেই মহিলারই বাড়ি দেখিয়ে বলল, ' ঐ বাড়ির বৌটা বলল কিনা ভিক্ষে দেবে না গো।' মহিলা বললেন, 'তাই ! এত বড় সাহস ! তুমি এসো তো আমার সঙ্গে।'
মহিলা ঘরের দিকে চললেন, পেছন পেছন ভিখারি। ঘরে ঢুকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মহিলা বললেন, 'শোনো এ বাড়ির গিন্নি আমি। ভিক্ষে দেবে কি দেবে না, বৌ বলার কে ? আমি বলছি, ভিক্ষে হবে না।' তারপর হতাশ ভিখারিটির মুখের ওপর সশব্দে দরজা বন্ধ করলেন দজ্জাল শাশুড়ি।
ভিখারিদের মানসম্মান থাকতে নেই। ভিখারিকে অসম্মান করার অধিকার নিয়েই যেন জন্মেছে এ সমাজের তামাম নাগরিক। বয়স যাই হোক, ভিখারিকে তুমি বা তুই সম্বোধনে তাই কোন অস্বাভাবিকতা দেখে না কেউ। সুযোগ পেলে বরং তাকে পরিশ্রম করে উপার্জন করার সৎ পরামর্শ দিতে অধিক তৎপরতা দেখায় তারা।

সবশেষে সদ্য-পড়া একটি অণুগল্প। এটি লিখেছেন গীতিলেখা মজুমদার। লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হল :
"এত বড় ছেলে, ভিক্ষা করিস কেন ? খেটে খেতে পারিস না ? অন্যের থেকে চেয়ে খেতে লজ্জা করে না ? যা এখান থেকে !" রাস্তার সিগনাল সবুজ হতেই গাড়ি চালাতে চালাতে রাজ বলল, "দেশটা একদম অকর্মন্যয় ভরে গেছে। সুস্থ, সবল ছেলে কাজ না করে ভিক্ষা করছে। যত্তসব !"
মেয়ের বাড়ি এসেছে রাজ আজকে। সঙ্গে বাবা-মা। মেয়েকে দেখে পছন্দ হবার পর রাজ এবং রাজের মা বসলেন দেনা-পাওনা সংক্রান্ত আলোচনা করতে। বেশি কিছু না ; রাজের চাই শুধু ঘরে একটা বড় খাট, এসি এবং একটা বাইক। রাজের বাবা চুপচাপ বসে সব শুনলেন শুধু।
বাড়ি আসার পথে রাজের মা রাজের বাবাকে অনুযোগের সুরে বললেন, "তুমি তো একটাও কথা বললে না ওখানে। ছেলেকে কি দেবে সেটা তোমাকেও তো বুঝে নিতে হবে নাকি !"
রাজের বাবা হেসে বললেন, "আসলে একটা সুস্থ, সবল ছেলেকে ভিক্ষা করতে দেখতে ভালো লাগছিল না। সত্যি, দেশটা একদম অকর্মন্যয় ভরে গেছে !"

রাজ এবং মা দু'জনেই চুপ।

সমাপ্ত

 

স্বপন নাগ
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top